ধূমকেতু বেনু থেকে সংগৃহীত শিলা ও মাটি বিজ্ঞানীদের সৌরজগত এবং পৃথিবীতে কীভাবে জীবনের উদ্ভব ঘটেছিল তা বুঝতে সাহায্য করবে

যুক্তরাষ্ট্রের ইউটা অঙ্গরাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ‘গ্রেট সল্ট লেক ডেজার্ট’ নামের মরুভূমির একাংশে অবস্থিত ‘ইউটা টেস্ট অ্যান্ট ট্রেনিং রেঞ্জ’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর বিশাল সংরক্ষিত অঞ্চল। এখানেই গত ২৪ সেপ্টেম্বর, রবিবার (২০২৩) অবতরণ করে একটি স্পেস ক্যাপসুল। ক্যাপসুলটির আকার ছিল মোটামুটি একটা ট্রাকের টায়ারের সমান আর ওজন ছিল প্রায় ১০০ পাউন্ড বা ৪৫ কেজি।

OSIRIS-REx গ্রহাণু বেনুর পৃষ্ঠ স্পর্শ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। ক্রেডিট: NASA/Goddard/University of Arizona

এ পর্যন্ত কোনো গ্রহাণু বা ধূমকেতু পৃষ্ঠ থেকে সংগ্রহ করা সবচেয়ে বড় নমুনা ছিল এই ক্যাপসুলে। ‘বেনু’ (Bennu) নামের যে গ্রহাণু থেকে এই নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, সেটির আগামী দেড়শ থেকে আড়াইশ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার ক্ষীণ আশঙ্কা আছে।

২১৭৮ সাল এবং ২২৯০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সাথে বেনু’র সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা ১৭৫০ ভাগের ১ ভাগ। বেনু’র কক্ষপথ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, আগামী ২১৮২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এই সংঘর্ষের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।


ফারহান মাসউদ


বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, বেনু’র পৃষ্ঠ থেকে সংগ্রহ করা নমুনা বিশ্লেষণ করে এই ধূমকেতুর গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। ভবিষ্যতে বেনু’র সঙ্গে আমাদের গ্রহের সংঘর্ষের মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হলে সেটা ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে এসব তথ্য।

ধূমকেতু থেকে সবচেয়ে বড় নমুনা সংগ্রহে সফলতা
ধুমকেতু বেনু

উল্লেখ্য, ধূমকেতু বা গ্রহাণুকে নিজ কক্ষপথ থেকে সরাতে ২০২১-২০২২ সালে ‘ডার্ট’ (ডাবল অ্যাস্টেরয়েড রিডাইরেকশন টেস্ট) নামের একটি মিশন সফলভাবে সম্পন্ন করে নাসা।

এ সম্পর্কিত আর্টিকেল: মহাকাশযানের ধাক্কায় গ্রহাণুর কক্ষপথ বদল—নতুন পরীক্ষায় নাসা

তবে পৃথিবীর চারপাশে অনেক গ্রহাণু ও ধূমকেতুই রয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে যেগুলির আমাদের গ্রহে আছড়ে পড়ার আশঙ্কা ক্ষীণ। বিজ্ঞানীরা এসব ধূমকেতু চিহ্নিত করেছেন ও পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। তবে এর মধ্যে কোনো ধূমকেতুকেই এখনও নিশ্চিতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়নি।

তাহলে বেনু থেকে নমুনা সংগ্রহের মূল উদ্দেশ্যটা কী?

ঠিক কীভাবে ও কোন পদ্ধতিতে এই নমুনা সংগ্রহ করা হল? মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এই সাফল্য থেকেই কি জানা যাবে পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার কীভাবে হয়েছিল?

ধূমকেতু ‘বেনু’ আবিষ্কার, নামকরণ ও সেখানে অভিযানের সিদ্ধান্ত

যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী, নাসা এবং ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’র যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয় ‘লিনিয়ার’ (LINEAR) নামে একটি প্রকল্প। লিনিয়ার (LINEAR) প্রকল্পের পূর্ণরূপ হল ‘লিংকন নিয়ার আর্থ অ্যাস্টেরয়েড রিসার্চ’।

অর্থাৎ, অ্যাস্টেরয়েড বা ধূমকেতু ও গ্রহাণু পর্যবেক্ষণ করাই এই প্রকল্পের মূল কাজ। প্রকল্পটির মাধ্যমে এ পর্যন্ত আমাদের সৌরজগতে অবস্থিত ধূমকেতু ও গ্রহাণুসহ কয়েক লক্ষ ছোট-বড় বস্তু আবিষ্কার করা হয়েছে।

১৯৯৬ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।

১৯৯৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই প্রকল্পের অধীনে পৃথিবীর নিকটে অবস্থান করা একটি গ্রহাণু শনাক্ত করা হয়, প্রাথমিকভাবে যার নাম দেয়া হয় ‘১৯৯৯ আরকিউ ৩৬’। এর পরের কয়েকদিন ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত আমেরিকার মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র এবং টেলিস্কোপের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণে রাখা হয় গ্রহাণুটি।

এর দুই বছর পর আমাদের সৌরজগত সম্পর্কে জানাশোনা বাড়াতে ‘নিউ ফ্রন্টিয়ার্স প্রোগ্রাম’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয় নাসা। ২০০২ ও ২০০৩ সালে এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয় আমেরিকার সংসদ।

আরো পড়ুন: মহাবিশ্বে এত সোনা এলো কোথা থেকে?

‘নিউ ফ্রন্টিয়ার্স প্রোগ্রাম’ এর অধীনে এ পর্যন্ত প্লুটো ও বৃহস্পতি গ্রহে মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। চলমান মিশনের অধীনে প্লুটো ও বৃহস্পতি বা তার আশেপাশে এখনও দুটি মহাকাশযান তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে।

নিউ ফ্রন্টিয়ার্স প্রোগ্রামের তৃতীয় মিশন বা অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল কোনো ধূমকেতু বা গ্রহাণু পর্যবেক্ষণ করা। এজন্য আমাদের সৌরজগতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৫ লক্ষাধিক ধূমকেতু ও গ্রহাণুর মধ্য থেকে ১৯৯৯ সালে আবিষ্কৃত ‘১৯৯৯ আরকিউ ৩৬’-কেই নির্বাচিত করা হয়।

ধূমকেতু থেকে সবচেয়ে বড় নমুনা সংগ্রহে সফলতা
৯ বছর বয়সী মাইকেল পুজিও, ছবি. ২০১৩

তবে অভিযানের সুবিধার্থে এই গ্রহাণুর সহজ কোনো নাম রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই ২০১৩ সালে আয়োজন করা হয় ‘নেইম দ্যাট অ্যাস্টেরয়েড’ প্রতিযোগিতা। যাতে আমেরিকা ছাড়াও পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ থেকে প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়।

শিক্ষার্থীদের প্রস্তাব করা হাজার হাজার সম্ভাব্য নাম থেকে অবশেষে ‘বেনু’ নামটিকে নির্বাচিত করা হয়। নামটি প্রস্তাব করেছিল নর্থ ক্যারোলাইনা রাজ্যের মাইকেল পুজিও নামের তৃতীয় শ্রেণীর এক ছাত্র।

কিছুটা বকপাখির মত দেখতে প্রাচীন মিশরীয় এক দেবতার নাম থেকে এই নামকরণ। ‘বেনু’ ছিল প্রাচীন মিশরের সূর্য, সৃষ্টি এবং পুনর্জন্মের দেবতা। ধারণা করা হয় এই দেবতার প্রতিকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই পরবর্তীতে ফিনিক্স পাখিকে নিয়ে বিভিন্ন লোককথা রচিত হয়।

‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন’ নামের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা পরবর্তীতে ‘বেনু’ গ্রহাণুর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের নামকরণ করে বিভিন্ন সভ্যতার রূপকথার চরিত্র ও দেবতাদের নাম অনুসারে।

গ্রীক, মিশরীয়, নর্স, আফ্রিকান ও মায়া সভ্যতা থেকে শুরু করে ফিলিপাইন, স্কটল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, পারস্য, আরব ও উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের রূপকথার বিভিন্ন চরিত্রের নামে বেনু গ্রহাণুর বিভিন্ন অংশের নাম দেয়া হয়েছে।

এছাড়াও ইংরেজ লেখক জে. আর. আর. টলকিন এর বিখ্যাত এপিক উপন্যাসের চরিত্র, বিখ্যাত রাশিয়ান সুরকার চাইকভস্কি রচিত এক সঙ্গীতের চরিত্র এবং ইংরেজ লেখক লুইস ক্যারল এর শিশুতোষ উপন্যাস ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ এর চরিত্র থেকেও বেনুর বিভিন্ন অংশের নাম দেয়া হয়েছে।

 

এত এত ধূমকেতুর মধ্যে বেনু’ই কেন?

