ইসরায়েল সংঘটিত আগ্রাসনের নিন্দা জানানো উচিৎ। সেটা শুধু এ কারণেই না যে, কোনো রাষ্ট্রের বিদেশী ভূখণ্ড দখল করার অধিকার নেই। বরং এ কারণেও যে, প্রতিটি দখলদারিত্বই একটি পরীক্ষা, যার মাধ্যমে বিশ্ব আরো কতটা আগ্রাসন সহ্য করতে পারবে তা আবিষ্কার করা হয়।

বারট্রান্ড রাসেলকে ব্রিটেনের সবচেয়ে বিখ্যাত দার্শনিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। একাধারে তিনি ছিলেন একজন গণিতবিদ, দার্শনিক, যুক্তিবিদ এবং বুদ্ধিজীবী। গণিত, যুক্তিবিদ্যা, সেট তত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞান বা কম্পিউটার বিজ্ঞান থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মত বিজ্ঞান ও দর্শনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি।

বিশ্লেষণী দর্শন বা ‘অ্যানালিটিক ফিলোসফি’ নামে দর্শনের একটি শাখা গড়ে উঠেছে তার কাজের ওপর ভিত্তি করে।

রাসেল এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেম্যাটিকা’ নামের তিন খণ্ডের এক বইকে। রাসেল এর সঙ্গে বইটির সহ-লেখক হিসেবে ছিলেন আরেক ইংরেজ গণিতবিদ আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং যুদ্ধবিরোধী একজন মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের জন্যে তাকে জেলে যেতে হয়েছিল।


ভূমিকা ও অনুবাদ: ফারহান মাসউদ


ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে তিনি ‘ইন্ডিয়া লীগ’ নামের একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইংল্যান্ড ভিত্তিক এই সংগঠন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রচারণা চালিয়েছিল।

১৯৫০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান রাসেল। পুরস্কার প্রদানকারী নোবেল কমিটি জানায়, এর মাধ্যমে রাসেলের লেখায় মানবতাবাদী আদর্শ এবং চিন্তার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

১৯৬৩ সালে ইসরায়েল-ভিত্তিক পুরস্কার ‘জেরুসালেম প্রাইজ’ দেয়া হয় তাকে। সেবারই প্রথম এই পুরস্কারের প্রবর্তন করা হয় এবং তখন থেকে প্রতি দুই বছর পর পর বিভিন্ন দেশের লেখক ও সাহিত্যিকদের ‘জেরুসালেম প্রাইজ’ দেয়া হচ্ছে। পুরস্কার প্রদানকারীদের মতে, যারা নিজেদের লেখায় মানুষের স্বাধীনতার ধারণা তুলে ধরেছেন, তাদেরকে পুরস্কৃত করাই এই পুরষ্কারের উদ্দেশ্য।

অক্তাবিও পাজ, ভি.এস. নাইপল, জে.এম. কোয়েটজি এবং মারিও ভার্গাস ইয়োসা চারজনই সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার আগে পেয়েছেন জেরুসালেম প্রাইজ।

যাহোক, ইসরায়েল এর পুরস্কার গ্রহণ করলেও দীর্ঘদিন দেশটির সাম্রাজ্যবাদী কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করে গেছেন বারট্রান্ড রাসেল। ১৮৭২ সালে জন্ম নেয়া এই মনিষী মারা যান ১৯৭০ সালে। এবং মৃত্যুর আগে লেখা শেষ চিঠিতে তিনি ইসরায়েল এর তৎকালীন আগ্রাসনের নিন্দা জানান।

রাসেল সে সময়ের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে চিঠিটা লিখলেও তার অনেক বক্তব্যই এখনও প্রাসঙ্গিক।

 

প্রেক্ষাপট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে গঠিত হয় ইসরায়েল। এবং এর পর থেকেই পশ্চিমের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রাষ্ট্রটি এর আশেপাশের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বেশ অনেক বার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। একইসঙ্গে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করার মাধ্যমে নিজের সীমানা বাড়াতে থাকে, যেই আগ্রাসন এখনও চলমান।

ইতিহাসে ইসরায়েল এর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলির যুদ্ধের অন্যতম একটি অধ্যায় হল ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চলমান ‘আরব-ইসরায়েল সংঘর্ষ’। আরবিতে এই যুদ্ধকে ‘হারব আল-ইসতিনজাফ’ এবং হিব্রুতে ‘মিলহেমেত হাহাতাশাহ’ বলা হয়।

সেই যুদ্ধে ইসরায়েল এর প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল মিশর। তখন মিশরের ভূখণ্ডে থাকা ‘সিনাই উপদ্বীপ’ (বা সিনাই উপত্যকা) নামের একটি অঞ্চল ছিল ইসরায়েল এর দখলে। মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গামাল আব্দেল নাসের বিশ্বাস করতেন সামরিক বল প্রয়োগের মাধ্যমেই দখল হওয়া এই অঞ্চল পুনরদ্ধার করা সম্ভব।

পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে সিনাই উপদ্বীপ থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয় ইসরায়েল এবং এই অঞ্চল মিশরকে ফিরিয়ে দেয়।

যাহোক, আরব-ইসরায়েল সংঘর্ষ চলাকালীন অবস্থায় যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরায়েল এর দখলদারিত্ব নিয়ে ১৯৭০ সালের ৩১ জানুয়ারি একটি চিঠি লেখেন বারট্রান্ড রাসেল। এর দুই দিন পর (২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০) ৯৭ বছর বয়সে মারা যান তিনি।

রাসেলের মৃত্যুর পরের দিন মিশরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে চিঠিটি পড়ে শোনানো হয়।

আমেরিকার সংবাদপত্র ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এই চিঠি প্রকাশ করে সে বছরের (১৯৭০) মার্চের ২ তারিখে।

চিঠিটি পরবর্তীতে প্রকাশিত হয় বারট্রান্ড রাসেল এর চিঠি নিয়ে সংকলিত এক গ্রন্থে। ‘ইয়োর্স ফেইথফুলি, বারট্রান্ড রাসেল’ (পুরো নাম ‘Yours Faithfully, Bertrand Russell: A Lifelong Fight for Peace, Justice, and Truth in Letters to the Editor’) নামের বইটির একেবারে শেষে চিঠিটি যুক্ত করা হয়েছে।

 

বারট্রান্ড রাসেলের শেষ চিঠি

৩১ জানুয়ারি, ১৯৭০

মধ্যপ্রাচ্যের অঘোষিত যুদ্ধ সর্বশেষ যে পর্যায়ে এসে ঠেকেছে, তার ব্যাপারে হিসাব করতে গিয়ে বড় ধরনের ভুল করা হয়েছে। মিশরের সীমানার গভীরে এভাবে বোমা হামলা করা হলে বেসামরিক জনগণ আত্মসমর্পণ করার কথা ভাববে না। বরং প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্যে তাদের সংকল্প আরো দৃঢ় হবে। আকাশপথে করা সব বোমা হামলার ক্ষেত্রেই এই সত্যিটা প্রযোজ্য।

ভিয়েতনামে যারা বছরের পর বছর ধরে আমেরিকার ভারি বোমা হামলা সহ্য করেছে, তারা জবাবে আত্মসমর্পণ করেনি। বরং শত্রু বিমানে আরো বেশি করে গুলি করেছে। ১৯৪০ সালে আমার নিজের দেশের (ইংল্যান্ডের) মানুষেরা অসাধারণ ঐক্য আর সংকল্পের সাথে হিটলারের বোমা হামলা প্রতিরোধ করেছিল। ঠিক এ কারণেই এখন ইসরায়েল যে উদ্দেশ্যে আক্রমণ করছে, তা ব্যর্থ হবে। কিন্তু একই সাথে সমগ্র বিশ্বেই [এই আক্রমণের] কঠোর নিন্দা জানাতে হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের সংকট যেভাবে তৈরি হয়েছে, সেটা একই সঙ্গে বিপজ্জনক এবং শিক্ষণীয়। গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল অস্ত্রের জোরে নিজেদের সীমানা বড় করেছে। সীমানা বাড়ানোর প্রতিটি পর্যায় শেষে ইসরায়েল আহ্বান জানিয়েছে “যুক্তি” মেনে চলতে এবং পরামর্শ দিয়েছে “আলোচনার”। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গতানুগতিক বৈশিষ্ট্যই এটা। কারণ তারা (সাম্রাজ্যবাদী শক্তি) সহিংসতার মাধ্যমে ইতিমধ্যে যেটুকু দখল করেছে, সেটুকু—যত কম ঝামেলা করে পারা যায়—ধরে রাখতে চায়। প্রতিটি নতুন বিজয়ে তাদের বেড়ে যাওয়া শক্তির ওপর ভিত্তি করেই আলোচনা প্রস্তাব করা হয়। অথচ [সেই আলোচনায়] পূর্বের আগ্রাসনের সময় ঘটে যাওয়া অন্যায়গুলি উপেক্ষা করা হয়।

বারট্রান্ড রাসেল এর শেষ চিঠিতে ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা
বিশ্বের কোনো প্রান্তের মানুষদেরকেই নিজ দেশ থেকে গণহারে বের করে দেয়া হলে তারা তা মেনে নেবে না। তাহলে কেউ কীভাবে ভাবতে পারে যে, ফিলিস্তিনের জনগণ এমন শাস্তি মেনে নেবে, যা অন্য কেউ মানবে না?

