কেনাকাটা করতে একটা শোরুমের উদ্দেশ্যে উত্তরা গেছিলাম বিকালে। আমার সঙ্গে দুইজন।

কোনো এক কারণে উত্তরার প্রতি আমি টান বোধ করি। হয়ত ছোটবেলার কারণেই। আমরা একবার ঈদের দিন চাইনিজ খাইতে উত্তরা গেছিলাম দুপুরে। হালকা বৃষ্টি হইতেছিল। আমি দুইহাতে চুড়ি পরছিলাম। সেদিন থেইকাই উত্তরা চিনি৷ উত্তরা আশেপাশে আসলেই টের পাইতাম।

এমনিতে উত্তরা সুন্দর। ভবিষ্যতে ব্যাচেলর লাইফ লিড করলে এমন সুন্দর রাস্তার পাশে একটা বাড়িতে আমি থাকব বইলা সিদ্ধান্ত নিলাম এলাকাগুলি দেখতে দেখতে।

আমরা গেছিলাম উত্তরা ৪ নাম্বার সেক্টরে। রেললাইনের ওখানে। রেললাইন পার হইয়া একদম ভিন্নধরনের অভিজ্ঞতা হইল।

রেললাইনের একপাশে পরিষ্কার ঝকঝকা বাড়ি, অনেকগুলি ডুপ্লেক্স বড়লোক বাড়ি, রাস্তা সুন্দর। ওই বাড়িগুলির সামনের ড্রেনের পানিতে মাছের পোনা ভরা।

রেললাইনটা জাস্ট পার হইয়া এক পা দিলেই একদম উল্টা দৃশ্য। ময়লা, ঘিঞ্জি এলাকা। দোকান আর বিল্ডিংগুলির কোনো আগামাথা নাই। আরো নানা সমস্যা। রেললাইনের দুইপাশের এই উল্টা চেহারা এতই কাছাকাছি বা লাগোয়া যে, দৃশ্যটা অবাস্তব মনে হয়। যেন, একটা বর্ডার বা সীমারেখা টাইনা দিয়া সমাজের দুই ক্লাসকে জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হইছে থাকার জন্য।

গিয়া আমরা ঠিকানা খুঁজতেছি। বহুবার ঘুইরাও না পাইয়া ওদের ফেসবুক পেইজে থাকা নাম্বারে শেষে ফোন করলাম। ফোন ধরল এক ভদ্রলোক। আমি ওদের স্টোরের নাম বইলা জানতে চাইলাম, আপনাদের দোকান কোথায়?

ভদ্রলোক বলে, আপনি কে?

আমি পরিচয় দিলাম ও তাদের শোরুমে কেনাকাটা করতে আসছি বললাম।

সে খুবই রুডভাবে বলল, আসবেন যে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করছেন?

আমি লোকের কথা বলার ভঙ্গি দেইখা অবাক। ওনাকে আমার জিজ্ঞেস কইরা আসতে হবে কেন? উনি কে? আমি আসছি কেনাকাটা করতে।

তো বলে, আমি এখন বের হব আর আপনারা এখন আসছেন। আমাকে জিজ্ঞেসও করেন নাই!

আমি ওনার স্পর্ধা নিয়া মাথা না ঘামায়া আবারো জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের দোকান কোথায়?

সে আরো জোর গলায় বলে, দোকান না এটা, এটা আমার অফিস।

অথচ আমি স্পষ্ট দেখছি, ফেসবুকে তারা শোরুম লেইখা রাখছে।

আমি বললাম, ফেসবুক পেইজে স্টোরের ঠিকানা দিয়া রাখছেন, পোস্টে শোরুম লেখা, তা দেইখা তো আমি অবশ্যই না জিজ্ঞেস কইরাই আসব।

সে বলল, ঠিক আছে, আমি বের হব এখনি, ৫ মিনিটে আসেন। ভদ্রলোকের শোরুম বা অফিস পাইতে তিন চার বার আমি ও আমার সাথীরা এই মাথা থেইকা সেই মাথা আসছি গেছি।

ওর মধ্যেই, দুই মিনিট পরই লোকটা আবার ফোন করল। আগের বিধ্বংসী গলা নাই, বলল, আপা কতটুকু আসছেন? আপনার সাথে দেখা করে আমি বের হব।

তার সঙ্গে আমার দেখা করার ঘটনা কখন ঘটল বুঝলাম না। আর তার ওই কণ্ঠে বলা ‘আপা’ হইল সেই আপা, যার সঙ্গে বইসা মানুষ চা খাইতে চায়। আমি আমার সঙ্গীদের বললাম, কিছু খাওয়াইতে চাইলে আমরা ডিরেক্ট না করব।

বাসার ঠিকানা বলার সময় উনি বলছে, পূর্ব পাশে ছোট একটা গলি ঢুকছে। আমরা পূর্ব পশ্চিম জানি না। ছোট গলি একটা দেইখা ঢুইকা পড়লাম।

