আপনি কি জানেন আপনার সকালের কাজ কী? বা দুপুর, বিকাল এবং রাতের কাজ? আমরা বেশিরভাগ মানুষই এটা জানি না। মানুষ ভেদে প্রতিটা কাজ করারই সঠিক সময় আছে। অফিস টাইমের মত সবার জন্য সবকিছু একই রুটিনে বাঁধা থাকা কারণে নিজেরা কোন সময়টাতে কোন কাজ সবচেয়ে ভালো করতে পারব তা আর জানা হয়ে ওঠে না। কিন্তু তা জানার খুব সহজ উপায় আছে।

আমাদের সবার মতো এলিসের কাজও নিয়মিত এবং দৈনন্দিন কাজের সমন্বয়। তার অনেক কাজ আছে এক্ষুনি করা দরকার। একইসাথে দীর্ঘমেয়াদী অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজও থাকে, যেগুলি জরুরি ভিত্তিতে না করলেও চলে।

সে সকাল বেলাতেই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করে, যেগুলি তাকে করতেই হবে। প্রতিদিন একই কাজ করা বিরক্তিকর। তাই তার দৃষ্টিভঙ্গি হলো দরকারি কাজের তালিকা তৈরি করা ও সেগুলি দ্রুত শেষ করা। এতে সে ঝামেলামুক্ত একটি বিকেল পায়। সেই সময়টা সে সৃষ্টিশীল কাজে ব্যয় করতে পারে। যেমন, গবেষণা, পরিকল্পনা, বিভিন্ন ধরনের প্রেজেন্টেশন তৈরি।

সমস্যা এটাই, সে সকালে কাজ করে অভ্যস্ত মানুষ। বিকেলে যে সময়ের মধ্যে সে দৈনন্দিন কাজ শেষ করতে পারে, ততক্ষণে অ্যানার্জি কমে যায়। আরেকটা খারাপ বিষয় হলো, সে যুক্তরাজ্যে কাজ করে। বিকালের সময়টাতে সে তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকর্মীদের কাছ থেকে অসংখ্য মনোযোগ বিচ্ছিন্নকারী ইমেইল ও ফোনকল পায়।

এজন্য তাকে সৃজনশীল কাজ বিকালের জন্য ফেলে রাখতে হয়, যখন সে আর কাজের মুডে থাকে না। এলিসকে অবশ্যই তার কাজ করার উপায় বদলাতে করতে হবে। এই আর্টিকেলে আমরা খুঁজে বের করব কীভাবে আপনি দিনের সব থেকে ভালো সময়টি খুঁজে বের করবেন এবং সেই অনুযায়ী আপনার কাজের রুটিন তৈরি করবেন।

# নোট:

কিছু কাজ সাথে সাথে করে ফেলতে হয়। এই পদ্ধতিটি যে কাজগুলি সাথে সাথে করা যায় না, সেগুলির ক্ষেত্রে ব্যবহার করুন।

প্রথম ধাপ: আপনার সবচেয়ে সেরা সময়গুলি খুঁজে বের করুন

আমাদের সবারই দিনের বেলায় ভিন্ন ভিন্ন সেরা সময় অথবা ‘হায়েস্ট অ্যানার্জি টাইম’ থাকে। আমাদের কেউ সকালে কাজ করতে পছন্দ করে, কেউ বিকেলে আর অন্যেরা রাতে।

তবে অধিকাংশ মানুষই সহজাতভাবে কাজ করার জন্য উপযুক্ত এবং অনুপযুক্ত সময় সম্পর্কে ধারণা রাখেন। এবং কারোরই সম্ভবত শুধুমাত্র উপযুক্ত বা শুধুমাত্র অনুপযুক্ত সময় থাকে না। কিছু মানুষ সকালের দিকে সতেজ অনুভব করে, বিকেলের দিকে খারাপ এবং সন্ধ্যার দিকে আবারো ভালো অনুভব করে।

সেই অনুসারে আপনাকে সকালের কাজ, বিকালের কাজ ও দিনের অন্যান্য সময়ে কাজ ভাগ করে নিতে হবে। আপনার ভালো সময় সম্পর্কে যদি নিশ্চিত না হন, তাহলে অ্যানার্জি লেভেল পরিমাপ করার জন্য কয়েকটা দিন ব্যয় করুন।

প্রতিটা দিনের জন্য একটি গ্রাফ আঁকুন, যাতে আপনি যতক্ষণ জেগে থাকেন, ততক্ষণ সময়কে আনুভূমিক অক্ষে সাজানো যায়। তারপর আপনার অ্যানার্জি লেভেল পরিমাপ করে ০% থেকে ১০০% এর একটি স্কেল উলম্ব অক্ষে সাজান।

ফিগার ১: ২৩ মার্চের জন্য এলিসের অ্যানার্জি চার্ট

সারা সপ্তাহব্যাপী আপনার শক্তি ও কাজকর্মের দিকে নজর দেয়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যখন আপনার কাজের জন্য সময়সূচি তৈরি করছেন, সপ্তাহের দিনগুলি ও প্রতিদিনের সময়ের ব্যাপারে ভাবুন।

অনেকের জন্য সাপ্তাহিক ছুটির পরের দিনটা ব্যস্ততাপূর্ণ হয়। এই দিনে অনেক মিটিং থাকে। সপ্তাহের শুরুতে মানু্ষ এই দিনে তাদের কর্মস্থলে ফিরে যায়। অনেকেই রবিবারকে সপ্তাহের সবচেয়ে কার্যকর দিন মনে করে থাকেন। সারা সপ্তাহে কোন কাজগুলি করতে হবে, সে সম্পর্কে এই দিনে তাদের ভালো ধারণা থাকে এবং তারা বেশি মনোযোগী থাকেন।

