১৫-মিনিট শহর (15-minute city) হচ্ছে এমন একটি শহরের মডেল যে শহরের প্রতিটি এলাকার বাসিন্দারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সব কিছু হাঁটার দূরত্ব অথবা সাইকেলে যাওয়া যায় এমন দূরত্বের মধ্যে পেয়ে যাবে।
এই শহর ব্যবস্থায় প্রতিটি এলাকা হয়ে উঠবে জীবন্ত, মানুষবান্ধব এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।
শহরগুলি এখানে উন্নত গণযোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সাইকেলের উপযোগী অবকাঠামোর মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকবে। যা ব্যবহার করে বাসিন্দারা প্রয়োজনে লম্বা দূরত্বের পথ পাড়ি দিতে পারবে। এই মডেলে শহুরে জীবন ও এর সেবাসমূহ বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে শহরের মধ্যে থাকা প্রতিটি এলাকায় নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করা হবে।
গত শতাব্দীতে নগর পরিকল্পনায় আবাসিক এলাকাগুলি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, খুচরা দোকান, শিল্প ও বিনোদন কেন্দ্র থেকে আলাদা করে রাখা হত। ১৫-মিনিট শহর এর মডেল, সেই ধারণার একেবারেই বিপরীত।
অবশ্য ১৫-মিনিট শহর মডেলের বেশ কয়েকটি আইডিয়া ও মূলনীতি অনেক দিন ধরেই কাজে লাগানো হচ্ছে এবং অনেক শহরই এগুলি বাস্তবায়ন করতে সফল হয়েছে। এই শহরগুলির অভিজ্ঞতা থেকে বাকিদের অনেক কিছু শেখার আছে।
এই মডেলের সবচেয়ে বিশেষ এবং নতুন বিষয় হচ্ছে এখানে মানুষকে কেন্দ্র করে শহর উন্নয়নের সকল নীতি ও আইডিয়া গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে বিশ্বের অনেকগুলি শহর এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই আর্টিকেল থেকে আমরা জানতে পারব কেন আপনার শহরেরও উচিত তাদের অনুসরণ করা।
মানুষের মধ্যে সংযোগ তৈরির করে এমন ইতিবাচক রুপকল্প প্রদান করে ১৫-মিনিট শহর মডেল
দ্য ফিফটিন মিনিট সিটি (FMC অথবা 15mc) হচ্ছে নগর পরিকল্পনার এমন একটি ধারণা যেখানে প্রতিদিনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি যেমন কাজ, শপিং, পড়াশোনা, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন এসকল সেবা বাসিন্দারা শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে ১৫ মিনিট হাঁটার দূরত্বে অথবা সাইকেল চালানোর দূরত্বে পাবে।
এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মোটরগাড়ির প্রতি নির্ভরশীলতা কমানো, টেকসই ও স্বাস্থ্যকর জীবন ব্যবস্থা শুরু করা এবং শহরের বাসিন্দাদের জীবনমান বৃদ্ধি করা।
আরো পড়ুন: সার্ভাইভাল গার্ডেন কী? বাড়িতে কীভাবে একটা সার্ভাইভাল গার্ডেন গড়ে তুলবেন?
