আপনাদের লিঙ্গ-অনুধাবন ২
লিঙ্গ নিয়েও আমার একাধিক টীকা পড়তে হচ্ছে আপনাদের। এক টীকাতে সারতে পারলে আমি নিজেই সবচেয়ে খুশি হতাম। কেবল তাই-ই নয়, আমি নিরাপদও বোধ করতাম। এমনকি একটাও যদি না লিখতে হতো তাহলে আরো ভাল হতো। লিঙ্গ বিষয়ে আমার বলাবলি নিয়ে সরাসরিই আপত্তি শুনেছি। এমন না যে আমি বাংলা লিঙ্গ ছেড়ে ইংরাজি জেন্ডার গ্রহণ করেও পরিত্রাণ পেতাম। ঝামেলাটা অন্য জায়গায়।
আপত্তির একটা ধরন হলো বর্গবাচক। পুংলিঙ্গের লোক হিসাবে লিঙ্গ বোঝাবুঝি হাজির করা নিয়ে বিশেষ সেই আপত্তি। আপত্তির আরেকটা ধরন অনুক্ত থেকে গেছে। কিন্তু বুদ্ধির ভরসায় আমি টের পাই। তা হলো যদি পুংলিঙ্গের কেউ লিঙ্গ বা নারীবাদ নিয়ে কথা কইতে অনুমোদিত হতে পারেনও, সেই পুরুষের ‘মহৎপ্রাণ’ ধরনের হতে হবে। হয়তো অযৌন হতে পারলে সবচেয়ে ভাল, নিতান্ত অন্তত যৌনশুচিতার বিষয়ে প্রকাশ্য ও সর্বস্বীকৃত একটা অবস্থান থাকতে হবে।
এইসব অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কারণে ভয়ে ভয়েই এই বিষয়ে আমার বলতে হচ্ছে। যাহোক, বিবিধ বিষয়ে নারীর কনসেন্ট কেন লোকে বুঝতে চান না সেটা আসলে বড় কোনো জটিল প্রসঙ্গই না। বিবিধ বিষয়ে বললাম বটে, তবে কনসেন্টের আলাপ-আলোচনা মূলত যৌনতার ক্ষেত্রেই চলে আসছে।
আসলে আরো ভেবে দেখলে ধর্ষণ-প্রাসঙ্গিক আলাপ-আলোচনাতেই কনসেন্ট ঘুরে-ফিরে আসছে। একথা ঠিকই যে অন্যান্য দেশেও তাই-ই হয়েছে। ধর্ষণকে সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সম্মতির ধারণা থাকছে। আবার ধর্ষণের মোকদ্দমা চালাতে গিয়েও ভুক্তভোগীর সম্মতি ছিল কিনা সেটা নিয়েই দুই পক্ষের আইনজীবীরা কষে লড়াই করে যেতে থাকছেন।
বাংলাদেশের নগরাঞ্চলের মধ্যবিত্তরা কয়েকটা অন্তত ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন করার কারণে কনসেন্ট আর ধর্ষণ প্রায় এক সঙ্গেই আলাপ হয়ে থাকছে। খুবই বিপদের কথা! অন্যান্য জায়গায় কনসেন্ট বা সম্মতির চর্চা থাকলে তাহলেই না ধর্ষণের ক্ষেত্রে সম্মতি লোকে বুঝবেন! সম্মতির বোঝাবুঝি তো কোথাওই নাই! আপনারা যখন খালি আনুগত্য বোঝেন তখন তো সম্মতি বুঝবেন না। কিংবা যদি আপনারা আধিপত্য দিয়ে বোঝেন তখনও সম্মতি বুঝবেন না। আসলে আনুগত্য আর আধিপত্য মিলেমিশেই থাকে। একপক্ষের বেলায় আধিপত্য, অন্যপক্ষের বেলায় আনুগত্য।
আপনার বাড়িতে বেশ একটা বাগান আছে। এরকম একটা কল্পনা করা খুবই কঠিন যদিও। আমার পরিচিতরা বিভিন্ন মাপের ফ্ল্যাটেই থাকেন। তাও ধরে নিতে সমস্যা কই! আপনার সেই বাগানে অন্তত একজন মালী কাজ করেন। আর আপনি ফুল ও ফলের বৃক্ষ অতিশয় পছন্দ করেন। আমরা আপনার রুচির প্রশংসা করতে থাকি।
