প্রাসঙ্গিক রচনা: সরি ভিগানস: দেখুন, মাংস-ভক্ষণ কীভাবে আমাদের মানুষ করেছে
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে ভেবে এসেছে, আগের তুলনায় বেশি মাংসাশী হয়ে উঠতে গিয়েই আমাদের পূর্বপুরুষেরা বিবর্তনের পথে হেঁটেছে। কিন্তু এই তত্ত্বকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে নতুন এক গবেষণায়।
ম্যাট রেনল্ডস
ওয়্যার্ড, জানুয়ারি ২৭ ,২০২২
অনুবাদ: মাহতাবুল আলম
২৪ বছর আগে ব্রিয়ানা পবিনার গিয়েছিলেন কেনিয়ার উত্তর অঞ্চলে। সে সময় নিজের হাত দিয়ে তিনি এমন কিছু হাড় স্পর্শ করেছিলেন, যেগুলি এর আগে শেষবারের মতো স্পর্শ করা হয়েছিল প্রায় ১.৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে। পবিনার মূলত একজন প্যালিওঅ্যানথ্রোপলজিস্ট, যেই পেশা গতানুগতিক নৃবিজ্ঞানীদের চেয়ে আলাদা। প্রাচীন মানুষদেরকে নিয়ে গবেষণা করাই মূলত এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কাজ। কেনিয়ায় গিয়ে পবিনার প্রাচীনকালের প্রাণীদের হাড়গোড় খুঁড়ে বের করছিলেন এবং খুঁজে দেখছিলেন হাড়ের গায়ে কাটাছেঁড়া বা গর্ত আছে কিনা। মূলত এসব দেখার মাধ্যমে তিনি লক্ষ্য করছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা এসব প্রাণীদের হত্যা করে তাদের অস্থিমজ্জা সংগ্রহ করেছে কিনা। কারণ একইসঙ্গে চর্বি আর ক্যালরি সমৃদ্ধ অস্থিমজ্জায় মানবদেহের জন্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি। পবিনার বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনে কর্মরত। তিনি বলেন, “আমরা যেন সময়ের জানালা দিয়ে অতীতের দিকে তাকাচ্ছি। যারা এসব প্রাণী হত্যা করেছিল তারা মোটেও আমাদের মত না। কিন্তু আমরাই এখন তাদের আচরণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ উন্মোচিত করছি। এটা সত্যিই শিহরণ জাগানোর মত।”
আর এই বিষয়টাই আমাদের পূর্বপুরুষদের খাদ্যাভাস নিয়ে পবিনারের মধ্যে তুমুল আগ্রহ তৈরি করেছিল। বিশেষ করে আমাদের পূর্বপুরুষদের খাদ্যাভাস কীভাবে তাদের বিবর্তনে প্রভাব ফেলেছিল এবং কীভাবে এসেছিল আমাদের প্রজাতি হোমো সেপিয়েন্স। ধারণা করা হয় হোমো সেপিয়েন্স এর বিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল মাংস ভক্ষণ। আমাদের অনেক আগের পূর্ব পুরুষেরা একসময় গাছপালা খেয়ে বাঁচত, এবং তাদের ছিল শিম্পাঞ্জির মত ছোট ছোট পা ও ছোট মস্তিষ্ক। কিন্তু প্রায় দুই মিলিয়ন বছর আগে হোমো ইরেক্টাস নামের একটি প্রজাতির উদ্ভব ঘটে, যার বৈশিষ্ট্য ছিল আধুনিক মানুষের মত। হোমো ইরেক্টাস এর মস্তিষ্ক ছিল বড় ও পাকস্থলী ছিল ছোট, এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অনুপাত ছিল আধুনিক মানুষের মতই। কেনিয়ায় খনন করে পবিনার আর তার সহকর্মীরা ঠিক একই সময়ের কিছু ফসিল উদ্ধার করেছিলেন। এই সময়ের ফসিল থেকে বোঝা যায় কেউ এসব প্রাণীদের হত্যা করে তাদের শরীরের হাড় থেকে মাংস আলাদা করে অস্থিমজ্জা সংগ্রহ করেছিল। আর দীর্ঘদিন ধরেই জীবাশ্মবিদেরা বলে যাচ্ছেন যে, মানুষের বৈশিষ্ট্যের বিবর্তন ও মাংস ভক্ষণের মধ্যে জোরালো সম্পর্ক রয়েছে।
পবিনার বলেন, “এই সম্পর্কের বিষয়টা এভাবে ব্যাখ্যা দেয়া হয় যে, মাংসাশী হওয়ার ফলে অনেক কিছুই সম্ভব হয়েছে। মাংস থেকে সহজে পুষ্টি সংগ্রহ করতে পারায় আমাদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে।” বড় ব্রেইন প্রচুর শক্তি ক্ষয় করে। এমনকি বিশ্রামে থাকা অবস্থাতেও মানুষের মস্তিষ্ক শরীরের ২০% শক্তি ব্যয় করে। অন্যদিকে পুষ্টিতে ভরা মাংস মানেই হচ্ছে অতিরিক্ত শক্তি। এভাবে মাংসের মত ক্যালোরিতে ভরপুর খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়াতেই মানুষের বড় ও জটিল আকৃতির মস্তিষ্ক চালানোর জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এদিকে প্রাচীন মানুষেরা শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। অর্থাৎ তাদের দূরবর্তী প্রাণী শিকার করার জন্যে লম্বা লম্বা পা ফেলে অনেকদূর যেতে হত। এ কারণেই তাদের লম্বা পায়ের দরকার ছিল। মোটকথা, অনেকদিন ধরেই এই মতবাদ প্রচলিত যে, মাংসই আমাদের মানুষ বানিয়েছে। এবং পবিনার নিজেও এই কথার সাথে একমত।
কিন্তু ২০২০ এর এপ্রিলে পবিনার একটা ফোনকল পান। এই ফোনকলই তাকে প্রচলিত মতবাদটি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। সে সময় তাকে কল করেন জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির জীবাশ্মবিদ অ্যান্ড্রু বার, যিনি হোমো ইরেক্টাস ও মাংসভোজী হওয়ার মধ্যে থাকা সম্পর্কের ব্যাপারটা নিয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন না। হোমো ইরেক্টাস বিবর্তিত হওয়ার সময় মানুষের পূর্বপুরুষরা সত্যিই আগের চাইতে বেশি মাংস খাচ্ছিল কিনা, সেই বিষয়টাই তিনি ফসিল রেকর্ড ব্যবহার করে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল আমরা এ ব্যাপারে খুব ভাল ভাবে অনুসন্ধান না করাতেই এমন ধারণা তৈরি হতে পারে। বার এর সঙ্গে আলাপের পরে পবিনার বিষয়টা নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। পবিনার বলেন, “আমি প্রচলিত মতবাদকে প্রশ্ন করতে ভালোবাসি, এমনকি সেটা যদি সমাজে প্রতিষ্ঠিত এমন কোনো মতবাদ হয় যা আমি নিজেই মানি।”
করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে গবেষকরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করার জন্যে কেনিয়ায় যেতে পারেননি। তাই এর পরিবর্তে তারা পূর্ব আফ্রিকায় মানুষের বিবর্তনের লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাসের ওপর করা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ৯টি প্রধান ক্ষেত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করেছিলেন। তারা যাচাই বাছাইয়ের জন্যে বিভিন্ন ধরনের মানদণ্ড ব্যবহার করে বুঝতে চেষ্টা করেছেন কতটা সঠিকভাবে প্রতিটা টাইম পিরিয়ড বা সময়কালকে গবেষণা করা হয়েছে। এবং খনন করে জীবাশ্ম নমুনা প্রাপ্ত স্থানে কাটাকুটির চিহ্নসহ কতগুলি হাড় পাওয়া গিয়েছে। ‘প্রসিডিংস অভ দ্যা ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেস’ (সংক্ষেপে PNAS) নামক জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বার ও পবিনার বলেন, মাংসাশী হওয়া ও মানুষের বিবর্তনের মধ্যে থাকা সম্পর্ক ততটা নিশ্চিত নয়, যতটা আগে ভাবা হত। তারা সিদ্ধান্তে আসেন, হোমো ইরেক্টাসের আবির্ভাবের পর মাটি খুড়ে বের করা কাটাকুটির চিহ্নসহ হাড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি মূলত গবেষকদের এক ধরনের বায়াস বা পক্ষপাত। যেসব স্থানে খনন কাজ চালিয়ে ঐতিহাসিক এই সময়কালের জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছিল, অনেক জীবাশ্মবিদই সেসব স্থান আবারো খোঁড়াখুঁড়ি করে হাড় অনুসন্ধান করেছিল। এর ফলেই তারা আরো হাড় খুঁজে পেয়েছিল।
