৫ দিনের অনুসন্ধান শেষে ‘টাইটান’ নামের ডুবোযানটির ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করা হয়েছে। সাগরের নিচে পড়ে থাকা জাহাজ টাইটানিক এর সামনের অংশ থেকে প্রায় ৪৯০ মিটার বা ১,৬০০ ফুট দূরে এসব ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়।

মূলত এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এতে থাকা যাত্রীদের কেউই বেঁচে নেই। ধারণা করা হচ্ছে বিস্ফোরণ ঘটেছিল ডুবোযানটিতে। টাইটান এর ধ্বংসাবশেষ প্রথম শনাক্ত করে গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানের জন্যে কাজে লাগানো একটি রোবট বা আরওভি।

তবে এখনই অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না। কীভাবে টাইটান নামের ডুবোযানটি ধ্বংস হল, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্যে আমেরিকা এবং কানাডার কোস্টগার্ড আরো অনুসন্ধান চালাবে।

তবে কাউকে জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা না থাকায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, তার পরিসর অনেক কমে আসবে।


ফারহান মাসউদ


গত ১৮ জুন (২০২৩) রবিবারে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ডুব দেয় ‘টাইটান’ নামের ডুবোযানটি। এই ডুবোযান কাজে লাগানো হত ১১১ বছর আগে ডুবে যাওয়া ঐতিহাসিক জাহাজ ‘টাইটানিক’ পরিদর্শনের জন্যে।

দর্শনার্থীরা ‘টাইটান’-এ চড়ে পানির তলদেশে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যেতেন।

টাইটানিক এর ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে পানির প্রায় ১২,৫০০ ফুট নিচে। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের ঠিক যেখানে টাইটানিক ডুবে গেছে, সেই জায়গা পর্যন্ত টাইটান ডুবোযানটিকে মূলত আরেকটি জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হত। এরপর সেই জাহাজ থেকে দর্শনার্থীরা ডুবোযানে চড়ে টাইটানিক এর ধ্বংসাবশেষ দেখার উদ্দেশ্যে ডুব দিত।

সর্বশেষ যেই জাহাজে করে টাইটানকে বহন করা হয়েছিল, তার নাম ‘এমভি পোলার প্রিন্স’।

‘এমভি পোলার প্রিন্স’ মূলত গবেষণা ও অভিযানের কাজে ব্যবহৃত জাহাজ। টাইটানকে বহন করার জন্য জাহাজটি ভাড়া করা হয়েছিল। গত রবিবারে টাইটান ডুবোযান এবং দর্শনার্থীদের নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের যেখানে টাইটানিক ডুবে গিয়েছিল, সেখানে পৌঁছায় পোলার প্রিন্স।

টাইটান
টাইটান

স্থানটি কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড উপকূলের কাছাকাছি হলেও ভূমি থেকে অনেক দূরে। এবং জায়গাটি আন্তর্জাতিক জলভাগ-এ পড়েছে। অর্থাৎ, কোনো দেশের নিয়ন্ত্রণে নেই সমুদ্রের এই অংশে।

সমুদ্রের যেখানটায় টাইটানিক ডুবে গিয়েছিল, তার কাছাকাছি যাওয়ার পরে পোলার প্রিন্স জাহাজ থেকে টাইটান ডুবোযানটিকে পানিতে নামানো হয়। এতে যাত্রী ছিলেন মোট ৫ জন।

যাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং বয়স্ক ব্যক্তির নাম পল-হেনরি নার্জোলে। ৭৭ বছর বয়সী ফরাসি নৌবাহিনীর সাবেক এই কমান্ডার ডুবোজাহাজ চালানোর কাজেও পারদর্শী ছিলেন। এছাড়াও ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেশন অফ দ্যা সী’ এর সদস্যও ছিলেন তিনি। আবার ‘ই/এম গ্রুপ’ এবং ‘আরএমএস টাইটানিক ইনকর্পোরেটেড’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন তিনি।

‘আরএমএস টাইটানিক’ প্রতিষ্ঠানটির কাছে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে জিনিসপত্র বা নিদর্শন সংগ্রহ করার আইনি অধিকার রয়েছে।

নার্জোলে নিজে টাইটানিক এর ধ্বংসস্তূপে ৩৫টিরও বেশি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এবং তার তত্ত্বাবধানেই ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রচুর পরিমাণ নিদর্শন পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। ফলে ধ্বংসস্তূপের জায়গা সম্পর্কে সবচেয়ে অভিজ্ঞ মানুষদের একজন হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হত।

যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ৬১ বছর বয়সী স্টকটন রাশ। আমেরিকান এই প্রকৌশলী, পাইলট এবং ব্যবসায়ীই ছিলেন ‘ওশানগেট’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও। উল্লেখ্য, ‘ওশানগেট’ নামের প্রতিষ্ঠানটিই ‘টাইটান’ ডুবোযান এর নির্মাতা এবং এই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানেই টাইটানিক এর ধ্বংসস্তূপ দেখাতে দর্শনার্থীদের নিয়ে যাওয়া হত।

টাইটান উদ্ধারের নজিরবিহীন অভিযান
 রোববার , ১৮ জুন ২০২৩, ডুবোযান টাইটান আটলান্টিকের গভীরে ডুব দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

যাত্রী হিসেবে টাইটান-এ ছিলেন ৫৮ বছর বয়সী ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, বিমানচালক এবং মহাকাশ পর্যটক হ্যামিশ হার্ডিং। বড় ধরনের বেশ কিছু অভিযানের অভিজ্ঞতা তার আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পৃথিবীর গভীরতম খাঁদ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর গভীরে যাওয়া, সমগ্র পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা এবং মহাকাশ ভ্রমণ। পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে তিনি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডও স্থাপন করেছিলেন।

৫ জন যাত্রীর মধ্যে বাকি দুজন হলেন ৪৮ বছর বয়সী পাকিস্তানি-ব্রিটিশ ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ এবং তার ১৯ বছর বয়সী পুত্র সুলেমান দাউদ। শাহজাদা দাউদ ছিলেন ‘দাউদ হারকিউলিস কর্পোরেশন লিমিটেড’ এর পরিচালনা পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান এবং পাকিস্তানের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন।

শাহজাদা এবং তার পুত্র সুলেমান দুজনই অ্যাডভেঞ্চার খুব পছন্দ করতেন। এবং শাহজাদা দাউদ ছিলেন অলাভজনক গবেষণা সংস্থা ‘সেটি ইনস্টিটিউট’ এর একজন ট্রাস্টি। ‘সেটি ইনস্টিটিউট’ এর নামকরণ হয়েছে ‘SETI’ অক্ষরগুলি থেকে, যার পূর্ণরূপ হল ‘সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স’, অর্থাৎ ‘বহির্জগতে বুদ্ধিমত্তার অনুসন্ধান’।

সুলেমান দাউদ স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো’তে অবস্থিত স্ট্র্যাথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন।

এই ৫ জন যাত্রী নিয়ে ডুব দেয়ার পরে প্রতি ১৫ মিনিটে পোলার প্রিন্স এর সাথে যোগাযোগ করার কথা টাইটানের এবং সেটাই করছিল টাইটান। তবে পানিতে নামার প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় ডুবোযানটি। এরপর টাইটান থেকে আর কোনো সংকেত পাওয়া যায়নি।

প্রায় একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ‘অ্যাকোস্টিক সিস্টেম’-এ এক ধরনের ‘অসঙ্গতি’ ধরা পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে সেই অসঙ্গতিই ছিল টাইটান এর বিস্ফোরণ থেকে আসা শব্দ।

এদিকে নৌবাহিনীর কাছ থেকে এই তথ্য আমেরিকার উপকূলরক্ষী বাহিনী বা কোস্ট গার্ডকে জানানো হয়। কিন্তু এই তথ্যকে নিশ্চয়তা বলে ধরে নেয়নি নৌবাহিনী। ফলে ডুবোযানটি নিখোঁজ হওয়ার পরও অনুসন্ধান অব্যাহত রাখা হয়েছিল।

কেননা ডুবোযানে যাত্রীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে যতটুকু অক্সিজেন ছিল, তা দিয়ে ৪ দিন বা ৯৬ ঘণ্টার মত বেঁচে থাকার কথা ছিল তাদের। ফলে যাত্রীদের জীবিত উদ্ধারের আশা থেকেই কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ও কোস্ট গার্ড বিভিন্ন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ৫ দিন ধরে নিখোঁজ টাইটান এর সন্ধান করেছে। এতে সাহায্য করেছে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। এছাড়া বেসরকারিভাবেও সাহায্য এসেছে আরো।

ডুবোযান নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে প্রতি মুহূর্তেই এর খোঁজ চালিয়ে যাওয়া হয়েছে, কাজে লাগানো হয়েছে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি।

জানা যাক, কী কী প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে খোঁজা হয়েছে টাইটানকে।

 

সোনার প্রযুক্তি বা ‘সোনোবয়া’

বেশ কয়েক দশক ধরে সমুদ্রের গভীর তলদেশে অনুসন্ধানের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ‘সোনার প্রযুক্তি’। শব্দের সাহায্যে গভীর পানিতে দিক নির্ণয়, বস্তু শনাক্ত কিংবা দূরত্ব পরিমাপ করতে কাজে লাগানো হয় এই প্রযুক্তি।

ফলে টাইটান ডুবোযান অনুসন্ধানের শুরুতেই সোনার প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কানাডার কোস্টগার্ডরা সেটা খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছেন। এজন্য আমেরিকান প্রতিষ্ঠান লকহিড এর তৈরি বিমান ‘সিপি ১৪০ অরোরা’ ব্যবহার করেছেন তারা। সেই বিমান থেকে ‘সোনার বয়া’ বা ‘সোনোবয়া’ (Sonobuoy) নামের এক ধরনের যন্ত্র পানিতে নামিয়েছেন অনুসন্ধানের জন্য।

টাইটান
অন্টারিও’র আকাশে ‘সিপি ১৪০ অরোরা’ বিমান

বিমান থেকে পানিতে ফেলার পরে ‘সোনোবয়া’ সাধারণত পানিতে ভাসতে থাকে। পানির গভীরে বস্তুর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য এতে বিশেষ ধরনের সেন্সর থাকে। এবং সেন্সর থেকে পাওয়া তথ্য রেডিও ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বিমানে বা অন্য কোথাও পাঠানো হয়।

যেখান থেকে ডুবোযানটি নিখোঁজ হয়েছে, তার আশেপাশের জলভাগ জুড়ে একাধিক সোনোবয়া বসানো হয়েছিল। প্রতিটি সোনোবয়া’ই আলাদা আলাদা ভাবে নির্দিষ্ট অঞ্চল জুড়ে তল্লাশি চলাচ্ছিল।

সোনোবয়া মূলত দুইভাবে শব্দের মাধ্যমে অনুসন্ধান চালায়।

প্রথম পদ্ধতি হল ‘প্যাসিভ ডিটেকশন’, যার মাধ্যমে সোনোবয়া টাইটান ডুবোযান থেকে আসা যেকোনো শব্দ শোনার চেষ্টা করেছে। টাইটান ডুবোযান এর প্রপেলার, যন্ত্রপাতি বা অন্য যেকোনো কিছুর শব্দই বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে এ পদ্ধতিতে।

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বিমান থেকে প্যারাসুট এর মাধ্যমে পানিতে ‘সোনোবয়া’ ছাড়া হচ্ছে।

এবং দ্বিতীয় পদ্ধতি হল ‘অ্যাক্টিভ ডিটেকশন’ বা সক্রিয় ভাবে শনাক্ত করার কৌশল। মূলত বাদুড় যেভাবে অন্ধকারে পথ খোঁজার জন্য প্রতিধ্বনির ওপর নির্ভর করে, অনেকটা সেভাবেই কাজ করে এ পদ্ধতি। এজন্য সোনোবয়া থেকে প্রথমে শব্দ তরঙ্গ উৎপন্ন করা হয়। এরপর সেই শব্দ পানির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় কোনো বস্তুতে বাধা পেলে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হয়। আর সেই প্রতিধ্বনি যখন রিসিভারের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়, তখনই বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করতে পারে সোনোবয়া।

প্যাসিভ ডিটেকশন এর মাধ্যমে যেসব জিনিস সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না বা যেসব বস্তু শব্দ করে না, সেসব বস্তু খোঁজার জন্যে কাজে লাগানো হয় অ্যাক্টিভ ডিটেকশন পদ্ধতি।

পানির নিচের বস্তুর অনুসন্ধানের জন্যে সোনোবয়া বেশ কার্যকর একটা পদ্ধতি। তুলনামূলক সস্তা এই যন্ত্র দ্রুত এবং সহজেই স্থাপন করা যায়। এছাড়াও যতটুকু জলভাগ জুড়ে কাজ করে, সেখানে থাকা খুব ছোট বস্তু থেকে আসা শব্দও শনাক্ত করতে পারে এসব ডিভাইস।

নিখোঁজ টাইটান ডুবোযান অনুসন্ধানের কাজে সোনোবয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সোনার প্রযুক্তির মাধ্যমে কিছু শব্দ শনাক্ত করা গিয়েছিল, তবে এসব শব্দ ডুবোযান থেকেই এসেছে কিনা, তা স্পষ্ট হয় নাই।

