গার্ডেল মার্টিনকে যখন খুঁজে পাওয়া গেল তখন তার পালস ছিল না, নিঃশ্বাসও বন্ধ ছিল।
ঘটনাটা এ বছর মার্চের। ১৫ মার্চ ২০১৫ বিকাল বেলায় বেশ আশ্চর্যজনক একটা ঘটনা ঘটল পেনসলভেনিয়ার মিফলিংবার্গ এলাকায়।
লুনা রুশদী
২২ মাস বয়সী গার্ডেল মার্টিন তার দুই ভাইয়ের সঙ্গে খেলছিল তাদের ৫ একর বাড়ির বিস্তৃত আঙিনায়। এক সময় দেখা গেল তার ভাইরা তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। ভাইদের একজন গ্রেগ (৭) বাড়ি এসে চিৎকার করছিল যে তারা গার্ডেলকে খুঁজে পাচ্ছে না। অনেক খুঁজেও যখন তার খোঁজ মিলল না তখন গার্ডেলের মা রোজি মার্টিনের মনে সন্দেহ উঁকি দিল, গার্ডেল বরফ গলতে থাকা খালের পানিতে পড়ে যায় নি তো!
গার্ডেলের দুই টিনেজ বোন যখন আরো বাইরের দিকটা খুঁজছে, তখন তিনি ৯১১ এ ফোন করছেন। আধা ঘণ্টা পর বাড়ি থেকে দূরে পাওয়া গেল গার্ডেলকে। পানিতে পড়ার পর ঠাণ্ডা বরফজলের স্রোতের টানে গার্ডেল ভেসে গিয়েছিল সিকি মাইল দূরে। খালে পড়ে থাকা গাছের ডালপালা ঝাড়ে আটকে ছিল তার নিস্পন্দ দেহ।
বছরের এ সময়টায় পেনসলভেনিয়ায় তাপমাত্রা প্রায়ই শূন্যের নিচে থাকে। বাফালো ক্রিকের শাখা নদীর বরফগলা পানি থেকে মার্টিনদের এক প্রতিবেশী উদ্ধার করেন গার্ডেলকে। গার্ডেলকে যখন খুঁজে পাওয়া যায় তখন তার পালস এবং নিঃশ্বাস দুইই বন্ধ ছিল। ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে সে আনুমানিক প্রায় ৩০ মিনিটের মত ভেসেছিল।
তাকে খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া হল। অ্যাম্বুলেন্স, প্যারামেডিকরা পৌঁছানোর পর তাকে অবিরাম সিপিআর দিতে দিতে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় ইভানজেলিকাল কম্যুনিটি হাসপাতালে, সেখান থেকে পরে হেলিকপ্টারে করে গেসিঙ্গারে।
গেসিঙ্গারে পৌঁছানোর পরও তার পালস পাওয়া যাচ্ছিল না। শরীরের তাপমাত্রা ছিল ৭৭ ডিগ্রি, মানুষের শরীরের সাধারণ তাপমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ ডিগ্রি নিচে। ডাক্তার আর নার্সদের ৩০ জনের একটা টিম গেসিঙ্গারে তার জ্ঞান ফেরানোর আর শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ফিরিয়ে আনার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।
ডাক্তার রিচার্ড ল্যাম্বারের কথায়, “তার পালস ছিল না, সে নিজে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল না, তার মস্তিষ্কের কাজ বন্ধ ছিল, সব চলছিল সিপিআরের মাধ্যমে। He’s dead।”
প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে ডাক্তারদের টিম তৈরি হচ্ছিল তার হার্ট বাইপাস সার্জারির জন্য। ঠিক তখন, প্রায় ২০ মিনিট চেষ্টার পরে, খুব হালকা ভাবে তার পালস টের পাওয়া যাচ্ছিল। ডাক্তাররা ঠিক করলেন আগের চেষ্টাই চালিয়ে যাবেন। গার্ডেল মার্টিনকে সিপি-আর দেয়া হয় সর্বমোট ১ ঘণ্টা ৪১ মিনিট। খুব ক্লান্তিকর কাজ, তাই বেশ কয়েকজন পালা করে করে কাজটা করেন।
শরীরের তাপমাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এলে তাকে ব্লাড প্রেশারের ওষুধ দিয়ে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়।
আশ্চর্যজনকভাবে, রাত ২টায় তার জ্ঞান ফেরে। দেখা যায় তার মস্তিষ্কের কোনো ক্ষতি হয় নাই।
৫দিন পরে বাবা-মায়ের সাথে বাড়ি ফিরে গেছে সে। বাড়ি ফিরে শিশুটি ভালো আছে, হাসিখুশি আছে এবং কথা বলছে।
২.
মৃত্যুর এত কাছ থেকে কীভাবে সে ফিরে এল? তার বেঁচে ফেরা প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হলেও এর পেছনে বড় দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত তার অল্প বয়স আর দ্বিতীয়ত সে যে ভীষণ ঠাণ্ডা পানিতে পড়েছিল, এই দুই তাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে।
কীভাবে?
৩.
ডুবে যাওয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি হলো শরীরে অক্সিজেনের অভাব অথবা হাইপোক্সিয়াজনিত কারণে মস্তিষ্ক ও হৃদপিণ্ডের আক্রান্ত হওয়া। ঠাণ্ডা পানি এই প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারে দুই উপায়ে।
প্রথমত, ঠাণ্ডা পানির কারণে শরীরে ‘ডাইভিং রিফ্লেক্স’ চালু হয়ে যায়। এর ফলে হৃদযন্ত্রের গতি কমে গিয়ে অক্সিজেন সংরক্ষণে সহায়তা করে এবং শরীরের অত্যাবশ্যক অংশে রক্তের যোগান দেয়, যেমন মস্তিষ্ক। আর কোনো এক কারণে বাচ্চাদের শরীরে এই প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি শক্তিশালী পূর্ণবয়স্কদের তুলনায়, সে কারণেই লম্বা সময় ডুবে থাকার পরেও একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের চেয়ে বাচ্চাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি।
দ্বিতীয় কারণ হলো, ভীষণ ঠাণ্ডা তাপমাত্রা আর তার মধ্যে খুব দ্রুত এত বেশি পরিমান পানি শরীরে ঢুকে যাওয়ায় হাইপোথারমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ৩০ ডিগ্রির নিচে যদি শরীরের তাপমাত্রা হয়, তাহলে মস্তিষ্কের কোষ প্রবলভাবে হাইপোক্সিয়া বাধা দিতে থাকে আর শরীরের শক্তি সংরক্ষণের চেষ্টা করতে থাকে। এ সময় শারীরিক শক্তির ব্যবহার প্রায় ৫০% কমে যায়।
মানুষের শরীরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে, তবে শিশুদের শরীরে এই ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিকাশ হয় না। তাই তাদের হাইপোথারমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বাচ্চাদের শরীরে বড়দের তুলনায় কম চর্বি থাকায় তাদের শরীর বেশি তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয় আর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে কম দক্ষ হয়। যা এ ক্ষেত্রে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে।
গার্ডেলের মা রোজের ভাষায়, “আমার কোনো সন্দেহ নেই যে এটা একটা অলোকিক ঘটনা। ইশ্বর সঠিক সময়ে সঠিক লোকদের সঠিক স্থানে এনেছিলেন এবং তারা অবিশ্বাস্য একটা কাজ করেছে।”