‘প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি’ মূলত পরিবেশ বিপর্যয় চিহ্নিত ও পরিমাপ করার ব্যবস্থা।

প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী নামের এই গ্রহটির জন্ম। শুরু থেকেই পৃথিবী প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল না। বিভিন্ন ধরনের পরিবেশগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে এই গ্রহে প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়েছে।

তবে এই গ্রহে প্রাণী এবং উদ্ভিদের বসবাস শুরু হওয়ার পরেও বিভিন্ন যুগে প্রাকৃতিক কারণে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। তাতে বিলুপ্ত হয়েছে কোটি কোটি প্রজাতির প্রাণ। ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ঘটা ডাইনোসর বিলুপ্তির ঘটনা আমরা অনেকেই জানি।


সেজাল শর্মা
ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩


এ ধরনের আরো অনেক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গেছে পৃথিবী। যেমন, ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে ঘটা অজানা এক বিপর্যয়ের কারণে সে সময়কার পৃথিবীর প্রতি ১০ ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির ৯টিই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

সমুদ্রে থাকা প্রাণী প্রজাতির মধ্যে বেঁচে ছিল ৫ শতাংশেরও কম। বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল প্রায় সকল প্রজাতির গাছ।

সেসব ভয়ঙ্কর সময়ের তুলনায় আমরা অনেক শান্ত ও স্থিতিশীল সময়ে বাস করছি। শান্ত এই সময়কালকে চিহ্নিত করতে বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘হলোসিন যুগ’। হলোসিন যুগ শুরু হয় আজ থেকে ১১ হাজার ৭০০ বছর আগে।

হলোসিন যুগেই আমাদের চেনা-জানা সকল মানব সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। গড়ে উঠেছে সব ধরনের প্রযুক্তি ও সমাজ।

তবে মানুষের আচরণ ও কাজের প্রভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে হলোসিন যুগ। এমনটাই ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।

মানবসৃষ্ট কর্মের প্রভাবে পৃথিবীতে যেসব পরিবর্তন ঘটলে হলোসিন যুগের শান্ত ও স্থিতিশীল অবস্থা শেষ হয়ে যেতে পারে, সেটা পরিমাপ করার জন্য ‘প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি’ নামের এক ধরনের মানদণ্ড রয়েছে। ‘প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি’ মূলত পরিবেশ বিপর্যয় চিহ্নিত ও পরিমাপ করার ব্যবস্থা।

জলবায়ু পরিবর্তন, মিঠা পানির উপস্থিতি কিংবা ভূমির ব্যবহারের মত ৯টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এই মানদণ্ড তৈরি করা হয়েছে।

সম্প্রতি নতুন একটি গবেষণায় সতর্ক করা হয়েছে, মানুষের কর্মকাণ্ডের প্রভাবে ইতিমধ্যে ৯টি প্ল্যানেটারি বাউন্ডারির মধ্যে ৬টিই অতিক্রম করা হয়ে গেছে। ফলে বড় আকারের পরিবেশগত পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে পৃথিবী।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘সায়েন্স অ্যাডভান্স’ জার্নালে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, মানুষ পরিবেশ দূষণ এবং প্রাকৃতিক জগত ধ্বংস করছে। এর কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণের জন্য আরো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে পৃথিবী।

‘প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি’ আসলে কী?
‘প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি’র বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘গ্রহের সীমা’। বিজ্ঞানীদের নির্ধারিত এই সীমা লঙ্ঘন না করলে মানবসমাজের পক্ষে আগামী প্রজন্মের জন্য উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব।

২০০৯ সালে ২৯ জন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের একটি দল প্রথম ‘প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি’র ধারণা প্রস্তাব করে। নয়টি প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি হল:

১. বায়োস্ফিয়ার বা জীবমণ্ডলের বিশুদ্ধতা
২. জলবায়ু পরিবর্তন
৩. স্বাদু পানির পরিমাণ পাল্টে যাওয়া
৪. সমুদ্রের অম্লতা
৫. স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডলে ওজোন স্তরের ক্ষয়
৬. বায়ুমণ্ডলে অ্যারোসল বৃদ্ধি
৭. ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন
৮. কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ বা পারমাণবিক বর্জ্যের মত “নতুন” বস্তু বা উপাদান তৈরি
৯. ‘বায়োজিওকেমিক্যাল ফ্লো’ বা ‘ভূ-জৈব-রাসায়নিক প্রবাহ’। ভূমির অভ্যন্তর, বায়ুমণ্ডল এবং প্রাণীর মধ্যে রাসায়নিক পদার্থ যেভাবে চক্রাকারে চলাচল করে।

গবেষণায় যা উঠে এসেছে
সাম্প্রতিক গবেষণাটিতে দেখা গেছে, আমাদের গ্রহের ৯টি বাউন্ডারি বা সীমার মধ্যে ৬টি সীমাই লঙ্ঘন করা হয়েছে।

সেগুলি হল বায়োস্ফিয়ার বা জীবমণ্ডলের বিশুদ্ধতা, জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাদু পানির পরিমাণ পাল্টে যাওয়া, ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন, নতুন বস্তু বা উপাদান তৈরি এবং ‘বায়োজিওকেমিক্যাল ফ্লো’ বা ‘ভূ-জৈব-রাসায়নিক প্রবাহ’।

জার্মানির ‘পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ’ এর পরিচালক এবং গবেষণাপত্রের সহ-লেখক ইয়োহান রকস্ট্রম এর মতে, আমরা খুবই খারাপ অবস্থায় আছি।

তিনি জানান, এই গবেষণা থেকে বোঝা যায়, পৃথিবী তার সহনশীলতা হারাচ্ছে। এবং আমাদের গ্রহ আসলে অসুস্থ।

৯ 'প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি'র ৬টির ক্ষেত্রেই বিপদসীমা অতিক্রম করেছে পৃথিবী
উর্বর জমি থেকে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন এবং ফসফরাস হ্রদ ও অন্যান্য জলের ধারায় মিশে গিয়ে ঘন সবুজ শৈবালের জন্ম দিতে পারে যা জলজ প্রজাতির জন্য ক্ষতিকর

গত ১৩ সেপ্টেম্বর (২০২৩) এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিশ্চিত করে। এর আগে ২০২২ সালে করা একটি গবেষণায় ‘নতুন বস্তু বা উপাদান তৈরি’কে আমাদের গ্রহের অতিক্রান্ত পঞ্চম সীমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এ বছরের গবেষণায় স্বাদু পানির পরিমাণ পাল্টে যাওয়াকে নতুন অতিক্রান্ত সীমা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

রকস্ট্রম এর মতে, নদীর প্রবাহ খারাপ দিকে যাওয়ার বিষয়টা এখন আগের চেয়ে আরো ভাল ভাবে পরিমাপ করা যাচ্ছে এবং সমস্যাটা আগের চেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফলে এই গবেষণার আগ পর্যন্ত স্বাদু পানির পরিমাণ পাল্টে যাওয়াটা অতিক্রান্ত সীমা হিসেবে বিবেচনা করা হত না।

তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় স্বাদু পানির পরিমাণ পাল্টে যাওয়াটা অতিক্রান্ত ষষ্ঠ প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি বা সীমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

গবেষকদের মতে, প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি বা সীমা আমাদের গ্রহের ভাগ্য নির্ধারণ করে। এর আগে অন্যান্য আরো অনেক গবেষণায় এই ৯টি প্ল্যানেটারি বাউন্ডারির ধারণা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

যদি পৃথিবী এই ৯টি সীমা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারে, তাহলে গ্রহটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ থাকবে। কিন্তু একাধিক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, তেমনটা হচ্ছে না।

বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই জানিয়েছেন, শিল্পবিপ্লবের আগে যেমন ছিল, তার তুলনায় আমাদের গ্রহের গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়া উচিৎ নয়। এবং ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের এই ধারণা মাথায় রেখেই অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের নীতি নির্ধারণ করেছে।

পৃথিবী তার সহনশীলতা হারানোর কারণে ১.৫ সেলসিয়াসের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এতে আমাদের গ্রহ চূড়ান্ত পর্যায়ের বিপর্যয়ের কাছাকাছি চলে যেতে পারে।

আগে করা ২,০০০টি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণার ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে সাম্প্রতিক এই গবেষণা।

অতিক্রান্ত ৬টি সীমা
অতিক্রান্ত ৬টি প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি বা সীমার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বায়োস্ফিয়ার বা জীবমণ্ডলের বিশুদ্ধতা।

বাস্তুতন্ত্র কতটা ভাল ভাবে কাজ করছে, সেটা পরিবর্তিত হয় জীবমণ্ডলের বিশুদ্ধতা কমে এলে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ধারণা নিয়ে বড় পরিসরে আলোচনা শুরু হয় ১৯৮০’র দশকে। তবে মানুষ যেভাবে ভূমি ব্যবহার করছে, তার ধরন পাল্টে যাওয়ার কারণে জীবমণ্ডলের বিশুদ্ধতা নষ্ট হওয়া শুরু হয় এরও এক শতাব্দী আগে।

১৯৬০-এর দশক থেকে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা ও ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ভূমি ব্যবহারের পরিমাণও বাড়ছে। এতে আমাদের জীবমণ্ডলের বিশুদ্ধতা প্রতিনিয়ত আরো ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আরো পড়ুন: কেন ১৫-মিনিট শহর?

দ্বিতীয় সবচেয়ে বেশি যে সীমানা বা প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি আমাদের গ্রহে প্রভাব ফেলছে, সেটা হল “নতুন” বস্তু বা উপাদান তৈরি। নতুন বস্তু বা উপাদান বলতে মূলত কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ এবং উপাদান বোঝানো হয়, যা মানুষ তৈরি করার আগে প্রকৃতিতে বিদ্যমান ছিল না।

এ ধরনের পদার্থের মধ্যে থাকতে পারে মাইক্রোপ্লাস্টিক, তেজষ্ক্রিয় পদার্থ, পারমাণবিক বর্জ্য এবং পারমাণবিক অস্ত্র।

এছাড়াও জৈব দূষণকারী পদার্থ কিংবা যেসব পদার্থ আমাদের হরমোনের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে, তা নতুন বস্তু বা উপাদানের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এ ধরনের কয়েক লক্ষ কৃত্রিম রাসায়নিক উপাদান বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে এবং পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যান্য অনেক সমস্যার পাশাপাশি এসব উপাদান ওজোন স্তরের ক্ষয়ের অন্যতম কারণ।

বিজ্ঞানীদের মতে, এসব কৃত্রিম রাসায়নিক যৌগ যতক্ষণ না পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার মাধ্যমে নিরাপদ হিসেবে নিশ্চিত করা যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত উন্মুক্ত পরিবেশে এগুলি মোটেও ছড়ানো উচিৎ না।

তৃতীয় ভয়ঙ্কর সীমানাটি হল ‘জলবায়ু পরিবর্তন’। প্রাথমিকভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস এবং অ্যারোসল নির্গমনের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে।

“বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই জানিয়েছেন, শিল্পবিপ্লবের আগে যেমন ছিল, তার তুলনায় আমাদের গ্রহের গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়া উচিৎ নয়। এবং ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের এই ধারণা মাথায় রেখেই অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের নীতি নির্ধারণ করেছে।”

অ্যারোসল হল কোনো গ্যাসের মধ্যে থাকা সূক্ষ্ম কঠিন পদার্থের কণা বা তরল পদার্থের একটি মিশ্রণ।

এই গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের নিরাপদ ঘনত্বের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫০ পার্টস পার মিলিয়ন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের গ্রহের বায়ুমণ্ডলে এর ঘনত্ব ৪১৭ পার্টস পার মিলিয়ন, যা আমাদের জন্য অনিরাপদ।

অতিক্রম করা চতুর্থ সীমানাটি হল স্বাদু পানি বা মিঠা পানির পরিমাণ পাল্টে যাওয়া। এই সীমানা কাঠামোতে স্থলভাগে থাকা সম্পূর্ণ জলচক্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। এবং এতে আসা যেকোনো পরিবর্তন বিবেচনা করা হয়।

এই প্ল্যানেটারি বাউন্ডারির অধীনে গাছপালায় থাকা অদৃশ্য পানিকেও বিবেচনা করা হয়। এ ধরনের পানির উপস্থিতিকে বলা হয় ‘গ্রিন ওয়াটার’ বা ‘সবুজ পানি’। নদী বা হ্রদের মত জলাশয়ে থাকা দৃশ্যমান পানিকে বলা হয় ‘ব্লু ওয়াটার’ বা ‘নীল পানি’।

এই প্ল্যানেটারি বাউন্ডারির অধীনে গাছপালায় থাকা অদৃশ্য পানিকেও বিবেচনা করা হয়। এ ধরনের পানির উপস্থিতিকে বলা হয় ‘গ্রিন ওয়াটার’ বা ‘সবুজ পানি’। নদী বা হ্রদের মত জলাশয়ে থাকা দৃশ্যমান পানিকে বলা হয় ‘ব্লু ওয়াটার’ বা ‘নীল পানি’।

এই প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি বা সীমা অতিক্রম করা হয়েছে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই। শিল্পবিপ্লবের আগে পৃথিবীতে স্বাদু পানির অবস্থা যেমন ছিল, সেটাকেই নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে সেই অবস্থা থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিচ্যুতি ঘটেছে। এ কারণে মিঠা পানি যেখানে যতটা থাকার কথা, সেই পরিমাণ ঠিক নেই।

পঞ্চম সীমানাটি হল ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন।

আমাদের গ্রহের সর্বশেষ বরফ যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে ১১ হাজার ৭০০ বছর আগে। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে হলোসিন যুগ। প্রাকৃতিকভাবে হলোসিন যুগে যতখানি বনভূমি থাকার কথা, তার সঙ্গে বর্তমান সময়ের পরিমাণকে তুলনা করে নির্ধারণ করা হয়েছে এই সীমানা।

সময়ের সাথে সাথে বনভূমির পরিমাণ অনেক কমে আসছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এই সীমা অতিক্রমের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দায়ী আমাজন জঙ্গলের বনভূমি ধ্বংস করা। আগের তুলনায় ২০১৫ সাল থেকে বনভূমি আরো বেশি পরিমাণে ধ্বংস হচ্ছে। এদিকে বনভূমি যেমন ব্যবহার করা হচ্ছে নতুন কাজে তেমনি দাবানলও বনভূমির পরিমাণ দ্রুত কমিয়ে ফেলছে।

বর্তমানে আমাদের গ্রহে বনভূমির উপস্থিতি বিপজ্জনক মাত্রায় কমে এসেছে।

ষষ্ঠ যেই সীমা আমরা অতিক্রম করেছি, সেটা হল ‘বায়োজিওকেমিক্যাল ফ্লো’ বা ‘ভূ-জৈব-রাসায়নিক প্রবাহ’। মূলত বায়ুতে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস, এই দুটি মৌলিক উপাদানের পরিমাণ পাল্টে যাওয়ার মাধ্যমে এই সীমার লঙ্ঘন ঘটেছে। এই দুটি মৌলিক পদার্থ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হল পৃথিবীতে থাকা সব ধরনের প্রাণের মধ্যেই এই দুটি উপাদান রয়েছে।

বাকি তিনটি নিরাপদ সীমা
৯টি প্ল্যানেটারি বাউন্ডারির ৩টি এখনও অতিক্রম করা হয়নি বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। এই তিনটি সীমার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রভাবিত হয়নি।

তিনটি সীমার প্রথমটি হল স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডলে ওজোন স্তরের ক্ষয়। পৃথিবীতে এই বিপর্যয়ের করুণ পরিণতি ঘটতে গিয়েও ঘটেনি।

ওজোন স্তরের ক্ষয় প্রতিরোধে ১৯৮৭ সালে মন্ট্রিয়ল চুক্তি বা মন্ট্রিয়ল প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। এরপর থেকে বিশ্বব্যাপী ওজোন স্তর ক্ষয়ের পরিমাণ কমানো সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডলে ওজোন স্তরের ক্ষয়ের মাত্রা কমেছে এবং নিরাপদ অবস্থার মধ্যে আছে।

