বিউটি পার্লার আমাকে খুব টানে। শুধু এর ভিতরে বিউটিবতীরা থাকেন বলে না। বরং পুরুষদের সেখানে একদম ঢোকা মানা বলে কেমন যেন একটা আকর্ষণ কাজ করে।
আমার বউ খুব একটা বিউটি পার্লারের বিশেষ ভোক্তা নন। কখনো হলেও বরকে বিশেষ বাইরে বসিয়ে রাখবেন বলেও মনে হয় না। বাইরে যে আমি বসে থাকতে চাই তাও নয়। আবার ভিতরে ঠিক যে যে পরিষেবা দেয়া হয় বলে শুনতে পাই সেগুলো পেতেও যে আমার অনেক ইচ্ছে করে তাও নয়।
মানে কোনো কিছুই নয়। তাছাড়া ইদানীং রকমারি পুরুষের বিউটিমূলক পার্লার ঢাকায় হয়েছে। সেগুলোতেও সেবা নিতে যেতে ইচ্ছে হয় নি। নেহায়েৎ কোনো গুরুতর নিজের স্বার্থ ছাড়াই বিউটি পার্লার আমাকে টানে।
ঢাকার প্রায় যে কোনো মানানসই রাস্তাতেই একটা প্রমাণ সাইজের সাইনবোর্ডওয়ালা বিউটি পার্লার থাকে। পর্যাপ্ত জায়গা নিয়ে যেসব বিউটি পার্লার থাকে সেগুলোর মানমর্যাদা আর পসার দুই-ই বেশি। সেখানকার খরিদ্দাররাও সবচেয়ে বেশি অভিজাত। পর্যাপ্ত জায়গা আছে মানেই পরিষেবার ধরন-ধারণ বিচিত্র ও বহুবিধ। পর্যাপ্ত জায়াগার মানেও নানান রকম। অভিজাত, মানে দামি, পার্লারের বহির্বাটিতে বৈঠকখানা থাকবে, সেখানে সাধারণত বিউটিকামীদের সঙ্গে আগত পুরুষকুল ট্যাব কিংবা স্মার্টফোন খোঁচাখুঁচিরত বা উসখুস অবস্থায় বসে থাকবেন। এর পরে ধাপে ধাপে পরিষেবার ধরনের উপর নানাবিধ ঘর থাকবে। পদসেবার আলাদা ঘর, চুলবাঁধার আলাদা ঘর, ত্বকের যত্নের আলাদা ঘর এরকম আর কি।
যত দামি বিউটি পার্লার, তার তত বেশি সৌন্দর্যকর্মী বা কর্মচারি। এসব সৌন্দর্যকর্মীদের নিয়েও আমার আগ্রহ কম নয়।
অনেক আগে, আমি মফস্বল থেকে কেবল ঢাকায় এসেছি আর মিরপুর সড়ককে আমার বিস্ময়ের এক খনি মনে হতো। নীলক্ষেতে বই থেকে শুরু করে মোরগ পোলাওয়ের খুপরি দোকান। ওদিকে নিউ মার্কেটের লাচ্ছি থেকে শুরু করে ফুটপাতের মশারি আর ব্রেইসলেটের দোকান। এদিকে গাউছিয়ার কোণায় পাকোড়ার দোকান, ভিতরে অজস্র শাড়ি। একটু কোণার দিকে ত্যারছা করে গানের ডালি, সবমিলে একেবারে উত্তেজনায় ঠাসা এক মহাসড়ক।
ঢাকা কলেজ, আর তারপর বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলোর সামনে খানিকক্ষণ অক্ষমের উত্তেজনাসমেত তাকিয়ে আরেকটু হাঁটলেই বাম হাতে ‘হংকং বিউটি পার্লার’। মিরপুর সড়কের বিস্ময় উপভোগ করতে করতে যেসব দিনে হাঁটতে থাকতাম, তার মধ্যে কোনো কোনো দিন হঠাৎ চোখে পড়ে যেত সৌন্দর্যকর্মী মানে বিউটি পার্লারের পরিষেবাদানকারী মেয়েদের কেউ কেউ বেরিয়ে আসছেন।
একেই নাম ‘হংকং…’, তার মধ্যে বেরোতেন যাঁরা তাঁদেরকে দেখলে চীনা-জাপানি-কোরিয়ানই মনে হয় অদক্ষ গোঁয়ার বাঙালি চোখে। এটা জানতে আরো খানিকটা সময় লেগেছে যে ঢাকা শহরের বিউটি পার্লারগুলোর এই চীনা-জাপানি সদৃশ সৌন্দর্যকর্মীদের বড় অংশই মান্দি (গারো) জাতির নারীরা। কেন ও কীভাবে তাঁরা এই পেশায় পয়লা পছন্দের শ্রমিক হলেন সেটা নিয়েও ভাবতে হয়েছে বিস্তর। তবে সেই কাহিনী এখানে নয়।
