কোনো খেলার সাথী, টিভি, কম্পিউটার গেমস ছাড়া, এবং কয়েক ঘণ্টা ধরে সঙ্গীত চর্চা করা কি সুখী সন্তান তৈরি করতে পারে? আর কী ঘটে যখন তারা প্রতিবাদ করে বসে?
চাইনিজ মায়েরা কেন সুপিরিয়র
অ্যামি চুয়া
অনেকেই আশ্চর্য হয়ে ভাবেন কীভাবে চীনা বাবা-মায়েরা এই ধরনের সফল বাচ্চাদের বড় করে তোলেন। তারা ভাবেন এই মা-বাবারা এতগুলি গণিত বিশারদ এবং সঙ্গীতের প্রতিভা তৈরি করার জন্যে কী করেন। এই ধরনের পরিবারের ভিতরটি আসলে কেমন, এবং তারা নিজেরাও এমনটি করতে পারবেন কিনা। আমি তাদের এই ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারি, কারণ আমি নিজে এমনটি করেছি। আমার দুই মেয়ে সোফিয়া ও লুইসা’র যা যা করার অনুমতি নেই তার কয়েকটি হল:
• ঘরের বাইরে রাত কাটানো
• প্লে-ডেট
• স্কুল নাটকে অংশ গ্রহণ করা
• স্কুল নাটকে অংশ গ্রহণ করতে না পারা নিয়ে অভিযোগ করা
• টিভি দেখা বা কম্পিউটার গেমস খেলা
• নিজেদের পছন্দমত এক্সট্রাকারিকুলার একটিভিটিজ নির্বাচন করা
• A এর নিচে কোনো গ্রেড পাওয়া
• জিম এবং ড্রামা ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ে প্রথম হতে না পারা
• পিয়ানো ও ভায়োলিন ছাড়া অন্য কোনো সঙ্গীত যন্ত্র বাজানো
• পিয়ানো ও ভায়োলিন না বাজানো
(২) আমি শিথিলভাবে “চাইনিজ মা” শব্দটি ব্যবহার করছি। আমি এমন কিছু কোরিয়ান, ভারতীয়, জামাইকায়ান, আইরিশ এবং ঘানায়ান অভিভাভকদের জানি যারা এই দলে আছেন। উল্টাভাবে, আমি অনেক মায়েদের জানি যারা চাইনিজ বংশোদ্ভূত হলেও বেশিরভাগই জন্মেছেন পশ্চিমে। জীবনযাত্রার ধরন বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, এরা চাইনিজ মা নন। আমি “পশ্চিমা অভিভাবক” শব্দটিও আলগাভাবে ব্যবহার করছি। পশ্চিমা অভিভাভক সব জাতেরই আছেন।
ব্যাটল হাইম অব দ্য টাইগার মাদার (২০১১) থেকে
অনুবাদ: দীপ্র আসিফুল হাই
(৩) সর্বোপরি, পশ্চিমা অভিভাবকরা যখন মনে করেন যে তারা খুবই কঠোর হচ্ছেন, তখনও তারা সাধারণত চাইনিজ মায়েদের ধারেকাছেও আসেন না। উদাহরণস্বরূপ, আমার পশ্চিমা বন্ধুরা যারা নিজেকে কঠোর বলে মনে করেন, তারা তাদের শিশুদের প্রতিদিন ৩০ মিনিটের জন্য তাদের যন্ত্র অনুশীলন করান। একজন চাইনিজ মায়ের জন্যে প্রথম ঘণ্টা হল সহজ পাঠ। আসল কষ্ট তো শুরু হয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঘণ্টায়।
(৪) কালচারাল স্টেরিওটাপ নিয়ে আমাদের খুঁতখুঁতানি সত্ত্বেও অসংখ্য গবেষণায় অভিভাবকত্বের বেলায় চাইনিজ এবং পশ্চিমাদের মধ্যে নির্দিষ্ট ও পরিমাণযোগ্য পার্থক্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। ৫০ জন আমেরিকান মা এবং ৪৮ জন চীনা অভিবাসী মায়েদের নিয়ে একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় ৭০% পশ্চিমা মায়েরা দাবি করেছেন, “শিক্ষাগত সাফল্যের উপর জোর দেওয়া শিশুদের জন্যে ভাল নয়” এবং “মা-বাবার এই ধারণা পোষণ করা উচিৎ যে শিক্ষা হবে আনন্দময়।”
