আপনার অন্ত্রের জীবাণুগুলি আপনাকে হালকা হতে, সুখী হতে এবং দীর্ঘজীবী হতে সাহায্য করতে পারে। সুতরাং তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন।
লক্ষকোটি ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে আপনার অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্র গঠিত, যারা আপনার গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্ট বা নাড়িভুড়ির প্রতিটি কোণায় বসবাস করে।
এরা আপনার বিপাক প্রক্রিয়া, শরীরের ওজন, অসুস্থতার প্রবণতা, রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা, ক্ষুধা এবং মেজাজের উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এসব জীবাণুর বেশিরভাগই আপনার নিচের অন্ত্রে (কোলন বা মলাশয়ে) বাস করে এবং আপনার শরীরে যত কোষ আছে তার চেয়েও এদের সংখ্যা অনেক বেশি।
ধারণাগতভাবে, আমাদের এই জীবাণুতন্ত্রকে আমাদের একটি নতুন আবিষ্কৃত অঙ্গ হিসাবে দেখা উচিত, যার ওজন আমাদের মস্তিষ্কের চেয়ে কিছুটা বেশি এবং প্রায় মস্তিষ্কের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের প্লীহা, পিত্তথলি, টনসিল এবং অ্যাপেন্ডিক্স সহ কিছু অঙ্গ আছে, যেগুলি ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি, কিন্তু আমাদের অন্ত্রের জীবাণুদের ছাড়া আমরা বেশিদিন বাঁচব না। বিস্ময়কর ভাবে, কোনো দুজন মানুষের জীবাণুতন্ত্র এক নয়—আমরা সবাই আলাদা। এবং এই জীবাণুগুলি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি জানতে পারছি।
গবেষণায় দেখা গেছে, আপনার অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্র যত সমৃদ্ধ এবং যত বেশি বৈচিত্র্যময় হবে ততই আপনার রোগ এবং অ্যালার্জির ঝুঁকি কমে যাবে।
প্রাণীদের ওপর পরীক্ষায় এবং গবেষণায় বিশেষ রোগ সহ এবং রোগ ছাড়া মানুষদের জীবাণুতন্ত্রের মধ্যে তুলনা করে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিংস কলেজ লন্ডনে এই বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক কাজের উদাহরণের মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, স্থূলতা, অ্যালার্জি এবং প্রদাহজনিত রোগ যেমন কোলাইটিস এবং আর্থ্রাইটিস নিয়ে গবেষণা।
এদিকে, প্রচুর প্রমাণ পাওয়া গেছে যে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুরা যোনিপথে জন্মের মাধ্যমে প্রাপ্ত কিছু জীবাণুর অভাবে ভোগে, যা তাদেরকে অ্যালার্জি এবং হাঁপানির প্রতি আরও বেশি সংবেদনশীল করে তোলে।
তাহলে কীভাবে আপনি আপনার অন্ত্রের সুস্থ্য-স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলি ধরে রাখবেন বা পুনরুদ্ধার করবেন?
আপনার দেহে ভাল ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে তুলবেন? এবং আপনার জীবাণুতন্ত্রকে আরো স্বাস্থ্যকর ও শক্তিশালী করে তুলবেন? তার জন্য এখানে রইল ১৪টি টিপস।
১. আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া বাড়ান
প্রতিদিন ৪০ গ্রাম আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন, যা বর্তমান গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। আঁশযুক্ত খাবার খেলে হৃদরোগ এবং কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে, সেইসাথে ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
২. যতটা বেশি সম্ভব ফলমূল এবং শাকসবজি খান
এবং মৌসুম অনুযায়ী খাওয়ার চেষ্টা করুন। বিভিন্নতাও পরিমাণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধরনের ফলমূল এবং শাকসবজি খেলে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক এবং আঁশ পাওয়া যাবে, যা থেকে বিভিন্ন প্রজাতির জীবাণুরাও উপকৃত হবে।
৩. উচ্চ আঁশযুক্ত সবজি বাছাই করুন
এর ভালো উদাহরণ হলো, সবুজ শাক-সবজি, পেঁয়াজ এবং রসুন। এসব খাবারে খুবই উচ্চমাত্রায় অন্ত্রের জন্য উপকারী আঁশ থাকে। তবে লেটুসের মতো কিছু সবজিতে ফাইবার বা পুষ্টির মান কম থাকে।
৪. উচ্চ মাত্রার পলিফেনলযুক্ত খাবার ও পানীয় বেছে নিন
পলিফেনল হলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা অন্ত্রের জীবাণুদের জন্য জ্বালানী হিসেবে কাজ করে। বাদাম, বীজ, বেরি, জলপাই তেল, ব্রাসিকাস, কফি এবং চা, বিশেষ করে গ্রিন টিতে প্রচুর পরিমাণে পলিফেনল থাকে ।
৫. স্ন্যাকিং এড়িয়ে চলুন
আপনার অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্রকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য দুই বেলা খাবারের মধ্যে সময়ের ব্যবধান আরো বাড়ানোর চেষ্টা করুন। মাঝেমধ্যে খাবার এড়িয়ে যান বা লম্বা সময় ধরে না খেয়ে থাকুন। এতে ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে, অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্রও শক্তিশালী হবে।
৬. জীবিত জীবাণুযুক্ত প্রচুর পরিমাণে গেঁজানো খাবার খান