অন্যদিকে সোনোবয়া যেহেতু যেকোনো শব্দের উৎসই শনাক্ত করতে পারে এবং দুর্ঘটনার এই জায়গায় শত বছরের বেশি সময় ধরে ডুবে রয়েছে টাইটানিক, ফলে বিভিন্ন উৎস থেকেই শব্দ শনাক্ত করেছে ভাসমান সোনোবয়া।

সোনার প্রযুক্তি কাজে লাগানোর জন্যে ‘জন ক্যাবট’ নামের কানাডার কোস্ট গার্ডের একটি জাহাজ কাজ করেছে। ২০৭ ফুট দীর্ঘ এই জাহাজে ছিল অত্যাধুনিক সোনার প্রযুক্তি, যা দিয়ে পানির অনেক গভীর থেকে আসা শব্দও শনাক্ত করা যায়।

এছাড়াও ‘সি-১৩০’ নামের আমেরিকান কোস্ট গার্ডের বিমান সহ আরো কিছু বিমান ও জাহাজ ব্যবহৃত হয়েছে সোনার প্রযুক্তি কাজে লাগাতে।

 

পানির ড্রোন বা ‘আরওভি’

আরওভি (ROV) এর পূর্ণরূপ হল ‘আন্ডারওয়াটার রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকেল’। একে পানিতে চালানোর ড্রোনও বলা যায়। মূলত চালকবিহীন এই যান দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এসব যানে ক্যামেরা, লাইট এবং সামনে পড়া বস্তু নাড়ানো বা সংগ্রহ করার জন্যে বিশেষ বাহু থাকে।

সমুদ্রে ‘ল্যতলন্ত’ জাহাজ

এসব কিছু ব্যবহার করে পানির নিচে কার্যকরভাবে অনুসন্ধান চালাতে পারে ‘আরওভি’। টাইটান অনুসন্ধানে ‘মোটর ভেসেল হরাইজন আর্কটিক’ নামের কানাডিয়ান এক জাহাজ কাজ করেছে আরওভি’র মাধ্যমে পানির গভীরে অনুসন্ধানের জন্যে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর দেয়া বেশ কয়েকটি আরওভি ছিল এতে।

দুর্ঘটনার একদিন পরে ‘ডিপ এনার্জি’ নামের বেসরকারি একটি জাহাজও অনুসন্ধানে যোগ দিয়েছিল। জাহাজটির কাজ মূলত সমুদ্রের নিচে ক্যাবল বা তার বিছিয়ে দেয়া। এই জাহাজে দুটি আরওভি রয়েছে, যেগুলি সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে অনুসন্ধান চালাতে পারে।

এছাড়াও নিখোঁজ ডুবোযান অনুসন্ধানে যোগ দিয়েছিল ২৭৯ ফুট দীর্ঘ ফ্রান্সের জাহাজ ‘ল্যতলন্ত’ (L’Atalante)। এই জাহাজে ‘ভিক্টর ৬০০০’ (Victor 6000) নামের এক আরওভি আছে, যেটা পানির ২০,০০০ ফুট পর্যন্ত গভীরে ডুব দিতে পারে। ভিডিও এবং শব্দ শনাক্ত সহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে অনুসন্ধান চালাতে পারে এই আরওভি।

পানির নিচে ‘ভিক্টর ৬০০০’ আরওভি

১৯৯৯ সাল থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে ভিক্টর নামের এই আরওভি, যার ওজন টনেরও বেশি। এতে হাই-ডেফিনিশন ক্যামেরা রয়েছে, যার মাধ্যমে ‘ফোর কে’ রেজোল্যুশন এর ভিডিও ধারণ করা যায়। ‘ল্যতলন্ত’ জাহাজের সঙ্গে এই আরওভি যুক্ত রয়েছে ৮.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক তারের মাধ্যমে। ভিক্টরের কাজ করার জন্যে প্রায় ২০ কিলোওয়াট বৈদ্যুতিক শক্তির প্রয়োজন হয়।

অনুসন্ধানে ‘কার্ভ-২১’ (CURV-21) নামের আমেরিকার এক আরওভি কাজে লাগানো হয়েছিল। ছোট একটি গাড়ির আকারের এই আরওভি মূলত তারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পানির ৬,০০০ মিটার পর্যন্ত গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান চালাতে পারে এই আরওভি। ক্যামেরা এবং লাইট ছাড়াও এই আরওভি’তে রয়েছে সোনার প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন ধরনের সেন্সর।

