অনুভূতির কাঠামো ১

এটা কিন্তু আপনারা খুবই বলেন! মানুষের ঘৃণা-বিদ্বেষ রাগ-ক্ষোভ নাকি বেড়ে গেছে! আগের দিনের ধৈর্য আর আজকাল নাকি দেখতে পাওয়া যায় না! আরো বলেন, মানুষের মধ্যে ‘মনুষ্যত্ব’ও নাকি আগের মতো নাই। এখানে ‘মনুষ্যত্ব’ বলতে সম্ভবত আপনারা সংবেদ বুঝিয়ে থাকেন। বা প্রজ্ঞা, বা আক্কেল বা মমতা। মানে কিছু একটা বা অনেকগুলা বোঝান। কিন্তু সেসব বোঝাতে ‘মনুষ্যত্ব’ কথাটা যে কেন ব্যবহার করেন তা আমার পক্ষে অবোধগম্য। একটু একটু ইংরাজি শেখার পর দেখলাম সেখানেও একই ভেজাল। তাঁরাও দেখি বলেন ‘হিউম্যানিটি’ বা ‘হিউম্যানিজম’। যাকগে, আজকে আমরা শব্দার্থ শিখতে বসিনি।

মানস চৌধুরীদেখুন, আমি এমন লোক নই যে কোনো বদল দেখতে পাব না। সব কিছু ঠিক আগের মতোই আছে ভাবার লোক আমি না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথে প্রতিদিন উন্নয়ন দেখতে পাই রাস্তায়, রাস্তার পাশে, হাওড়ের পেটের মধ্যে। আগের চেহারাই আর হাতড়ে মনে আনতে পারি না। আমি কেন ভাবতে যাব যে বদল হচ্ছে না? আবার আমি সারাক্ষণ বদলাচ্ছে বলতে থাকা লোকদেরও পর্যাপ্ত পরিমাণ সন্দেহ করি। আপনাদেরও তাই করা দরকার। অত্যন্ত জরুরি। প্রতিবছরই বাসস্ট্যান্ডের একই জায়গায় দাঁড়িয়ে একই লোক একই ভাবে যে বিলাপ করতে থাকেন “বাপের জন্মে এবারেরর মতো গরম দেখিনি”, তা যদি সন্দেহ না-করে বিশ্বাস করতে থাকতেন, তাহলে তো ঠিকমতো জামা গায়ে না দিয়েই এবারে বের হতেন। গ্লোব্যাল ওয়ার্মিংয়ের তত্ত্ব দেন, ঠিক আছে। কিন্তু ওই লোক এই তত্ত্ব না জানলেও এই কথাই ঠিক এইভাবেই প্রতিবছরই বলতে থাকবেন। এটা বাসস্ট্যান্ডে আলাপ তৈরি করার একটা উপায়; গরমের পরিমাণের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত না। এটুকু যদি বুঝলেন তো, আজকের আলাপ অনেকখানিই আপনার বোঝা শেষ।

এখন আমাদের আলোচ্য জিজ্ঞাসাটি হচ্ছে সাইবার কালে মানুষের হিংসা-বিদ্বেষ-রাগের তীব্রতা বেড়েছে কিনা। এটা তো কোনো মিটার দিয়ে মাপতে পারবেন না। ফলে আমাদের ঘোরালো-প্যাঁচালো কিছু রাস্তায় বুঝে নেয়াই ঠিক হবে। প্রথমেই আমরা বোঝার চেষ্টা করি সাইবাররাজ্যে এসে অনুভূতি প্রকাশ তথা অভিব্যক্তিতে কী বা কী-কী বদল আসলো। আপাতত, কাজ চালানোর জন্যকে আমরা অনুভূতির প্রকাশকে অভিব্যক্তি নাম দিতে পারি। ফলে আপনাদের আর অভিব্যক্তি প্রকাশ বলার দরকার পড়বে না। প্রকাশভঙ্গিও আজকের জন্য বলা লাগবে না। সাইবারের জগতে এটা কীভাবে ঘটে তা বোঝার জন্য আপনাদের হলিউডি কিছু ছায়াছবি সাহায্য করতে পারে।