কিন্তু আপনি এক্ষণে বাগানের ফুলগাছ বদলের কথা ভাবলেন। আপনি খুব গোঁয়ার প্রকৃতির পুরুষ-লোক হলেও ফুলের কোমলতা আর মাধুর্যের কথা স্মরণ করে সম্ভাবনা আছে যে আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে সম্ভাব্য গাছ কী হতে পারে কিংবা কোথায় লাগানো হতে পারে তার বিষয়ে শলাপরামর্শ করলেন। এমনও হতে পারে কম গোঁয়ার্তুমির মুহূর্তে বাচ্চাদের সাথেও একটু আলাপ করে নিলেন। কিন্তু এই সম্ভাবনা কম, এমনকি প্রায় নাই বললেই চলে যে, আপনি মালীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক একটা বৈঠকে বসবেন ফুল বা ফলের গাছের প্রকার বা লোকেশন বিষয়ে।
মালীর সঙ্গে আপনার যে বৈঠক হবে ওটা বড়জোর ফিন্যান্স বিষয়ক। এর বাইরে সকল কিছুই হবে হুকুম। “এটা কর, ওটা কর।” এমনকি মালী যখন বলবেন “এইডা তো এই মাটিতে হবে না” তখনও সম্ভাবনা আছে যে আপনি বলে বসলেন “হবে না ক্যান—হবে হবে, তুই লাগায়া দ্যাখ।” অথচ কোন মাটিতে কী হবে না-হবে সেই বিষয়ে মতামত দেবার জন্য তাঁরই অধিক যোগ্যতা থাকার কথা। এখন যদি মাটি ও ফুলবৃক্ষ বিষয়ে মালীর মতামতকেই গুরুত্ব প্রদানে আপনার অভ্যাস না থাকে, যৌনতা বিষয়ে নারীর মতামতকে আপনি গুরুত্ব দিয়ে বিচার করবেন এটা ভাবতে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। ভাবিও না।
সম্মতি বা মতামত আদান-প্রদানের দুনিয়ার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে সমতা। সম্মতি আর সমতা বাংলাতে ধ্বনিগতভাবে খুব কাছাকাছিও বটে। সে অবশ্য হাত আর হাতিও। তাই বলে হাতের সাথে হাতির কোনো সম্পর্ক দেখানো কঠিন। তো, সমতা যদি সম্পদের দুনিয়ায় নাও থাকে, নাই তো বটেই, অন্তত অধিকারের দুনিয়ায় থাকতে হয়। কোথাও না থাকলে আপনার আমার মাথায় থাকতে হয় যে অমুক বা তমুকের, দবির বা মর্জিনার, পর্যাপ্ত অধিকার আছে।
যাঁর অধিকার আপনারা জানেন না, মানেন না, জানার পরও মানতে পারেন না, তার মতামত নিয়ে কাজ করবেন কীভাবে? তাও যে সে কাজ না! যৌনকাজ! যৌনকাজের একটা গুরুতর সঙ্কট তো ইতোমধ্যেই পেঁচায়ে আছে। তামাম দুনিয়ার মেলা মেলা লোকজন যৌনকাজকে মানব জীবনে অপ্রতিরোধ্য এক বিষয় হিসাবে দেখার চল আছে। কখনো কখনো এমনকি ডাক্তার-উকিল-শিক্ষক-সাংবাদিক-সাহিত্যিকেরা পর্যন্ত এভাবে দেখে থাকেন। পলিসি-নির্মাতারা দেখে থাকেন। সিনেমা-নির্মাতারা দেখে থাকেন। ওই যে হলিউডের ছবিতে আপনারা দেখেছেন না যে সাধারণত একজন নারী ও একজন পুরুষ, পরস্পরকে স্পর্শ করার পর মৃদু চুম্বনের পর, আর কিছুতেই স্থির থাকতে পারছেন না! লিফট, গাড়ি গ্যারাজ, কিচেন! জনদরবারে থাকুন আর প্রার্থনাগৃহে থাকুন, এরপর দৌড়ে কোথাও গিয়ে কিছু একটা না করতে পারলে আর নিস্তার নাই!
এই হুড়াহুড়িটা নিয়ে কিছু আলাপ না করলে যৌনতায় কনসেন্টের বিষয়টা আমরা কিছুতেই বুঝব না। কোথা থেকে আসে এই হুড়াহুড়ি? এমন নয় যে অন্যরা এরকম হুড়াহুড়ি করলে আমার কোনো আপত্তি আছে, কিংবা আমি হিংসা করে থাকি। বরং আমার বক্তব্য হলো যৌনতাকে একটা প্রায় প্রক্ষালনগোত্রীয় নিষ্কাশন ব্যবস্থা হিসাবে দেখার সঙ্কট এটা।
বাস্তবে, শাস্ত্র ও পণ্ডিতরা যার যা খুশি বলুন গে, একে প্রক্ষালনসম নিষ্কাশন হিসাবে দেখার কোনোই কারণ নাই। যৌনতা, অন্তত মানবযৌনতা, অত্যন্ত পরিকল্পিত বাসনামণ্ডিত জগৎ থেকেই আসার কথা। অন্তত এই কারণেও যে, অন্যান্য জন্তুদের মতো নিছক বাচ্চা উৎপাদনের মহৎ লক্ষ্যে মানবযৌনতা সাধিত হয়ে থাকে না। তবে ইন্টারভ্যু নিতে পারলে অন্যান্য জন্তুর মনোভাব সম্পর্কে আরো ভাল বলা যেতে পারত। তবে তাঁরা আমাদের আজকের আলোচ্য নহেন। যাকগে, আমি মানবযৌনতাকে যাই ভাবি না কেন, আমার কথাতে তো আর এসব চলছে না! যৌনতাকে এইভাবে অদম্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা হিসাবে দেখার নিখিল বিশ্বের যে সমস্যা সেটা সেসব অঞ্চলে আরো বেশি যেখানে পুরুষ নারীদের অধিকারের বিষয়ে অপেক্ষাকৃত অধিক অনীহা পোষণ করে থাকেন। একটু ভেবে দেখেন! সঙ্কটটা ধরতে পারবেন। পুরুষ ও নারী বললাম নেহায়েৎ আলাপের সুবিধার্থে। লিঙ্গ-পরিচয় এর থেকে যে জটিল ও নানাবিধ সেটা নিশ্চয়ই আপনাদের কানে এসেছে।
সঙ্গীত, উপন্যাস ও ছায়াছবির দুনিয়াও কনসেন্ট বোঝাবুঝিতে পর্যাপ্ত ভেজাল বাঁধিয়ে থাকে। একটু আগে আমরা হলিউডি বা ইউরোপীয় ছায়াছবিতে চেপে-রাখতে-অসম্ভব তথা দৌড়াদৌড়ি-হুড়াহুড়িপূর্ণ যৌনকর্ম বিষয়ে বলছিলাম। এই অঞ্চলের সঙ্কটটা আবার স্বতন্ত্র প্রকৃতির। সঙ্গীত, উপন্যাস ও ছায়াছবিতে নারীপক্ষকে একটা বিশাল হেঁয়ালিপূর্ণ রহস্যময় “না”-এর ডিব্বা হিসাবে দেখানো হয়েছে। হয়তো এসব পুরুষনির্মাতারা নিজেরাও সেভাবে দেখেছেন। তাঁরা ভেবেছেন ও ভাবিয়েছেন যে নারীর পক্ষে যৌনতামূলক যেকোনো কর্মকাণ্ডে লাগাতার “না” বলতে থাকাই সঙ্গত। এই বৈশিষ্ট্যকে তাঁরা নাম দিয়ে এসেছেন ‘লজ্জা’ আর এই বৈশিষ্ট্যধারী নারীজাতিকে তাঁরা নাম দিয়ে এসেছেন ‘লজ্জাশীলা’ বা ‘লজ্জাবনতা’।
কেবল নাম দিয়েই কর্তব্যপালন শেষ করেননি, উপরন্তু সেই লজ্জা অবলোপের দায়িত্বও পুরুষবর্গের উপর আরোপ করেছেন। ফলে তাঁরা সাব্যস্ত করেছেন যে নারীর “না”কে আসলে ‘না’ হিসাবে গণ্য করা যাবে না; বরং তাকে দেখতে হবে একটা শরমপ্রাপ্ত ‘হ্যাঁ’ হিসাবে। ফলে কুস্তি লড়ে এই লজ্জাবনতার ‘না’-কে ‘হ্যাঁ’ বানাতে হবে। এই তৎপরতার সর্ববৃহৎ দলিল মুম্বই ও সাবেক জ্যান্ত ঢাকাই চলতি ধারার ছায়াছবির নায়কদের মধ্যে দেখা গেলেও মোটের উপর এই মডেল চালু আছে। কেউ কেউ আছেন যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার কাছে জবাবদিহিতা চাইতে পারেন সালমান খানের গোস্তময় নাচে নায়িকাকে ‘হ্যাঁকরণ’ প্রকল্প আর চিকন-বুদ্ধির রুচিশীল সাহিত্যে নায়কের লাগাতার জ্ঞানালাপকে আমি কীভাবে একাকার করে ফেললাম! আমি ফেলিনি। শুধু বললাম নারীকে চিত্রণের ক্ষেত্রে মোটের উপর চিন্তাপাটাতনগুলো বেশ এক জায়গা থেকেই আসছে।
তাহলে কি আমি সমাজে নারীর সম্মতি না বুঝবার পরিস্থিতির জন্য কেবল সঙ্গীত-সাহিত্য-চলচ্চিত্রকেই দায়ী করছি?
জ্বি না! আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে আমি মোটের উপর সমাজে সম্মতি-টম্মতি, অন্যের মতামত-টতামত পাত্তা না দেবার বৃহত্তর পটভূমিকেই বরং আগে রাখলাম। পরে এসব আনলাম। এখন যদি গোড়া থেকেই শিশুপুরুষরা জেনে আসেন যে লজ্জাশীলা নারীকে পটিয়ে-পটিয়েই কেবল ‘হ্যাঁ’মূলক মানাতে হবে, তাহলে তো পটভূমিটাই বদলে গেল। পটাতে থাকা আর পিটাতে থাকার সীমানার বিষয়ে যথেষ্ট চৈতন্য তৈরিও তখন কঠিন। পটাতে-পটাতে খুব কার্যকরী না হলে পিটানি চলে আসতে পারে, ওই ‘চাপতে-না-পারা’ অদম্য যৌন-ইচ্ছার মতো।
মোদ্দা কথা খুবই সোজা। আপনারা পুরুষজাতিকে অধীশ্বর ভাবেন বলে সম্মতি বোঝেন না; “না”-কে উদ্ভট সব আর্ট-কালচারের ব্যাখ্যা দিয়ে রেখেছেন বলে সম্মতি বোঝেন না; নারীর (বা যে কোনো লিঙ্গের মানুষের) যৌনাগ্রহ প্রদর্শনের জন্য ন্যূনতম গণতান্ত্রিক একটা পরিবেশ যে দরকার সেটা কোনোদিন মাথাতেই আসে নাই বলে সম্মতি বোঝেন না। যদি মোটামুটি একটা সমতা মান্য করা হয় প্রথম পদক্ষেপ, তাহলে যৌনতাকে নিষ্কাশন ব্যবস্থা হিসাবে না দেখা হলো দ্বিতীয় জরুরি পদক্ষেপ।
আদাবর, ১২, ১৫ জুলাই ২০২১
কভারে মানস চৌধুরী; ছবি. ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা, ২০১৮