বিজ্ঞানীরা রক্তের কোষের গঠনে এক ধরনের ‘ভয়াবহ’ পরিবর্তন আবিষ্কার করেছেন। এতে বার্ধক্যের প্রক্রিয়া ধীর করার জন্য নতুন নতুন থেরাপির সম্ভাবনা বাড়ছে।

বার্ধক্যের ওপর যুগান্তকারী তত্ত্ব হতে যাচ্ছে এটি। এখান থেকে বোঝা যেতে পারে, কেন মানুষ ৭০ এ পৌঁছানোর পরে হঠাৎ দুর্বল হয়ে যায়।

তত্ত্বটির ওপর ভিত্তি করে বার্ধক্য ও বার্ধক্যজনিত নানান ধরনের রোগ নিরাময় করার জন্য নতুন নতুন থেরাপির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।


আয়ান স্যাম্পল
দি গার্ডিয়ান, ১ জুন ২০২২


সম্প্রতি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মানবদেহে এমন একটি প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন, যে প্রক্রিয়ায় বৃদ্ধ বয়সে রক্তের গঠনে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। ব্লাড ক্যান্সার ও রক্তাল্পতার ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া জীবাণুর সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শ্বেত রক্তকণিকার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন ত্বক থেকে শুরু করে মস্তিষ্ক পর্যন্ত শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও এমন পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তনটি ভালভাবে বোঝা গেলে জানা যাবে, কেন মানুষের জীবনের প্রথম কয়েক দশক বেশ স্বাস্থ্যকরভাবে বয়স বাড়ে, অথচ ৭০ ও ৮০ বছর বয়সের পরে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।

আরো পড়ুন: প্রতিটি শহরের আছে নিজস্ব মাইক্রোবায়োম বা জীবাণুতন্ত্র

কেমব্রিজের স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউটের ক্যান্সার, বার্ধক্য ও সোমাটিক মিউটেশন প্রোগ্রামের প্রধান এবং এ গবেষণার প্রধান লেখক ডক্টর পিটার ক্যাম্পবেল বলেন, “এর মূল লক্ষ্য হবে বার্ধক্য প্রক্রিয়ার গতি কমানো বা এই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা। তবে এখন আমরা কম করে হলেও, এটি ব্যবহার করে বায়োলজিকাল বয়স পরিমাপ করার একটি সুযোগ দেখতে পাচ্ছি।”

বার্ধক্য এক জটিল প্রক্রিয়া। তবুও অনেক বিজ্ঞানী আশঙ্কা করে আসছিলেন, দেহকোষে আস্তে আস্তে গঠিত হওয়া মিউটেশন শরীরের সঠিক ভাবে কাজ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলে। তবে সর্বশেষ এই গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, এ ধারণা ভুল। বা বলা যায়, অসম্পূর্ণ। বরং এ গবেষণা অনুসারে, শরীরের সঠিক ভাবে কাজ করার ক্ষমতা কমে যাওয়ার পেছনে শরীরের ‘স্বার্থপর’ বা সেলফিশ কোষগুলি দায়ী। ‘স্বার্থপর’ এসব দেহকোষ বৃদ্ধ বয়সে শরীরে আধিপত্য বিস্তার করে।

ড. ক্যাম্পবেল ‘ওয়েলকাম-এমআরসি ক্যামব্রিজ স্টেম সেল ইনস্টিটিউট’ এর বিজ্ঞানীদের সাথে একসাথে কাজ করেছেন। সেখানে তিনি ও তার সহকর্মীরা নবজাতক থেকে শুরু করে ৭০ ও ৮০ বছর বয়সী লোকদের রক্তের কোষ নিয়ে গবেষণা করেছেন।

তারা দেখতে পেয়েছেন, ৬৫ বছরের কম বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বিস্তৃত পরিসরে লাল ও সাদা রক্তকণিকা রয়েছে। এগুলি তাদের অস্থি মজ্জার ২০,০০০ থেকে ২০০,০০০টি আলাদা ধরনের স্টেম সেল থেকে উৎপন্ন হয়েছে।

কেন মানুষ ৭০ এর পর ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে
স্টেম সেলকে বলা হয় মানবদেহের ‘র ম্যাটেরিয়াল’ বা কাঁচামাল। এটি এমন এক ধরনের সেল বা কোষ যা থেকে অন্যান্য আরো নির্দিষ্ট কাজের কোষ তৈরি হয়।