আরওভি’তে থাকা সোনার প্রযুক্তির মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশের ভূমি বা সি-ফ্লোরের মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে এবং সেসব মানচিত্র বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে টাইটান ডুবোযানের অবস্থান। সোনার প্রযুক্তির এ ধরনের ব্যবহারকে বলা হয় ‘সাইড স্ক্যান সোনার’।

আরো পড়ুন: নেকড়েরা যে ভাবে নদীর স্বভাব পাল্টে দেয়

এর বাইরে ‘আটলান্টিক মার্লিন’ এবং নরওয়েতে নির্মিত ‘স্কন্দি ভিনল্যান্ড’ নামের দুটি জাহাজও অনুসন্ধানের কাজ করার কথা ছিল। এবং এসব জাহাজেও রয়েছে আরওভি।

গভীর-সমুদ্র ম্যাপিং এর প্রতিষ্ঠান ম্যাগেলান এর একটি আরওভি ডিভাইসও অনুসন্ধানের কাজে যোগ দেয়ার কথা ছিল। তাদের এই আরওভি পানির ১৯,০০০ ফুট পর্যন্ত গভীরে যেতে পারে। এর আগে এই প্রতিষ্ঠানটিই আটলান্টিকের তলদেশে নিমজ্জ্বিত টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ম্যাপিং এর কাজ করেছে।

তবে আরওভিরও রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। যুক্তরাজ্যের জাতীয় মেরু গবেষণা ইনস্টিটিউট এর নাম হল ‘ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভে’। এই ইনস্টিটিউট এর সাথে যুক্ত গবেষক ডক্টর রব লার্টার জানান, টাইটানিক যেখানে রয়েছে, সেই সমুদ্রের তলদেশে, পানির এতটা গভীরে, আলো পৌঁছায় না। ফলে প্রতিটা আরওভি প্রতিমুহূর্তে ৫ বা ১০ মিটার পর্যন্ত দূরত্বের জিনিস দেখতে পারে। এছাড়াও তুলনামূলক ধীর গতিতে চলে এসব আরওভি। এবং ঘণ্টায় মাত্র কয়েক মাইলের বেশি আগাতে পারে না।

 

বিমান এবং উদ্ধারকারী জাহাজ

রাডার এবং অন্যান্য সেন্সর দিয়ে সজ্জিত বিমান কাজে লাগানো হয়েছে টাইটান ডুবোযান অনুসন্ধানে। এর মাধ্যমে মূলত পানির পৃষ্ঠে ভেসে থাকা বস্তুর মধ্যে কোনোটা টাইটান ডুবোযান কিনা, সেটাই শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

পানির পৃষ্ঠের মানচিত্র তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়েছে রাডার। পরবর্তী সময়ে মানচিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে তাতে কোনো ডুবোযান ভেসে রয়েছে কিনা। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডার’।

কানাডার ‘পি-৮ পোসাইডন’ নামের একটা বিমান কাজে লাগানো হয়েছিল অনুসন্ধানে। বোয়িং এর তৈরি এই বিমানটি এর গতির জন্য বিখ্যাত। সমুদ্রে টহল দেয়ার কাজে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত বিমান হিসেবেও পরিচিত পি-৮ পোসাইডন। মূলত বিমান দিয়ে নজরদারি করে অনুসন্ধানের স্থান ছোট করে আনাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

ক্যাপশন: জার্মানির একটি ‘পি-৮ পোসাইডন’ বিমান

জার্মানির একটি ‘পি-৮ পোসাইডন’ বিমান

অনুসন্ধানে যোগ দিয়েছিল ‘গ্লেস বে’ নামের কানাডার নৌবাহিনীর এক জাহাজ। ১৮১ ফুট দীর্ঘ এই জাহাজে চিকিৎসক এবং বিশেষ ‘ডিকম্প্রেশন চেম্বার’ রয়েছে। সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে আসা জীবিত কোনো মানুষকে পাওয়া গেলে বায়ুমণ্ডলের চাপের সঙ্গে তার দেহ খাপ খাওয়াতে কাজে লাগে এই ‘ডিকম্প্রেশন চেম্বার’।

এছাড়াও অনুসন্ধানের কাজ করেছে চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট কানাডার বিমান ‘পি-৩ ওরিয়ন’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ডের বিমান ‘এইচসি-১৩০ হারকিউলিস’। যুক্তরাজ্যের বিমানবাহিনী দুটি বিমান পাঠিয়েছিল, যার মধ্যে একটি ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার’ এবং আরেকটি ‘এ ৪০০ এম অ্যাটলাস’।

 

অন্যান্য প্রযুক্তি

স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা চিত্র কাজে লাগিয়েও খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে টাইটানকে।

২০ জুন, মঙ্গলবারে আমেরিকা থেকে কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডে অবস্থিত সেন্ট জনস বিমানবন্দরে ‘ফ্যাডোস’ পৌঁছানোর সময়কার দৃশ্য।

এছাড়াও উদ্ধার কাজে সাহায্য করার সম্ভাবনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর যন্ত্র ‘ফ্যাডোস’ (FADOSS) এর। ‘ফ্যাডোস’ এর পূর্ণরূপ হল ‘ফ্লাইওয়ে ডিপ ওশান স্যালভেজ সিস্টেম’। একে এক ধরনের ক্রেন বা কপিকল বলা যায়। সমুদ্রের নিচে ২০,০০০ ফুট গভীর থেকেও বস্তু বা জাহাজ টেনে তুলতে পারে এই যন্ত্র।

তবে ‘ফ্যাডোস’ কাজে লাগানোর জন্য একে আগে কোনো জাহাজের সাথে সংযুক্ত করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ। তবে গত বুধবারে যুক্তরাজ্যের নৌবাহিনী থেকে জানানো হয়েছিল কোনো জাহাজের সঙ্গে ‘ফ্যাডোস’ সিস্টেম সংযুক্ত করার চেষ্টা করছে তারা।

 

টাইটান সম্ভাব্য যেসব দুর্ঘটনায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল

নিখোঁজ টাইটান ডুবোযান ঠিক কী ধরনের সমস্যায় পড়েছে, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু বিষয় খতিয়ে দেখেছেন। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ৫টি সম্ভাব্য দুর্ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। সেগুলি হল:

১. আটকে যেতে পারে টাইটানিক এর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে

টাইটানিক সমুদ্রের তলদেশের যেখানে আছে, মানুষের পক্ষে যাওয়ার জন্য সেই জায়গাটা বেশ বিপজ্জনক। এখনো পর্যন্ত যারা ডুবোযানে চড়ে সেখানে গিয়েছেন, তাদের মতে সেখানে আটকে যাওয়া অসম্ভব কিছু না।

একজন গবেষক তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, একটি ডুবোযানে চড়ে তিনজনের একটি দল টাইটানিক এর ধ্বংসাবশেষ এর স্থানে গিয়েছিলেন। সেখানেই স্রোতের তোড়ে ভেসে গিয়ে তারা টাইটানিক এর প্রপেলার এর সঙ্গে আটকে যান। প্রায় এক ঘণ্টার মত তারা আটকে ছিলেন এবং শেষে স্রোতের গতি পাল্টালে তাদের ডুবোযান সেখান থেকে বের হয়ে আসে।

২. ডুবোযানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটতে পারে বা যন্ত্রপাতিতে দেখা দিতে পারে সমস্যা

ডুবোযানটি যোগাযোগ, নিয়ন্ত্রণ এবং চালানো হয় ব্যাটারি দিয়ে। ফলে বিদ্যুৎ সংযোগে সমস্যা দেখা দেয়াটা সমুদ্র পৃষ্ঠে থাকা ‘পোলার প্রিন্স’ জাহাজের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ হিসেবে ধারণা করেছেন অনেকে।

আরো পড়ুন: তিমির বিষ্ঠার আশ্চর্য ক্ষমতা

তবে বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটলে ডুবোযানের ভেতরকার সব কার্যক্রমই বন্ধ হয়ে যাবে। আর এমনটা হলে অক্সিজেন এর অভাবে নয়, বরং বরফ ঠাণ্ডা তাপমাত্রাতেই মৃত্যু হতে পারে যাত্রীদের।

এক্ষেত্রে টাইটান কীভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল, তা নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছেন। একজন যাত্রী দেখেছেন, ডুবোযানটি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণ ভিডিও গেম কন্ট্রোলার। এছাড়াও এই টাইটান নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ডেভিড লকরিজ নামের একজন কর্মকর্তাও পদত্যাগ করেছিলেন এই দাবি করে যে, ডুবোযানের যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে এখানে খুব বেশি ভাবা হয় নাই।