সেসব ছায়াছবিতে দেখা যেতে পারে যে কোনো এক চীনা বা উত্তর কোরীয় লোক, কিংবা চীনা বা উত্তর কোরীয় হিসাবে প্রতিভাত হতে পারেন এমন কোনো লোক একটা সুইচের সামনে হাত বাগিয়ে বসে আছেন। আসলে চীনা বা কোরীয় যেকোনো চেহারার লোক হলেই হবে না। চলচ্চিত্রের স্বার্থে লোকটাকে যথাসম্ভব ক্রুদ্ধ ও ক্রূর দেখাবার ব্যবস্থাও করতে পারতে হবে। এখানে রাশিয়ান বা রাশিয়ান-প্রতিভাত কোনো লোকও দায়িত্বটা পেতে পারেন। এখন আর আগের সেই দিন নাই। নাহলে এই কাজটা রাশিয়ানের বদলে সোভিয়েত ইউনিয়ান লোকের কাঁধে, মানে হাতে, গিয়ে পড়ত। তখন আসলে চীনা-কোরীয়ও লাগত না।

তো সুইচটা কীসের তা কিন্তু তামাম বিশ্বের লোকজন, মানে চলচ্চিত্র-লভার লোকজন জানতেন। এমনকি যদি ওটা বাংলাদেশের কোনো মিন্টু-পলাশ কোম্পানির বিদ্যুতের সুইচও লাগানো থাকত, তাতেও লোকজন কীভাবে যেন বুঝতে পারতেন ওই সুইচেই তামাম বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তছনছ করে দেবার নিউক্লিয়ার বোমাটি সেট করা আছে। তিনি মানে ওই ক্রূর-ক্রুদ্ধ-‘মনুষ্যত্বের’ শত্রু চীনা (বা সাবেক সোভিয়েতীয়) লোকটি টাচ করলেই শেষ। ব্যস! পুরা খতম! মানুষের এই গোলকটি চূর্ণ হয়ে যাবে। মানে এরকমই ভাবা হয় আরকি! ফলে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মনুষ্যত্ব’প্রেমী মহান মুক্তিদাতারা কোনো না কোনো উপায়ে ওই লোকটির সুইচ পর্যন্ত আঙুল যাতে না যায় তার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত আছেন। দরকার মতো তাঁরা সব জায়গায় আঙুল দেবেন; কিন্তু কিছুতেই ওই পাষণ্ডের আঙুলকে সুইচে স্পর্শ করতে দেবেন না। এবং অবশ্যই তাঁরা সফল হতেন, হন, হবেন; হলিউড যতদিন থাকবে হতেই থাকবেন।

এখানে আমরা বাস্তবতার বিষয়েও একটা সাইডডিশ পরিবেশন করতে পারি। দেখুন, হলিউডের ছবিতে যতই গাড়ি সাতটা ডিগবাজি খেয়ে আছাড় খাক, এই সুইচে হাতের ক্ষেত্রে কোনোদিনই তাঁরা চীনা-কোরীয় মডেলের বাইরে যাননি, কিংবা রাশিয়ান। এই যে এতসব ‘যুদ্ধ’ হলো (নিন্দুকেরা বলেন একতরফা হামলা), আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া – বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু ওই সুইচের পাশে কোনো সিরিয়, ইরাকীয়, আফগান বা লিবিয় পাষণ্ড কিন্তু দেখানো হয়নি। এমনকি লাদেন, এত্তবড় লাদেন, তাঁকে বা তাঁর অনুসারী কাউকেও দেখানো হয়নি। কেন হয়নি? কারণ হলিউডের ছায়াছবিও বাস্তবতার বিষয়ে ইতিহাসদর্শী। তাঁরা জানেন যে নিউক্লিয়ার ডাব্বাখানা এঁদের কারো কাছে নেই। আগামীতে ইরানীয় কোনো পাষণ্ডকে দেখানো হবে কিনা আমার জানা নেই। তাছাড়া হলিউডের নির্মাতারা আমার সাথে তাঁদের ছবির প্লট নিয়ে আলাপও করেননি এখন পর্যন্ত। এই যে নিউক্লিয়ার ডাব্বাখানি কার কাছে আছে আর কার কাছে নেই সে বিষয়ে সজাগতা প্রদর্শন করে হলিউড, তার থেকে তাঁদের সত্যনিষ্ঠাকে বুঝতে হবে। অর্থাৎ, প্রপাগান্ডা আর সত্যের মধ্যে যে মৌলিক তফাৎ সেটা বোঝা দরকার। মানে প্রপাগান্ডা আর সত্যবচনের তফাৎ যে বোঝা যায় না, কিছুতেই বোঝা যায় না, সেটা আপনাদের বোঝা দরকার। আজকের আলাপে এটাও প্রাসঙ্গিক।