তবে ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে চিত্রটি একেবারেই ভিন্ন। তাদের রক্তের কোষের প্রায় অর্ধেকই, মাত্র ১০ বা ২০টি স্বতন্ত্র স্টেম সেল থেকে এসেছে। এতে বয়স্ক ব্যক্তিদের রক্তকণিকার বৈচিত্র্য অনেক কমে আসে। ফলে তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।

আরো পড়ুন: আপনার দেহে ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে তুলবেন কীভাবে

নেচার জার্নালের একটি লেখায় এই গবেষকরা ব্যাখ্যা করেছেন, সংশ্লিষ্ট স্টেম সেলগুলি রক্ত তৈরির সময় মিউটেশনের মধ্য দিয়ে যায়। এ সময়ে যে পরিবর্তনগুলি ঘটে, তার মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষতিকারক নয়।

কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন বিরল ‘ড্রাইভার’ মিউটেশন, স্টেম সেলের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটায়। এতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রায়ই নিম্নমানের ব্লাড সেল তৈরি হয়। যখন একজন ব্যক্তির বয়স ৩০ ও ৪০ এর মধ্যে থাকে, স্টেম সেলের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে খুব বেশি কিছু হয় না। কিন্তু যখন বয়স ৭০ বা তার বেশি হয়, দ্রুত বাড়তে থাকা এই কোষগুলি রক্তকণিকার উৎপাদনে অনেক প্রভাব বিস্তার করে।

ক্যাম্পবেল বলেন, “এই অত্যধিক দ্রুত বৃদ্ধির মাধ্যমে বোঝা যায়, কেন ৭০ বছর বয়সের পর শরীরে এমন হঠাৎ পরিবর্তন হয়। কেন বার্ধক্য এই বয়সেই আঘাত করে।” রক্তের এই দ্রুত বর্ধনশীল স্টেম সেলগুলি ব্লাড ক্যান্সার ও রক্তাল্পতার জন্যেও দায়ী। এই কোষগুলিই যেকোনো সংক্রমণ ও কেমোথেরাপির মতো চিকিৎসার পরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা কমিয়ে ফেলে।

“এই পর্যবেক্ষণে যা দেখা গেছে, তার অনেকগুলিই অন্যান্য অঙ্গ বা অরগান সিস্টেমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য,” ক্যাম্পবেল বলেন। কেন বার্ধক্যের কারণে চামড়ায় ভাঁজ দেখা দেয় ও কোনো ক্ষত সহজে সারে না, তা ভালোভাবে বুঝতে গবেষকরা এখন ত্বকে একই প্রক্রিয়া কাজ করছে কিনা, তা নিয়ে অনুসন্ধান করতে চান।

কেন মানুষ ৭০ এর পর ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে
স্টেম সেলে দ্রুত বৃদ্ধিতে ক্যান্সার কোষের সৃষ্টি

ওয়েলকাম-এমআরসি কেমব্রিজ স্টেম সেল ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং এই গবেষণার যুগ্ম সিনিয়র গবেষক ড. এলিসা লরেন্টি বলেন, “দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, ধূমপান, সংক্রমণ বা ইনফেকশন ও কেমোথেরাপির মতো সবকিছুই ক্যান্সার-সৃষ্টিকারী মিউটেশন সহ মাতৃকোষ বা স্টেম সেল তৈরি করতে পারে।”

“আমরা ধারণা করছি, এই ফ্যাক্টরগুলি বার্ধক্যের সাথে যুক্ত স্টেম সেলের বৈচিত্র্য কমিয়ে দিতে কাজ করে,” তিনি বলেন। এমনকি এও সম্ভব, এখানে এমন কিছু ফ্যাক্টর আছে, যা এই প্রক্রিয়ার গতি ধীর করে দিতে পারে। এই নতুন আবিষ্কৃত মিউটেশনগুলি কীভাবে বয়স্কদের রক্তের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে, তা খুঁজে বের করার জন্য আমাদের হাতে এখন এই প্রকল্পটি আছে। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারব কীভাবে রোগের ঝুঁকি কমানো যায় ও স্বাস্থ্যকর উপায়ে মানুষের শরীরে বার্ধক্য আনা যায়।”

অনুবাদ. জুবায়েদ দ্বীপ