গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা যা বিশ্বাস করি তাতে আমাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থাকে। কিন্তু আমাদের কথাটা শোনা হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস কমই থাকে। তখন আমরা চিৎকার করে তা পুষিয়ে নিতে চাই।
— ভ্যানেসা বোহন্স, ২১.৮.২০২১

এখনকার আলাপচারিতায় অনেক চিৎকার চেঁচামেচি হতে দেখা যায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক মাঠের দুই দিক থেকে এমনটা হয়। চিৎকার-চেঁচামেচির প্রতিযোগিতা চিৎকার দেখা যায় সংসদের ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে। কোনো কংগ্রেস সদস্যের ভ্যাকসিন সম্পর্কিত মন্তব্য নিয়ে স্কুল বোর্ড মিটিংয়ে, সংকটপূর্ণ জাতিগত তত্ত্ব নিয়ে, কোনো কিছু গোপন করার ব্যাপারে, অথবা মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তার মতো বিভিন্ন বিষয়েই বিতর্ক আর চিল্লাপাল্লা হয়।

এটা তো স্পষ্ট, চিৎকার আসলে কাউকে প্ররোচিত করে না। তাহলে, আমরা কেন চিৎকার করি?

সাম্প্রতিক গবেষণায় এর একটা বিস্ময়কর উত্তর পাওয়া গেছে, তা হলো, আত্মবিশ্বাসের অভাব।


ভেনেসা বোহন্স
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ২১ জুলাই ২০২১


কোনো কিছুর প্রভাবের ব্যাপারে মানুষের ভুল ধারণা আছে। আর একজন সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট হিসাবে ১৫ বছর ধরে আমি এর ওপরেই কাজ করছি। আমি দেখেছি, যখনই নিজেদের বিশ্বাস নিয়ে আমাদের খুব বেশি আত্মবিশ্বাস থাকে, আমাদের ভেতরে চিৎকার করার প্রবণতা তৈরি হয়। এমনটা হয় প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব অথবা প্রতিপক্ষকে বোঝাতে পারার মতো আত্মবিশ্বাস আমাদের নেই, এমন মনে করার কারণে।

আরো পড়ুন: অ্যামি চুয়া: চাইনিজ মায়েরা কেন সুপিরিয়র

সম্ভবত দীর্ঘদিন ধরে গবেষকরা এমন সব নতুন নতুন পথের সন্ধান পাচ্ছেন, যার মাধ্যমে মানুষ আরো আত্মবিশ্বাসী হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০২ সালে স্ট্যানফোর্ডের একদল গবেষক ‘পার্সোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজি বুলেটিন’ সাময়িকীতে তিনটি গবেষণার ওপর প্রতিবেদন করেছেন।

এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, কোনো কিছু বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তারা সহকর্মী বা অন্যান্য আমেরিকানদের চেয়ে কম আত্মবিশ্বাসী। এমন আরেকটা গবেষণায় অংশ নেয়া উত্তরদাতারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শোনার পরও নিজেদের আত্মবিশ্বাসের সপক্ষে মতামত দিয়েছিলেন।

চিৎকার
ড. ভেনেসা বোহন্স কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক। লেখাটি তার বই ‘You Have More Influence Then You Think: How We Understand our Power of Perception and Why It Matters’ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর W. W. Norton থেকে।

একই পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, গড়ে প্রতিটা লোক নিজের সম্পর্কে সব বিষয়ে অসংখ্য ভালো ধারণা পোষণ করে। তারা মনে করে অন্যান্য সাধারণ লোকদের চেয়ে তারা বেশি নৈতিক, সৃজনশীল, শারীরিকভাবে ফিট, ও ভালো গাড়ি চালক। পরিসংখ্যানগতভাবে এই ফলাফল বাস্তবে সম্ভব নয়।

এসব ফলাফলের বিপরীতে সাম্প্রতিক গবেষণায় সামাজিক দক্ষতার ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের বিষয় দেখা গেছে। তা হলো, বন্ধুত্ব অর্জন ও মানুষকে প্রভাবিত করতে নিজেদের সামাজিক দক্ষতা সম্পর্কে আমরা যে বিশ্বাস রাখি, তার গুরুত্ব।