ইসরায়েল সংঘটিত আগ্রাসনের নিন্দা জানানো উচিৎ। সেটা শুধু এ কারণেই না যে, কোনো রাষ্ট্রের বিদেশী ভূখণ্ড দখল করার অধিকার নেই। বরং এ কারণেও যে, প্রতিটি দখলদারিত্বই একটি পরীক্ষা, যার মাধ্যমে বিশ্ব আরো কতটা আগ্রাসন সহ্য করতে পারবে তা আবিষ্কার করা হয়।

সম্প্রতি ওয়াশিংটনের সাংবাদিক আই.এফ.স্টোন ফিলিস্তিন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে যে, এটা “বিশ্বের ইহুদিদের গলায় ঝুলে থাকা নৈতিক জাঁতাকলের পাথর”। অনেক শরণার্থীই অস্থায়ী ছাউনির নিচে বাস করছে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে, যারা নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে অনিশ্চিত।

ফিলিস্তিনের জনগণের ট্র্যাজেডি এটাই যে, এক বিদেশী শক্তি (ব্রিটেন) অন্য লোকদেরকে (ইহুদি) একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের জন্য তাদের দেশটা “দিয়ে দিয়েছিল”। [সরাসরি উল্লেখ না করলেও সম্ভবত তিনি ‘ব্যালফুর ঘোষণা’র (Balfour Declaration) ব্যাপারে বলছেন এখানে। – অনুবাদক] এর ফলে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ চিরকালের জন্যে গৃহহীন হয়ে পড়ে। এরপর থেকে প্রতিটি নতুন সংঘাতের ফলে তাদের (গৃহহীন মানুষদের) সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবী আর কতকাল এই অমানবিক নিষ্ঠুরতার দৃশ্য সহ্য করবে?

এটা একেবারেই স্পষ্ট যে, যেসব শরণার্থীদেরকে নিজেদের মাতৃভূমি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, সেখানে থাকার সমস্ত অধিকার আছে তাদের। আর এই অধিকার অস্বীকার করাটাই চলমান সংঘাতের পেছনে থাকা মূল কারণ।

বিশ্বের কোনো প্রান্তের মানুষদেরকেই নিজ দেশ থেকে গণহারে বের করে দেয়া হলে তারা তা মেনে নেবে না। তাহলে কেউ কীভাবে ভাবতে পারে যে, ফিলিস্তিনের জনগণ এমন শাস্তি মেনে নেবে, যা অন্য কেউ মানবে না?

মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংকট সমাধানের যেকোনো প্রচেষ্টার মধ্যেই শরণার্থীদেরকে তাদের নিজের দেশে বসবাসের একটি স্থায়ী ও ন্যায্য বন্দোবস্ত রাখতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

প্রায়ই আমাদের বলা হয় যে, ইসরায়েলের প্রতি অবশ্যই সহানুভূতিশীল হতে হবে আমাদেরকে। কারণ ইউরোপে নাৎসিদের হাতে ইহুদিরা কষ্ট স্বীকার করেছে। আমি এই পরামর্শে অবিরাম ভাবে কষ্টের পরিমাণ বাড়ানোর কোনো কারণ দেখি না। ইসরায়েল আজ যা করছে, তা ক্ষমা করা যায় না। এবং বর্তমানে তাদের কর্মের ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য অতীতের ভয়াবহতার কথা টেনে আনাটা চরম ভণ্ডামি।

ইসরায়েল আজ যা করছে, তা ক্ষমা করা যায় না। এবং বর্তমানে তাদের কর্মের ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য অতীতের ভয়াবহতার কথা টেনে আনাটা চরম ভণ্ডামি।

শুধুমাত্র বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর দুর্দশার জন্যেই নয়, তাদের দখলদারিত্বে থাকা অঞ্চলে বহু আরব জনগণ যে সামরিক শাসনের মধ্যে রয়েছে, শুধু সে কারণেই নিন্দা নয়, বরং এর বাইরে সম্প্রতি ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে বেরিয়ে আসা আরব দেশগুলি যে দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে, সে কারণেও ইসরাইল নিন্দনীয়। কারণ (ইসরাইলের আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে) সেসব দেশে জাতীয় উন্নয়নের চেয়ে সামরিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বেশি।

যারা মধ্যপ্রাচ্যে রক্তপাতের অবসান দেখতে চান, তাদেরকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো মীমাংসার মধ্যেই যাতে ভবিষ্যৎ সংঘাতের বীজ লুকিয়ে না থাকে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে ১৯৬৭ সালের জুন মাসের পর থেকে দখলকৃত সমস্ত অঞ্চল থেকে ইসরায়েলি সৈন্যদের প্রত্যাহার করতে হবে।

দীর্ঘদিন ধরে যন্ত্রণা ভোগ করা মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে এখন নতুন এক প্রচারণা শুরু করা দরকার।