এর ভাল উদাহরণ হলো টক দই এবং কেফির বা মাঠা। মাঠাতে দইয়ের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি উপকারী জীবাণু থাকে। এছাড়া কাঁচা দুধের পনির, সাওয়ারক্রট বা বাঁধাকপি কুচি কুচি করে কেটে ল্যাকটিক অ্যাসিড দিয়ে গেঁজানো খাবার যা জার্মানিতে বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার, কিমচি (রসুন, বাঁধাকপি এবং মরিচ দিয়ে তৈরি একটি কোরিয়ান খাবার); এবং সয়াবিন ভিত্তিক পণ্য যেমন সয়া সস, টেম্পে এবং ন্যাট্টো ইত্যাদিতেও অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্রের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া রয়েছে।
৭. অ্যাসপারটেম, সুক্রালোজ এবং স্যাকারিনের মতো কৃত্রিম মিষ্টি থেকে দূরে থাকুন
এগুলি জীবাণুর বিপাক ক্রিয়াকে ব্যাহত করে এবং অন্ত্রের বৈচিত্র্য ধ্বংস করে। প্রাণীদের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, এসব খাবার স্থূলতা এবং ডায়াবেটিসের দিকে নিয়ে যায়। প্রক্রিয়াজাত খাবারও এড়িয়ে চলুন। কারণ তাও জীবাণুর বিপাক ক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
৮. শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বেশি সময় ব্যয় করুন
গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারীদের অন্ত্রে শহরবাসীদের চেয়ে বেশি সংখ্যক ভালো জীবাণু থাকে। যখন গ্রামে থাকবেন, তখন কোদাল বা নিড়ানি হাতে কাজে নেমে পড়ুন। বাগান করা এবং অন্যান্য মাঠের কাজকর্ম আপনার অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্রের জন্য অনেক উপকারী।
৯. অন্য প্রাণীদের সংস্পর্শে যান
গবেষণায় দেখা গেছে যে, কুকুরের সাথে বসবাসকারী ব্যক্তিদের জীবাণুতন্ত্রের বৈচিত্র্য বেশি থাকে।
১০. অ্যান্টিবায়োটিক এবং অপ্রয়োজনীয় ওষুধ এড়িয়ে চলুন
বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ভাল এবং খারাপ জীবাণু ধ্বংস করে এবং অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পর অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্র স্বাভাবিক হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যায়। তাই আপনার প্রয়োজন না হলে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করবেন না। অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে পশুদের মধ্যে স্থূলতা এবং অ্যালার্জিও দেখা দেয়। এমনকি প্যারাসিটামল এবং অ্যান্টাসিডের মতো সাধারণ ওষুধও আপনার অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্রে নেতিবাচকভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
১১. বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হবেন না
বারবার সাবান দিয়ে হাত বা শরীর ধোয়াধোয়ি এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল স্প্রের অতিরিক্ত ব্যবহার আপনার অন্ত্রের জন্য ভাল নাও হতে পারে।
১২. হালকা-পাতলা দেহের মানুষদের সঙ্গে সময় ব্যয় করুন
ইঁদুরের ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, হালকা-পাতলা গড়নের ইঁদুরের সঙ্গে থেকে থেকে মোটা ইঁদুররাও চিকন হয়ে যাচ্ছে। একটি চর্বিহীন প্রাণীর দেহে থাকা জীবাণু মোটা প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে তার শরীর থেকেও চর্বি কমিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মোটা প্রাণীদের জীবাণু চর্বিহীন প্রাণীদের দেহে আসে না এবং চিকন প্রাণীকে মোটা করে না।
১৩. খাবার ও ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট এড়িয়ে চলুন
সাপ্লিমেন্টারি খাদ্য এবং ভিটামিনের ছোট্ট একটা অংশকেই শুধু মানুষের উপকার করতে দেখা গেছে। এসবের পরিবর্তে, আপনার দেহের সমস্ত পুষ্টির যোগান দিতে বিভিন্ন ধরনের আসল খাবার খাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করুন।
১৪. হাদজাদের মতো খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
পুরো পৃথিবীর মধ্যে তানজানিয়ার হাদজা জনগোষ্ঠীর অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্রের বৈচিত্র্যই সবচেয়ে বেশি। তাদের জীবাণুতন্ত্রের বৈচিত্র্য গড়পড়তা আমেরিকানদের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ এবং গড়পড়তা ব্রিটিশদের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
আরো পড়ুন: পেটের ভেতরে আপনার দ্বিতীয় মস্তিষ্ক
গড়পড়তা হাদজা ব্যক্তিরা বছরে প্রায় ৬০০ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী খায় এবং তাদের খাদ্যাভ্যাসে মৌসুমভিত্তিক বৈচিত্র্যও রয়েছে। স্থূলতা, অ্যালার্জি, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মতো সাধারণ পশ্চিমা রোগগুলির একটিও নেই তাদের মধ্যে। বিপরীতে, বেশিরভাগ পশ্চিমা নাগরিক বছরে মাত্রে ৫০টিরও কম প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণী খায়। যে কারণে তারা প্রচুর অসুস্থ হয় এবং স্থূলতার মহামারীতে আক্রান্ত হচ্ছে।
সূত্র. সায়েন্স ফোকাস
অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক