ডাচ স্থপতি কোয়েন ওলথুইস নকশা করেছেন চমৎকার দেখতে এই সিপডগুলির। সমুদ্র উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের সাথে মিল রেখে জীবনযাপনের নতুন একটা উপায় উপস্থাপন করা হয়েছে সিপডগুলির মাধ্যমে। অতিরিক্ত মিনিমালিস্ট এবং পুরাই সাদা রঙের এই অস্বাভাবিক ভাসমান বাড়িতে থাকার জায়গার পরিমাণ ৮৩০ বর্গফুট।

সিপডগুলির নকশা করেছেন ডাচ স্থপতি কোয়েন ওলথুইস

একটা বেডরুম, কিচেন, বসার ঘর, বাথরুম আর স্টোররুমসহ এই বাড়ি তিন স্তরে বিভক্ত। পানির নিচে লুকানো একটা ভাসমান ভিত্তির সাথে যুক্ত সাড়ে সাত ফুট উঁচু একটা স্তম্ভের ওপর বসানো হয়েছে বাড়িটিকে। বাড়িটি যাতে স্থিতিশীল থাকে তার জন্যে ১,৬৮৮ ঘনফুটেরও বেশি বায়ু ভরা নল ব্যবহার করা হয়েছে। বাড়িতে যাওয়া-আসার জন্য বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মজুদের জন্য এই বাড়ির বাসিন্দাদের একটা স্মার্ট রিং পরতে হবে যা যানবাহন বা খাবার সরবরাহকারী ড্রোনে খবর পাঠাতে পারবে।  সিপডগুলিতে সৌর প্যানেল, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ব্যবস্থা এবং বর্জ্য পরিচালনা ব্যবস্থা আছে। এগুলির নিজস্ব বিদ্যুৎ, পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আছে।

তবে সিপড কবে চালু হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। ওশেন বিল্ডার্স এখনও ডেভেলপমেন্টের পর্যায়ে রয়েছে।

ইনোভেশন টেকনোলজি কোম্পানি ‘ওশেন বিল্ডার্স‘ তাদের সিপড উন্মোচন করেছিল ২২ সেপ্টেম্বর ২০০২ তারিখে, পানামার লিন্টন বে মেরিনায়। পানামার প্রেসিডেন্ট লরেন্টিনো কর্টিজোও বিলাসবহুল ভাসমান বাড়ির ভিতরে যাওয়ার জন্য দর্শকদের সঙ্গে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ প্রোটোটাইপটি পাশের ডকের দিকে হেলে পড়ে যাওয়ায় অনুষ্ঠানে বিপত্তি নেমে আসে। ওশেন বিল্ডার্সের পরিবেশ-বান্ধব স্বর্গের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৈরি মহাকাশযানের মত এই পড হোমের জন্য সেটি খুব একটা শুভ সূচনা ছিল না। তবে কেউ আহত হয়নি।

২.
ভাসমান বাড়ি, বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং স্মার্ট হোম টেকনোলজি এই তিনটি জিনিসকে একসাথে পাওয়া যায় না।

কিন্তু পানামা-ভিত্তিক কোম্পানি ওশেন বিল্ডার্স এই তিনটি বিষয়কে একসাথে আনতে যাচ্ছে। কোম্পানিটি উদ্ভাবনী সামুদ্রিক প্রযুক্তিতে বিশেষজ্ঞ। তারা সদ্যই “বৈপ্লবিক লিভিং পড” এর এই বহর উন্মোচন করেছে।

এই পডটিকে “বিশ্বের প্রথম ইকো-রিস্টোরেটিভ হোমস” হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। (সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে বাস্তুতন্ত্রের যে ক্ষতি সাধিত হয় তার পুনরুদ্ধারকে ইকোলজিক্যাল রেস্টোরেশন বলে।) এগুলির দাম হবে প্রায় ২,৯৫,০০০ থেকে ১.৫ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। পানামার উত্তর উপকূলে লিন্টন বে মেরিনায় এগুলি নির্মাণাধীন রয়েছে।