(৫) অন্যদিকে, প্রায় ০% চীনা মায়েরা একমত পোষণ করেছেন। বেশিরভাগ চীনা মায়ের দাবি, তারা বিশ্বাস করেন যে তাদের সন্তানরা সেরা শিক্ষার্থী হতে পারে। আর একাডেমিক কৃতিত্ব মা-বাবার সাফল্যকে প্রতিফলিত করে। আর যদি বাচ্চারা স্কুলে ভালো না করে তবে কোনো ‘সমস্যা’ আছে এবং তাদের বাবা-মা নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন না। অন্যান্য গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে পশ্চিমা অভিভাবকদের তুলনায় চীনা অভিভাভকরা তাদের বাচ্চাদের সাথে প্রতিদিন একাডেমিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ে আনুমানিক ১০ গুণ বেশি সময় ব্যয় করেন। বিপরীতে, পশ্চিমা শিশুদের খেলাধুলায় অংশ গ্রহণের হার বেশি।
(৬) চাইনিজ মা-বাবা যা বোঝেন তা হ’ল কোনো কিছুতে পারদর্শী না হওয়া পর্যন্ত সেটা আনন্দময় হতে পারে না। কোনো কিছুতে পারদর্শী হয়ে উঠতে হলে পরিশ্রম করতে হবে, আর বাচ্চারা নিজে থেকে কোনো কাজ করতে চায় না। তাই তাদের পছন্দকে অগ্রাহ্য করাটা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে মা-বাবাকে ধৈর্য্য ধরতে হয়, কারণ বাচ্চারা কথা শুনতে চায় না। সবকিছুই শুরুতে কঠিন হয়। আর এই সময়েই পশ্চিমা অভিভাবকরা হাল ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা দেখান। তবে যদি সঠিকভাবে করা হয় তবে চীনা কৌশলটি একটি উৎকৃষ্ট প্রক্রিয়া তৈরি করে।
(৭)) কঠোর অনুশীলন, অনুশীলন ও অনুশীলন শ্রেষ্ঠত্বের জন্য অপরিহার্য। অথচ, আমেরিকায় পুনরাবৃত্তিকে অবহেলা করা হয়। যখন কোনো শিশু কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে শুরু করে―এটি গণিত, পিয়ানো, পিচিং বা ব্যালে যাই হোক না কেন―সে প্রশংসা, তারিফ এবং পরিতৃপ্তি পেয়ে যায়। এটি আত্মবিশ্বাস তৈরি করে এবং একসময় যা নিরানন্দময় ছিল তাকে আনন্দময় করে তোলে।
এর ফলে মা-বাবার পক্ষে সন্তানকে দিয়ে আরও বেশি পরিশ্রম করানো সহজ হয়।
(৮) চাইনিজ বাবা-মায়েরা অনেক কিছু করে পার পেয়ে যান যা পশ্চিমা বাবা-মায়েরা পারেন না। আমার ছেলেবেলায় এক বা একাধিকবার যখন আমি আমার মায়ের প্রতি অত্যন্ত অসম্মান দেখিয়েছিলাম, তখন আমার বাবা ক্রুদ্ধভাবে আমাদের স্থানীয় হক্কিয়েন উপভাষায় আমাকে ‘আবর্জনা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। এটি সত্যিই ভাল কাজ করেছিল। আমি যা করেছি তা নিয়ে আমার ভয়ানক অনুশোচনা হয়েছিল এবং আমি গভীরভাবে লজ্জিত হয়েছিলাম। তবে এতে আমার আত্মসম্মান বোধ নষ্ট হওয়া বা এমন কিছু ঘটেনি। আমি জানতাম আমাকে নিয়ে তার ধারণা কত উঁচু। আমি মোটেই নিজেকে অপদার্থ ভাবিনি, কিংবা নিজেকে আমার আবর্জনার টুকরা বলেও মনে হয়নি।
(৯) একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে, আমি একবার সোফিয়ার সাথে একই জিনিস করেছিলাম। আমি তাকে ইংরেজিতে ‘আবর্জনা’ বলেছিলাম যখন সে আমার সাথে অত্যন্ত অসাম্মানজনক আচরণ করেছিল। একটি ডিনার পার্টিতে যখন আমি ঘটনাটি উল্লেখ করি, তখন তাৎক্ষণিকভাবে সবাই আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। মার্সি নামে এক অতিথি এতটাই মন খারাপ করে যে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। আমার বন্ধু সুসান, পার্টির আয়োজক, আমাকে বাকি অতিথিদের সাথে আবার মিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল।
(১০) আসল বিষয়টি হ’ল চাইনিজ মা-বাবারা অনেক কিছু করতে পারে যা কল্পনাও করা যায় না। এগুলি এমনকি পশ্চিমাদের কাছে আইনত দণ্ডনীয় হতে পারে। চাইনিজ মায়েরা তাদের মেয়েদের বলতে পারেন, “ওহে ফ্যাটি―কিছুটা ওজন কমাও।” উল্টাদিকে, পশ্চিমা মা-বাবাদের এই সমস্যাটি সম্পর্কে অতি সাবধানে আলোচনা করতে হবে। আলোচনাটি হতে হবে “সুস্বাস্থ্য” বিষয়ে এবং ভুলেও এফ (F) শব্দটির উল্লেখ করা যাবে না। এরপরেও তাদের সন্তানদের খাদ্য সমস্যা এবং নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে থেরাপি নিতে হয়। এবং তাদের বাচ্চারা এখনও খাওয়ার ব্যাধি এবং নেতিবাচক স্ব-ইমেজ থেরাপি করে। (আমি একবারও একজন পশ্চিমা বাবাকে তার প্রাপ্তবয়স্ক কন্যাকে আদর করে “সুন্দরী এবং অবিশ্বাস্যভাবে দক্ষ” সম্বোধন করতে শুনেছিলাম। মেয়েটি পরে আমাকে বলেছিল এর ফলে তার নিজেকে আবর্জনা বলে মনে হয়েছে।)
(১১) চাইনিজ বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের সরাসরি A পাওয়ার জন্যে নির্দেশ দিতে পারেন। পশ্চিমা বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের কেবল সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে বলতে পারেন। চাইনিজ বাবা-মা বলতে পারেন, “তুমি অলস। তোমার সমস্ত সহপাঠী তোমার চেয়ে এগিয়ে চলেছে।” অন্যদিকে, পশ্চিমা অভিভাবকদের কৃতিত্ব সম্পর্কে তাদের নিজস্ব দ্বন্দ্ব বোধের সাথে লড়াই করতে হয়, এবং নিজেদের বোঝাতে হয় যে তাদের সন্তানেরা যেভাবে বেড়ে উঠছে এ নিয়ে তাদের কোনো হতাশা নেই।
চাইনিজ বাবা-মা কীভাবে তারা যা করেন তা করা সত্ত্বেও পার পেয়ে যান সে বিষয়ে আমি অনেক চিন্তা করেছি। আমি মনে করি চীনা এবং পশ্চিমা মা-বাবাদের মনস্তত্ত্বের মধ্যে তিনটি বড় পার্থক্য রয়েছে।
(১২) প্রথমত, আমি লক্ষ্য করেছি যে পশ্চিমা মা-বাবারা তাদের সন্তানের আত্ম-সম্মান সম্পর্কে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। তারা যদি কোনো কিছুতে ব্যর্থ হয় তবে তাদের শিশুরা কেমন বোধ করবে তা নিয়ে তারা চিন্তিত। সন্তানেরা পরীক্ষায় মোটামুটি ফল করলেও তারা ক্রমাগত বাচ্চাদের বোঝাতে থাকেন যে তারা কত ভাল।
অন্য কথায়, পশ্চিমা অভিভাবকরা তাদের বাচ্চার মনোজগৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। চাইনিজ বাবা-মা নন। তারা ভঙ্গুরতা নয়, জোর দেন শক্তির উপর। ফলস্বরূপ, তাদের আচরণও হয় ভিন্ন।
(১৩) উদাহরণস্বরূপ, কোনো শিশু যদি পরীক্ষায় এ-মাইনাস নিয়ে বাড়িতে আসে, তবে একজন পশ্চিমা অভিভাবক বড়জোর সন্তানের প্রশংসা করবেন। চীনা মা কোথায় ভুল হয়েছে তাই নিয়ে হৈচৈ বাঁধিয়ে দিবেন। যদি শিশুটি পরীক্ষায় বি পেয়ে বাড়িতে আসে তবুও পশ্চিমা কিছু বাবা-মা সন্তানের প্রশংসা করবেন। অন্যান্য পশ্চিমা মা-বাবারা তাদের সন্তানকে সামনে বসিয়ে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করবেন। তবে তারা সতর্ক থাকবেন যেন তাদের সন্তান নিজেকে অযোগ্য ও অনিরাপদ মনে না করে, এবং তারা তাদের সন্তানকে “বোকা,” “অকেজো” বা “অসম্মানজনক” বলবেন না।
(১৪) ব্যক্তিগতভাবে, পশ্চিমা অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন হতে পারেন যে তাদের সন্তান পরীক্ষায় ভাল করছে না, অথবা বিষয়টিতে তার সন্তানের আগ্রহ কম। কিংবা, পাঠ্যক্রম এমনকি সম্ভবত পুরো স্কুলটিতেই কিছু একটা ত্রুটি রয়েছে। যদি সন্তানের গ্রেড ভাল না হয় তবে তারা শেষ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করে বিষয়টি কীভাবে শেখানো হচ্ছে তা চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। অথবা, শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারেন।
(১৫) যদি কোনো চীনা শিশু ‘বি’ পায়―যা প্রায় কখনোই ঘটে না―প্রথমেই শুরু হবে চিৎকার ও চুল ছেঁড়ার মত বিস্ফোরণ। বিধ্বস্ত চীনা মা তখন কয়েক ডজন, এমনকি শত শত অনুশীলন পরীক্ষা নেবে এবং যতক্ষণ না গ্রেড ‘এ’ হচ্ছে ততক্ষণ সন্তানের সাথে লেগে থেকে কাজ করবে।
(১৬) চাইনিজ অভিভাবকেরা নিখুঁত গ্রেড দাবি করেন কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে তাদের সন্তানেরা এটি পাওয়ার যোগ্য।
যদি তাদের সন্তানেরা এটি না পায় তবে চীনা মা-বাবারা ধরে নেন তাঁদের সন্তানেরা যথেষ্ট পরিশ্রম করেনি। এজন্য নিম্নমানের পারফরম্যান্সের সমাধান হল প্রচণ্ড সমালোচনা করা, শাস্তি দেয়া এবং লজ্জা দেয়া। চাইনিজ অভিভাবকেরা বিশ্বাস করেন যে তাদের সন্তান লজ্জা নেয়ার মত শক্তি অর্জন করবে এবং এর থেকে উন্নতি করবে। (এবং যখন চীনা বাচ্চারা দক্ষতা অর্জন করে, তখন বাবা মায়ের কাছ থেকে বাসার প্রচুর প্রশংসা পাওয়া যায়।)
(১৭) দ্বিতীয়ত, চাইনিজ মা-বাবারা বিশ্বাস করেন, তাদের বাচ্চারা তাদের কাছে সব কিছুর জন্যে ঋণী। এর কারণটা কিছুটা অস্পষ্ট। তবে এটি সম্ভবত তৈরি হয়েছে কনফুসিয়াসের মতবাদে পিতামাতার প্রতি সন্তানের ভক্তি এবং বাবা-মা তাদের সন্তানদের জন্য এত বেশি ত্যাগ স্বীকার করার সংমিশ্রণের ফলে। (এবং এটা সত্য যে চাইনিজ মায়েরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করেন সন্তানকে প্রশিক্ষণ দিতে, জিজ্ঞাসাবাদ করতে এবং তাদের পিছনে গুপ্তচরবৃত্তি করতে।) যাহোক, কথা হল এই যে চাইনিজ সন্তানদের সারাজীবন ব্যয় করতে হয় বাধ্যগত থেকে এবং সফল হওয়ার মাধ্যমে মা-বাবার ঋণ শোধ করতে করতে।
(১৮) অন্যদিকে, আমার মনে হয় না অধিকাংশ পশ্চিমা মা-বাবারা মনে করেন যে সন্তানেরা তাদের কাছে সারাজীবনের জন্যে ঋণী। আমার স্বামী জেড-এর দৃষ্টিভঙ্গি আসলে একদমই উল্টা। সে একবার আমাকে বলেছিল, “সন্তানেরা বাবা-মাকে বেছে নেয় না। তারা এমনকি জন্মাবে কিনা সেটাও ঠিক করে না। মা-বাবারাই সন্তানদের জীবন দান করেন। তাই এটা পিতামাতার কর্তব্য সন্তানকে লালন-পালন করা। মা-বাবার কাছে সন্তানদের কোনো ঋণই নেই। তাদের দায়িত্ব হল তাদের সন্তানদের জন্যে।” আমার কাছে এটি পশ্চিমা অভিভাবকদের জন্যে একটি ভয়ানক ব্যাপার বলে মনে হয়েছে।
(১৯) তৃতীয়ত, চাইনিজ মা-বাবারা মনে করেন তাদের সন্তানদের জন্যে কী সবচেয়ে ভালো তা তারা জানেন। তাই, সন্তানদের নিজস্ব ইচ্ছা ও পছন্দকে তারা অগ্রাহ্য করেন। এইজন্যেই চাইনিজ মেয়েদের হাইস্কুলে বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারে না, আর চাইনিজ বাচ্চারা স্লিপওয়ে ক্যাম্পে যেতে পারে না। আর ঠিক এই কারণেই কোনো চাইনিজ শিশু তার মাকে বলতে পারে না, “আমি স্কুল নাটকে একটা গ্রাম্য চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর বিকাল ৩টা থেকে ৭টা পর্যন্ত আমাকে রিহার্সালের জন্যে থাকতে হবে। আর উইকএন্ডে আমাকে রিহার্সালে পৌঁছে দিতে হবে।” এমন দুঃসাহস যে চাইনিজ বাচ্চা দেখাবে ঈশ্বর তার সহায় হোন!
(২০) আমাকে ভুল বুঝবেন না। এমন নয় যে চাইনিজ মা-বাবারা তাদের সন্তানদের মঙ্গল চান না। আসলে ব্যাপারটা ঠিক উল্টা। তারা তাঁদের সন্তানদের জন্যে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। আসলে, এটা একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের সন্তান পালনের পদ্ধতি।
চাইনিজ স্টাইলে জোরজবস্তি’র সপক্ষে একটি গল্প বলি। লুলু’র বয়স তখন সাত। তখনো সে দুইটা সঙ্গীতযন্ত্র বাজায়, আর পিয়ানো-তে ফ্রেঞ্চ কম্পোজার জাঁক ইবার্ট’র “দ্য লিটল হোয়াইট ডংকি” বাজানো শিখছে। এই সুরটি খুবই মজার। শুনলেই আপনি কল্পনায় দেখতে পাবেন একটা ছোট্ট গাধা তার মনিবের সাথে গ্রামের রাস্তা ধরে হেলতে দুলতে যাচ্ছে। কিন্তু শিশুদের জন্যে এই সুর তোলা খুবই জটিল, কারণ দুই হাতের ছন্দের পার্থক্য এত বেশি যে একদম পাগল হওয়ার উপক্রম হয়।
(২১) লুলু এটি শিখতে পারছিল না। আমরা একটানা এক সপ্তাহ এটা নিয়ে কাজ করেছি, বার বার তার দুই হাতকে আলাদাভাবে অনুশীলন করিয়ে। কিন্তু যখনই আমরা দুই হাতকে একসাথে কাজ করাতে যাই, ততবারই একটার সাথে আরেকটা উলটপালট হয়ে যায়। ফলে, সবকিছু ভেস্তে যায়। শেষপর্যন্ত, অনুশীলনের আগের দিন, লুলু রেগেমেগে ঘোষণা দিলো যে সে হাল ছেড়ে দিয়েছে এবং সেখান থেকে চলে যায়।
―“পিয়ানো-তে ফিরে আসো,” আমি আদেশ দিলাম।
―“তুমি আমাকে বাধ্য করতে পারো না।”
―“অবশ্যই পারি!”
(২২) পিয়ানো-তে বসে লুলু আমার উপর ঝাঁঝ মিটিয়েছিল। সে ঘুষি মেরেছে, আঘাত করেছে, লাথি দিয়েছে। সে স্বরলিপি ছিড়ে টুকরা টুকরা করেছে। আমি স্বরলিপিটি আবার জোড়া লাগিয়ে একটি প্লাস্টিক শিল্ডের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম, যেন আর কখনোই এটা নষ্ট করা না যায়। আমি লুলুর ডলহাউজটি গাড়িতে তুলে বলেছিলাম যদি সে পরের দিনের মধ্যে “দ্য লিটল হোয়াইট ডংকি” নিখুঁতভাবে না শিখে তাহলে আমি সালভেশন আর্মির কাছে এটি টুকরা টুকরা করে দান করে দেব।
(২৩) লুলু আমাকে বললো, “আমি তো ভেবেছি তুমি সালভেশন আর্মির কাছে যাচ্ছো। তো, এখনো এখানে কী করো?” তখন আমি হুমকি দিলাম আগামী দুই, তিন, চার বছর তাকে কোনো লাঞ্চ, ডিনার, ক্রিসমাস অথবা হানুকাহ উপহার দিব না। এমনকি কোনো বার্থ-ডে পার্টিও না। তারপরেও যখন সে উল্টাপাল্টা বাজিয়ে যেতে লাগল তখন আমি তাকে বললাম, সে ইচ্ছে করে এরকম পাগলের মত করছে কারণ সে জানে যে সে আসলে এটি বাজাতে পারবে না। আমি তাকে বললাম অলস, ভীতু, আত্মকেন্দ্রিক এবং হতভাগা না হতে।
(২৪) জেড আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেল। সে আমাকে বললো লুলুকে অপমান না করতে ―যা আমি মোটেও করছিলাম না। আমি শুধু তাকে উৎসাহিত করছিলাম। তার মতে লুলুকে হুমকি দেয়াটা ভালো হচ্ছে না। সে আরো বললো, আমি কি এই ব্যাপারটি ভেবে দেখেছি যে হয়ত লুলু আসলেই কৌশলটি ধরতে পারছে না, তার হয়ত এখনো সমন্বয়টি আসে নি।
আমি বললাম, “তার ওপর তোমার কোনো ভরসা নেই।”
জেড রেগে গিয়ে বললো, “এটা অবান্তর! অবশ্যই আমার তার ওপর ভরসা আছে।”
“সোফিয়া এই বয়সে এই সুরটি বাজাতে পারত।”
“কিন্তু লুলু আর সোফিয়া দুইজন ভিন্ন ব্যক্তি,” জেড যুক্তি দিল।
(২৫) আমি চোখ উল্টে বললাম, “ওহ না, এটা নয়।” আমি ব্যঙ্গ করে ওকে অনুকরণ করে বললাম, “প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ বিশেষ গুণে বিশিষ্ট। এমনকি পরাজিতরাও তাদের নিজেদের বিশেষ গুণে বিশিষ্ট। যাহোক, তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই, তোমাকে একটা আঙুলও নাড়তে হবে না। যতই সময় লাগুক আমি লেগে থাকতে রাজি আছি। আমি খুশি মনেই অপছন্দের ভাগীদার হব। আর তুমি হবে পছন্দের মানুষ কারণ তুমি তাদের প্যানকেক বানিয়ে দাও আর ইয়েংকিদের খেলা দেখাতে নিয়ে যাও।”
(২৬) আমি আস্তিন গুটিয়ে আবার লুলুর কাছে ফিরে গেলাম। আমার মাথায় যা আসে সব ধরনের অস্ত্র এবং কৌশল ব্যবহার করলাম। রাতের খাবারের সময় পেরিয়ে গেল কাজ করতে করতে। আমি লুলুকে একবারের জন্যেও উঠতে দেই নি, এমনকি পানি খাওয়া কিংবা বাথরুমে যাওয়ার জন্যেও নয়। বাসা পুরো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। চিৎকার করতে করতে আমার গলা দিয়ে আর আওয়াজ বের হচ্ছিল না। কিন্তু অগ্রগতি যা হচ্ছিল সবই নেতিবাচক। শেষপর্যন্ত আমার আত্মবিশ্বাসও টলতে শুরু করল। তারপর, আচমকা, লুলু সঠিকভাবে কাজটা করতে পারল। তার দুই হাতের মধ্যে হঠাৎ সমন্বয় চলে এল। সহসা, তার ডান এবং বাম হাত অকপটে তাদের নিজেদের কাজ করতে লাগল।
(২৭) লুলু আর আমি একই সময়ে বিষয়টি বুঝতে পারলাম। আমি শ্বাস আটকে ফেললাম। সে পরীক্ষামূলকভাবে আবার চেষ্টা করল। তারপর সে আরো আত্মবিশ্বাস ও দ্রুততার সাথে বাজাতে লাগল, আর তালও ধরে রাখছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই, সে একদম ঝলমল করছিল।
“মা, দেখো―এটা খুবই সহজ!” এরপরে সে এই সুরটি বার বার বাজাতে চাইল, আর একবারও পিয়ানো থেকে সরতে চায় নি। সেই রাতে, সে আমার বিছানায় ঘুমাতে আসল। আমরা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, আর হাসিতে ফেটে পড়ছিলাম। কয়দিন পরে এক অনুষ্ঠানে সে যখন “দ্য লিটল হোয়াইট ডংকি” বাজিয়েছিল তখন অন্য অভিভাবকরা আমার কাছে এসে বলেছিলেন, “এই সুরটা দারুণ এবং লুলুর জন্যে একদম মানানসই।”
(২৮) এমনকি জেডও এক্ষেত্রে আমার কৃতিত্ব স্বীকার করেছে। পশ্চিমা মা-বাবারা তাদের সন্তানদের আত্ম-বিশ্বাস নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করেন। অথচ, অভিভাবক হিসেবে আপনার সন্তানের আত্মবিশ্বাসের নিয়ে সবচেয়ে খারাপ যে কাজটি আপনি করতে পারেন তা হল তাদেরকে হার স্বীকার করে নিতে দেয়া। অন্যদিকে, আপনি যা করতে পারবেন না বলে ভাবছেন তা আপনি করতে পারবেন এটি শিখতে পারাই হল আত্মবিশ্বাস তৈরির সবচেয়ে ভালো উপায়।
(২৯) অনেক নতুন বই প্রকাশ হচ্ছে যেখানে এশিয়ান মায়েদের বর্ণনা করা হচ্ছে ধূর্ত, নিষ্ঠুর, মাত্রাতিরিক্ত কর্মঠ হিসেবে, যাদের নিজেদের সন্তানদের সত্যিকারের ইচ্ছার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। চাইনিজরা আবার মনে মনে বিশ্বাস করে যে তারা নিজেদের সন্তানের প্রতি বেশি যত্নশীল এবং অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত, অন্তত পশ্চিমাদের চাইতে যারা কিনা নিজেদের সন্তানদের খারাপভাবে বেড়ে ওঠা বিষয়ে পুরাপুরি ওয়াকিবহাল।
(৩০) পশ্চিমা অভিভাবকেরা নিজেদের সন্তানদের স্বাতন্ত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে চেষ্টা করেন, তাদের সত্যিকারের ইচ্ছাকে উৎসাহিত করেন, তাদের পছন্দকে সমর্থন করেন, ইতিবাচক শক্তির এবং একটি সযত্ন পরিবেশের যোগান দেন। উল্টাদিকে, চাইনিজেরা বিশ্বাস করেন, তাদের সন্তানকে রক্ষা করার সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হল তাদের ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুত করা, তাদেরকে নিজেদের সামর্থ্যটুকু বুঝতে দেয়া, এবং দক্ষতা, কাজের অভ্যাস ও অভ্যন্তরীণ আত্মবিশ্বাসের অস্ত্র দিয়ে তাদের সজ্জিত করা যা কেউ কোনোদিন কেড়ে নিতে পারবে না।
লেখক পরিচিতি
অ্যামি লিন চুয়া আমেরিকান লেখক ও অধ্যাপক। তিনি ইয়েল ল স্কুলে আইন পড়ান। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক লেনদেন, আইন ও উন্নয়ন, জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং বিশ্বায়ন বিষয়ে তার পেশাগত দক্ষতা রয়েছে। ২০১১ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির একজন ঘোষণা করে।
তার বই ওয়ার্ল্ড অন ফায়ার: হাউ এক্সপোর্টিং ফ্রি মার্কেট ডেমোক্রেসি ব্রিডস এথনিক হেইট্রেড অ্যান্ড গ্লোবাল ইনস্ট্যাবিলিটি (২০০৩); ডে অব এম্পায়ার: হাউ হাইপারপাওয়ারস রাইজ টু গ্লোবাল ডমিনেন্স – অ্যান্ড হোয়াই দে ফল (২০০৭); ব্যাটল হাইম অব দ্য টাইগার মাদার (২০১১); দ্য ট্রিপল প্যাকেজ: হাউ থ্রি আনলাইকলি ট্রেইটস এক্সপ্লেইন দি রাইজ অ্যান্ড ফল অব কালচারাল গ্রুপস ইন আমেরিকা (২০১৪, সহলেখক: জেড এল রুবেনফেল্ড); পলিটিক্যাল ট্রাইবস: গ্রুপ ইন্সটিংক্ট অ্যান্ড দ্য ফেইট অব নেশন (২০১৮)।
এমি চুয়ার মায়ের জন্ম চীনে, ১৯৩৬ সালে, যিনি দুই বছর বয়সে ফিলিপাইনে পাড়ি জমিয়েছিলেন।