তবে নতুন এই তত্ত্ব মাংস ভক্ষণের সাথে বিবর্তনের সম্পর্ককে বাতিল করে দিচ্ছে না। বরং এই সম্পর্ক যে আরো জটিল হতে পারে, সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বার এর মতে, প্রাচীন মানুষদের যেকোনো সাধারণ অভ্যাস বা আচরণ খুঁজে বের করতে গিয়ে আমরা নির্দিষ্ট সময়ের পুরনো নির্দিষ্ট কিছু স্থানেই খননকাজ চালিয়েছি বেশি। অন্তত অন্যান্য স্থানের চাইতে নির্দিষ্ট সেসব স্থানে খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে বেশি। তার ওপর জীবাশ্ম হিসেবে প্রাচীনকালের প্রাণীদের হাড় ভালভাবে সংরক্ষিত রয়েছে, এমন জায়গার সংখ্যা খুব কম। এ কারণে জীবাশ্মবিদেরা এক জায়গা থেকে সংগ্রহ করা নমুনার কথা উল্লেখ করেই অনেক গবেষণাপত্র লিখেছেন। বার ও পবিনার গবেষণা করে দেখতে পেয়েছেন, যে সময়টাতে হোমো ইরেক্টাস বিবর্তিত হয়েছিল, অর্থাৎ ১.৯ থেকে ২.৬ মিলিয়ন বছরের মাঝামাঝি সময়ের পুরনো খননকাজ চলা অন্যান্য স্থানে গবেষণা হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম। “আমরা শুধুমাত্র সেসব জায়গাতেই অনুসন্ধান চালাই যেখানে সংরক্ষিত ফসিল বা জীবাশ্ম পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কারণ ফসিল হচ্ছে বিজ্ঞানের এই ধারার কাঁচামাল। কাজেই আমরা একই জায়গায় বার বার যেতে থাকি”, বলেন অ্যান্ড্রু বার।
বার মনে করেন, জীবাশ্মবিদ্যায় একটা শূন্যস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছে তাদের নতুন এই গবেষণা, যেটা পূর্ণ হওয়া দরকার। বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের মত বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হওয়ার পেছনে অন্যান্য কারণ থাকতে পারে। অথবা এমনও হতে পারে যে, হোমো ইরেক্টাস বিবর্তিত হওয়ার এই সময়টার বহু আগেই মাংস ভক্ষণ প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল, যার কারণ আমরা এখনো খুঁজে পাইনি। “[ইতিহাসের] একটা সময়ে [পশু-প্রাণী] হত্যার কোনো প্রমাণই খুঁজে পাওয়া যায় না, আবার একটা সময়ে পাওয়া যায় প্রচুর প্রমাণ। এই দুই সময়ের মধ্যে কিছু একটা ঘটারই কথা।” জানান ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী জেসিকা থম্পসন।
অবশ্য নতুন গবেষণাপত্রটি “মাংসই আমাদেরকে মানুষ বানিয়েছে”, এই অনুমান সম্পূর্ণ বাতিল করে দিচ্ছে বলে মনে করেন না থম্পসন। বরং বিভিন্ন সমকাল নিয়ে কতটা ভালভাবে গবেষণা করা হয়েছে, সে ব্যাপারে এই গবেষণাপত্রের গবেষকদের সাথে তিনি একমত। ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ফসিল রেকর্ড হিসেবে কতগুলি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী পাওয়া গেছে, তার ওপর ভিত্তি করেই বার ও পবিনার বিষয়টা অনুমান করেছেন। তারা যুক্তি দেখান, জীবাশ্মবিদেরা যদি নির্দিষ্ট একটি সময়কালের পুরনো বিভিন্ন স্থানেই বেশি খনন করতে থাকেন, তাহলে সেই সময়কালের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ফসিল রেকর্ডই বেশি থাকবে। আর এই বিষয়টা বিবেচনায় রেখেই তারা মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন কাটাকুটির চিহ্নসহ প্রাপ্ত হাড়গুলি প্রাগৈতিহাসিক যেই সময়কালের, সেই সময়কাল যথেষ্ট ভালভাবে গবেষণা করা হয়েছে কিনা।
অবশ্য থম্পসনের মতে, জীবাশ্মবিদেরা হত্যা করা প্রাণীদের হাড়গোড় কতটা ভালভাবে খুঁজেছে, সেটা নির্ধারণ করতে গিয়ে বার ও পবিনার যেভাবে “বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী থাকার কথা” ভেবে সিদ্ধান্তে এসেছেন, তা খুব কার্যকর না। তার মতে, প্রাচীন জীবাশ্ম পাওয়া যাওয়া প্রত্যেকটি স্থান নিয়ে একইভাবে গবেষণা করা হয় না। আর প্যালিওঅ্যানথ্রোপলজিস্টদের কাজই হচ্ছে প্রাচীন মানুষদের জীবন সম্পর্কে গবেষণা করা। সেজন্যেই তারা হয়ত একটা নির্দিষ্ট স্থানে হত্যা করা প্রাণীদের হাড়ের অবশিষ্টাংশ খোঁজার অনেক চেষ্টা করছেন। অর্থাৎ জীবাশ্মবিদেরা যারা অন্য কোনো ধরনের ফসিল খোঁজেন, বিশেষ কোনো সময়কাল নিয়ে তাদের খুব বেশি গবেষণা না থাকলেও প্যালিওঅ্যানথ্রোপলজিস্টরা তাদের পেশাগত কাজই করে গিয়েছেন।
তিনি মনে করেন এ ব্যাপারে প্রচলিত ধারণাই হয়ত সঠিক। অর্থাৎ গবেষকরা হোমো ইরেক্টাসদের আবির্ভাবের আগের সময়ে প্রাণীদের হাড়ে হত্যাকাণ্ডের চিহ্ন খুঁজে না পাওয়ার কারণ হয়ত এই না যে তারা ভালভাবে খুঁজে দেখেনি। বরং আসলেই এর কারণ হতে পারে, সে সময়ে হত্যা করা প্রাণীদের জীবাশ্মের নমুনাই হয়ত খুব বেশি নেই।
তবে বার ও পবিনারের মত থম্পসনও শেষ পর্যন্ত মনে করেন যে, মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগের ফসিল সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে জানার একমাত্র নিশ্চিত পথ হচ্ছে যে সময়কাল সম্পর্কে আমাদের হাতে তথ্য কম আছে, তা আরো সূক্ষ্মভাবে খতিয়ে দেখা। তিনি বলেন, “[এই গবেষণাপত্র দেখে] আমার মনে হয়েছে যে গবেষণায় নমুনা হিসেবে দেখানোর ‘স্যামপ্লিং’ পদ্ধতিতে মারাত্মক সমস্যা রয়েছে আমাদের। [এই গবেষণা থেকে] পাওয়া শিক্ষাটাই হল, আমাদেরকে ২.৬ এবং ১.৯ মিলিয়ন বছর আগের সময়ের জীবাশ্ম নমুনার দিকে আরো ভালভাবে নজর দিতে হবে। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে আসল বিষয়টা কী।”
নতুন এই গবেষণা মাংস ভক্ষণের সঙ্গে বিবর্তনের সম্পর্কের ধারণা পুরোপুরি বাতিল করে না দিলেও সেই যুগের মানুষের বিবর্তন কীভাবে হয়েছিল, তা নিয়ে আরো অনেক ধরনের তত্ত্ব বা অনুমান রয়েছে। বার্মিংহামে অবস্থিত আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী স্টিফেন মেরিট (Stephen Merritt) মাংস ভক্ষণের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেন, হোমো ইরেক্টাসের আচরণ সম্পর্কে এমন অনেক কিছুই আছে যা আমরা জানি না। তারা মৃত প্রাণীর মাংস খেত নাকি শিকার ধরে খেত? কীভাবে প্রাণীদের মারতে হবে, তা তারা কীভাবে শিখেছিল? ধরা যাক কোনো হরিণ শিকার করার পরে সেই মাংস কি প্রজাতির অন্যান্যদের সাথে ভাগাভাগি করে খেত নাকি অন্যান্য বানর জাতীয় প্রাণীদের মত তারাও সবটুকু মাংস নিজের জন্যে রেখে দিত?