উত্তরা থেকে আমার চাকরি ক্ষেত্রে আসার সময় আশুলিয়া আর জিরাব এই দুইটা রাস্তা ধরতে হয়। দুটো রাস্তাই নিজগুণে স্মরণযোগ্য। ঢাকার এত কাছে এরকম ঘিয়ে-ভাজা রাস্তা থাকাই বিস্ময়কর, তাও বছরের পর বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস সাধারণত আশুলিয়া সড়কটাই ধরে। আমি নিজে রাস্তার গাড়িতেও চড়ি। তাই দুই রাস্তাই আমার পরিচিত।
আশুলিয়া-জিরাব এলাকাটা ঢাকা মহানগরের তোলপাড় বদল ও বিস্তারের দুর্দান্ত সাক্ষী। নানান ভাবে। ইঁটের ভাটা থেকে শুরু করে শয়ে শয়ে গার্মেন্টস; বিদ্যুৎ কারখানা থেকে শুরু করে ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানি; কিংবা ফ্যান্টাসি কিংডম থেকে শুরু করে হাওড়ের বর্ষাকালের পানিতে ভ্রমণপিপাসু নগরজীবীরা।
সব মিলে বিপুল এক আয়োজন, আবার বিকট বিশৃঙ্খল। ব্যস্ত অথচ বেসামাল। আর এসবের ফাঁকে ফাঁকে প্রায় চোখের আড়ালে অসংখ্য ভাড়াটে। ছোট ছোট ঘরে তাঁরা থাকেন। বাংলাদেশের নানান গ্রাম আর শহর থেকে তাঁরা এসেছেন। এইসব কারখানার শ্রমিক হিসেবে তাঁরা কাজ করেন। নানান শ্রমিক। যদিও গার্মেন্টস শ্রমিকই কেবল নগর-চৈতন্যে উদ্ধৃত।
আশুলিয়া আর জিরাব’র রাস্তার দুই পাশে কিছুক্ষণ পর পরই ‘বিউটি পার্লার’। ছোট ছোট দোকান ঘরে বিউটি পার্লার। এত ছোট তার সাইনবোর্ড যে একদম খেয়ালই না করতে পারেন আপনি। এত ছোট সেসব দোকান যে বিউটি পার্লার বিষয়ক প্রচলিত ধ্যানধারণা দিয়ে কিছুতেই তাকে চেনা সম্ভব নয়। কিন্তু এত ঘন ঘন যে ঢাকার যে কোনো অভিজাত এলাকার তুলনায় বেশি। ছোট ছোট ম্রিয়মান এই বিউটি পার্লারগুলোর, প্রায়ই, খুব গা-ঘেঁষে একটা ছবির দোকানও থাকে। ফোটো স্টুডিও। সেগুলোও ছোট ছোট। বাস-চলতি পথে দেখতে দেখতে বিউটি পার্লার বিষয়ক আমার আগ্রহ আরও দাঁনা বেঁধে ওঠে। মাঝে মাঝেই মনে হয়। নেমে আর দেখতে যাওয়া হয় না। আর ফোটো স্টুডিওগুলোর দেয়ালে ঝোলানো ফোটোগুলোতে সেইসব মুখ যেগুলো কিছুক্ষণ আগেই বিউটি পার্লার থেকে সাজগোজ করে এসেছে। এক ঝলক সেসব অস্পষ্ট মুখেদের বাসে বসেই দেখে নেয়া যায়। অথবা ঝলকানির মধ্যেই বাকি দৃশ্যগুলো ভেবে নেয়া যায়।
বিউটি পার্লার নিয়ে আগ্রহ আরেক দফা আমার বেড়ে গেল। যখন রানা প্লাজাতে মানুষ মারা গেল। কত মারা গেল তা কেউই প্রথমে জানে না। কত মারা গেল কেউই এখনো জানে না। তবে একটা হিসেব আছে। দুর্ঘটনার শুরুর দিন থেকে চাপা পড়া মানুষগুলোর আত্মীয়-স্বজন, মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোন একটা করে ফোটো হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দাঁড়িয়ে থাকতেন। এখনো মৃত্যুর এক বছর বাদে ওই জমিটার পাশে ফোটো-হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। খামকাই। ফোটোগুলোতে একজন করে মানুষের মুখ। কাছের কোনো ছোট বিউটি পার্লারে সাজানো একখানি মুখ।