পরিবেশ দুর্যোগের প্রভাব একতরফাভাবে অশ্বেতাঙ্গ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়াই হল পরিবেশগত বর্ণবাদ। ইংরেজিতে একে ‘এনভায়রনমেন্টাল রেসিজম’ (Environmental Racism) বলা হয়। ভিন্ন জাতি বা বর্ণের ব্যক্তি, দল কিংবা সমাজের মানুষের ওপর ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে পরিবেশ বিষয়ক নানা ধরনের নীতি, নির্দেশনা, আইন ও অনুশাসন আরোপের মাধ্যমে এই বৈষম্য করা হয়ে থাকে।

বর্ণবাদ শব্দটা নিয়ে ভাবার সময় প্রথমে সবাই সেটা চিন্তা করে ব্যক্তি পর্যায়ে। একজন ব্যক্তির মনে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষের প্রতি থাকা বিদ্বেষ বা কুসংস্কারকেই বর্ণবাদ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষ ছাড়াও ক্ষমতা ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার ব্যাপারে কারো পূর্বধারণার কথা চিন্তা করা হয় বর্ণবাদ নিয়ে ভাবতে গিয়ে। কিন্তু এ সবকিছু ব্যক্তি কেন্দ্রিক।


জুভা সেভেন
ভেরি ওয়েল মাইন্ড, ১৮ মে, ২০২৩


বড় পরিসরে চিন্তা করলে দেখা যায়, বর্ণবাদের ওপর ভিত্তি করে এক ধরনের শোষণ কাঠামো গড়ে উঠেছে। আর এই কাঠামোতে পরিবেশগত বর্ণবাদ অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই পরিবেশগত বর্ণবাদের মাধ্যমে সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান, আদিবাসী, প্রশান্ত তীরবর্তী দ্বীপের বাসিন্দা ও ল্যাটিনো জনগোষ্ঠীকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অথচ তারা সবাই দেশটির নাগরিক।

কিন্তু কীভাবে তারা অন্যদের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়? এর বড় একটা উদাহরণ হল এই সংখ্যালঘু মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে, তার আশেপাশেই স্থাপন করা হয় বড় বড় শিল্প কারখানা। কারণ এসব সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করার মত সামর্থ্য তাদের নাই। অন্যদিকে যেসব এলাকায় শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী বেশি থাকে, সেখানে স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক অবকাঠামোর পরিমাণ বেশি। এ ধরনের অবকাঠামোর মধ্যে সবুজে ঢাকা অঞ্চল থাকতে পারে। গাছপালা, পার্ক, ঝোপঝাড় বা ফসল উৎপাদনের জন্য যা সংরক্ষিত রাখা হয়।

২০১৯ সালের এক গবেষণায় পরিবেশগত বর্ণবাদ বিষয়ে বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা যায় যে, পরিবেশগত বর্ণবাদের ফলে শ্বেতাঙ্গদের জন্য বিশেষ জায়গা তৈরি হচ্ছে, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘হোয়াইট স্পেস’। ‘হোয়াইট স্পেস’-এ বসবাস করা শ্বেতাঙ্গরা সংখ্যালঘুদের তুলনায় অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকেন।

এই গবেষণাপত্রের গবেষকরা ‘ক্রিয়েটিভ এক্সট্র্যাকশন’ (creative extraction) নামের নতুন পরিভাষা ব্যবহার করেন, যার বাংলা করা যায় ‘সৃজনশীল লুণ্ঠন’। অশ্বেতাঙ্গরা যেখানে বসবাস করে, সেখান থেকে সম্পদ নিয়ে তা শ্বেতাঙ্গদের এলাকায় বিনিয়োগ করার প্রক্রিয়া বোঝাতে এই পরিভাষা ব্যবহার করা হয়।

গবেষণায় রাজনীতি ও আইন পর্যায়ে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সম্পদের বণ্টনের সাথে উন্নয়ন, অবকাঠামো ও পরিবেশের ক্ষতির সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। এই সম্পর্কের মধ্য দিয়েই ‘সৃজনশীল লুণ্ঠন’ এর মাধ্যমে আপাত দৃষ্টিতে সম্পর্কহীন বিষয়গুলি একই উদ্দেশ্য পূরণে ভূমিকা পালন করে।

