বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই কার্ডবোর্ড সিগারেটের প্যাকেটগুলিতে সতর্কতামূলক নানান ছবি বা টেক্সট দেয়া থাকে। সতর্কতামূলক এসব বার্তার মধ্যে রয়েছে, ধুমপান করলে হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সার বা গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হতে পারে, ইত্যাদি। এসব স্বাস্থ্যঝুঁকি তামাকের ধোঁয়া মুখ দিয়ে নিঃশ্বাসের সাথে টেনে দেহের ভেতরে নেয়ার ফলে তৈরি হয়। কিন্তু ধূমপানের ফলে চোখের উপরিভাগে কী প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে।


নিক ওগাসা
সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ১৮ অক্টোবর, ২০২১


অথচ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাকিউলার ডিজেনারেশন, গ্লুকোমা এবং ছানি পড়ার মতো চোখের রোগের পেছনেও ধূমপানের দায় আছে।

এসব রোগ বিশ্বব্যাপী অন্ধত্ব এবং তীব্রভাবে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু এই পীড়াগুলি যথাক্রমে রেটিনা, অপটিক নার্ভ এবং লেন্স-এর মতো চোখের ভেতরের অংশে হয়। এবার গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন কীভাবে উত্তপ্ত তামাকের যন্ত্র থেকে বের হওয়া সিগারেটের ধোঁয়া এবং অ্যারোসল—যা দিয়ে তামাকের পাতা পোড়ানোর বদলে সেঁক দিয়ে বা তরল তামাকজাত দ্রব্যকে বাষ্পীভূত করে ধোঁয়া তৈরি হয়—চোখের সবচেয়ে উন্মুক্ত স্তর তথা কর্নিয়ার কোষকেও মেরে ফেলে।

জাপানের গিফু ফার্মাসিউটিক্যাল ইউনিভার্সিটির বায়োমেডিকেল গবেষক ওয়াতারু ওৎসু বলেন, “এই কর্নিয়া হলো চোখের সবচেয়ে বাইরের পৃষ্ঠ, যা রাসায়নিক পদার্থ, আলো এবং জীবাণু সংক্রমণের মতো পরিবেশগত নানান উপাদানের সংস্পর্শে আসে।” ধূমপায়ীদের মধ্যে ‘ড্রাই আই সিনড্রোম’ বা শুকনো চোখের উপসর্গে ভোগার ঝুঁকি অ-ধূমপায়ীদের চেয়ে দ্বিগুণ। যার ফলে চোখের পৃষ্ঠ পানিশূন্য হয়ে লাল হয়ে যায় এবং চুলকানি হয়, যা থেকে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, সংক্রমণ বা কর্নিয়ার আলসারও হতে পারে।

সাধারণত চোখের মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার দূরে থাকা সিগারেট এবং তামাক উত্তপ্ত করার যন্ত্রগুলি থেকে নির্গত ধোয়াঁ বা অ্যারোসোল চোখের সবচেয়ে উন্মুক্ত টিস্যুকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তা বুঝতে চেয়েছেন গবেষকরা। আর এর মধ্য দিয়েই তারা চোখের ক্ষয়ক্ষতির বিরুদ্ধে আরও ভালো সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে পারবেন, বলেন ওৎসু।

২০০৬ সালে একটি ক্লিনিকাল জরিপে দেখা গেছে যে, ধুমপায়ীদের ‘টিয়ার ফিল্ম’ নামের চোখের একটি অংশ অকালে ক্ষয়ে যায়, যা কর্নিয়ার পৃষ্ঠকে ঢেকে রাখে এবং রক্ষা করে। আবার, ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রাণীটির কর্নিয়া এবং অশ্রু-গ্রন্থি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অনলাইনে ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ নামের জার্নালে সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত নতুন গবেষণায় ওৎসু এবং তার সহকর্মীরা প্রকাশ করেছেন যে, সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা যৌগগুলি লোহা বা আয়রনের আবরণ তৈরি করে। আর এই আবরণ ‘কর্নিয়াল এপিথেলিয়াম’ নামক কর্নিয়া টিস্যুর বাইরের স্তরের গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলিকে মেরে ফেলে। তার ওপর গবেষকরা দেখেছেন যে, এমনকি ধোঁয়া চোখের মধ্যে না ঢুকলেও কর্নিয়ার ক্ষতি হতে পারে। কর্নিয়ার কোষগুলি যখন অন্য কোনো ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের সংস্পর্শে আসে, তখনও আয়রনের ফলে কোষের মৃত্যু ঘটতে পারে।

