কখনো কখনো আমাদের এমন মনে হতে পারে যে আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই আবার আমাদের সাথে ঘটছে। এই অনুভুতিকে দেজাভ্যু বলা হয়। দেজাভ্যু বিষয়টি দার্শনিক। এটি নিউরোলজিস্ট ও লেখকদের অনেকদিন ধরেই বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে।
অ্যান ক্লিয়ারি, দ্য কনভারসেশন
৩ অক্টোবর, ২০২২
আপনার কি কখনো এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছে যখন মনে হয়েছে, এর আগেও আপনি ঠিক একই পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়েছেন? যদিও এমনটা ঘটা অসম্ভব।
১৮০০-এর দশকের শেষের দিকে, দেজাভ্যু এর কারণ কী হতে পারে তা নিয়ে অনেক তত্ত্ব উদ্ভূত হতে শুরু করে। দেজাভ্যু একটি ফরাসি শব্দ। যার অর্থ “ইতিমধ্যেই দেখা”।
সবাই ভেবেছিল তেজাভ্যু মানসিক বৈকল্যের কারণে ঘটে। অনেকে মনে করত এটা সম্ভবত মস্তিষ্কের কোনো সমস্যা থেকে তৈরি হয়। অথবা হয়ত মানুষের স্বাভাবিক স্মৃতির মধ্যে অস্বাভাবিক কোনো অস্থায়ী বুদবুদ এটা।
দেজাভ্যু নিয়ে আলাপ-আলোচনার ইতিহাস পুরোনো হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে এসে বিষয়টি বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করেছে।
প্যারানরমাল থেকে বিজ্ঞানে আসা
এই সহস্রাব্দের শুরুর দিকে, অ্যালান ব্রাউন নামের একজন বিজ্ঞানী সিদ্ধান্ত নেন দেজাভ্যু নিয়ে এখন পর্যন্ত গবেষকরা যা যা লিখেছেন তিনি তার সমস্ত কিছু পর্যালোচনা করবেন।
তিনি যেসব গবেষণা সংগ্রহ করেছিলেন, বেশিরভাগের মধ্যেই অলৌকিকতার গন্ধ ছিল। অধিকাংশই ছিল অতিপ্রাকৃত, অতীত জীবন বা সাইকিক ক্ষমতার মতো জিনিসের সাথে সম্পর্কিত। তবে এমন কিছু গবেষণাও তিনি খুঁজে পেয়েছেন যেখানে সাধারণ মানুষের দেজাভ্যুর অভিজ্ঞতা নিয়ে জরিপ করা হয়েছে।
এসমস্ত কাগজপত্র থেকে ব্রাউন দেজাভ্যু সম্পর্কে কিছু মৌলিক বিষয় সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।
উদাহরণস্বরূপ, ব্রাউন হিসাব করে বের করেছেন, মোটামুটি দুই তৃতীয়াংশ মানুষ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে দেজাভ্যু অনুভব করে। তিনি আরো বের করেছেন, দেজাভ্যু ঘটার সবচেয়ে কমন ট্রিগার হল কোনো দৃশ্য বা স্থান। তার পরবর্তী কমন ট্রিগারটি হলো কোন কথা বা কথোপকথন।
আরো পড়ুন: বাম দিকে মোড় নেয়া ৬১% অ্যাকসিডেন্টের কারণ
ধারণা করা হতো, মস্তিস্কের সিজার বা খিঁচুনির সাথে দেজাভ্যুর সম্পর্ক আছে। এ বিষয়টি নিয়ে গত এক শতাব্দী বা তারও বেশি সময় ধরে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নানা গবেষণা হয়েছে। ব্রাউনও এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
ব্রাউনের পর্যালোচনাটি দেজাভ্যুকে মূলধারার বিজ্ঞানের জগতে নিয়ে এসেছে। দু’টি কারণে তা হয়েছে। প্রথমত, ব্রাউনের পর্যালোচনাটি একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানীরা কগনিটিভ বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত বিজ্ঞানীরা এ জার্নালটি পড়েন। এছাড়াও বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে দেজাভ্যু নিয়ে একটি বইও লিখেছেন ব্রাউন। দেজাভ্যু নিয়ে ব্রাউনের কাজ অন্য বিজ্ঞানীদের দেজাভ্যু নিয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ক্ষেত্রে একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
সাইকোলজি ল্যাবে দেজাভ্যু পরীক্ষা
ব্রাউনের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, আমার নিজের গবেষণা দল দেজাভ্যু এর সম্ভাব্য গঠন পক্রিয়া সম্পর্কে যেসব হাইপোথিসগুলি আছে সেগুলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে।
আমরা প্রায় এক শতাব্দী পুরানো একটি হাইপোথিসিস নিয়ে কাজ করেছি। সেটির মূল প্রস্তাব হলো, যখন একটি বর্তমান দৃশ্যের সাথে আপনার স্মৃতিতে থাকা কোনো একটি ভুলে যাওয়া দৃশ্যের মিল থাকে, তখন দেজাভ্যু ঘটতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা একে ‘গ্যাসটল্ট ফামিলিয়ারিটি হাইপোথিসিস’ (Gestalt Familiarity Hypothesis) বলে অভিহিত করেছেন।
মোটামুটি দুই তৃতীয়াংশ মানুষ তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে দেজাভ্যু অনুভব করে।
কল্পনা করুন, আপনি একজন অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে হাসপাতালে এসেছেন। হাসপাতালের যে ইউনিটে নার্সিং স্টেশন আছে সেটা মাত্রই অতিক্রম করলেন। আপনি যদিও আগে কখনো এই হাসপাতালে আসেননি, কিন্তু আপনার মনে হচ্ছে যে এসেছেন।
এ ধরনের দেজাভ্যু অভিজ্ঞতার অন্তর্নিহিত কারণ হতে পারে দৃশ্যের বিন্যাস এবং আসবাবপত্র বা নিদৃষ্ট কোন বস্তুর অবস্থান। এগুলির সাথে যদি আপনার অতীতের কোন দৃশ্যের মিল থাকে তখন আপনার দেজাভ্যু হতে পারে।
আরো পড়ুন: বড় আকারের ছবি বা ভিডিও কি বেশি মনে থাকে?
