সেলফ রিপেয়ারিং ইলেকট্রনিক্সের বিষয়টা কেমন? হলিউডের মুভিতে আমরা এমন দেখেছি আগে। কিন্তু এই প্রযুক্তি বাস্তবে দেখতে যাচ্ছি আমরা খুব শীঘ্রই। এ বছরের ২০ মে এ নিয়ে লিখেছেন রে ফার্নান্দেজ।

সেলফ রিপেয়ারিং ইলেকট্রনিক্স আপনার চিন্তার চেয়েও অনেক দ্রুত বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে

কেমন হবে যদি আপনার ভেঙে যাওয়া মোবাইল ফোনের স্ক্রিন কিংবা স্যাটেলাইটের জন্যে শক্তি উৎপাদনকারী সোলার প্যানেলগুলি নিজে নিজেই মেরামত হয়ে যায়?

এধরনের রোবট বা ইলেকট্রনিক্স এখন আর বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনীর ব্যাপার নয়। টার্মিনেটরের মত আত্ম-সচেতন মেশিনগুলি  এখন সারাইয়ের কাজ নিজেই করতে পারবে।

বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের আগ্রহের বিষয়ও আজকাল এমন সব প্রযুক্তি নিয়ে। টেকনিয়ন ইসরাইল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি এর গবেষকরা বলেন, সেলফ রিপেয়ারিং ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তির উদ্ভাবন বাস্তবে সম্ভব হতে পারে, এটা প্রমাণ করার জন্য প্রযুক্তিও আছে।

প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে, জটিল কাজের ক্ষেত্রগুলিতে দীর্ঘস্থায়ী ইলেকট্রনিক যন্ত্র বা যন্ত্রাংশগুলি ক্রমে আরো মূল্যবান ও অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ও ট্যাবলেট এর মত যেসব প্রযুক্তি আমরা প্রতিদিন ব্যবহার করছি, সেগুলি দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করা যায় না। ইলেকট্রনিক পণ্যের অল্প দিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ইলেকট্রনিক পার্টসের স্বাভাবিক ক্ষয় এবং লিথিয়াম ব্যাটারির নষ্ট হয়ে যাওয়া।

সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ড্যামেজ মারাত্মক ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। ২০১০ সালে ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক ডিসচার্জ অ্যাসোসিয়েশন (PSD) পরিচালিত এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিবছর ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক ইলেকট্রিক ক্ষতির কারণে শিল্পকারখানায় প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ক্ষতি হয়ে থাকে। ২০২২ সালের মধ্যে ক্লাউড চালিত সার্ভারগুলি আরো বেশি ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

আরো পড়ুন: প্লাস্টিক প্যাকেজিং এর সমস্যা মোকাবেলায় যুগান্তকারী ৫টি প্রকল্প

ইলেকট্রিক্যাল পণ্য যেভাবে নষ্ট হতে পারে সেগুলির মধ্যে ধোঁয়া, আগুন, পানি, ধুলা, ক্ষয়প্রাপ্তি, তাপমাত্রার ওঠানামা, বিকিরণ, যান্ত্রিক সংঘর্ষ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, তাপীয় চাপ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলি ছাড়াও আরো অনেক কারণে ইলেকট্রনিক্সের ক্ষতি হতে পারে।

নাসার মহাকাশ প্রযুক্তি বা বাণিজ্যিক কৃত্রিম উপগ্রহের মতো প্রযুক্তি, যেগুলি মানুষের নাগালের বাইরে থাকে বলে সাধারণ নিয়মে রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করা যায় না। সেসব প্রযুক্তিতে দীর্ঘ সময় টিকে থাকার মতো আয়ুষ্কাল থাকতে হয়। কিন্তু এই ধরনের প্রযুক্তিগুলিকেও ইলেকট্রনিক্স এর ওপর নির্ভর করতে হয়। আর ইলেকট্রনিক্স মানেই হচ্ছে সেটা যেকোনো সময় ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। যেসব ইলেকট্রনিক্স নিজেই নিজেকে মেরামত করতে পারে সেগুলি হতে পারে প্রযুক্তির ‘পরশ পাথর’। যদিও এই ধরনের প্রযুক্তি এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে।

সেলফ-হিলিং ন্যানোপার্টিকেল নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গবেষকরা বড় ধরনের হোঁচট খান।

টেকনিকনের ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স ফ্যাকাল্টি এবং সলিড টেস্ট ইন্সটিটিউটের একদল গবেষক অধ্যাপক ইয়োনাদাভ বেকেনিস্টাইন এর নেতৃত্বে পারভোস্কাইট ন্যানোপার্টিক্যাল নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তারা দেখতে চেয়েছিলেন, ইলেকট্রনিক্সে ব্যবহৃত বিষাক্ত সীসার পরিবর্তে পারভোস্কাইট ন্যানোপার্টিকেল ব্যবহার করা যায় কিনা।

গবেষক দল আণুবীক্ষণিক পর্যায়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছিলেন, ন্যানোক্রিস্টাল যান্ত্রিক কাঠামোর ক্ষতিগ্রস্থ জায়গাকে সারিয়ে তুলতে পারে। এই ঘটনায় গবেষকরা বিস্মিত হয়েছিলেন।

তারা একটা কোড ব্যবহার করে এই ভিডিওকে বিশ্লেষণ করে ক্রিস্টালের ভেতরের গতিশক্তি ও সঞ্চালন লক্ষ্য করেছিলেন। গবেষকরা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, ন্যানো পার্টিকালের উপর ক্ষতিগ্রস্থ স্থানটি প্রচণ্ড শক্তিতে ভেতরের দিকে চলে যায়, এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে গর্তটাকে পূর্ণ করে বাইরে বেরিয়ে আসে। গবেষকরা ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, এই সেল্ফ-হিলিং প্রক্রিয়ায় ন্যানো পার্টিকেলস কোনোরকম ক্ষতিগ্রস্থ না হয়েই আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।

টেকনিয়নের গবেষকরা বিশ্বাস করেন, এই আবিষ্কার পারভোস্কাইট ন্যানোপার্টিকেল কীভাবে নিজেরাই নিজেদেরকে সারিয়ে তুলতে পারে এই বিষয়টি বুঝতে আমাদেরকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। গবেষক দলটি মনে করে, পারভোস্কাইট ন্যানোপার্টিকেল সোলার প্যানেল ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা উচিত। অ্যাডভান্সড ফাংশনাল ম্যাটেরিয়াল-এ প্রকাশিত এই গবেষণার শিরোনাম হচ্ছে ‘Self-Healing of Crystal Voids in Double Pervoskite Nanocrystals is Related to Surface Passivation’। উইলি অনলাইন লাইব্রেরিতে এই গবেষণা পত্রটি পাওয়া যায়।

সেলফ রিপেয়ারিং প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ

টেকনিয়ন এর গবেষকগণ ছোট বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে নিজে নিজেই মেরামত করতে পারে এমন বৈশিষ্ট্যের উপাদান নিয়ে ভাবছেন। এগুলি ছাড়া অন্য আরো কিছু প্রকল্প আছে যেখানে সেলফ রিপেয়ারিং যন্ত্র, সিস্টেম ও রোবটিক্সের বিবর্তনে বিজ্ঞানীরা এখন কোয়ান্টাম জাম্প পদ্ধতি গ্রহণ করার কথা চিন্তা করছেন। বড় পরিসরে হার্ডওয়ার ও সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে সেলফ রিপেয়ারিং প্রযুক্তির একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে ডেক্সটার। এটা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে হ্যান্ডিম্যান বা কাজের মানুষ নামে পরিচিত।

২০১৯ সালের ২ মে, নাসার বিজ্ঞানীরা ডেক্সটারের সাহায্যে একটা অকেজো মেইন বাস সুইচিং ইউনিট থ্রি (Main Bus Switching Unit-3) প্রতিস্থাপন করেছিলেন। এর সাহায্য তারা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। নাসার ব্যাখ্যা ছিল এরকম, ডেক্সটারের সাহায্যে এই কাজ করতে পারায় নভোচারীদের স্পেস ওয়াক করতে হয়নি। মহাকাশ স্টেশনের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যেতে ডেক্সটার একটা রেল ব্যবহার করে। এপাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়ার এই রেলটি স্টেশনের মডিউলে স্থাপন করা হয়। যে সিস্টেমগুলি মহাকাশ স্টেশনের মডিউলে থাকে না, সেগুলির মেরামত দরকার হলে ক্যানাডার্ম নামক যান্ত্রিক হাত (robotic arm) এর সাহায্যে ডেক্সটার সেগুলি মেরামত করে।

আরো পড়ুন: ভিনচি যেভাবে মোনা লিসার মুখে ছায়া তৈরি করেছিলেন—সায়েন্টিস্টদের ধারণা

কানাডিয়ান মহাকাশ সংস্থা সিএসএ (CSA) -এর তৈরি ডেক্সটার হচ্ছে একটা বিশাল রোবট। এই রোবটটি বহুবিধ কাজ করতে পারে। এটা স্টেশনের ব্যাটারি পরিবর্তনের কাজ করে, অ্যামোনিয়া ছিদ্র চিহ্নিত করে ও মহাকাশ স্টেশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহ আর নানা ধরনের কাজ করে। NASA এবং CSA থেকে ডেক্সটার পরিচালনা করা হয়। তবে এই রোবটটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেও কাজ করতে পারে। মহাকাশ ষ্টেশনের ডেক্সটার রোবটটির মেরামত কাজ দেখে অনুমান করা যায় ভবিষ্যতে বড় মাপের সেলফ রিপেয়ারিং রোবটগুলি কেমন হতে পারে।