আমাদের সৌরজগতে থাকা লক্ষ লক্ষ গ্রহাণুর মধ্যে অভিযানের জন্য বেনুকে নির্ধারণ করার বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব কম। মানে, বেনু থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে সেটা সহজেই নিয়ে আসা যাবে।

দ্বিতীয়ত, ছুটতে থাকা ধূমকেতু থেকে নমুনা সংগ্রহের জন্য সেটার আকারও বেশ বড় হতে হয়। এবং বেনু’র ব্যাস প্রায় ৪৯০ মিটার এবং আকার আমেরিকার ১০২ তলা বিশিষ্ট এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের সমান।

আরো পড়ুন: মাইক্রোগ্র্যাভিটি কাজে লাগিয়ে মহাশূন্যে তৈরি করা হবে নতুন ধরনের ওষুধ

তৃতীয়ত, বেনু হল ২০০টি ধূমকেতুর মধ্যে একটি, যার কক্ষপথ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে। বেনু ধূমকেতুটি প্রতি ৪৩৬ দিনে একবার সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে।

চতুর্থত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণে অভিযান পরিচালনার জন্য বেনুকে নির্ধারণ করা হয়েছে তা হল, এই ধূমকেতুর সম্ভাব্য উপাদান। টেলিস্কোপের মাধ্যমে সংগ্রহ করা ছবি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন এই ধূমকেতুতে কার্বন-ভিত্তিক উপাদান আছে। এবং এসব উপাদান গঠিত হয়েছে আমাদের সৌরজগৎ যখন আকৃতি পাওয়া শুরু করেছে, সে সময়।

অর্থাৎ, বেনুকে এক ধরনের ‘টাইম ক্যাপসুল’ হিসেবে বিবেচনা করছেন বিজ্ঞানীরা। কেননা কয়েক বিলিয়ন বছর আগে গঠনের পর থেকে ধূমকেতু বেনুতে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি।

নাসার ধারণা, বেনুর আকার একটা সময় আরো বড় ছিল। তবে প্রায় ২ বিলিয়ন বছর আগে এই গ্রহাণু ভেঙে আকারে ছোট হয়ে আসে।

 

মিশন ‘ওসাইরিস-রেক্স’ (OSIRIS-REx) এর উদ্দেশ্য এবং শুরু থেকে বর্তমান

ধূমকেতু বেনু থেকে নমুনা সংগ্রহের জন্য নাসা যে মিশন হাতে নিয়েছে, তার নাম ‘ওসাইরিস-রেক্স’। এই অভিযানের একাধিক উদ্দেশ্য থাকলেও মূল উদ্দেশ্য আমাদের সৌরজগতের গঠন ও ইতিহাস সম্পর্কে জানাশোনা বাড়ানো।

গবেষকদের ধারণা, এই মিশনের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার কীভাবে ঘটল, সে সম্পর্কে আরো ভাল ধারণা পাওয়া যাবে।

ওসাইরিস-রেক্স মিশনের বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০০ মিলিয়ন ডলার। এছাড়াও খরচের তালিকায় রয়েছে যে রকেটে করে মহাকাশযান পাঠানো হবে তার মূল্য। আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ‘লকহিড মার্টিন’ এর তৈরি ‘অ্যাটলাস ফাইভ’ নামের রকেটের দাম ছিল ১৮৩.৫ মিলিয়ন ডলার।

এই মিশন পরিচালনার কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং ইতালির বিজ্ঞানীরা রয়েছেন। মিশনের নেতৃত্বে আছেন অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।

২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরু করে অ্যাটলাস ফাইভ রকেট। আর এই রকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিল ‘ওসাইরিস-রেক্স’ নামের মহাকাশযানটি।

ধূমকেতু থেকে সবচেয়ে বড় নমুনা সংগ্রহে সফলতা
উড্ডয়নের আগে মহাকাশযান ‘ওসাইরিস-রেক্স’

মহাকাশে যাওয়ার ২ বছরের মাথায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মত বেনুকে প্রদক্ষিণ করে মহাকাশযান ওসাইরিস-রেক্স। সেই সময় এই ধূমকেতুর ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহ করা সেসব তথ্য থেকেই নির্ধারণ করা হয় ধূমকেতুটির ঠিক কোন স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হবে।