তাদের এ ধরনের আচরণের ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া যদিও কঠিন, তবে এসবই হয়ত আমাদের বিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। মানুষের মত বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হওয়ার পেছনে আরেকটি বিকল্প তত্ত্বের নাম হচ্ছে ‘গ্র্যান্ডমাদার হাইপোথিসিস’। এই হাইপোথিসিস অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃক্ষ বা ফলমূল জাতীয় খাবারের সংকটে পড়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষরা। সে সময়ে খাবার সংগ্রহের বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখত বয়স্ক নারী সদস্যরা। তারা জানত কীভাবে খোসা ছাড়িয়ে বাদাম থেকে বীজ বের করতে হয় বা মাটি খুঁড়ে কীভাবে গাছের মূল বা কাণ্ড বের করে নিতে হয়। তারা এসব খাবার তাদের সন্তানদের সাথে ভাগাভাগি করত। এবং এসব খাবারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার কারণে তাদের সন্তানেরাও দ্রুত মাতৃস্তন ছাড়তে পারত। এভাবে তাদের মায়েরাও দ্রুত তাদের পরবর্তী সন্তান ধারণ করতে পারত। কেন বিবর্তনের ফলে মানুষের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য এসেছে যে, স্থায়ীভাবে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও মানব নারীরা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকে, এই হাইপোথিসিস থেকে এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
কিন্তু বিবর্তনের অন্যান্য তত্ত্বের মত এটাও ঝাপসা হয়ে আসা এক ছবির ওপর ভিত্তি করে অস্পষ্ট কিছু ধারণা মাত্র। হোমো ইরেক্টাসদের খাদ্যাভাসের চাইতেও মানুষের বিবর্তনের গল্প অনেক জটিল। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের খাদ্যাভাস সংক্রান্ত তত্ত্বই এখন অনেক গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রাচীন খাদ্যাভাস নিয়ে আগ্রহীদের অনেকে প্রক্রিয়াজাত খাবার বাদ দিয়ে মাংস ও কাঁচা শাকসবজি খাওয়ার কথা বলেন। তারা এমন যুক্তি দেন যে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেসব খাবার খেত, সেগুলি আমাদের জন্যেও স্বাস্থ্যকর। কেউ কেউ আবার রান্না করা মাংস একেবারেই পরিহার করতে বলেন, যদিও আগুন কাজে লাগিয়ে খাবার রান্না করার অনেক প্রাচীন প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে। পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের দ্বিমত সত্ত্বেও জর্ডান পিটারসন ও তার মেয়ে মিখাইলা পিটারসন একবার শুধুমাত্র গরুর মাংস, লবণ ও পানি রেখেছিলেন তাদের খাদ্য তালিকায়। উচ্চমাত্রার চর্বি ও অল্প কার্বোহাইড্রেট যুক্ত ‘কিটো ডায়েট’কে অনেকসময় আমাদের পূর্বপুরুষদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে তুলনা করা হয়। কিন্তু গবেষণা থেকে জানা যায় আধুনিক সময়ের জনপ্রিয় সব ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাসে যেভাবে দাবি করা হয়, তার তুলনায় প্রাচীন মানুষদের খাবারের তালিকায় অনেক কম মাংস থাকত।
কারো কারো মতে, মানবজাতির উৎপত্তির গল্পটা মাংসাশী হওয়ার সাথে গভীরভাবে জড়িত হওয়ার মানে হচ্ছে অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া আমাদের কিছু পুরুষালি আদর্শের সাথে এর সংযোগ রয়েছে। আর পুরুষালি সেই আদর্শের ব্যাপারটা এমন, যেন মানুষের অস্তিত্ব ঋণী হয়ে আছে রক্ত ও মাংসের প্রতি আমাদের আদিম লোভের কাছে। কিন্তু গবেষণা থেকে পাওয়া প্রমাণ থেকে বোঝা যায় বাস্তবতা এর চেয়ে বেশি জটিল। মাংস ভক্ষণের অভ্যাসের সাথে সাথেই আরো অনেক আচরণ বিবর্তিত হয়েছিল। এবং সেসব আচরণের ফলেই আমাদের বড় আকারের মস্তিষ্ক চালানোর মত শক্তি পাওয়া গিয়েছিল, যা আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল জটিল ভাষা ও সমাজের দিকে। মেরিট এর মতে, বেশি পরিমাণে মাংস খেতাম বলেই আমরা মানুষ হয়েছি, ব্যাপারটা এমন না। বরং মাংস ভক্ষণকে ঘিরে আমরা যে অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ড করতাম, সেগুলিই হতে পারে এর আসল কারণ। তিনি বলেন, ‘মাংসই কি আমাদের মানুষ বানিয়েছিল?’ এই প্রশ্নের চাইতে আমি বরং জানতে আগ্রহী মাংস কীভাবে আমাদেরকে মানুষ বানিয়েছিল।
সংযুক্তি:
তার মিট অনলি ডায়েট প্রসঙ্গে জর্ডান পিটারসন