গবেষকরা ল্যাবে উৎপাদিত মানুষের কর্নিয়ার বাইরের স্তরের কোষে সিগারেটের ধোঁয়ার নির্যাস লাগিয়ে পরীক্ষা করছেন। ওই নির্যাসে ধূমপায়ীরা শ্বাসের সঙ্গে যেসব উপাদান টেনে নেয়, তার বেশিরভাগ উপাদানই ছিল। দ্রবণের মাধ্যমে সিগারেটের ধোঁয়াকে বুদবুদ আকারে তৈরি করে এই নির্যাস বানানো হয়। এবং প্রি-ক্লিনিকাল বিভিন্ন গবেষণায় প্রায়ই তামাকের ধোঁয়ার বিকল্প হিসেবে এই নির্যাস ব্যবহৃত হয়।

গবেষকরা আরো পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, নন-কম্বাস্টেড সিগারেট বা হিট-নট-বার্ন ডিভাইস হিসেবে পরিচিত তামাক উত্তপ্ত করার যন্ত্রগুলি একইভাবে কর্নিয়ার কোষগুলিকে প্রভাবিত করে। এই যন্ত্রগুলি পোড়ানো ছাড়াই তামাকের পাতাকে তাপ দিয়ে সেঁকে অ্যারোসল তৈরি করে।

‘অনেকেই এই নতুন তামাক উত্তপ্ত করার ডিভাইসগুলিকে সিগারেটের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছেন। কিন্তু এই নতুন ডিভাইসগুলি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলে, সে সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানি না’, বলেন ওৎসু।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, তামাক পুড়িয়ে তৈরি করা ধোঁয়া বা তাপ দিয়ে তৈরি করা বাষ্পীয় ধোঁয়া উভয়ই কর্নিয়ার বাইরের স্তরের কোষের ক্ষতি করতে পারে। এমনকি তাতে যদি কোনো টার বা নিকোটিন নাও থাকে। ধারাবাহিকভাবে সিগারেটের ধোঁয়ার সংস্পর্শে এলে অধূমপায়ীরাও কর্নিয়ার সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন বলে উল্লেখ করেন ওৎসু। তবে গবেষকরা এখনো কোষে ‘ভেপিং’-এর প্রভাব পরীক্ষা করে দেখেননি।

ওৎসু এবং তার সহকর্মীরা গবেষণায় দেখতে পান যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধোঁয়া বা তামাকের সংস্পর্শে না আসা নমুনার তুলনায় সিগারেটের ধোঁয়ার নির্যাস এবং উত্তপ্ত তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসা নমুনায় বেশি কোষ মারা গেছে। এমনকি নিকোটিন ছাড়া ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসার ফলেও একই ফলাফল দেখা গেছে।

নিবিড় পর্যবেক্ষণের পরে দেখা গেছে যে, ধোঁয়ার সংস্পর্শে কোষের ঝিল্লি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, লোহার আবরণ জন্মেছে এবং প্রচুর পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত ফেরিটিনের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফেরিটিন হলো একধরনের প্রোটিন যৌগ, যা ডিএনএ সংশ্লেষণ এবং বিভাজনের মতো কোষীয় কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় লোহা সংরক্ষণ করে। অর্থাৎ এসব লক্ষণ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, তামাকজাত দ্রব্যের সংস্পর্শে এলে ফেরোপটোসিস নামে লোহার আবরণের প্রভাবে অবধারিতভাবে কর্নিয়ার কোষগুলির মৃত্যু ঘটে।