৩. মাছ ধরার জালের মত কোনো বর্জ্যের সঙ্গে জট পাকিয়ে যেতে পারে

মাছ ধরার হাজার হাজার জাল সমুদ্রের বিভিন্ন অংশে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাছ ধরার ট্রলার থেকে সমুদ্রে ফেলা এমন অনেক জাল রয়েছে গভীর সমুদ্রেও। নষ্ট বা হারিয়ে যাওয়া এসব জালের মত বর্জ্য থেকেও হতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

২০০৫ সালে ‘এএস-২৮’ নামক রাশিয়ার এক ডুবোযান এমন একটি জালেই আটকা পড়ে। সে সময় পূর্ব সাইবেরিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপের কাছে ছিল সেই ডুবোযান। জালে আটকে পড়ার ফলে সমুদ্রের তলদেশে ডুবে গিয়ে ভূমিতে আটকে গিয়েছিল সেটি।

পরে ব্রিটিশ একটা আন্ডারওয়াটার ড্রোন সেখানে গিয়ে জাল কেটে দিলে ডুবোযান আবার চলা শুরু করে এবং ২ দিন আটকে থাকার পরে সমুদ্রে ভেসে ওঠে। তবে তারা সমুদ্রের মাত্র কয়েকশো ফুট নিচে আটকে ছিল।

৪. ঘটতে পারে ভয়ানক বিস্ফোরণ

মাইকেল হ্যারিস নামের একজন অভিজ্ঞ এক্সপ্লোরার বেশ কয়েকবার টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ এর কাছে গিয়েছেন। তার মতে বিস্ফোরণই হতে পারে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা এবং সম্ভবত তাই ঘটেছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় পানির হাজার হাজার ফুট নিচের সেই জায়গায় চাপের পরিমাণ ৩৫০ গুণ বেশি। বিপুল পরিমাণ এই চাপ সহ্য করতে না পারলে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়তে পারে ডুবোযান। যদিও কার্বন ফাইবার এবং টাইটেনিয়াম দিয়ে তৈরি হয়েছে ডুবোযানটি, তবে গঠনের মধ্যে সামান্য ত্রুটি থাকলেই চাপ সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার কথা এই কাঠামোর।

আর্জেন্টিনার নৌবাহিনীর সাবমেরিন ‘এআরএ স্যান হুয়ান’

কাঠামোতে সমস্যা দেখা দেয়ার কারণে এর আগেও ৩ বার অভিযান বাতিল করেছে টাইটান।

২০১৭ সালে স্যান জর্জ উপসাগরের কাছে নিখোঁজ হয় ‘এআরএ স্যান হুয়ান’ নামের আর্জেন্টিনার নৌবাহিনীর এক ডুবোযান। এক বছর পরে সমুদ্রের তলদেশে ডুবোযানটির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়।

ঠিক কীভাবে এই পরিণতি হয়েছিল ডুবোযানটির, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে সমুদ্রের এতটাই গভীরে তলিয়ে গিয়েছিল জাহাজটি, যাতে আর পানির চাপ সহ্য করতে পারেনি। এতে বিস্ফোরণ হয় এবং মৃত্যু হয় সেখানে থাকা ৪৪ যাত্রীর।

৫. আগুন

বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকেও আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে ডুবোযানে। ২০১৯ সালে ‘লুশারিক’ নামের রাশিয়ার এক ডুবোযানে এমনটাই ঘটেছিল। সেখানকার ব্যাটারি কম্পার্টমেন্ট এর ভেতর ছড়িয়ে পড়ে আগুন, যখন পানির প্রায় এক হাজার ফুট নিচে ছিল সেটি।

সেই দুর্ঘটনায় রাশিয়ার নৌবাহিনীর সাবমেরিন চালনায় দক্ষ ১৪ জন নাবিক মারা যায়।

টাইটান-এ খুব ছোট আকারে আগুন ধরলেও সেটা যন্ত্রপাতি নষ্ট করে ফেলতে পারে। এছাড়াও নিঃশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কমিয়ে ফেলতে পারে সেই আগুন।

 

টাইটান ধ্বংস হওয়ার পেছনে কে দায়ী?