এই লেখায় পরিবেশগত বর্ণবাদ এবং অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ওপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। একইসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে পরিবেশগত বর্ণবাদের ইতিহাস, উদাহরণ এবং এই বর্ণবাদ প্রশমনের জন্য করণীয় বিষয়ে।

 

পরিবেশগত বর্ণবাদের ইতিহাস

১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দপ্তর জেনারেল অ্যাকাউন্টিং অফিসের একটি প্রতিবেদনে সর্বপ্রথম পরিবেশগত বর্ণবাদের প্রভাবের কথা স্বীকার করা হয়। এই প্রতিবেদনে প্লাস্টিক কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মহাসড়কের আশেপাশে থাকা বাসিন্দাদের ব্যাপারে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সমীক্ষায় দেখা যায়, এ সকল স্থানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ৭৫% কৃষ্ণাঙ্গ।

রেড লাইনিং

বৈষম্যমূলক এক চর্চার নাম হল ‘রেড লাইনিং’ (Redlining)। সংখ্যালঘু ও নিম্ন আয়ের বাসিন্দারা যে অঞ্চলে থাকেন, সেসব অঞ্চলকে বিনিয়োগের জন্য ‘বিপজ্জনক’ হিসাবে চিহ্নিত করাই হল রেড লাইনিং।

১৯৩৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাংকলিন ডি. রুজভেল্ট এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত সংস্থা ‘হোম ওনার্স লোন কর্পোরেশন’। এই সরকারি সংস্থা ‘রেড লাইনিং’ এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ সৃষ্টি করে। মূলত বৈষম্যমূলক একটি বন্ধকি ব্যবস্থা চালু করে হোম ওনার্স লোন কর্পোরেশন।

কর্পোরেশনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের শহরাঞ্চলে অশ্বেতাঙ্গ মানুষদের বন্ধকি সুবিধা দেয়া হত না। ফলে অশ্বেতাঙ্গরা তখন নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় জমি কিনতে পারত না। এমনকি নিজেদের ঘরবাড়ি সংস্কারের জন্যেও কোনো প্রকার ঋণ সহায়তা পেত না। কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের অনেক মানুষই তখন থেকে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় গৃহ নির্মাণে বাধ্য হয়।

তবে রেড লাইনিং শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতাতেই শেষ হয়ে যায় নাই। গবেষকরা দেখিয়েছেন, বর্তমানে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মধ্যে যে সম্পদের বৈষম্য, তার পেছনে দায়ী বিভিন্ন কারণের মধ্যে রেড লাইনিং ব্যবস্থা অন্যতম। গত ৪০ বছরে এই বৈষম্যমূলক আবাসন নীতির কারণে শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারগুলিই তাদের সম্পদের ২,১২,০০০ ডলার সমান মূল্যমান হারিয়েছে।

পরবর্তীতে এ ধরনের নীতি থেকে সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের পরিবেশগত বৈষম্য।

তাই বোঝা যাচ্ছে, পরিবেশগত বর্ণবাদ মূলত বর্ণবাদেরই আরেকটি রূপ। কেননা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ভৌগলিকভাবে বিভাজিত এবং পৃথক করাটা বর্ণবাদের একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

 

পরিবেশগত বর্ণবাদের প্রভাব

পরিবেশগত বর্ণবাদের ফলে অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মানুষেরাই অধিক পরিমাণে বায়ু, পানি ও বর্জ্য দূষণের ভুক্তভোগী হয়। ফলে শ্বেতাঙ্গদের সাথে তুলনা করা হলে এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত হয় বেশি।

গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশের দিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসের কারণে অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতার শিকার হন। এর মধ্যে রয়েছে হরমোন জনিত, স্নায়ুজনিত, শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত এবং হৃদযন্ত্র জনিত নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি।

 

শুক্রাণুর মান

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের শুক্রাণুর মানের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে পরিবেশ দূষণ। গবেষণাটির ফলাফল অবশ্য সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত হয়নি। তবে গবেষণা থেকে ধারণা করা হচ্ছে কীটনাশক, সীসা, বায়ুদূষণ ও প্ল্যাস্টিসাইজারের মত পরিবেশে থাকা বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ শুক্রাণুর মান কমিয়ে আনতে পারে।

এমন দূষণের ঝুঁকি অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিদের বেশি থাকলেও দুর্ভাগ্যবশত গবেষণাটি করা হয়েছে মূলত শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের ওপর। বোঝাই যাচ্ছে এ ধরনের বিষয় নিয়ে গবেষণা ক্ষেত্রেও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।

