সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ক্লান্তি থেকে মুক্ত থাকার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলির একটি হল মামুলি জিনিস নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করা।
আমরা অনেকেই সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। সিদ্ধান্ত নিতে নিতে অনেক সময় করার কাজটিও আর বর্তমান থাকে না।
আমাদেরকে প্রতিদিনই অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই আরও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারলে আমাদের মূল্যবান সময় এবং শক্তি বাঁচানো সম্ভব হবে। যদিও তা অতটা সহজ নয়।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হলে যে আপনাকে সবসময় নতুন কোনো দক্ষতা আয়ত্ত করতে হবে তা নয়। বরং এর জন্য আপনাকে জীবন থেকে কিছু জিনিস বাদ দিতে হবে। দ্রুত ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হওয়ার জন্য আপনাকে যে ১০টি বিষয় এড়িয়ে চলতে হবে।
১. শত ব্যস্ততার মাঝেই সিদ্ধান্ত নেওয়া
জীবনে এমনও সময় আসে যখন আপনাকে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে সাধারণত, আপনি একটু সচেতন হলেই আপনার সব সিদ্ধান্ত আগেভাগেই নিয়ে রাখতে পারবেন। এর জন্য আপনাকে যা করতে হবে তা হল সামনের সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে ভাবার জন্য আলাদা করে কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখা।
অনেকে ছুটির দিন শেষ হওয়ার রাতেই তাদের পুরা সপ্তাহের ক্যালেন্ডার পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলেন। অনেকে আবার ছুটি শুরুর আগের দিন বিকেলে পরের সপ্তাহের জন্য তাদের ক্যালেন্ডার পরিকল্পনা তৈরি করতে পছন্দ করেন। আপনিও এভাবে সপ্তাহের কোনো একটা দিন পুরা সপ্তাহের পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে ভাবুন। এবং আগাম কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখুন।
এটাকে একটা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করুন। তাহলে আপনি দেখতে পাবেন যে, সময়ের আগে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে আপনি অনেক ঝামেলা থেকেই মুক্ত থাকতে পারছেন।
এই অভ্যাস আপনার সময় এবং শক্তিও বাঁচাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলে সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়।
২. অতিরিক্ত চিন্তা
বাস্তব জীবনটা আসলে আমাদের ভাবনার সঙ্গে প্রায়ই মেলে না। ভবিষ্যতে কী হবে তা অনুমান করাটা প্রায় অসম্ভবই। কারণ মানুষ এবং জীবন খুবই আনপ্রেডিক্টেবল, কী হবে না হবে তা আগে থেকে বোঝা যায় না। ফলে, কোনো বিষয়ে আগাম সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সাধারণত অনেকটা জুয়া খেলার মতো। তবে এরপরও নিজের সিদ্ধান্তগুলির ওপর আপনাকে আস্থা রাখতে হবে। তবে আপনার সিদ্ধান্তগুলির ফলাফলের ওপর যে আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এবং ফলাফল আপনার প্রত্যাশা মতো নাও হতে পারে সে ব্যাপারে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে।
সুতরাং, বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করা বাদ দিন।
৩. যেসব জিনিস মনোযোগ নষ্ট করতে পারে
গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনোযোগ নষ্ট করতে পারে এমন সব জিনিস দূরে সরিয়ে রাখুন। যেমন, আপনার ফোনটি বন্ধ করে রাখুন, নিরিবিলি কোনো জায়গায় বসে কাজ করুন এবং একসঙ্গে শুধু একটি বিষয়েই মনোযোগ দিয়ে কাজ করুন। টাইম ম্যানেজমেন্টও একটা প্রধান বিষয়।
৪. অন্যদের চাপে কিছু করা
আপনাকে কোনোভাবেই এ কথা বলা হচ্ছে না যে, আপনি আপনার সামাজিক দায়িত্ব উপেক্ষা করুন। কিন্তু যেসব কাজ করার জন্য আপনি শুধু শুধু চাপ অনুভব করেন তাতে আপনার সময় এবং শক্তি অপচয় করবেন না।
যেমন, আপনি আপনার স্টার্টআপের জন্যে বড় কোনো অফিস ভাড়া নিতে প্রলুব্ধ হতে পারেন। কিন্তু, এর কি কোনো দরকার আছে, নাকি শুধু অন্য উদ্যোক্তাদের কথা শুনে আপনি এমনটা করতে চাচ্ছেন? যদি এমন করাটা একেবারেই দরকারি না হয়, তাহলে আপনি তা উপেক্ষা করতে পারেন।
৫. অন্যের সঙ্গে তুলনা
বেশিরভাগ মানুষই অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা এড়াতে পারেন না। যখন আপনি অন্যকে সফল হতে দেখবেন আর নিজেকে পিছিয়ে থাকতে দেখবেন তখন অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা না করে থাকাতে পারাটে বেশ কঠিন কাজ।
আমরা জানি যে অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা এড়িয়ে চলার কথা বলা সহজ কিন্তু করা অনেক কঠিন। তবে, আজই এই অভ্যাস কাটিয়ে ওঠার মাধ্যমে নিজের জন্য সেরা একটি সিদ্ধান্ত নিন। আপনার সম্পর্কে অন্যদের মতামত পরিবর্তন করার চেষ্টা করে নিজের শক্তি অপচয় করবেন না। নিজের কাজ করুন। কে কী বলল বা পছন্দ করল কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
৬. নিজের সহজাত প্রবৃত্তির কথা না শোনা