২০১৭ সালে ‘পার্সোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজি’ সাময়িকীতে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। সেটিতে অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়েছিল গবেষণার বিষয়ের সাথে তাদের উত্তরগুলিকে মেলাতে। গবেষণার প্রশ্নগুলির মধ্যে ছিল, কার বেশি সংখ্যক বন্ধুবান্ধব ছিল, কে বেশি সামাজিক পরিসরে মেলামেশা করত, এবং কার কার সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যাপক বিস্তৃত, তাদের নিজেদের নাকি অন্যদের?

আরো পড়ুন: কখনো কখনো মনোযোগের চেয়ে অমনোযোগ ভালো

উত্তরদাতারা কিছু অসামাজিক বিষয়ের ওপর তাদের অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস আছে বলে স্বীকার করেছিল। যেমন, তারা বিশ্বাস করেছিল, অন্যান্যদের চেয়ে তাদের শব্দভাণ্ডার অনেক বেশি সমৃদ্ধ। কিন্তু সামাজিক বিষয় সমূহের ব্যাপারে তারা নিশ্চিতভাবে কম আত্মবিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করে, তাদের বন্ধু সংখ্যা কম, তাদের সামাজিক পরিসর ক্ষুদ্র, এবং অন্যান্য মানুষদের থেকে তাদের সামাজিক নেটওয়ার্ক সংকীর্ণ।

গত ৫ বছরে প্রকাশিত আরো কিছু গবেষণা থেকে জানা যায়, সামাজিক পরিসরে মানুষের আত্মবিশ্বাস স্বাভাবিকভাবেই একটু কম থাকে। যেমন, কোনো সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছিল, এমন মানুষদের জিজ্ঞেস করে জানা গেছে, তারা তাদের চারপাশের লোকজন সম্পর্কে যতটুকু আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, এর বিপরীতে তাদের আশেপাশের লোকজন তাদের প্রতি ততটা আগ্রহ দেখায়নি।

একজন অপরিচিত ব্যক্তির সাথে কথোপকথন হওয়ার পর অংশগ্রহণকারীদের মতামত জানতে চাওয়া হলে তারা প্রত্যেকেই এমনটাই বলে, অপরিচিত লোকটি তাদের প্রতি যতটা আগ্রহ দেখিয়েছিল, সত্যিকার অর্থে ততটা আগ্রহ তার ভিতরে ছিল না। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদেরকে ভবিষ্যৎবাণী করতে বলা হয়েছিল যে, তারা যদি তাদের বন্ধু অথবা কোনো আগন্তুককে কোনো কিছু করার অনুরোধ করে, তাহলে তাদের অনুরোধ রাখা হবে কিনা। বাস্তবে দেখা গেছে, তাদের বন্ধুরা ও অপরিচিতজন একটা পাত্রে মটরশুঁটি গোনার মত বিরক্তিকর কাজটিও সহজে করেছে, যেমনটা তাদের কাছে প্রত্যাশা করা কঠিন ছিল।

এই ফলাফল দুটি একটা অন্যটার সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু দুইটাই সম্পর্কিত। আর এই দুই বিষয়ই এমন এক পরিস্থিতির জন্ম দেয়, যখন মানুষ চিৎকার চেঁচামেচি করে। নিজের নৈতিকতার প্রতি আত্মবিশ্বাস ও নিজেকে কম পক্ষপাতদুষ্ট মনে করার অনুভূতিই মানুষকে নিজস্ব বিশ্বাসের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। একইসাথে, অন্যেরা তাদের প্রতি কম মনোযোগী অথবা তারা যা বলছে অন্যরা তা শুনছে কিনা, এরকম অনুভূতি তাদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। অথচ তখন তারা অন্যদেরকে তাদের চিন্তাগুলি বোঝাতে চায়।

অন্যভাবে বলা যায়, আমরা চিৎকার করি, কারণ আমরা মনে করি, আমরা শূন্যগর্ভ চিৎকার করছি।