যাহোক, ওই আঙুল! ওই আঙুলটা সুইচ থেকে দুই ইঞ্চি দূরে বসে নিশপিশ করতে থাকে। “লাগালাম, লাগিয়ে দিলাম, কী! কেমন! দিলাম কিন্তু” এরকম একটা মুডে। আর মুক্তিসেনানীরা (মার্কিন মুক্তিসেনার কথা হচ্ছে, এটা আবার চেতনার সাথে প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়েন না) ওই “দিলাম দিলাম” মুডের আঙুলের মালিকের ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেন যাতে আঙুলের নিশপিশানি মেটানোর আগেই পাষণ্ডের হাত থেকে ‘মানুষ জাতি’ রক্ষা পায়।

আমরা এক সুইচ নিয়ে এত বিপদ দেখে আসলাম। এখন ভেবে দেখুন, আপনার কম্পুটারে সুইচ বা চাবি কম করেও ৬০ খানা। উৎকৃষ্ট মানের ডিজাইনার ল্যাপটপ-কম্পুটারে সংখ্যাটা ১০০’র কাছাকাছি যাবে। এবং আপনার পড়ার বা লেখার (বা চ্যাটাচ্যাটির) টেবিলের আশপাশে মার্কিন মুক্তিসেনারাও ঘুর ঘুর করে না। আপনি ইচ্ছামতো আঙুল চালাতে পারেন; এখানে সুইচ বা কীবোর্ডের বোতামগুলোর কথাই হচ্ছে। এটা ঠিকই যে ‘এন্টার’ বাটন থাকে মাত্র একটাই, সাধারণত। হতে পারে যে কম্পুটারের নির্মাতারা আগেভাগে বিষয়টা নিয়ে ভেবেছিলেন। হতে পারে, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে ঘরে ঘরে মুক্তিসেনারা আপনার আঙুল লাগানো, আই মিন কম্পুটারের কীবোর্ড চালানো, তদারকি করতে পারবেন না। হয়তো সেজন্যই তাঁরা একটাই এন্টার দিয়েছেন। কিন্তু একটা এন্টারেও আসলে ওই একই কাজ করতে পারে। আপনার সদ্যলিখিত বাক্যটি, আপনার অভিব্যক্তিটি ভগ্নসেকেন্ডের মধ্যে জনদরবারে পাঠিয়ে দিতে পারেন। ব্যস! খতম!