শহর কর্তৃপক্ষ তাদের শহরের সংস্কৃতি ও অবস্থা বিবেচনা করে এর বাসিন্দা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী এবং তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করে ১৫-মিনিট শহর মডেল বাস্তবায়ন করতে পারে। শহুরে জীবনে একসাথে থাকার যে ধারণা তার সাথে একাত্ম হয়ে শহরের জলবায়ু, সমতা, স্বাস্থ্য ও নগর উন্নয়নের যে উদ্দেশ্য সেগুলিকে সামনে রেখে মানুষের সম্পৃক্ততা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সাথে নিয়ে শহরের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারে।
শহরের অধিবাসীরা চায়, এমন কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিতে পারে ১৫-মিনিট শহর
করোনা মহামারীর আগেই বেশ কয়েকটি শহর এই মডেল বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। তবে মহামারীর পর এর প্রতি আগ্রহ বহুগুণে বেড়ে যায়। তখন মানুষ রাস্তাঘাটে আরো বেশি খোলামেলা বা উন্মুক্ত স্থান চাইতে শুরু করে, বাইসাইকেল লেনের চাহিদা বেড়ে যায়, সর্বোপরি মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের ইচ্ছা তৈরি হয়।
২০২০-এর শেষের দিকে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের একটি বৈশ্বিক জরিপ থেকে জানা যায়, আরো টেকসই এবং সমতাভিত্তিক বিশ্বের জন্য মানুষের মধ্যে একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। কেউই আর মহামারীর পূর্বের অবস্থায় ফেরত যেতে রাজি না।
১৫-মিনিট শহর থেকে আমরা কী পেতে পারি?
স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার: এই মডেলে আমরা শহরের বিভিন্ন স্থানের আরো উন্নত ব্যবহার দেখতে পাব। স্থানীয়দের জন্য নানা রকমের কাজের সুযোগ তৈরি হবে, শহরের বিল্ডিং এবং রাস্তার জায়গাগুলির আরো উৎপাদনশীল ব্যবহার দেখা যাবে।
আরো সমতাভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শহর এবং কমিউনিটির মধ্যে জোরালো বন্ধন: একটি সফল ১৫-মিনিট শহর মডেলের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে সমতা ও অন্তর্ভুক্তি। শহরের সবচেয়ে বঞ্চিত এলাকাকে প্রাধান্য দেয়া, শহরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারকারীদের জন্য রাস্তা ও যাতায়াত সুবিধা প্রদান করা এ সবই আছে এর মধ্যে। ১৫-মিনিট শহর এর মডেল স্থানীয় মানুষের সাথে আরো একাত্ম হয়ে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে, পাবলিক জায়গাগুলিতে মানুষ পরস্পরের সাথে মেলামেশার সুযোগ পায়, এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়। এছাড়া মানুষ তাদের প্রিয়জনের সান্নিধ্যে আরো বেশি সময় কাটাতে পারে ও নিজেদের পছন্দের কাজ করার জন্য সময় পায়।
আরো পড়ুন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত খাদ্যের এক তৃতীয়াংশ অপচয়—পরিবেশের ওপর এটি যেমন প্রভাব ফেলছে
উন্নত মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য: এই মডেলের কারণে পরিষ্কার বাতাস, স্বাস্থ্যকর খাবারের সহজ প্রাপ্তি, সবুজ এলাকা এবং একাকীত্ব দূর করার জন্য শক্তিশালী কমিউনিটির সবই পাওয়া যায়।
হাঁটা ও সাইকেল চালানো থেকেও বাসিন্দারা উপকৃত হয়। অধিক গাছপালা, সবুজ এলাকার কারণে শহুরে উত্তাপ কমে, বন্যার ঝুঁকি হ্রাস পায়, জীববৈচিত্র্যের উন্নতি ঘটে। এছাড়া অন্যান্য স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক দিক দিয়েও লাভবান হওয়া যায়।