বহু বছর ধরেই গভীর সমুদ্রে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে টাইটান এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘ওশানগেট’কে অনেকেই দুষছেন যথেষ্ট সতর্ক না থাকার জন্যে। বিশেষত, সমুদ্রের গভীরে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান পরিচালনার জন্যে টাইটান এর কোনো অনুমোদন বা সার্টিফিকেশন ছিল না।

২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান লেখক এবং টিভি উপস্থাপক ডেভিড পোগ টাইটান-এ চড়ে অভিযানে গিয়েছিলেন। এবং ফিরে আসার পরে তিনি জানান, টাইটান-এ যেসব যাত্রী চড়বে, তাদের সবাইকে একটা কাগজে স্বাক্ষর করতে হয়। সেই কাগজে লেখা থাকে, এটি একটি পরীক্ষামূলক ডুবোযান এবং এর কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নেই। ফলে এতে চড়লে শারীরিক আঘাত, অক্ষমতা, মানসিক আঘাত বা মৃত্যু হতে পারে।

আরো পড়ুন: গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে ফসলে প্রোটিন কমছে—১৫ কোটি মানুষের অকালমৃত্যুর আশঙ্কা

বিখ্যাত সিনেমা টাইটানিক এর পরিচালক ডেভিড ক্যামেরন এ ব্যাপারে জানান, টাইটান এর অনুমোদনের জন্যে তারা আবেদন করেনি এ কারণেই যে, তারা জানত এ পরীক্ষায় তারা পাশ করবে না। তিনি টাইটানিক এবং টাইটান এর দুটি দুর্ঘটনার পেছনে একই কারণ রয়েছে বলে দাবি করেন। কারণটা হল, দুটি ক্ষেত্রেই আগাম সতর্কতাকে পাত্তা দেয়া হয়নি।

২০১৮ সালে ‘মেরিন টেকনোলজি সোসাইটি’ নামের একটি সংস্থা সতর্ক করে দেয় যে, ওশানগেট বর্তমানে যেই পরীক্ষামূলক অভিযান চালাচ্ছে, তাতে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া ডেভিড লকরিজ নামের একজন কর্মকর্তাও নিরাপত্তা বিষয়ে সতর্ক করে পদত্যাগ করেছিলেন।

মানচিত্রে টাইটানিক এর ডুবে যাওয়ার স্থান।

‘ওশানগেট’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুইজন, যার মধ্যে সিইও স্টকটন রাশ এই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা গুইলেরমো সোহনলাইন জানান, তিনি এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবে এই সহ-প্রতিষ্ঠাতা জানান, ১৪ বছর ধরে ডুবোযানটি নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। নিরাপত্তা অবহেলা সংক্রান্ত যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেসব অভিযোগও উড়িয়ে দেন তিনি।

 

সমুদ্রের গভীরতম স্থান থেকে মানুষ উদ্ধারের রেকর্ড

টাইটান বিধ্বস্ত হওয়ার এই ঘটনা দুঃখজনক। তবে ইতিহাসে গভীর সমুদ্রের মত প্রতিকূল অনেক স্থান থেকে মানুষ উদ্ধারের ঘটনা রয়েছে।

৫০ বছর আগে কানাডার এক ডুবোযান তলিয়ে যায় ১৬০০ ফুট নিচে। ‘পাইসিস থ্রি’ (Pisces III) নামের ডুবোযানটিতে ছিলেন দুজন মানুষ: রজার চ্যাপম্যান এবং রজার ম্যালিনসন। ‘পাইসিস থ্রি’ মূলত সমুদ্রের তলদেশে ক্যাবল বা তার বিছানোর কাজ করত। এবং ডুবোযানের যাত্রী দুজনও পেশাগত কাজই করছিলেন।

আরো পড়ুন: ২০১৩ সালের ঘটনা, পানির নিচে ৩ দিন বেঁচে ছিলেন হ্যারিসন ওকেন

তবে তাদের অভিজ্ঞতা ছিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে কাজ করার। ডুবে যাওয়ার পরও উদ্ধারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল তাদের। দুজনের ব্যবহারের জন্যে ৭২ ঘণ্টার মত অক্সিজেন ছিল ‘পাইসিস থ্রি’ ডুবোযানে।

তারা শান্ত ছিলেন এবং নড়াচড়াও করেছিলেন কম। ফলে ৭২ ঘণ্টার অক্সিজেন দিয়ে তারা ৮৪ ঘণ্টা শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়েছিলেন। অবশেষে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে ৩ দিন পরে তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ১৯৭৩ সালে ঘটা এই ঘটনায় কেউ মারা যায়নি।

ইতিহাসে এটাই ছিল সমুদ্রের গভীরতম স্থান থেকে মানুষ উদ্ধারের ঘটনা।