নমুনা সংগ্রহের জন্যেও অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ‘ট্যাগসাম’ নামের সেই সিস্টেম অনুসারে ধূমকেতুর নির্দিষ্ট স্থানে বিশুদ্ধ নাইট্রোজেন গ্যাসের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কেননা, নাইট্রোজেন গ্যাস সাধারণত অন্য কোনো পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়া করে না।

যাহোক, ২০১৮ সালে বেনুকে প্রথম পর্যবেক্ষণ করার পর ২০২০ সালের অক্টোবরের ২১ তারিখে ‘ট্যাগসাম’ পদ্ধতিতে বেনু থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনা সংগ্রহের সম্পূর্ণ কাজটা করতে মাত্র ৬ সেকেন্ড লেগেছিল।

ধূমকেতু থেকে সবচেয়ে বড় নমুনা সংগ্রহে সফলতা
স্যাম্পল নিয়ে ইউটার গ্রেট সল্ট লেক ডেজার্টে গত ২৪ সেপ্টেম্বর, রবিবার (২০২৩)অবতরণ করে ৪৫ কেজির স্পেস ক্যাপসুলটি

বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য ছিল কমপক্ষে ২ আউন্স বা ৬০ গ্রাম নমুনা সংগ্রহ করা। তবে মহাকাশযানটি সবশেষে প্রায় ২৫০ গ্রাম নমুনা সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়।

এই নমুনাই স্পেস ক্যাপসুল-এ করে পৃথিবীতে ফেরত আনা হয় গত রবিবার (২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার সময় শব্দের গতির চেয়ে ৩৬ গুণ গতি অর্জন করে ক্যাপসুলটি। তবে অবশেষে ক্যাপসুলের সাথে যুক্ত থাকা প্যারাশুটের মাধ্যমে গতি কমিয়ে নিরাপদে ইউটা’র মরুভূমিতে অবতরণ করে।

বেনু থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতে ওসাইরিস-রেক্স মহাকাশযানটি এ পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে ৩.৮৬ বিলিয়ন মাইল। যাত্রাপথে পৃথিবী থেকে ৩ মিলিয়ন মাইল বা ৫ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্বে পৃথিবী ও চাঁদের বেশ কিছু দুর্দান্ত ছবি তুলেছে।

ধূমকেতু থেকে সবচেয়ে বড় নমুনা সংগ্রহে সফলতা
৬৯ হাজার মাইল দূর থেকে পৃথিবী। ছবিটিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে নর্থ পোল বা উত্তর মেরু ওপরের দিকে থাকে
ধূমকেতু থেকে সবচেয়ে বড় নমুনা সংগ্রহে সফলতা
ওসাইরিস-রেক্স নভোযানের ন্যাভক্যাম ১ দিয়ে চাঁদ ও পৃথিবীর এই ছবিটি তোলা হয় ২০১৭ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর; ২৪৯ হাজার মাইল বা ৪০১, ২০০ কিলোমিটার দূরত্বে চাঁদ ও পৃথিবী

তবে ওসাইরিস-রেক্স এর কাজ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। মহাকাশযানটি ‘অ্যাপোফিস’ (Apophis) নামের আরো একটি ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করবে ২০২৯ সালে।  সে বছর ধূমকেতুটি পৃথিবীর ১৯ হাজার মাইল বা ৩১ হাজার কিলোমিটার নিকট দিয়ে যাবে। অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট এর চেয়ে বেশি দূরে অবস্থিত।

এদিকে স্পেস ক্যাপসুল-এ ধূমকেতু বেনু’র নমুনা পৃথিবীতে আসার পর সেটা হেলিকপ্টারে করে গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্যাপসুল থেকে নমুনাটি বের করার সময়ও তাতে নাইট্রোজেন গ্যাস ছাড়া হয়, যাতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কোনো পদার্থের সাথে বিক্রিয়া না করে।

বেনু’র নমুনার ক্ষুদ্র একটি অংশ এরপর বিশ্বের অন্তত ৩৮টি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদেরকে পাঠানো হবে।

আর বেনু’র অবশিষ্ট নমুনা সংরক্ষণ করা হবে নাসার ‘জনসন স্পেস সেন্টার’-এ। এখানেই সংরক্ষিত আছে অ্যাপোলো মিশনের মাধ্যমে উদ্ধার করা চাঁদের নমুনা।

 