আমি নিশ্চিত আপনি আগেও এ কথাটা শুনেছেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন, চরম কোনো পরিস্থিতিতে পড়লে তা থেকে মুক্তির জন্য আপনাকে আপনার গাট ইনস্টিংক্ট বা সহজাত প্রবৃত্তির কথা শুনতে হবে। বস্তুতই, ৬৮% শতাংশ সময়েই ইনটুইশন বা স্বজ্ঞা আপনাকে সেরা সিদ্ধান্তটি গ্রহণের দিকেই নিয়ে যাবে।
যদিও এক্ষেত্রে একটা সতর্কতা আছে যে, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নিজের সহজাত প্রবৃত্তির কথা শোনা সবচেয়ে কার্যকর, যেমন, কোথায় মুভ করতে হবে বা সরে যেতে হবে তা নির্ধারণ করা। কিন্তু আরো জটিল কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আপনাকে সাবধানতার সঙ্গে এবং বেশি সময় নিয়ে এর সুবিধা এবং অসুবিধাগুলি ভেবে-চিন্তে দেখতে হবে।
৭. ভয়
সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের দেরি করার সবচেয়ে বড় একটি কারণ হল আমরা ভয় পাই। এবং এর একটি ভাল কারণও রয়েছে, আর তা হল, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকে কিন্তু এরপরে সেই সিদ্ধান্তের ফল কী হবে তার ওপর আমাদের আসলে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যেমন, নিজের ব্যবসা শুরু করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আপনি আপনার চাকরি ছেড়ে দিলেন। আপনি বই পড়ে পড়ে সবকিছু করেন। কিন্তু, আপনি ব্যবসায় সাফল্যের মুখ দেখা শুরু করতে না করতেই অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হল! এখন আপনি কী করবেন? এই ঘটনা আপনার ব্যবসাকে প্রভাবিত করবে, যা সম্পূর্ণরূপে আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
এর সমাধান কী? এর সমাধান একটাই―ভবিষ্যতে কী হবে তা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে না রাখা।
৮. মামুলি জিনিস
সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ক্লান্তি থেকে মুক্ত থাকার সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলির একটি হল মামুলি জিনিস নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করা।
যেমন, প্রতিদিন কী পরতে হবে তা খুঁজে বের করতে গিয়ে আধা ঘণ্টা সময় ব্যয় করা বন্ধ করুন। জীবনের বিশাল পরিকল্পনায় এটা বরং একটা গুরুত্বহীন সিদ্ধান্ত, যা শুধু শুধু আপনার মানসিক শক্তি এবং সময় নষ্ট করবে। এ থেকে বাঁচতে পুরো সপ্তাহের জন্য আপনার পোশাক কী হবে তা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং বাছাই করে রাখতে পারেন। অথবা স্টিভ জবস বা মার্ক জাকারবার্গের মতো সবসময় একই রকম পোশাক পরতে পারেন।
৯. পরিপূর্ণতার প্রবণতা বা নিখুঁত হওয়ার প্রবণতা
পারফেকশনিজম বা নিখুঁত হওয়ার প্রবণতা আপনার উন্নতি এবং নতুন সুযোগ আবিষ্কার করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আর নিখুঁত হতে গিয়ে কোনো কাজে বেশি সময় ব্যয় করার ফলে আপনার উৎপাদনশীলতাও কমে যাবে।
কীভাবে আপনি এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসবেন? এর একটাই উপায়। বাস্তবতার কাছে সারেন্ডার করা। আপনি নিখুঁত নন। এই দুনিয়ায় কেউই নিখুঁত নয়। এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। আর আপনার সিদ্ধান্তগুলিকেও প্রক্রিয়ার একটি অংশ বলে স্বীকার করে নিন।
এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করুন, যা আপনার পক্ষে বাস্তবে অর্জন করা সম্ভব। অন্যদের ফিডব্যাক নিন।
“হাইপোথেসিস টেস্টিং” পদ্ধতি ব্যবহার করুন। যেমন, ব্লগে একটি পোস্ট লিখুন এবং বানান ঠিক না করেই সেটি পাবলিশ করুন। এরপর আপনি দেখতে পাবেন যে ভুল থাকা সত্ত্বেও এমন না যে সব শেষ হয়ে গেল। লোকে হয়তো আপনার বানান ভুল নিয়ে কোনো মাথাই ঘামাবে না।
আর অতীতে বাস করবেন না বা সমাধান নেই এমন কোনো বিষয় নিয়ে অযথা মাথা ঘামাবেন না।
১০. নিজেকে শুধু “হ্যাঁ” বা “না” এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা
অবশেষে, একটা বিষয় উপলব্ধি করুন যে আপনাকে যেসব সিদ্ধান্ত নিতে হবে তার সবই যে শুধু “হ্যাঁ” বা “না” হবে এমন নয়। তার পরিবর্তে বরং, বিকল্প বা আপোস করার কথাও ভাবুন।
আরো পড়ুন: দক্ষতার ফাঁদ থেকে মুক্তি ও মনের শান্তি খুঁজে পাওয়া
ধরা যাক যে, একজন কর্মচারী বা ব্যবসায়িক অংশীদার আগামীকাল লাঞ্চের সময় দেখা করতে চান। আপনার হয়ত ইতিমধ্যেই অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে, তাই আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুধু একটি “না” দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে চান। পরের দিন লাঞ্চের সময়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার আগে, আপনার ক্যালেন্ডারটি একবার দেখে নিন। আপনার কি আগামী মঙ্গলবার দুপুরে ফ্রি সময় আছে? যদি থাকে তাহলে সরাসরি না বলার পরিবর্তে মঙ্গলবার দুপুরে দেখা করার প্রস্তাব করুন। আরো ভাল, আপনার ক্যালেন্ডারটি অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করে রাখুন যাতে তারা দেখতে পায় যে আপনি কখন ফ্রি থাকবেন, কখন দেখা করতে পারবেন।
সূত্র. এন্টারপ্রেনার ডটকম