 

শিশু

বয়স কম হওয়ার কারণে শিশুরা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়। ফলে পরিবেশগত বর্ণবাদের ক্ষতিকর প্রভাব শিশুদের ওপরেই বেশি পড়ে।

বর্জ্য বা ময়লার ভাগাড়ের কাছাকাছি থাকার কারণে শিশুদের দেহে কী পরিমাণ সীসা বিষক্রিয়া হয়, ২০০৭ সালে তার ওপর একটি যুগান্তকারী গবেষণা করা হয়েছিল। গবেষণায় উঠে আসে, বর্জ্য থেকে সীসা বিষক্রিয়ার আশঙ্কা শ্বেতাঙ্গ শিশুদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের মধ্যে ৫ গুণ বেশি থাকে।

আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, দূষিত পরিবেশে থাকা শিশুদের মধ্যে অ্যাজমা, সীসা বিষক্রিয়া এবং স্থূলতাজনিত সমস্যাও বেশি দেখা যায়।

 

পরিবেশগত বর্ণবাদের উদাহরণ

এবার দেখা যাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পরিবেশগত বর্ণবাদ সংক্রান্ত বড় দুটি বিপর্যয়ের ঘটনা।

ফ্লিন্ট অঞ্চলে পানি দূষণ

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যে ফ্লিন্ট  নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ফ্লিন্ট নামেরই এক শহর। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে সাময়িকভাবে এই শহরের বাসিন্দাদের খাওয়ার পানি হিসেবে ফ্লিন্ট নদীর পানি সরবরাহ করা শুরু হয়।

তবে নদীর পানি সরবরাহের আগে যেসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা তখন নেয়া হয় নাই। ফলে ১০ মাসের মধ্যে দেখা যায় যে ওই এলাকার অধিবাসীদের কাছে সরবরাহ করা পানির রঙ বদলে গেছে। পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেই পানিতে সীসার মাত্রা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গেছে।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্লিন্ট শহরের অধিবাসী শিশুদের রক্ত পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাদের রক্তে সীসার মাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। তখনই জরুরী অবস্থা জারী করা হয়।

তবে জরুরী অবস্থা ঘোষণার পরও এ ব্যাপারে প্রাথমিক ব্যবস্থা নিতে ১৮ মাস সময় লেগে যায়। এ সময়ের মধ্যেই এই অঞ্চলের অন্তত ১২ জন অধিবাসী “লিজোনেয়ারস’ ডিজিজ” নামের এক ধরনের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

এর বাইরেও বাসিন্দাদের অনেকেরই চুল পড়ে যাওয়া বা চর্মরোগের মত বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।

 

ডাকোটা অ্যাক্সেস পাইপলাইন

যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলে ‘দ্য ডাকোটা অ্যাক্সেস পাইপলাইন’ নামের ১,১৭২ মাইল দীর্ঘ এক পাইপলাইনের মাধ্যমে অপরিশোধিত খনিজ তেল পরিবহন করা হয়।

২০১৪ সালের জুন মাসে এই পাইপলাইন তৈরির ঘোষণা দেয়া হয় এবং ২০১৬ সালের জুন মাসে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

তবে এই পাইপলাইন নির্মাণের জন্যে যে স্থান প্রস্তাব করা হয়, সেটা ছিল ‘স্ট্যান্ডিং রক স্যু’ নামের  আদিবাসীদের বাসস্থান থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে।

প্রথমে পরিকল্পনা করা হয়েছিল এই পাইপলাইন মিসৌরি রাজ্যের বিসমার্ক শহরের কাছাকাছি এলাকা দিয়ে মিসৌরি নদী অতিক্রম করবে। কিন্তু পাইপলাইন স্থাপনের কারণে সম্ভাব্য যেসব দূষণ সৃষ্টি হবে, তা নদীর পানিকে দূষিত করতে পারে, এমন আশঙ্কা ছিল কর্মকর্তাদের। কেননা মিসৌরি রাজ্যের পানীয় জলের সরবরাহ মিসৌরি নদী থেকেই আসে। ফলে পাইপলাইনের অবস্থান পরিবর্তন করা হয়।

অথচ পাইপলাইনের এই নতুন অবস্থান সেখানে বসবাসরত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য বিশাল ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশেষ করে সেখানকার পানি দূষিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