এর রয়েছে তিনটি মডেল। এর ফ্ল্যাগশিপ মডেলটির নাম সিপড, এটি জলজ জীবনযাপনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। আরেকটি হল গ্রিন-পড, এটি তৈরি করা হয়েছে ভূমিতে ব্যবহারের জন্য। এবং ইকোপড, এটি পরিবেশ এবং অর্থনীতি-বান্ধব বিকল্প হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।

উঁচু ও উন্নত কাঠামো
এই সিপডগুলির ধারণা এসেছে মূলত ওশেন বিল্ডার্সের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রধান রুডিগার কোচ এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গ্রান্ট রোমুন্ডের কাছ থেকে। জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকতগুলিতে স্থানের অভাব থাকে—এই সমস্যার সমাধান হিসেবে এটি নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন তারা।

এর উন্নত ও উঁচু কাঠামোর মাধ্যমে ৮৩৩ বর্গফুট থাকার জায়গা পাওয়া যাবে। এর মধ্যে থাকবে একটি মাস্টার বেডরুম, বসার ঘর, রান্নাঘর ও বাথরুম। তিন তলা বা স্তর জুড়ে এগুলি বিস্তৃত হবে।

দুই জনের বসবাসের জন্য ঘর থাকবে এগুলিতে। এই ইউনিটটি স্রোতের উপর ৭.৫ ফুট উচ্চতায় ভেসে থাকার জন্য ১,৬৮৮ ঘনফুট বায়ুভর্তি এক ধরনের ইস্পাতের টিউব ব্যবহার করে। এবং এতে আরও রয়েছে ৫৭৫ বর্গফুটের বিশালাকার প্যানোরামিক জানালা এবং ৩৬০-ডিগ্রিতে সমুদ্রের দৃশ্য দেখার সুবিধা।

রোমুন্ড আশা করেন, এই ডিজাইনটি বাড়ি এবং ভ্রমণ সমন্ধে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করবে। সেইসাথে বাসিন্দাদের “আধুনিক বিলাসী জীবনযাপনের” কোনো সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ না করেই পানির ওপর বসবাস করার সুযোগ দেবে।

“সাধারণত যখন আপনি পানির উপর বাস করেন, তখন আপনি একটা নৌকায় থাকেন, তবে নৌকার জীবনযাত্রা বেশিরভাগ মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য,”—গ্রান্ট রোমুন্ড বলেন। “সুতরাং আমরা এমন একটি বাড়ি তৈরি করেছি যেটি পানির উপর ভাসমান থাকবে, অথচ আপনাকে ভূমিতে বসবাসের অভিজ্ঞতা দেবে, এমনকি আরও বেশি পরিমানে।”

পডগুলিকে সর্বশেষ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত করা হবে। এবং এগুলিতে থাকবে কাস্টমাইজ করার সুবিধা। ফলে এগুলিতে যারা থাকবে তাদের সাথে কাস্টমাইজ করে এর ডিজাইন এবং কার্যকারিতা তৈরি করা হবে৷

ফিউচারিস্টিক বাড়ি
এছাড়াও এর বাসিন্দাদের হাতে পরা “স্মার্ট রিং” এর মাধ্যমে শুধু হাত নাড়িয়েই তারা তাদের ঘরের দরজা খুলতে এবং গান চালু করতে পারবে।

বেডরুম

“যদি প্রযুক্তি সংস্থা অ্যাপল একটি বাড়ি তৈরি করত, আমি মনে করি সেটি সিপড, বা গ্রিনপড, বা ইকোপড এর মতই হত,” রোমুন্ড বলেছেন৷ “বাড়িতে ব্যবহারের জন্য অনেক প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে।”

“আমি মনে করি যে, ডিজিটাল সহকারি হিসাবে একটি ফোনের পরিবর্তে, এখানে আপনার বাড়িটিই আপনার সহকারি হয়ে ওঠে এবং আপনি এটিকে আপনার জীবনকে অপ্টিমাইজ করতে ব্যবহার করতে পারেন।”

এই পডগুলি প্রাথমিকভাবে লিন্টন বে মেরিনার কাছাকাছি একটি এলাকায় থাকবে। ওশেন বিল্ডার্স আশা করছে যে, প্রযুক্তিটি অন্য কোথাও স্থাপন করার ব্যাপারে যখন তারা নিশ্চিত হবে, তখনই তারা আন্তর্জাতিকভাবে এগুলির বিতরন শুরু করবে।

সমুদ্রতটে বসবাসের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন রোমুন্ড। তিনি নিজে আগে টরন্টোতে একটি ভাসমান বাড়িতে থাকতেন। তিনি বলেন যে, এটি এমন একটি জীবনধারা যার কোনো তুলনা পাওয়া কঠিন।

“সকাল বেলায় ঘুম থেকে জেগে, হাঁটতে হাটতে নিচে নেমে, লাফ দিয়ে একটি প্যাডেলবোর্ডে উঠে, প্যাডেল করতে করতে পানিতে ঘুরে বেড়াবার মধ্যে সত্যিই যাদুকরী কিছু একটা আছে,” তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন।

ডেলিভারি ড্রোন
“এটি খুবই সুন্দর এবং শান্তির একটা ব্যাপার। বেশিরভাগ লোকেরই স্বপ্ন থাকে যে দুই সপ্তাহের ছুটিতে তারা একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দ্বীপে যাবে, আড্ডা দেবে, বিশ্রাম নেবে, নিজেকে পুনরুদ্ধার করবে এবং এতে তার আত্মিক ও নৈতিক উন্নতি ঘটবে।

“সেক্ষেত্রে সারা বছর এভাবেই বাঁচবেন না কেন? বর্তমানে দূর থেকে অফিস বা ব্যবসার কাজ করা যায়৷ ফলে এই জীবনধারা গ্রহণ এখন খুবই সহজ।”

যদিও যারা এই নির্দিষ্ট ইউনিটগুলির মধ্যে বাস করতে পছন্দ করবেন তাদের সম্ভবত আডভেঞ্চার বা দুঃসাহসিক অনুভূতির প্রতি ঝোক এবং এর পাশাপাশি পানির প্রতি গভীর অনুরাগ থাকতে হবে। রোমুন্ড বলেন, এই বাড়িগুলির জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট ধরনের গ্রাহকের কথা তারা চিন্তা করেননি।

বরং তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে মনে করেন যে, যারা মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য এই সিপডের অভিজ্ঞতা পাবে, তাদের বেশিরভাগই এটির মালিক হতে চাইবে।

“যখন আমি টরন্টোতে আমার ভাসমান বাড়িতে থাকতাম, তখন সেখানে যারা বেড়াতে এসেছিলেন, তাদের প্রত্যেকেই জায়গাটির প্রেমে পড়ে গেছিলেন,” তিনি বলেন।

“সুতরাং আমাকে যা করতে হবে তা হল, লোকেদেরকে ৫ মিনিটের জন্য সিপডে পা রাখার সুযোগ করে দেওয়া। এই অভিজ্ঞতা আপনাকে মুগ্ধ করে ফেলবে। এটা সত্যিই বিষ্ময়কর।”

কিন্তু ব্যবহারিক জীবনের কী হবে? দোকানে যাওয়া অথবা পড থেকে মূল ভূখণ্ডে যাওয়া-আসার কী হবে?

রোমুন্ডের মতে, এই ধরনের ব্যবহারিক কাজে কাস্টমাইজড এরিয়াল ডেলিভারি ড্রোনগুলি ব্যবহার করা হবে। এগুলির মাধ্যমে খাদ্য এবং ওষুধের পাশাপাশি “প্রতিদিনের ছোটখাটো সামগ্রী” সরবরাহ করা যাবে।

বড় বা ভারি সামগ্রীর ডেলিভারির জন্য এর একটি পৃথক স্বায়ত্তশাসিত ভেসেল থাকবে। এই ভেসেলটি পানিতে ভেসে থাকা আবর্জনা এবং ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করবে, যাতে আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার থাকে।

‘ইকো-রিস্টোরেটিভ হোমস’ বা পরিবেশ পুনরুদ্ধারকারী বাড়ি
সিপডে বাসিন্দাদের এবং দর্শনার্থীদের আসা-যাওয়া করার জন্য ডিঙ্গি বোট, জেট স্কি, স্থানীয় ওয়াটার ট্যাক্সি অথবা নিজস্ব নৌকা বা জাহাজ ব্যবহার করা যেতে পারে।

যদিও এই পডগুলিকে মিনিমালিস্ট লোকজনের জন্য তৈরি করা হয়েছে বলে মনে হয়, তবুও এটির ভিতরে ১২৫০ ফুটের একটি বিশাল স্টোরেজ রয়েছে।

এটি নির্মাণের সময় এর স্থায়িত্বের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পডগুলিকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন এগুলি “আশেপাশের পরিবেশের উপকার করে” এবং “সামুদ্রিক প্রাণগুলির স্বাভাবিক চলাফেরা এবং বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক আবাসস্থল” কোনো ভাবে নষ্ট না করে।

“আমরা এমন একটি বাড়ি তৈরি ও ডিজাইন করার চেষ্টা করছি যা পরিবেশের জন্য ভাল, এবং যা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না,” রোমুন্ড ব্যাখ্যা করেন।

“এবং এ কাজটি আরও ভালভাবে করার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উপায় খুঁজে চলেছি এবং বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করছি। আমরা এই মুহূর্তে নিখুঁত নই, তবে আমরা সব সময় ভাল থেকে আরও ভাল হওয়ার চেষ্টা করছি।”

যে পডগুলির কাজ ইতিমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে সেগুলি অনলাইনে প্রকাশ করা হবে, এবং সম্ভাব্য ক্রেতারা শীঘ্রই এগুলি নিজে গিয়ে দেখতে পারবে।

“লোকেরা বছরের পর বছর ধরে এগুলি কেনার চেষ্টা করছে,” রোমুন্ড বলেছেন। তিনি আরও বলেন যে, যতক্ষণ না ক্রেতারা বাস্তব জীবনে পডগুলি দেখতে পাচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত ওশেন বিল্ডার্স এগুলির জন্য আমানত না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

‘ব্যাপক উদ্যোগ’
“এটা একদমই নতুন। এবং পৃথিবীতে এমন অনেক রিয়েল এস্টেট প্রকল্প রয়েছে, যেগুলিতে লোকেরা অর্থ বিনিয়োগ করে কিন্তু প্রকল্পগুলি কখনোই বাস্তবে রূপলাভ করে না।

“সে কারণে যতক্ষণ না মানুষ পডের ওপর নিজেই পা রাখতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কোনো আমানত নিতে চাইনি। তাই এখন আমি উচ্ছ্বসিত, কারণ আমরা শেষ পর্যন্ত সেই মুহূর্তটিতে এসে পৌঁছেছি।”

“এটি একটি বিশাল উদ্যোগ। আমি ২ বছর আগে এটা শেষ করতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। তবে মাত্র সাড়ে ৩ বছরে এই ব্যাপক উদ্যোগ শেষ করাটা পারাটা সত্যিই অত্যন্ত আনন্দদায়ক।”

সিপডগুলি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চালু হতে যাচ্ছে। এগুলির মত আরও বেশ কয়েকটি নতুন ভাসমান বাড়ির প্রকল্প অচিরেই চালু হবে। এর মধ্যে একটি প্রকল্প ফ্লোটিং সিহর্স। এটি ১৩১টি ভাসমান ভিলা সমন্বিত একটি মেগা-রিসর্ট। ক্লেইন্ডিয়েনস্ট গ্রুপ ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে, দুবাই উপকূলে কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জে ‘দ্য হার্ট অফ ইউরোপ’ নামের একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে এটি তৈরি করছে।

যারা ওশেন বিল্ডারস এর প্রথম ১০০টি পডের মধ্যে থেকে একটি চটজলদি কিনে নিবে, তারা ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ এতে প্রবেশ করতে পারবে, যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে।

২০২৪ সালের মধ্যে আরও ১,০০০টি পডের উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

ওয়েব থেকে অনুবাদ. জুবায়েদ দ্বীপ