প্রতিদিনের যোগাযোগে আমরা অনেক সময় আশেপাশের মানুষের আচরণ, অঙ্গভঙ্গি বা মুখভঙ্গি নকল করি। এটাকে বলা হয় ‘ক্যামেলিওন ইফেক্ট’। এই ইফেক্টের কারণে আমরা নিজের অজান্তেই অন্যদের আচরণ অনুসরণ করতে শুরু করি, তা সে ঘনিষ্ঠ মানুষ হোক বা সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ।

এর নামকরণ হয়েছে ক্যামেলিওন বা গিরগিটি থেকে, যে প্রাণীটি যখন তখন নিজের রঙ বদলে নিয়ে চারপাশের পরিবেশের সাথে মিশে যেতে পারে।

আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন, আপনার বন্ধুরা বা কাছের মানুষজন প্রায়ই আপনার প্রিয় ক্যাচফ্রেজ (catchphrase) বা অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করে, কিংবা আপনিও তাদেরটা করে ফেলেন। এটাই ক্যামেলিওন ইফেক্ট, যা খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। জীবনের কোনো না কোনো সময় আমরা সবাই এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাই।

ক্যামেলিওন ইফেক্ট

ক্যামেলিওন ইফেক্ট হয় কেন
মানুষকে অনুকরণ করার কাজটি, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে, আমরা প্রতিনিয়তই করি। অনেক সময় মজা করার জন্য আমরা অনেককে অনুকরণ করি, তবে অবচেতন মনে কেন আমরা কাউকে অনুকরণ করি তা এখনও স্পষ্ট না।

গবেষকদের মতে, আমরা এটা করি কারণ এটা আমাদের সামাজিক যোগাযোগে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আপনি যখন কাছের কোনো ব্যক্তির আচরণ অনুকরণ করেন, সে বিষয়টা লক্ষ্য করে এবং এর ফলে আপনার প্রতি তার ইতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয়।

এটা মনে রাখা দরকার যে “অনুকরণ” শব্দটি কখনো কখনো নেতিবাচক মনে হতে পারে, কিন্তু ক্যামেলিওন ইফেক্ট সাধারণত এমন একটি ঘটনা বোঝায় যেখানে নকল করার ফলে ক্ষতিকর কিছু ঘটে না।

ক্যামেলিওন ইফেক্টের উদাহরণ
ক্যামেলিওন ইফেক্ট সাধারণত খুব সূক্ষ্ম বা নিগূঢ় হয়, বেশিরভাগ সময় আমরা খেয়ালও করি না। তবে এর কিছু বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাবেন এই বিষয়গুলির মধ্যে:

  • বন্ধুর কথা বলার ভঙ্গি বা প্যাটার্ন অনুকরণ করা
  • কারো সাথে কথা বলার সময় সে যেভাবে দাঁড়িয়েছে, নিজেও সেভাবে দাঁড়ানো
  • হেসে কথা বলা কারও সাথে কথা বলার সময় নিজেও হাসা
  • মিটিং এর সময় অন্যদের পশচার অনুকরণ করা
  • যার সাথে কথা বলছেন, তার মত একই অঙ্গভঙ্গি করা
  • যার সাথে কথা বলছেন, তার মত একই টোনে কথা বলা
  • কেউ পা গুটিয়ে বসলে নিজেও পা গুটিয়ে নেওয়া
  • যার সাথে কথা বলছেন, তার মত একইভাবে মাথা নাড়ানো বা অন্য কোনো অঙ্গভঙ্গি করা

ক্যামেলিওন ইফেক্টের প্রভাব
ক্যামেলিওন ইফেক্ট হল নিজের অজান্তেই অন্যদের আচরণ অনুকরণ করা, যা একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। কারও সাথে যদি পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করেন বা থাকেন, তাহলে তাদের কিছু বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, আচার আচরণ, মুখভঙ্গি ও অঙ্গভঙ্গি আপনার মধ্যে চলে আসতে পারে। অনেক দিন ধরে একসাথে আছেন এমন জুটি কিংবা বেস্ট ফ্রেন্ডদের মধ্যে এই বিষয়গুলি খেয়াল করে থাকবেন।