এছাড়াও পাইপলাইন তৈরি করার সময় অনেক মাটি খনন করতে হয়েছে। এর ফলে প্রাচীন এই আদিবাসীদের অনেক পুরাকীর্তি, কবরস্থান, পবিত্র জায়গা এবং সাংস্কৃতিক স্থানসমূহের ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

২০১৬ ও ২০১৭ সালে এই পাইপলাইন নির্মাণের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ আন্দোলন হয়। এরপরও এই আদিবাসীরা এবং তাদের সমমনা দলগুলি পাইপলাইনের কাজ বন্ধ করতে পারে নাই।

প্রাচীন এই জাতির পূর্বপুরুষদের পৈত্রিক কবরস্থান ধ্বংস করে পাইপলাইন নির্মাণ করার সময় তাদের ভাল থাকা ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়টি মূল্যায়ন করা হয় নাই। বিবেচনা করা হয়েছে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গ তেল ব্যবহারকারী ক্রেতাদের স্বার্থের কথা।

 

পরিবেশগত বর্ণবাদ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা

এসব উদাহরণ ছিল শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তবে আমাদের উপলব্ধি করা দরকার, বিশ্বায়ন আর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে পরিবেশগত বর্ণবাদ এখন সারা পৃথিবীর জন্যেই সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

আর এর দায়ও সকল দেশের ওপর সমানভাবে বর্তায় না। যত যাই হোক, পৃথিবীর উত্তরাঞ্চল বা ‘গ্লোবাল নর্থ’ বিশ্বের অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ৯২ শতাংশের জন্যে দায়ী। এসব দেশের যেখানে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার কথা, তাদের অনেকেই পৃথিবীর দক্ষিণাঞ্চলকে দূষিত বর্জ্য ফেলার জায়গা হিসাবে ব্যবহার করছে।

এ বিষয়ে “ই-বর্জ্য” সংক্রান্ত একটা উদাহরণ দেয়া যাক। সহজ কথায় ই-বর্জ্য হল বাতিলকৃত ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র, যন্ত্রাংশ বা ইলেক্ট্রিক সরঞ্জাম। এবং ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা, যথাযথ উপায়ে এর ব্যবস্থাপনা করা না হলে এখান থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

২০১৪ সালের একটি গবেষণায় অনুমান করা হয়, প্রতি বছর তৈরি হওয়া ২০-৫০ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্যের ৭৫-৮০%-ই এশিয়া বা আফ্রিকায় রিসাইকেল কিংবা ফেলে দেয়ার জন্যে পাঠানো হয়।

২০২১ সালের অন্য আরেকটি গবেষণায় আফ্রিকার প্রেক্ষাপট থেকে দেখানো হয়, ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহ করার জন্যে আফ্রিকায় অনেক কারখানা আছে। এসব কারখানার শ্রমিকেরা বর্জ্য থেকে দূষণ ও বিষক্রিয়ার মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকেন।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে, এসব ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য আলাদা করা কিংবা পোড়ানোর কাজ প্রায় ক্ষেত্রেই বাসা-বাড়ির ভেতরে অথবা বসতবাড়ির খুব কাছেই করা হয়।

 

পরিবেশগত বর্ণবাদ মোকাবেলার উপায়

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশগত বর্ণবাদ মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার?

• আর্থিক সহায়তা: প্রথমত সকল দেশের জনগণ ও সরকার ব্যবস্থাকে স্বীকার করতে হবে, পরিবেশের সাথে সামাজিক বিভিন্ন বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এরপর প্রয়োজনীয় আইনি ও আর্থিক সুযোগ সুবিধা তৈরির মাধ্যমে পরিবেশগত বর্ণবাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দিতে হবে।

• পরিবেশ ভিত্তিক আন্দোলনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এই উদ্দেশ্য পূরণে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং তাদের উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হবে।

• তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে সাহায্য করতে হবে। পরিবেশগত বর্ণবাদের শিকার মানুষদের জন্যে প্রতিষ্ঠা করতে হবে ‘পরিবেশগত ন্যায়বিচার’। এই উদ্দেশ্যে কাজ করা বিভিন্ন তৃণমূল প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে আরো বেশি সহায়তা প্রদান করতে হবে।

