বিজ্ঞানি ও উদ্ভাবক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলকে টেলিফোন যন্ত্রের আবিষ্কারক ধরা হয়ে থাকে। তিনি যখন ১২ বছরের বালক, তখন থেকেই ধীরে ধীরে কানে কম শোনা শুরু করেন তার মা। পুরোপুরি বধির হওয়ার আগে মায়ের কপালের কাছে দাঁড়িয়ে একদম পরিষ্কার ও নিয়ন্ত্রিত কণ্ঠে আলাপ করার এক উপায় বের করেছিলেন তিনি।

পরে মায়ের সাথে কথাবার্তা চালানোর জন্যে বেল আঙুলের ইশারায় কথা বুঝিয়ে দেওয়ার এক ধরনের ভাষা রপ্ত করেন।

বসার ঘরে মায়ের পাশে বসে থেকে এই ভাষা ব্যবহার করে চুপচাপ পরিবারের বাকিদের কথাগুলি মা’কে বলে যেতেন বেল।


আয়মান আসিব স্বাধীন


বধির মায়ের সাথে সময় কাটানোর ফলেই অ্যাকুইস্টিক্স এর ব্যাপারে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের আগ্রহ তৈরি হয়। গ্যাস, তরল এবং কঠিন পদার্থে ভাইব্রেশন ও শব্দসহ সব রকম যান্ত্রিক তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি।

মেবেল হাবার্ড, ১৩ বছর বয়সের ছবি

গ্রাহাম বেল আমেরিকার বস্টনে বধিরদের জন্য ১৮৭২ সালে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুলের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক বধির ছাত্র-ছাত্রীর সাথে পরিচয় হয় তার। এদের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত শিক্ষার্থী ‘হেলেন কেলার’। এই মূক, বধির ও অন্ধ ভদ্রমহিলা তার জীবনে ‘নীরবতা ভেঙে দেওয়ার জন্য’ গ্রাহাম বেলের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন আজীবন।

গ্রাহাম বেল এবং সেসময়কার অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিই এমন মনে করতেন যে, বধিরতা যেভাবেই হোক নির্মূল করা প্রয়োজন।

তাদের বিশ্বাস ছিল, সমাজে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার এই অন্তরায় থেকে মুক্তি দিতে বধিরদের কথা বলার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের এ রকম ধারণা থেকে অবশ্য বধিরদের কিছু স্কুলে হিতে বিপরীত হওয়ার ঘটনা দেখা যায়।

কিছু কিছু শিক্ষক বধির ছাত্র-ছাত্রীদের হাত বেঁধে রাখতেন, যাতে করে তারা চাইলেও সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে কথা বলতে না পারে; এতে হয়ত তারা মুখ দিয়ে কথা বলতে বাধ্য হবে— এই আশায়।

বেল ও মেবেল

সকাল-বিকাল শিক্ষকতা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় গ্রাহাম বেল তার বোর্ডিং হাউজে রাত জেগে এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন।

কেউ যাতে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে জানতে না পারে সেজন্য তার নোটবুক লুকিয়ে ও ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি ভাল করে তালা মেরে রাখতেন তিনি। এক সময় তার স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া শুরু হয়। প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে ১৮৭৩ সালের বসন্তে বস্টনে ফিরে আসেন বেল। এরপর শব্দ নিয়ে তার গবেষণায় মনোযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

১৮৭৬ সালে টেলিফোন প্যাটেন্ট করেছিলেন আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল। ১৮৯২ সালের ১৮ অক্টোবর নিউ ইয়র্ক থেকে শিকাগো পর্যন্ত ১৫২০ কিলোমিটারের টেলিফোন সংযোগের উদ্বোধন করছেন গ্রাহাম বেল।

তিনি বস্টনের লাভজনক শিক্ষকতার কাজ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাই মাত্র দুইজন শিক্ষার্থীর সাথেই কাজ করতেন তিনি।

একজন আজন্ম বধির ৬ বছর বয়সী ছেলে জর্জি স্যান্ডার্স ও অন্যজন ১৫ বছরের মেয়ে মেবেল হাবার্ড।

জর্জির বাবা থমাস স্যান্ডার্স গ্রাহাম বেলকে জর্জির দাদির বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন, যেখানে জর্জির সাথে কাজ করার পাশাপাশি একটি রুমকে ল্যাবরেটরি বানিয়ে তাতে নিজের গবেষণা করার সুযোগ পেতেন বেল।

অন্যদিকে সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী মেবেল বয়সে বেলের চাইতে দশ বছরের ছোট হলেও পরবর্তীতে তাদের মাঝে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়।

মেবেলের বাবা গার্ডিনার গ্রিন হাবার্ডের সাথে গ্রাহাম বেলের ভাল বন্ধুত্ব ছিল। ‘স্কারলেট’ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পাঁচ বছর বয়সে বধির হয়ে যাওয়া মেবেল ঠোঁটের ওঠানামা দেখে অন্যদের কথা বুঝতে পারতেন। তবুও তার বাবা তাকে গ্রাহাম বেলের সাহচর্যে থাকার পরামর্শ দেন।

বেল ও মেবেল, ১৮৮৪

এর কয়েক বছর পরেই আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল বিশ্বের প্রথম টেলিফোন আবিষ্কার করেন।

১৮৭৬ সালে ফিলাডেলফিয়ার বার্ষিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এই নতুন আবিষ্কৃত যন্ত্রটি গোটা বিশ্বে প্রচার করার ব্যবস্থা করে। অথচ শিক্ষকতা নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকায় বেল সেই অনুষ্ঠানে যেতেই চান নি।

বাগদত্তা মেবেল তার এই ইতস্তত ভাবটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই হবু স্বামীকে ফিলাডেলফিয়া পাঠানোর জন্যে কাউকে কিছু না জানিয়েই ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলেন। তারপর সুন্দর করে ব্যাগ গুছিয়ে বেলকে অন্য জায়গায় যাবার কথা বলে নিয়ে আসেন স্টেশনে।

দুই মেয়ে এলসি ও ম্যারিয়ানের সঙ্গে বেল ও মেবেল, ১৮৮৫

হতবুদ্ধি বেল প্রেমিকার এরকম কাণ্ডে বেশ খেপে যান। চেঁচামেচি শুরু করে দেন তিনি। আর মেবেল আস্তে করে অন্যদিকে তাকিয়ে আক্ষরিক অর্থেই বেলের চিৎকার না শোনার ভান করতে থাকেন।

‘বেল টেলিফোন কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরেই ১৮৭৭ সালের ১১ জুলাই মেবেলের পৈতৃক নিবাস ক্যাম্ব্রিজে বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে ফেলেন তারা। যদিও তাদের মাঝে সম্পর্ক চলছিল কয়েক বছর ধরেই, কিন্তু আর্থিকভাবে সচ্ছল ও নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না বেল।

এই দম্পতি চার সন্তানের মা-বাবা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাদের দুই ছেলে একেবারে শিশু থাকতেই মারা যায়।

১৯২২ সালের ২ আগস্ট রাত দুইটায় নিজ বাড়িতে ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতার কারণে মৃত্যু হয় আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের। তার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্ত্রী মেবেল, কন্যা ডেইজি ও ডেইজির স্বামী। মৃত্যুর আগে জানালা দিয়ে প্রিয় পাহাড়চূড়ায় চাঁদ ওঠা দেখছিলেন বেল। অশ্রুসিক্ত মেবেল ফিস ফিস করে বললেন, “আমাকে ছেড়ে যেও না…।”

বেল হাতের ইশারায় জানালেন, “কখনো না।”

বেল ও মেবেল। এই ডকে বেশির ভাগ এক্সপেরিমেন্টের প্রদর্শন করতেন বেল।

স্বামীর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে চোখের জ্যোতি হারাতে থাকেন মেবেল। ফলে মেয়েদের সাহচর্যে একেবারে নীরব ও অন্ধকার জীবন কাটান কিছুদিন।

এর এক বছর যেতে না যেতেই মৃত্যু হয় তার। নিজেদের বাড়ির সেই পাহাড়চূড়ার এক টুকরো গ্রানাইট পাথরের নিচে কবর দেওয়া হয় তাকে—তার স্বামীর একদম পাশেই।