মনে আছে পোস্ট কার্ড বলে একটা জিনিস ছিল? এখনো আছে অবশ্য। মনে আছে সেলফোন বলে কিছু ছিল না? আপনার বন্ধুকে আপনি একটু প্রেমপ্রেমমূলক বার্তা দিতে হলে কী করতেন তখন? (আপনাদের যাদের বয়স কম, তাঁরা হয়তো এটার মাথামুণ্ডু বুঝবেন না।) না, প্রেম প্রেম মুডে আজকের আলাপে আপনারা বুঝবেন না। ধরুন আপনার শত্রুকে একটা ধামকিবার্তা বা ঘৃণাবার্তা দেবেন। আপনি সাব্যস্ত করলেন চিঠিতেই করবেন। সেটা সাব্যস্ত করলেন কেন? কারণ, নাহলে সেই ‘শত্রু’র প্রতিবেশীকে ল্যান্ডফোনে কল দিয়ে বলতে হতো “বিলটু ভাই, বুধবার রাইতের ১০টার দিকে চান্দুরে একটু আপনার বাসায় থাকতে কইয়েন; অর টেংরি ভাঙার জন্য আমি একটা ফোন দিমু।” বিলটু ভাই যদি নিরপেক্ষভাবে এই টেংরিভাঙা কলের জন্য অনুমোদন দিতেনও, আপনার বুধবার রাত পর্যন্ত মুডটা হোল্ড করে রাখতে হতো। এই পুরা আয়োজনের দুরূহতার কারণেই আপনি লিখিত মাধ্যমের কথা ভাবলেন। তাহলে, সাধারণত একটা পোস্টকার্ড বা খাম কিনতে যেতেন পোস্ট অফিসে। যদি আপনি গোছানো মাথার লোক হতেন, তাহলে একটা খাম বা পোস্টকার্ড আপনার টেবিলের দেরাজ থেকেই বের হতো। তারপর খানিকক্ষণ কলম ঝাঁকাঝাঁকি করে কোনটা দিয়ে লিখবেন সাব্যস্ত করতেন। তারপর তিনটা কাগজ নষ্ট করতেন হয়তো। তারপর আপনার সেই আকাঙ্ক্ষিত বাক্যগুলো হয়তো লিখতে পারলেন “তর মনে লয় তুই তালেবর হয়া গেছস….তর প্যাটের উপর বয়া আমি জিবভা বাইর করাইয়া দিমু…” ইত্যাদি। তারপর নিজের জিবভা দিয়ে খানিক লালা মাখিয়ে খামটা আটকাতেন। তারপর দুদিন হয়তো টাকমাথা লাল ডাকবাক্সের দিকে সময় মিলিয়ে যাওয়াই হলো না। আপনার হয়তো আর একই ভাষায় আর চিঠিটা পাঠাতে ইচ্ছা করলো না। হয়তো মঙ্গলবার রাত্রে খামটা আবার পিট পিট করে খুললেন; চিঠিটা পড়লেন, ছিঁড়লেন, আবার লিখতে বসলেন। এই যে পুনঃ পুনঃ সম্পাদনা ঘটল তার কারণ আপনার অনুভূতি আর অভিব্যক্তির মধ্যকার সময়কাল, গতি। আপনার রাগ বা ঘৃণার প্রকৃত পরিমাণ নয়।

মানস চৌধুরীর ব্লগ ‘সরল সমাজপাঠ’ এর আরো লেখা

চীনা পাষণ্ডটি সুইচের পাশে বসে আছেন কেন? যাতে মার্কিন মুক্তিসেনা এসে আঙুলের আগেই তাঁর ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দিতে পারেন। কীবোর্ডের পাশে আঙুল বাগিয়ে কিছু সময় কাটাতে দিলে হয়তো একই পরিস্থিতি দেখা দিত না। মানে কারো কারো ক্ষেত্রে। অন্য আরেকজন হয়তো সাইবার কালকে স্বাগত জানাতে পারছেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কারণে। তিনি হয়তো ভাবছেন “বাহ কী মজা! অমুকের পুত বলার পর এক সেকেন্ডও লাগছে না পুতের তা পেতে।”

অনুভূতিকে অভিব্যক্তিতে আসতে দিতে পারার মধ্যকার সময়কালের ফারাকটা হলো যুগের পার্থক্য। “রাগ বাইড়ে গেছে” ধরনের নয়। কারণ ওটা ইন্টেন্টসাপেক্ষ, টেকনোলজিসাপেক্ষ নয়। টেকনোলজি অনুভূতির কাঠামোকে মদদ দেয় বড়জোর।

জাবি ক্যাম্পাস, ২৮ আগস্ট ২০২২