কেননা একটা বৈশ্বিক সমস্যা কখনও একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য ‘গ্রাসরুটস ইন্টারন্যাশনাল’ বা ‘গ্রিন অ্যাকশন’ এর মতো সংস্থার ওয়েবসাইটে ভিজিট করতে পারেন, তাদের অনুদান দিতে পারেন।

সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব ব্যাপারে অন্যদের মাঝে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। আপনি নিজেও এ বিষয়ে নিজের অবস্থান প্রকাশ করতে পারেন। এক্ষেত্রে নিজেই একটা বিশেষ ইভেন্ট তৈরি করতে পারেন অথবা আপনার প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমেও ভূমিকা রাখতে পারেন।

• অন্যদের জানানোও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশগত বর্ণবাদ ও যারা এর শিকার, তাদের ন্যায়বিচারের গুরুত্ব সম্পর্কে অন্যদের জানাতে ও বোঝাতে হবে। সর্বোপরি বাড়াতে হবে সচেতনতা।

• বিভিন্ন শিল্পের সঙ্গে একসাথে কাজ করতে হবে, যাতে সবাই একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে চেষ্টার প্রভাব বৃদ্ধি করা যায়। জলবায়ু পরিবেশ সংক্রান্ত ন্যায়বিচারের বিষয়টা নিয়ে যেন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সচেতন হয় এবং জলবায়ু বিষয়ক কার্যক্রমের সাথে যোগ দেয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

• অ্যাকটিভিস্টদের মধ্যে ‘ইন্টারসেকশনাল এনভায়রনমেন্টালিজম’ (Intersectional Environmentalism) নামের একটি পরিভাষা সম্প্রতি চালু হয়েছে। এই ধারণা অনুসারে, সমাজের বিভিন্ন অংশ ও গোষ্ঠীর স্বার্থে এবং সকলের সহযোগিতায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অধিকৃত ভূখণ্ডে ঔপনেবেশিকতার শিকার মানুষদের ন্যায়বিচার কিংবা পরিবেশগত বর্ণবাদের সমাপ্তি টানার মত বিষয় নিয়ে কাজ করা হয় এই ধারণা অনুসারে।

এছাড়াও সকল গোষ্ঠী ও বর্ণের মানুষের জন্য সবুজ অঞ্চলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এই ধারণার উদ্দেশ্য। একইসঙ্গে সমকামী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সব জায়গায় সমান অংশগ্রহণ ও প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করাও এই কাজের অংশ।

মানুষ এবং পৃথিবী, এই দুইয়ের সুরক্ষার ব্যবস্থার কথাও বলা হয় ইন্টারসেকশনাল এনভায়রনমেন্টালিজম এর ধারণায়।

এই ধারণায় স্বীকার করে নেয়া হয়, জলবায়ু সমতার জন্য আগে সামাজিক সমতা প্রয়োজন। আর এ দুটি বিষয় একে অন্যের জন্য অপরিহার্য।

 

সারাংশ

পরিবেশগত বর্ণবাদের বিপরীতে ‘পরিবেশগত ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠা করা অনেক কঠিন কাজ বলে মনে হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজের ভূমিকাকে খাটো করে না দেখা।

আপনি হয়ত নিরাশাবাদী হতে পারেন। কিন্ত জরুরী বিষয় হচ্ছে এই যুদ্ধে আপনি একা নন, সেটা বুঝতে পারা। যদি মনে করেন নিজের কাজে ও প্রচেষ্টায় আরো বেশি সহযোগিতা প্রয়োজন, তবে সবার সঙ্গে মিলে সামষ্টিকভাবে চেষ্টা করতে পারেন। এজন্যে অন্যদের কাছে পৌঁছানো এবং তাদের বোঝানোর মত কাজ ভূমিকা রাখতে পারে।

আরো পড়ুন: আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রতি চলমান বর্ণবৈষম্য নিয়ে র‍্যালফ রিচার্ড ব্যাংকস

এছাড়াও আপনি যদি এমন কেউ হয়ে থাকেন, যে পরিবেশগত বর্ণবাদের শিকার, তাহলে মানসিক সহায়তার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ আপনার কাজে লাগতে পারে।

এছাড়াও নিজের সমাজ বা আশেপাশের অন্যান্য মানুষের কাছে বুদ্ধি পরামর্শ চাইতে পারেন। হয়ত নিজেদের মধ্য আলোচনা থেকেই এ বিষয়ে একটি উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

অনুবাদ. আমিন আল রাজী