যানবাহন থেকে কম দূষণ ও উন্নত বায়ু: ১৫ মিনিটের শহর মডেল অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত ভ্রমণ কমায়। ফলে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার কম হয়। একটি সবুজ ও স্বাস্থ্যকর যানবাহন ব্যবস্থা ও উন্নত বায়ু শহরের বাসিন্দারা উপভোগ করতে পারে।
বিশ্বজুড়ে এই মডেল বাস্তবায়ন
১৫-মিনিট শহর মডেল বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন সেক্টরের মানুষের মিলিত চেষ্টার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে আছে যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকল্পনা, নগর পরিকল্পনা, নীতি নির্ধারণ। আবার জনসাধারণের জন্য উন্নত ডিজাইনের স্থান, পথচারী বান্ধব সড়ক ইত্যাদি। জীবনযাত্রার এই পরিবর্তনে অনেক সময় রিমোট জব এর মতো বিষয়ও জড়িত থাকে, যেখানে প্রতিদিনের যাতায়াত কম করার প্রয়োজন হয় এবং তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এই আইডিয়াকে নাম দেয়া হয়েছে “স্থানীয় জীবন যাপনে ফিরে যাওয়া”।
বিশ্বজুড়ে ১৫-মিনিট শহর মডেলের শহরগুলির পরিকল্পনা ও কার্যক্রম সম্বন্ধে তাহলে জেনে নেয়া যাক:
• ইউরোপ
২০২০ সালে প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগো তার নির্বাচনী প্রচারণায় ১৫-মিনিট শহর এর ধারণার সাথে মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং কোভিড-১৯ মহামারীর সময় এর বাস্তবায়ন শুরু করেন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে স্কুলের খেলার মাঠগুলিকে স্কুলশেষে জনসাধারণের জন্য পার্ক হিসেবে খুলে দেয়া, বাস্তিল দুর্গ বা অন্যান্য পাবলিক স্পেসগুলি গাছপালা দিয়ে নতুন করে সাজিয়ে তোলা এবং বাইসাইকেল লেন চালু করার মত কাজের কথা বলা যায়।
স্কুলের খেলার মাঠগুলিকে স্কুলশেষে জনসাধারণের জন্য পার্ক হিসেবে খুলে দেয়া… অন্যান্য পাবলিক স্পেসগুলি গাছপালা দিয়ে নতুন করে সাজিয়ে তোলা এবং বাইসাইকেল লেন চালু করার মত কাজের কথা বলা যায়।
ইতালির সার্দিনিয়া দ্বীপে অবস্থিত কাগলিয়ারি শহর কর্তৃপক্ষ তাদের শহরকে নতুনভাবে গুছিয়ে তোলার জন্য এবং শহরের হাঁটার ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য একটি কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শহরটি একটি অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে পরিকল্পনা প্রণয়নে শহরের নাগরিকদের পরামর্শ গ্রহণ করে। তাদের এই পুরো পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল পাবলিক স্থান এবং পরিত্যক্ত বাড়িঘর যা এখন আর কাজে লাগে না, সেগুলিকে সাধারণ নগর পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া।
বার্সেলোনা তাদের সুপারব্লক সড়ক নেটওয়ার্ককে রূপান্তর করে ৪০০ বর্গমিটার ব্লকে নিয়ে এসেছে, যাতে মানুষ সহজে চলাফেরা করতে পারে। এছাড়া বিনোদন ও কমিউনিটি কর্মকাণ্ড ও পথচারী ও সাইকেল চালকদের সুবিধার্থে পাবলিক জায়গাটি ব্যবহার করা যায়।
• এশিয়া
সাংহাই তাদের ২০১৬ সালের মাস্টার প্ল্যানে ‘১৫-মিনিট কমিউনিটি লাইফ সার্কেল’ এর ধারণা নিয়ে আসে। এই পরিকল্পনায় শহরের অধিবাসীরা তাদের দৈনন্দিন সকল কাজ ১৫ মিনিট হাঁটার দূরত্বে সম্পন্ন করতে পারবে। সাংহাই ছাড়াও অন্যান্য শহর যেমন বাওডিং এবং গুয়াংজুতে কমিউনিটি লাইফ সার্কেল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
২০১৮ সালে নগরের আবাসিক এলাকা পরিকল্পনা ও নকশার জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড বা মান ঠিক করা হয়। এখানে চারটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছিল: পথচারীদের জন্য ১৫ মিনিটের আবাসিক এলাকা, ১০ মিনিটের আবাসিক এলাকা, ৫ মিনিটের আবাসিক এলাকা এবং একটি এলাকাভিত্তিক ব্লক।
চেংডু শহরের অপরিকল্পিত বৃদ্ধি থামানোর জন্য একটি ‘গ্রেট সিটি’ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, যেখানে শহরের সকল প্রান্তে এমন নাগরিক ব্যবস্থা রাখা হবে যাতে ১৫ মিনিটের দূরত্বে শহরবাসীরা তাদের সকল দরকারি সুযোগ সুবিধা পেতে পারে।
অন্যদিকে সিঙ্গাপুরের ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি একটি মাস্টার প্ল্যান করে যার উদ্দেশ্য ২০৪০ সালের মধ্যে ‘২০ মিনিটের শহর এবং ৪৫ মিনিটে মহানগর’ বাস্তবায়ন করা।
ইসরায়েলও তাদের নতুন আবাসিক প্রকল্পে ১৫-মিনিট শহর এর আইডিয়া গ্রহণ করেছে।
• উত্তর আমেরিকা
২০১২ সালে অরেগন এর পোর্টল্যান্ড শহর একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এলাকার পরিকল্পনা করে যার উদ্দেশ্য হচ্ছে তরুণদের সাহায্য করা, সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন ব্যবস্থা করা এবং সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত এই এলাকায় কমিউনিটি ভিত্তিক উন্নয়ন ও ব্যবসা পরিচালনা করা।
টেক্সাস এর হুইস্টন-এ ২০২০ সালে ওয়াকেবল প্লেসেস অর্থাৎ হাঁটার জায়গা নিশ্চিত করার জন্য একটি অর্ডিন্যান্স পাশ করা হয়েছে এবং ট্রানজিট ভিত্তিক উন্নয়নের জন্য নীতিমালা হালনাগাদ করা হয়েছে যার উদ্দেশ্য হচ্ছে পথচারীদের ভাল মানের সেবা দেয়া এবং শহরের ভেতরে যান চলাচল কমানোর জন্য ৬টি বিশেষ ব্যবসা অঞ্চল গড়ে তোলা। একাধিক কেন্দ্র তৈরি করার এই পরিকল্পনা ১৫ মিনিট নীতি ও কম ঘনত্বের নগর ব্যবস্থাপনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
টেক্সাস এর হুইস্টন-এ ২০২০ সালে ওয়াকেবল প্লেসেস অর্থাৎ হাঁটার জায়গা নিশ্চিত করার জন্য একটি অর্ডিন্যান্স পাশ করা হয়েছে…।
• অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহর ‘২০ মিনিটের এলাকা’ মূলনীতি সামনে রেখে তাদের ২০১৭-২০৫০ সালের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। তাদের এই মূলনীতির অন্যতম দিক হচ্ছে স্থানীয়ভাবে শহরের সকল চাহিদা মেটানো এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্রাণবন্ত ও স্বাস্থ্যকর কমিউনিটি তৈরি করা।
মেলবোর্নে শহরের পরিকল্পনা এমনভাবে করা হচ্ছে যাতে মানুষ তাদের ঘর থেকে আসা ও যাওয়া সহ মাত্র ২০ মিনিট দূরত্বের (অথবা ৮০০ মিটার) মধ্যেই দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সব সেবা পেতে পারে।
শহরের বাসিন্দাদের জন্য নিরাপদ সাইকেল ও অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থাও থাকবে। ২০১৮ সালে মেলবোর্ন এই ‘২০ মিনিটের এলাকা’ ধারণাটি পরীক্ষা করার জন্য শহরের বিভিন্ন এলাকায় সফলভাবে একটি পাইলট প্রজেক্ট সম্পন্ন করে। এই উদ্যোগকে আরো সফল করার জন্য কমিউনিটিকে সাথে নিয়ে কীভাবে নতুন কৌশল গ্রহণ করা যায় সেই বিষয়েও নগর কর্তৃপক্ষ কাজ করছে।
সূত্র: c40knowledgehub ডটঅর্গ
অনুবাদ: আমিন আল রাজী