ওৎসু ব্যাখ্যা করে বলেন, এই প্রক্রিয়া শুরু হয় যখন তামাকজাত দ্রব্যের যৌগগুলি কর্নিয়ার কোষের সংস্পর্শে আসে এবং ফেরিটিন কোষের ভেতরে ঢুকে সঞ্চিত লোহা ভাঙতে শুরু করে। এই লোহার কিছু অংশ একত্রিত হয় এবং প্রাকৃতিক হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রক্সিল মৌল নামের অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল অণু তৈরি করে, যা কোষের ক্ষতি করতে পারে। সাধারণত কোষের মেরামত ব্যবস্থা এই মৌলগুলির সাথে মোকাবেলা করতে পারে। কিন্তু যখন মৌলের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়, তখন কোষের ঝিল্লিতে থাকা চর্বি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কোষগুলি মারা যেতে থাকে।

ওৎসু এবং তার সহকর্মীরা গবেষণায় দেখেছেন যে, যখন তারা তাদের কোষ কালচার বা নমুনায় এমন রাসায়নিক পদার্থ যোগ করেন, যা লোহা এবং যৌগগুলিকে আবদ্ধ করার মাধ্যমে ফেরোপটোসিসকে ব্লক বা নিরোধ করতে পারে, তখন বিভিন্ন তামাকজাত দ্রব্যের সংস্পর্শের ক্ষতি থেকে আরো বেশি কোষ বেঁচে যায়। এর মাধ্যমে আরো একবার প্রমাণিত হয় যে, ফেরোপটোসিসই কোষের মৃত্যুর জন্যে দায়ী। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ফেরোপটোসিস চিকিৎসা সেসব ধূমপায়ীদের সাহায্য করতে পারে, যাদের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এই গবেষণায় যেহেতু জীবিত মানুষের চোখের পরিবর্তে কালচার করা কোষ ব্যবহৃত হয়েছে, সেহেতু গবেষকরা এখনো নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না যে, ধূমপান বা উত্তপ্ত তামাকজাত দ্রব্য একজন ব্যক্তির কর্নিয়াকে কত দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত করে বা ধূমপান সংক্রান্ত কর্নিয়ার রোগের চিকিৎসার জন্যে ফেরোপটোসিস নিরোধ করা কতটা কার্যকর। গবেষণার পরবর্তী ধাপগুলিতে প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হবে এবং কর্নিয়ার কোষে তামাকের বাষ্পীয় ধোঁয়ার প্রভাব পরীক্ষা করা দেখা হবে, জানান ওৎসু।

কিন্তু তুরস্কের বাসকেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডিলেক আলটিনর্স বলেছেন, এই গবেষণার ফলাফলগুলি ইতিমধ্যেই বেশ কাজের হয়েছে। তিনি এই গবেষণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। যদি ধোঁয়ার সংস্পর্শে কর্নিয়ার বাইরের দিকের কোষের লিপিড ভেঙে যায়, কর্নিয়াকে আবৃতকারী টিয়ার ফিল্মও একইভাবে ভুগতে পারে, অনুমান করেন তিনি। লিপিড চোখকে শুকিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। এবং ইতোমধ্যেই দেখা গেছে যে, ধূমপায়ীরা টিয়ার ফিল্ম ক্ষয়ে যাওয়া এবং শুকনো চোখের উপসর্গে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। কিন্তু গবেষকরা এখনো এর পেছনে ফেরোপটোসিস দায়ী কিনা, তা নিয়ে অনুসন্ধান করেননি।

আলটিনর্স বলেন, এই গবেষণা ধূমপায়ীদের চোখ শুষ্ক হওয়ার রোগ থেকে দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষা পেতে ফেরোপোটোসিস-নিরোধী যৌগ ধারণকারী টিয়ার ড্রপ ব্যবহারের কার্যকারিতা সম্পর্কে আরো গবেষণা করতে প্রেরণা যোগাবে। চোখ শুষ্ক হওয়ার রোগে দীর্ঘস্থায়ী বিরক্তি এবং কখনো কখনো বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হয়। “হয়তো আমরা এই পদার্থগুলি কৃত্রিম অশ্রুতে যোগ করতে পারি। এটি চোখ শুষ্ক হওয়ার রোগের চিকিৎসায় সম্পূর্ণ এক নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে,” যোগ করেন আলটিনর্স।

অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক