“একটা আদর্শ খাবার বলতে যা বোঝায়, কাঠবাদাম অনেকটা তেমনই।”
কিন্তু কেন?
বৃক্ষ থেকে পাওয়া যায় এমন বাদামের মধ্যে কাঠবাদাম (Almonds) সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। কাঠবাদাম থেকে পাওয়া যায় নানা ধরনের পুষ্টি উপাদান। এটি উপকারী ফ্যাট, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন এবং মিনারেলে সমৃদ্ধ। কাঠবাদামের ৯টি প্রমাণিত উপকারিতার কথা এখানে থাকছে।
১. কাঠবাদামে আছে প্রচুর পুষ্টি উপাদান
কাঠবাদাম হচ্ছে ‘Prunus dulcis’ নামের গাছ থেকে আসা খাওয়ার উপযোগী বীজ। এ গাছটিকে আমরা কাঠবাদাম গাছ নামেই চিনি। গাছটি মূলত মধ্যপ্রাচ্যে দেখা যায়, তবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি কাঠবাদাম উৎপাদন করে থাকে।
দোকান থেকে আমরা যে কাঠবাদাম কিনি সেটার বাইরের আবরণ থাকে না। তাতে থাকে ভেতরের খাদ্যযোগ্য অংশটুকু। কাঠবাদাম কাঁচা অবস্থায় বা হালকা ভেজে (রোস্ট) খাওয়া যায়। নানারকম ডেজার্টে উপাদান এবং টপিং হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কাঠবাদাম থেকে দুধ, তেল, মাখন, ময়দা এমনকি পেস্টও তৈরি করা হয়। এর পেস্টকে বলা হয় মার্জিপান (Marzipan)।
কাঠবাদামের পুষ্টিগুণ সত্যিই অবাক করার মতো। এক আউন্স বা ২৮ গ্রাম কাঠবাদাম থেকে আপনি পাবেন:
- আঁশ বা ফাইবার: ৩.৫ গ্রাম
- প্রোটিন: ৬ গ্রাম
- ফ্যাট: ১৪ গ্রাম (এর মধ্যে মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট ৯ গ্রাম)
- ভিটামিন-ই: প্রতিদিনের চাহিদার ৩৭%
- ম্যাঙ্গানিজ: প্রতিদিনের চাহিদার ৩২%
- ম্যাগনেসিয়াম: প্রতিদিনের চাহিদার ২০%
এছাড়া এতে যথেষ্ট পরিমাণে তামা, ভিটামিন বি ২ (রিবোফ্লাভিন) এবং ফসফরাস আছে।
মাত্র এক মুঠ কাঠবাদাম থেকে আপনি এত ধরনের পুষ্টি উপাদান পাবেন। তবে বিপরীতে এতে একইসঙ্গে আছে মাত্র ১৬১ ক্যালোরি ও পাচনযোগ্য শর্করা কেবল ২.৫ গ্রাম।
আরো পড়ুন: উদ্ভিজ্জ আমিষ: মাছ-মাংস বাদে প্রোটিন পেতে পারেন অন্য যেসব খাবার থেকে
একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি যে কাঠবাদাম থেকে পাওয়া ১০-১৫% ক্যালোরিই আমাদের শরীর গ্রহণ করতে পারে না। কারণ কাঠবাদামের মধ্যে কিছু ফ্যাট আছে, যেগুলি হজমের কাজে লাগে এমন এনজাইম পর্যন্ত পৌঁছায় না।
এছাড়া কাঠবাদাম থেকে প্রচুর ফাইটিক এসিড পাওয়া যায়। এই এসিড কিছু মিনারেল এর সাথে যুক্ত হয়ে যায়। ফলে আমাদের শরীর তা গ্রহণ করতে পারে না।
২. কাঠবাদাম অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের খুব ভাল উৎস কাঠবাদাম। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের শরীরকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। অক্সিডেশনের ফলে আমাদের কোষের অণু নষ্ট হয়ে যায়, প্রদাহ দেখা দেয়। এছাড়া ক্যান্সার ও দ্রুত বার্ধক্যের কারণও এটা।
কাঠবাদামের বাদামী চামড়ায় আছে যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তাই চামড়া ছাড়ানো কাঠবাদাম থেকে আপনি প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাবেন না।
“কাঠবাদামের বাদামী চামড়ায় আছে যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তাই চামড়া ছাড়ানো কাঠবাদাম থেকে আপনি প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাবেন না।”
৬০ জন ধুমপায়ী পুরুষের ওপর করা একটা ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা যায়, প্রতিদিন ৩ আউন্স (৮৪ গ্রাম) কাঠবাদাম গ্রহণ করণে ৪ সপ্তাহের মধ্যে তাদের শরীরে অক্সিডেটিভ ক্ষতির পরিমাণ ২৩-৩৪% পর্যন্ত কমেছে।
আরেকটি গবেষণায় কাঠবাদামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণের প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায় প্রতিদিন খাবারের সাথে কাঠবাদাম রাখা হলে তা অক্সিডেটিভ ক্ষতি কমাতে ভূমিকা রাখে।
৩. কাঠবাদামে আছে প্রচুর ভিটামিন-ই
চর্বিতে দ্রবীভূত হয় এমন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গ্রুপ হচ্ছে ভিটামিন-ই। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের সেল মেমব্রেন অর্থাৎ কোষ প্রাচীর তৈরিতে সাহায্য করে। এতে শরীরের কোষ অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়।
কাঠবাদাম হচ্ছে ভিটামিন-ই-এর সবচেয়ে ভাল উৎসের একটি। মাত্র ১ আউন্স কাঠবাদাম থেকে আপনি দৈনিক চাহিদার ৩৭% শতাংশ ভিটামিন-ই পেতে পারেন।
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি কমাতে ভিটামিন-ই সাহায্য করে।
৪. রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে
বাদামে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা কম থাকলেও এতে উপকারী ফ্যাট, প্রোটিন এবং ফাইবার যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি আদর্শ খাবার।
কাঠবাদামের আরেকট গুণ হচ্ছে এর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম আছে। শরীরের ৩০০০ এরও বেশি কাজে ম্যাগনেসিয়াম এর প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে অন্যতম কাজ রক্তের গ্লুকোজ বা চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ। প্রতিদিন আমাদের ৩১০-৪২০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম এর প্রয়োজন হয়। ২ আউন্স কাঠবাদাম থেকে প্রায় ১৫০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায়।
আরো পড়ুন: ছাতা পড়া পাউরুটির ‘পরিষ্কার’ অংশ কেন খাওয়া যাবে না—বিজ্ঞান কী বলে?
আর অবাক করা বিষয় হচ্ছে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ২৫-৩৮% শতাংশ ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতিতে ভোগে। এই ঘাটতি পূরণ করতে পারলে তাদের রক্তের চিনির মাত্রা অনেক কমিয়ে ফেলা এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব।
ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সাপ্লিমেন্ট (ঔষুধ) হিসেবে ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণ করলে তাদের ইনসুলিন রেজিস্টেন্স (রক্ত থেকে ইনসুলিন গ্রহণে পেশির কোষ, চর্বি ও যকৃ্ৎ এর অপারগতা) অনেক পরিমাণে হ্রাস পায়।
এতে বোঝা যায়, ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন কাঠবাদাম শরীরবৃত্তীয় সমস্যা (মেটাবোলিক সিনড্রোম) এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস এর মতো জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৫. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও কাজে আসে ম্যাগনেসিয়াম
এছাড়া কাঠবাদামে থাকা ম্যাগনেসিয়াম রক্তচাপ কম রাখতেও সাহায্য করে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আপনার ওজন যতই নিয়ন্ত্রণে থাকুক না কেন, ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি রক্তচাপ বাড়িয়ে তুলতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরে ম্যাগনেসিয়াম ঘাটতি কমাতে পারলে রক্তচাপের সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আপনি যদি প্রতিদিনের খাবার থেকে ম্যাগনেসিয়ামের চাহিদা পূরণ করতে না পারেন, নিয়মিত কাঠবাদাম খেলে অনেক উপকার পাবেন।
৬. কোলেস্টেরল লেভেল কমাতে পারে
রক্তের এলডিএল লিপোপ্রোটিন—যাকে খারাপ কোলেস্টরেলও বলা হয়—হৃদরোগের ঝুঁকির অন্যতম কারণ। শরীরে এলডিএল এর মাত্রা অনেকটাই নির্ভর করে খ্যাদ্যাভাসের ওপর। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কাঠবাদাম কার্যকরভাবে এলডিএল কমাতে পারে।
প্রি-ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিক হওয়ার আগের ধাপ) আছে এমন ৬৫ জন মানুষের ওপর ১৬ সপ্তাহ গবেষণা চালিয়ে দেখা যায়, খাবারের ২০% ক্যালোরি কাঠবাদাম থেকে আসে এমন ডায়েট নেয়ার পর তাদের শরীরে এলডিএল কোলেস্টেরল গড়ে ১২.৪ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার কমে গেছে।
আরেকটা গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ৪২ গ্রাম কাঠবাদাম খেলে এলডিএল কোলেস্টরল ৫.৩ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার কমে যায়। অন্যদিকে শরীরে ভাল কোলেস্টরল এইচডিএলও ঠিক থাকে। এই ডায়েটে অংশগ্রহণকারীদের পেটের চর্বিও কমে যায়।
৭. এলডিএল কোলেস্টেরলের ক্ষতিকর অক্সিডেশন কমাতে সাহায্য করে
কাঠবাদাম শরীরে এলডিএল লেভেল কমানো ছাড়াও অনেক কাজ করে। এলডিএল কোলেস্টেরলকে অক্সিডেশন অর্থাৎ অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করার হাত থেকে রক্ষা করে। এটা হৃদরোগ প্রতিরোধ করার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
কাঠবাদামের চামড়াতে প্রচুর পরিমাণে পলিফেনল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। টেস্ট টিউব ও জীবজন্তর ওপর পরীক্ষা করে দেখা যায় এটিও কোলেস্টেরলের অক্সিডেশন কমায়।
আরো পড়ুন: আপনি আর্সেনিক যুক্ত ভাত খাচ্ছেন না তো?
আবার ভিটামিন-ই এর উপস্থিতির কারণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কার্যকারিতা আরো বাড়তে পারে ।
মানুষের ওপরে করা একটা পরীক্ষায় দেখা যায়, স্ন্যাকস বা নাস্তা হিসেবে এক মাস কাঠবাদাম খেলে অক্সিডাইজড এলডিএল কোলেস্টরল ১৪% কমে যায়। হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৮. কাঠবাদাম খেলে ক্ষুধা কমে, ক্যালোরি গ্রহণ কম হয়
কাঠবাদামে শর্করা যেমন কম, তেমনি এতে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও ফাইবার। প্রোটিন ও ফাইবার দুটি’ই ক্ষুধা ভাব কমাতে সাহায্য করে। ফলে কম ক্যালোরি গ্রহণ করতে এটি সাহায্য করে।
১৩৭ জন মানুষের ওপর ৪ সপ্তাহ ধরে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন ৪২ গ্রাম কাঠবাদাম খাওয়ার ফলে তাদের খাওয়ার ইচ্ছা ও ক্ষুধা দুটি’ই অনেক কমে গেছে। এছাড়া আরো অনেক গবেষণায় বাদামের ক্ষুধা নষ্ট করার গুণাগুণ সম্পর্কে জানা যায়।
৯. ওজন কমাতেও কাজে আসতে পারে কাঠবাদাম
বাদামে এমন কিছু পুষ্টি উপাদান থাকে যা আপনার শরীরের জন্য হজম করা কঠিন হয়। এজন্য এর মধ্যে থাকা ১০-১৫% ক্যালোরিই আপনার শরীর গ্রহণ করতে পারে না। তবে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, বাদাম শরীরের মেটবলিজম (কাজ করার ক্ষমতা) কিছুটা বাড়াতে সাহায্য করে।
অন্যদিকে বাদাম ক্ষুধা মেটাতে পারে বলে ওজন কমানোর ক্ষেত্রে বেশ কাজে দেয়। কোয়ালিটি হিউম্যান রিসার্চ থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। একটা গবেষণায় দেখা যায়, ওজন কমাতে প্রতিদিন ৩ আউন্স (৮৪ গ্রাম) কাঠবাদাম আছে এমন লো-ক্যালোরি ডায়েট, জটিল কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ ডায়েটের চেয়ে ৬২% বেশি কার্যকর।
১০০ জন স্থূলকায় নারীর ওপর করা গবেষণায় দেখা যায়, যাদের ডায়েটে বাদাম ছিল, তাদের ওজন বাকিদের চেয়ে বেশি কমেছে। তাদের কোমরের মাপ কমেছে এবং সুস্বাস্থ্যের অন্যান্য লক্ষণও ভাল হয়েছে। তাই বলা যায় ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার হলেও কাঠবাদাম ওজন কমাতে বেশ ভাল কাজে দেয়।
“১০০ জন স্থূলকায় নারীর ওপর করা গবেষণায় দেখা যায়, যাদের ডায়েটে বাদাম ছিল, তাদের ওজন বাকিদের চেয়ে বেশি কমেছে।”
তবে একটা বিষয় হচ্ছে, কাঠবাদামের মতো অন্য সব বাদামেও প্রচুর ক্যালোরি থাকে। তাই যাদের অনেক খাবার খেয়ে ফেলার অভ্যাস আছে তারা নাস্তা হিসেবে বাদাম রাখবেন না।
শেষ কথা
কাঠবাদামে আছে প্রচুর উপকারী ফ্যাট, ফাইবার, প্রোটিন, ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন-ই। এর উপকারিতার মধ্যে আছে রক্তে চিনির পরিমাণ কমানো, রক্তচাপ কম রাখা ও কোলেস্টেরল লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখা। এছাড়া ক্ষুধা কমাতে ও শরীরের ওজন কমাতে কাঠবাদাম সাহায্য করে। সব মিলিয়ে বলা যায়, একটা আদর্শ খাবার বলতে যা বোঝায় কাঠবাদাম অনেকটা তেমনই।
সূত্র. হেলথলাইন
অনুবাদ. আমিন আল রাজী