এই ঘটনা নিয়ে প্রথম গবেষণা করা দুই মনোবিজ্ঞানী তানিয়া এল চার্ট্র্যান্ড ও জন এ বার্গের মতে, সহানুভূতিশীল মানুষেরা অন্যদের তুলনায় বেশি অনুকরণ করেন। স্বভাবতই সহানুভূতিশীলরা অন্যদের প্রতি বেশি মনোযোগ দেন, যা গভীর সংযোগ গড়ে তোলে, তাই তাদের মধ্যে অনুকরণের প্রবণতাও বেশি থাকে।

কারো মধ্যে যদি সহানুভূতি খুব বেশি না থাকে, এ ধরনের আচরণ নেতিবাচক বার্তা দিতে পারে। তখন ক্যামেলিওন ইফেক্টের ফলে যে সামাজিক সুবিধা পাওয়া যায়, সেটি পাওয়া সম্ভব হবে না।

ক্যামেলিওন ইফেক্ট কীভাবে কাজ করে
মানুষ দুইভাবে অন্যের অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করে। ক্যামেলিওন ইফেক্টের সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হল ‘মিররওয়াইজ’, আরেকটি পদ্ধতির নাম ‘অ্যানাটমিক্যাল মিমিক্রি’।

১. মিররওয়াইজ মিমিক্রি

একজন মানুষ যখন অন্যের ‘মিররওয়াইজ’ অনুকরণ করে, সেই ব্যক্তির একদম উল্টা কাজটা সে করে। যাকে অনুকরণ করা হচ্ছে, সে যদি কথা বলার সময় ডান হাত নাড়াচাড়া করে, তাহলে যে অনুকরণ করছে সে একইভাবে তার বাম হাত নাড়াবে।

২. অ্যানাটমিকাল মিমিক্রি

অণুকরণ অ্যানাটমিকালিও হতে পারে। এর অর্থ, তারা যা করছে, আপনিও তাই করছেন। ধরুন, কথা বলার সময় তারা বাম পা নাড়াচ্ছে, আপনিও নিজের বাম পা নাড়ানো শুরু করলেন।

এই দুটি পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য খুব কম মনে হলেও গবেষণায় দেখা গেছে দুটির সামাজিক ফলাফল ভিন্ন।

একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের ভার্চুয়াল জগতে ডিজিটাল মানুষের সাথে কথা বলতে বলা হয়েছিল। যাদের শরীরের সব অঙ্গভঙ্গি ঠিকঠাক নকল করা হয়েছিল, তারা সেই ডিজিটাল মানুষের প্রতি বেশি খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। কিন্তু যাদের হুবহু নকল করা হয়নি, তারা এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।

এটি দেখায়, আপনি যদি অজান্তেও কারো অঙ্গভঙ্গি নকল করেন, তাহলে সে আপনার প্রতি খারাপ আচরণ করতে পারে।

ক্যামেলিওন ইফেক্ট তৈরি কীভাবে করবেন
ক্যামেলিওন ইফেক্ট একটি সাধারণ ঘটনা, এটি সাধারণভাবেই ঘটে, চর্চা করার প্রয়োজন নেই। তবে, এর সামাজিক সুবিধাগুলির কথা মাথায় রাখতে হবে ও সেটা মেনে নিতে হবে।

আরো পড়ুন: তুলনার হাত থেকে মুক্তির উপায়

অচেনা কিংবা চেনা মানুষের মধ্যে, ক্যামেলিওন ইফেক্ট আপনাকে পছন্দনীয় ও সামাজিক করে তুলবে। একটি পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সচেতনভাবে ক্যামেলিওন ইফেক্ট অবলম্বন করতে পারেন, যাতে আপনার আচরণ অন্যদের কাছে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।

ক্যামেলিওন ইফেক্টের ব্যাপারে সচেতন থাকলে ও বিষয়টি হতে দিলে তা নিজের সুবিধার জন্য কাজে লাগাতে পারেন। একটি কাস্টমার সার্ভিস গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যামেলিওন ইফেক্ট অনুকরণকারীর জন্য প্রতি কাস্টমারদের আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। এর ফলে একটি ‘স্পিলওভার’ ইফেক্টও ঘটে, বিজনেস সম্পর্কে কাস্টমারদের মনে ভাল ধারণা জন্মায়।

স্পিলওভার মানে হল এক ক্ষেত্রের প্রভাব অন্য কোনো সম্পর্কিত ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়া। এখানে “স্পিলওভার ইফেক্ট” বলতে বোঝানো হচ্ছে, ক্যামেলিয়ন ইফেক্টের কারণে কাস্টমারের আচরণে যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে, তা শুধু অনুকরণকারীর প্রতি সীমাবদ্ধ থাকে না। সেই ইতিবাচক প্রভাব ব্যবসার ওপরও পড়ে, যার ফলে কাস্টমারদের মনে ব্যবসার প্রতি ভাল ধারণা তৈরি হয়।

কী অনুকরণ করবেন
সাধারণত যেসব আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করা হয় তা হল:

  • মুখভঙ্গি
  • উচ্চারণভঙ্গি
  • গলার তীক্ষ্ণতা
  • গলার টোন

যখন কাউকে অনুকরণ করেন, তাদের মনে হয় আপনাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গির মিল আছে, তারা যেভাবে পৃথিবীটা দেখে, আপনিও ঠিক একইভাবে দেখেন। এর ফলে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সহজ হয়।

স্বাভাবিক অনুকরণই মূল
ক্যামেলিওন ইফেক্টকে আপনার কাছে স্বাভাবিকভাবেই আসতে দিন। যার সাথে কথা বলছেন, তার যদি মনে হয় আপনি তাকে হুবহু নকল করছেন বা করার চেষ্টা করছেন, তাহলে বিষয়টিকে তার কাছে অপমান বা উপহাসের বিষয় বলে মনে হতে পারে, যার ফলাফল হতে পারে নেতিবাচক।

আরো পড়ুন: ব্লু ডলফিন রুল ও মিল্ক কার্টন রুল—নেগেটিভ চিন্তা থেকে বের হওয়ার দুই পদ্ধতি

ইচ্ছাকৃতভাবে যখন কাউকে নকল করেন, তাহলে তা অ্যানাটমিক্যালি করার, অর্থাৎ সেই ব্যক্তির আচরণ হুবহু নকল করার আশঙ্কা বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, এরকম ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ে।

যেসব টিপস কাজে লাগাতে পারেন
ক্যামেলিওন ইফেক্টকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে এই টিপসগুলি ব্যবহার করতে পারেন:

  • সহানুভূতির চর্চা করুন: অন্যের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হওয়ার চেষ্টা করুন। সহানুভূতি হল নিজেকে অন্যের জায়গায় রেখে তাদের দিকটা বুঝতে চেষ্টা করা। আপনি যদি কারও প্রতি সহানুভূতিশীল হন, তাহলে ক্যামেলিওন ইফেক্ট স্বাভাবিকভাবে ঘটার সম্ভাবনা বাড়বে।
  • অন্যের কথা শুনুন: কথা বলার সময় অন্যের কথা শুনে বোঝার চেষ্টা করুন। শুধু সাড়া দেওয়ার জন্য কথা শুনবেন না।
  • সঠিক কারণে ব্যবহার করুন: আপনি যদি জোর করে নিজের সুবিধার জন্য ক্যামেলিওন ইফেক্ট ব্যবহার করার চেষ্টা করেন, তাহলে তারা বিষয়টি ধরতে পারবে ও তা নেতিবাচকতার জন্ম দেবে।
  • স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করুন: অন্যকে কীভাবে প্রভাবিত করা যায়, তা না ভেবে তাদের বোঝার চেষ্টা করুন। তাদের সাথে সুস্থ ও অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন।

ক্যামেলিওন ইফেক্টের কার্যকারিতার পেছনে একটি কারণ হল এটি অবচেতনে ও সহজাতভাবেই ঘটে। বিষয়টিকে যদি স্বাভাবিক ও অকৃত্রিম হিসাবে দেখা হয়, তাহলেই আপনি এর সুবিধাগুলি পাবেন। তাই, ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে অনুকরণ করা থেকে বিরত থাকুন। অন্যের কথা শোনা, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার দিকে বেশি মনোযোগ দিন।

মূল: তোকেতেমু ওহওভোরিওলে, অনুবাদ: জোহানা নিশো