দ্বিতীয় নিরাপদ প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি হল বায়ুমণ্ডলে অ্যারোসল বৃদ্ধি। তবে সময়ের সাথে সাথে এই সমস্যাও প্রকট আকারে দেখা দিচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে অ্যারোসল এর মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রভাব ইতিমধ্যেই ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ুর ওপর দেখা যাচ্ছে।

আরো পড়ুন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত খাদ্যের এক তৃতীয়াংশ অপচয়—পরিবেশের ওপর এটি যেমন প্রভাব ফেলছে

তবে গবেষণায় বলা হয়েছে, এখনও পর্যন্ত এই প্রভাব বৃষ্টিপাতের পরিমাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এবং শুধুমাত্র আঞ্চলিক জলবায়ুর ওপরেই এই প্রভাব পড়ে। এসব কারণে বায়ুমণ্ডলে অ্যারোসল বৃদ্ধি এখনো বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।

তৃতীয় এবং শেষ নিরাপদ সীমাটি হল সমুদ্রের অম্লতা। যদিও বর্তমানে এটি নিরাপদ সীমার মধ্যে রয়েছে, কিন্তু কার্বন ডাই অক্সাইড এর নির্গমন বাড়ার সাথে সাথে পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে।

প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি লঙ্ঘনের প্রভাব যেভাবে কমানো সম্ভব
প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি অতিক্রমের ফলে পরিবেশে যেসব বিরূপ প্রভাব পড়েছে, সেগুলি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

প্রথমত জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো বন্ধ করা এবং ধ্বংসাত্মক চাষাবাদ বন্ধ করা খুবই জরুরী।

এছাড়াও জরুরী বনভূমির পরিমাণ বাড়ানো। গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে, ২১০০ সালের মধ্যে আমাদের মোট বিশ্বব্যাপী বনভূমি ২০ শতকের শেষের দিকে যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এই পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হলে বায়ুমণ্ডলে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নেওয়ার একটা উপায় তৈরি হবে।

কিন্তু গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা এটাও উল্লেখ করেছেন যে, ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি একই রকম থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে এমনটা ঘটবে বলে আশা করা যায় না।

গবেষণার সারাংশ
প্ল্যানেটারি বাউন্ডারির ৯টি সীমার মধ্যে ৬টি অতিক্রম করার ঘটনায় বোঝা যায়, পৃথিবী এখন আর মানুষের বসবাসের জন্য নিরাপদ নেই। এমনকি যেসব প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি সীমার মধ্যে রয়েছে, সেগুলিও খুব দ্রুতই অতিক্রান্ত হয়ে যাবে।

যেমন, সমুদ্রের অম্লতার মাত্রা অদূর ভবিষ্যতেই সীমা অতিক্রম করবে। এবং বিভিন্ন অঞ্চলের বায়ুমণ্ডলে অ্যারোসল এর মাত্রাও বাড়ছে। এই মাত্রা অব্যহত থাকলে এসব সীমাও অতিক্রম করা হয়ে যাবে।

তবে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডলে ওজোন স্তরের ক্ষয় কিছুটা কমে এসেছে।

এর আগে প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি নিয়ে যেসব গবেষণা করা হয়েছিল, তার তুলনায় এই গবেষণায় দেখা গেছে সকল বাউন্ডারি বা সীমা অতিক্রমের মাত্রা বেড়ে গেছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানের ভাষায় পৃথিবীতে থাকা সব জীবনের ভিত্তি হল ‘প্রাইমারি প্রডাকশন’ বা ‘প্রাথমিক উৎপাদন’। এটি পৃথিবীর সকল প্রাণকে প্রভাবিত করে। সহজ কথায় প্রাথমিক উৎপাদন হল সেই প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থ তৈরি হয়।

প্রাথমিক উৎপাদনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল সালোকসংশ্লেষণ, যার মাধ্যমে উদ্ভিদ সূর্যালোক ব্যবহার করে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং পানিকে অক্সিজেন ও জৈব পদার্থে রূপান্তর করে।

সাম্প্রতিক এই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী রাখতে হলে এই গ্রহের প্রাকৃতিক উৎপাদনের ওপর মানুষের প্রভাব কমাতে হবে।

অনুবাদ: জুবায়েদ দ্বীপ