তখন ভদ্রলোককে আগের মতই আমার ফোন দিয়া ফোন করলাম। কিন্তু কথা বলাইলাম আমার সঙ্গে থাকা দুই তরুণের একজনকে দিয়া। সে ঠিকানা বিষয়ে নিশ্চিত হইল, আমরা সঠিক বাড়ির নিচেই আসছি।

একটা বাগানবিলাসের ডাল আইসা ওই বাড়ির ঠিকানার ১০ এর ০ কে ঢাইকা রাখছিল। সেইটাকে দূর থেইকা মনে হচ্ছিল ১২। ফোন করা তরুণ ডাল সরায়া প্রমাণ দেখাইল আমাদের বাকি দুইজনকে।

অদ্ভুত এক বিল্ডিং। বাসার গেট থেইকা শুরু কইরা ভিতরের কেচিগেট কোথাওই বাসা বাসা ভাব নাই। বিল্ডিংটা না হইছে গ্যারেজ, না গোডাউন, না কিছুই।

ফোন করার প্রায় কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের অজান্তে ভদ্রলোক আইসা গেট খুলতে লাগলেন। কোনো শব্দ হয় নাই। এতটাই না দেইখা থাকা যায় এই বাসার জিনিসপত্র!

ফোনে কথা বইলা ভদ্রলোককে আমি শুরুতে আনপ্রফেশনাল ভাবছিলাম। কিন্তু উনি যেই ভঙ্গিতে আসলেন নিচে এবং আমাদেরকে রিসিভ করলেন, তাতে মনে হইল সমস্যাটা কালচারাল।

কেচিগেট খুলতে খুলতে উনি বললেন, আপনাদের সাথেই কথা বলছি?

আমরা বললাম, হ্যাঁ।

উনি বলল, আসেন।

দোতলায় উঠলাম। সিঁড়ি অন্ধকার। একটা গ্লুমি, ডিপ্রেসিং বাসার মধ্যে গেলাম। হলুদ কম পাওয়ারের লাইট লাগানো। তাতে বাসা আরো অন্ধকার লাগে। ওই রুমের সঙ্গে থাকা অন্য রুমগুলিতে যাওয়ার কাঠের দরজা ও কাচের স্লাইডিং ডোর বন্ধ কইরা রাখা। অনেকগুলি কার্টুন একটার ওপর আরেকটা রাখা একপাশে। পুরানো দিনের ভেলভেট কাপড়ের লম্বা একটা সোফা আর ওনার টেবিল, টেবিলের অপর পাশে অন্যদের বসার জন্য দুইটা চেয়ার।

আমি গিয়া সোফায় বসলাম, আমার সঙ্গে যাওয়া একজনও বসল। বাকি জনকে উনি আঙুল দিয়া ওনার সামনে চেয়ার দেখায়া দিলা বললেন, এখানে বসেন।

আমি বললাম, আপনার কি হুকুম দেওয়ার রোগ আছে? না শুধু এখনই এরকম করতেছেন?

উনি একটু হাসলেন আবার হাসলেন না। একটু শুদ্ধ ভাষা ও ভদ্রতার ভঙ্গিতে বললেন, কেন মনে হল?

আমি বললাম, আঙুল দিয়া দেখায়া বসতে বললেন যে।

তখন উনি ওনার ধমক দেয়ার পজিশন থেইকা একটু সরলেন মনে হইল। অনেক ব্যাখ্যা কইরা একই কথা বোঝাইতে লাগলেন। কেন ওনাদের পেইজে দেখানো জিনিসগুলি এখানে নাই। আমরা গিয়া জানলাম, ওনাদের পেইজের লাইভগুলি এখান থেকে হয় না, হয় থাইল্যান্ড থেকে। অর্থাৎ, শোরুম যেইটা দেখছি আমরা সেইটা থাইল্যান্ডে। এই কথাটাও কোথাও স্পষ্টভাবে বলা নাই ওনাদের ফেসবুক পেইজে। আমি কোনোমতে শুইনা থ্যাংক ইউ জানায়া বিদায় নিলাম।

পড়ুন: যেইটা সেইটা’র আরো লেখা

উনি তখন আরো নরম হইয়া নানা কিছু বলতে লাগলেন। যে, এইটা আসলে আমার বাসা এবং অফিস দুইটাই। ভিতরে বাসা, এইটুকু অফিস।

আমরা টোটাল ৫-৭ মিনিট বসছিলাম। নামার সময় উনি আমাদের আগে নামলেন গেইটের তালা খুলতে। আরেকবার থ্যাংক ইউ দিয়া বের হয়ে যাওয়ার সময় উনি বললেন, উপরে উঠাইলাম, কিছু মনে নিয়েন না।

৬ নভেম্বর ২০২১