পূর্বে ধূমকেতুর নমুনা সংগ্রহে জাপানের মহাকাশ সংস্থার সফলতা

মিশন ‘ওসাইরিস-রেক্স’ এর আগেই জাপানের মহাকাশ সংস্থা জাক্সা (JAXA) ইতিহাসে প্রথমবারের মত সফলভাবে ধূমকেতু থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। ‘হায়াবুসা’ এবং ‘হায়াবুসা টু’ নামে জাক্সা’র দুটি মিশনের মাধ্যমে যথাক্রমে ‘ইতোকাওয়া’ ও ‘রিয়ুগু’ নামের দুটি ধূমকেতু থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

তবে দুটি মিশনের মাধ্যমে খুব বেশি পরিমাণ নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। ‘হায়াবুসা’ মিশনের মাধ্যমে সামান্য কিছু ধূলিকণা এবং ‘হায়াবুসা টু’ মিশনের মাধ্যমে ৫.৪ গ্রাম নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল।

ধূমকেতু থেকে সবচেয়ে বড় নমুনা সংগ্রহে সফলতা
‘হায়াবুসা ২’ এর সংগ্রহ করা স্যাম্পল

তবে জাক্সা’র এ দুটি মিশন থেকে ওসাইরিস-রেক্স বেশ উপকৃত হয়েছে। এ দুটি মিশনের সঙ্গে যুক্ত জাপানের মহাকাশ বিজ্ঞানীরাও ওসাইরিস-রেক্স মিশনের পরিকল্পনায় অবদান রেখেছেন।

নাসার ওসাইরিস-রেক্স মিশনের সফটওয়্যার কিংবা ডেটা থেকে শুরু করে নমুনা গবেষণার কৌশল পর্যন্ত অনেক কিছু নির্ধারণ করা হয়েছে জাক্সা’র কার্যক্রমের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে।

 

ধূমকেতুর নমুনা থেকে যা কিছু জানার চেষ্টা করবেন বিজ্ঞানীরা

আমাদের সৌরজগতে বিদ্যমান ধূমকেতুর বেশিরভাগই গঠিত হয়েছিল যখন সৌরজগত নিজেই গঠনের শুরুর দিকে আছে। প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে গঠিত এসব গ্রহাণু বা ধূমকেতু সৌরজগতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ফলে গঠনের সময় থেকেই অনেক ধূমকেতুতে থাকা জৈব পদার্থের অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। তুলনায় পৃথিবী ভৌগলিকভাবে বেশ সক্রিয় একটা গ্রহ। এই গ্রহে বিভিন্ন বস্তু, পদার্থ ও গ্যাস একে অপরের সঙ্গে প্রতিনিয়তই বিক্রিয়া ঘটিয়ে চলছে।

ধূমকেতু থেকে সবচেয়ে বড় নমুনা সংগ্রহে সফলতা
বেনু’র নমুনা সহ স্পেস ক্যাপসুল পৃথিবীতে আসার পর প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ ও উদ্ধারের কাজে নিয়োজিত দুজন গবেষক

অথচ গঠনের সময় পৃথিবী ছিল অত্যন্ত গরম লাভার একটি পিণ্ড। সে সময় থেকে কীভাবে পৃথিবীতে প্রাণ সঞ্চারের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস ও জৈব পদার্থ এলো, তা নিয়ে একাধিক তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। এমন একটি তত্ত্বই হল ধূমকেতুর প্রভাব সংক্রান্ত।

এই তত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীর তাপমাত্রা যখন কমে আসছিল, একের পর এক উল্কা বা ধূমকেতু আছড়ে পড়তে থাকে এই গ্রহে। সেসব ধূমকেতুর সঙ্গে যুক্ত পদার্থই পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বেনু’র নমুনা সংগ্রহের আগেই টেলিস্কোপের ছবি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এতে এক সময় পানির অস্তিত্ব ছিল। এছাড়াও বেনু’তে কার্বন-ভিত্তিক জৈব পদার্থের উপস্থিতির ব্যাপারেও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত।

এখন ধূমকেতুর সাহায্যেই পৃথিবী বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল কিনা, সেটা পরীক্ষা করে দেখবেন গবেষকরা। বেনু’র নমুনা নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করবেন, পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে ধূমকেতুর ভূমিকা থাকলেও সেই ভূমিকা কীভাবে পালন করেছিল মহাকাশে ঘুরতে থাকা প্রাণহীন এসব শিলাখণ্ড।