নার্সিং স্টেশনটি যেভাবে অবস্থিত–এর আসবাবপত্র, কাউন্টারের জিনিসপত্র, হলওয়ের সাথে এর কোণাটি যেভাবে মিলেছে–তা হয়তো আপনার অতীতে দেখা কোন দৃশ্যের সাথে মিলে যায়। হয়তো এক বছর আগে কোনো স্কুলের অনুষ্ঠানে আপনি গিয়েছিলেন, সেখানকার হলওয়েতে অতিথিদের স্বাগতম জানানোর টেবিলটির সাথে নার্সিং স্টেশনের দৃশ্যটির মিল আছে।
গ্যাসটল্ট ফামিলিয়ারিটি হাইপোথিসিস অনুসারে, যদি বর্তমান পরিস্থিতির সাথে অতীতের কোন পরিস্থিতির মিল থাকে, এবং অতীতের সিচুয়েশনটি যদি আপনার মনে না থাকে বা মাথায় না আসে, তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিকে আপনার পরিচিত মনে হওয়ার অনুভুতি হতে পারে।
বিষয়টি ল্যাবে পরীক্ষা করার জন্য, আমার দল ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ব্যবহার করেছে। এবং ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ব্যবহার করার মাধ্যমে আমরা পরিবেশ প্রভাবিত করতে পারি। এখানে যে দৃশ্যগুলি ব্যবহার করা হয়েছে তা মোটামুটি সবক্ষেত্রেই ভিন্ন, শুধু এর স্থানিক বিন্যাসটি একইরকম রাখা হয়েছে।
আরো পড়ুন: মাছ কথা বলে
ফলাফল যা আশা করা হয়েছিল, তাই ঘটেছে। দেজাভ্যু তখনই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি যখন আগে দেখা (এবং ইতিমধ্যে ভুলে যাওয়া) কোন দৃশ্যের সাথে বর্তমানে দেখা দৃশ্যটির স্থানিক বিন্যাসে মিল থাকে।
এই গবেষণা থেকে আমরা পেয়েছি যে ভুলে যাওয়া একটি পুরোনো দৃশ্যের স্থানিক অবস্থানের সাথে যদি এই মুহুর্তের কোন দৃশ্যের স্থানিক অবস্থানের মিল থাকে–তাহলে এই ফ্যাক্টরটি দেজাভ্যু ঘটাতে অবদান রাখতে পারে।
যাইহোক, এর মানে এই না যে স্থানিক সাদৃশ্যই দেজাভ্যুর একমাত্র কারণ। একটি দৃশ্য বা পরিস্থিতিকে পরিচিত মনে হওয়ার আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। দেজাভ্যু নামের এই রহস্যময় ব্যাপারটি আর কী কী কারণে ঘটতে পারে তা জানার জন্য গবেষণা চলছে।
লেখক পরিচিতি
অ্যান ক্লিয়ারি কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির কগনিটিভ সাইকোলজির অধ্যাপক। তার রিসার্চ প্রজেক্টের মধ্যে দেজাভ্যু ছাড়াও রয়েছে, ‘রিকগনিশন উইদআউট কিউড রিকল’ (Recognition without Cued Recall)।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরীক্ষার শুরুতে অংশগ্রহণকারীদের যদি কিছু দেখানো হয় এবং কিছুক্ষণ পর যদি তাদেরকে জিনিসগুলি মনে করতে বলা হয়, তারা তা মনে করতে পারে না। তবে অন্য আরো জিনিসের সাথে যখন প্রাথমিক পর্যায়ের জিনিসগুলি আবারো দেখানো হয়, তখন তারা সেগুলিকে আলাদা করতে পারে। একেই বলা হচ্ছে রিকগনিশন উইদআউট কিউড রিকল ইফেক্ট।
টিপ-অফ-দ্য-টাং এক্সপেরিয়েন্স: টিপ-অফ-দ্য-টাং এক্সপেরিয়েন্স বলতে বোঝায় যখন একটি শব্দ স্মৃতিতে আছে কিন্তু মনে করা যাচ্ছে না।
অনুবাদ. জুবায়েদ দ্বীপ