এটা খুবই হাস্যকর, আমাদেরকে যারা বেশি বেশি ইতিবাচক কথা বলতে প্ররোচিত করে, তারা মূলত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস না থাকার কারণে আমাদের আরো বেশি খেসারত দেওয়া উচিৎ।  আর এভাবে আমাদের হতাশা আরো বাড়তে থাকে। আমাদের হতাশাগ্রস্ত মানসিকতা এতটা নিচে নেমে যায় যে, অন্যেরা তখন আমাদের ওপর খুব সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এবং তর্ক করার সময় আমরাও অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকি।

আরো পড়ুন:গবেষণা: ছবি যত বড় হবে মনে রাখতে তত সুবিধা

এ বিষয়ে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, একদল গবেষক একটা প্রশ্ন সামনে রেখে তাদের পরীক্ষা চালিয়েছিল। তাদের প্রশ্নটি ছিল: মানুষ অন্যকে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে নিজেদের ইতিবাচক হওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয় কিনা। অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়েছিল দুই ধরনের মেসেজের মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নিতে, যাতে তারা কাউকে স্বাস্থ্য পরিবর্তনের জন্য প্ররোচিত করতে পারে। তাদের মধ্যে একটা মেসেজ ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত প্রকৃতির। অন্যটি ছিল চিৎকার-চেচামেচিপূর্ণ ও আদেশসূচক।

এই পরীক্ষাতে বিভিন্ন ধরনের দৃশ্যপট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এটা জানার জন্য যে, এর মধ্যে ঝুঁকির গুরুত্ব কতটুকু ছিল এবং এই মেসেজগুলিতে উপদেশ ছিল কিনা। গবেষকরা দেখেছিল, অংশগ্রহণকারীরা তাদের মেসেজের ইতিবাচকতার বিষয়টা পছন্দ করেছিল তাদের গুরুত্বের ওপর নির্ভর করে। অন্য লোকেদের ধারণক্ষমতাকে উপেক্ষা করেছিল। যখন তারা বুঝতে পেরেছিল, এগুলি ছিল হাই স্টেকের, তখন তারা বেছে নিয়েছিল চিৎকার-চেচামেচি। এটা করতে তারা অন্য লোকদের গুরুত্ব মাথায় রাখেনি।

প্ররোচনা করার ওপর গবেষণা থেকে আমরা জানতে পেরেছি, আপনি যদি কাউকে প্ররোচিত করতে চান, তাহলে তা হবে আপনার জন্য একটা নিশ্চিত ভুল কাজ। অন্য আরেকটি গবেষণায় একই গবেষকরা দেখেছেন, ইতিবাচক মেসেজ বাস্তবে বিপর্যয় ঘটায়, বিশেষ করে যখন অপর ব্যক্তির ধারণক্ষমতা কম থাকে।

প্রকৃতপক্ষে, কোমল মেসেজ প্ররোচিত করার জন্য বেশি কার্যকর। যে বিশেষজ্ঞরা মেসেজের ইতিবাচকতা নিয়ে গবেষণা করেছেন স্বাস্থ্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে, যারা কাজ করেছেন ধূমপান কমানো এবং শরীরচর্চা বৃদ্ধি করার অভিযানে, সবাই এমনটাই মত দিয়েছেন। মানুষের অনুভূতি হলো, কীভাবে নিজেদের মতামত ও উপদেশ দশকের পর দশক ধরে প্ররোচনামূলক গবেষণা এবং সামাজিক আধিপত্যে ছড়িয়ে দেয়া যায়, যা অল্প জিনিসকে সবসময়ই বাড়িয়ে দেখায়। আমরা চিৎকার করি, কারণ আমরা মনে করি না যে, মানুষ আমাদের কথা শুনবে।

ফলে, আমরা আমাদের বক্তব্য অন্যদেরকে জানাতে মরীয়া হয়ে যাই। যদিও আমরা ভাবি না, আমাদের যুক্তি, উপদেশ ও আবেদন যদি আরেকটু নম্র হতো, তাহলেই তা বেশি কার্যকরী হতো।

অনুবাদ: মাহতাবুল আলম