সাপ্তাহিক ছুটি যত এগিয়ে আসে, কর্মক্ষমতাও তত কমতে থাকে। বৃহস্পতিবারই সাধারণত কম প্রোডাক্টিভ দিন হয়। কারণ পুরো সপ্তাহে কাজ করে সবাই খুব ক্লান্ত থাকে এদিন এবং তারা পরবর্তী দুইদিনের ছুটির জন্য অপেক্ষা করেন।

আরো পড়ুন: টাইম ব্লকিং কাজ করছে না—এই ৮টি কৌশল ব্যবহার করুন

দ্বিতীয় ধাপ: আপনার কাজকে বিশ্লেষণ করুন

এমন কিছু কাজ থাকে, যা সময়সূচি মেনে করতে হয়। যেমন ফোন করা, মেইল চেক করা, ডেটা এন্ট্রি করা অথবা কর্মচারীদের বেতন তৈরি করা। আপনার আরো কিছু কাজ থাকতে পারে, যেগুলিতে আবার সৃজনশীলতার প্রয়োজন পড়ে। যেমন, চিন্তাভাবনা বা লেখালেখির কাজ।

আবার এমন কিছু কাজ থাকে, যেগুলি করতে যথেষ্ট শক্তির প্রয়োজন হয়। যেমন, প্রেজেন্টেশন দেয়া অথবা প্রোডাক্ট বিক্রির জন্য কল করা। কিছু কাজ করতে প্রচুর মনোযোগ লাগে। যেমন, এডিটিং করা অথবা কোড লেখা।

তাই আগে দৈনন্দিন কাজের একটা তালিকা তৈরি করুন এবং সেগুলি সঠিকভাবে শ্রেণীবিন্যাস করুন। নিচের পদ্ধতিতে আপনি এগুলি শ্রেণীবিন্যাস করতে পারেন, যদিও কিছু কিছু কাজ একাধিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:

  • দৈনন্দিন কাজ
  • সৃজনশীল কাজ
  • বেশি মনোযোগ-এর কাজ
  • শক্তির প্রয়োজন হয়, এমন কাজ

আপনি দৈনিক কী ধরনের কাজ করেন, সেটা যদি জানা থাকে, পরবর্তী ধাপে এটা কাজে লাগবে।

তৃতীয় ধাপ: বাইরের উপাদানগুলি চিহ্নিত করুন

আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে এমন কোনো কিছু কি আছে যা আপনার কাজের ওপর প্রভাব ফেলে? যেমন:

এমন সহকর্মী, যাদের সাথে একটা নির্দিষ্ট সময়ে দেখা হয়: এমন কিছু নির্দিষ্ট কাজ কি থাকে আপনার, যার জন্য সকালে কাজ করে, এমন সহকর্মীদের সাথে দেখা করার প্রয়োজন পড়ে? অথবা একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করা সহকর্মীদের সাথে?

  • অফিসে কোলাহলের মাত্রা: আপনার যদি খোলা পরিবেশে পূর্ণ মনোযোগের কাজ করতে হয়, তাহলে কাজটা কি সকালের সময়টায় নাকি বিকালের নিরব মুহূর্তে করা বেশি সহজ?
  • সম্পদ বা রিসোর্সের সহজলভ্যতা: আপনাকে কি এমন কোনো সিস্টেম বা যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে হয় যেগুলি খুবই কম ব্যবহৃত হয়?
  • গ্রাহকদের সময়: আপনি হয়তো বিকালের সময়টাতে গ্রাহকদের কাছে প্রোডাক্ট বিক্রির জন্য সেল কল করতে পছন্দ করেন। কিন্তু যে ধরনের গ্রাহকদেরকে টার্গেট করছেন, তারা যদি সেই সময়টায় ব্যস্ত থাকে, তাহলে আপনার সময়সূচি পরিবর্তন করতে হবে।

আরো পড়ুন: উদ্ভাবনী আইডিয়া তৈরি হয় কীভাবে 

চতুর্থ ধাপ: কাজের সাথে মিলিয়ে সময় বরাদ্দ করুন

আপনার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজগুলিকে সাজানো প্রয়োজন। সৃজনশীল ও পূর্ণ মনোযোগের কাজ করার জন্য আপনার সবচেয়ে ভালো সময়টা বাছাই করুন এবং দৈনন্দিন সাধারণ কাজগুলি করার জন্য দিনের অন্য সময় নির্দিষ্ট করুন।

যেমন, মেরি একজন হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার। সারা সপ্তাহে করার মতো তার কিছু দায়িত্ব আছে। ইন্টারভিউ নেয়া, প্রশিক্ষণ দেয়া, বেনিফিট ম্যানেজমেন্ট, টিমের মিটিং পরিচালনা করা ও কর্মীদের কর্মদক্ষতা তদারকি করা। সকালের সময়টায় মেরি যখন অফিসে উপস্থিত হয়, তখন তার অ্যানার্জি লেভেল কম থাকে। এ সময় সে মেইল দেখা, দরকারি ফোন কল করা এবং অন্যান্য দৈনন্দিন সাধারণ কাজগুলি করে থাকে।

মেরি জানে তার সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা। এই সময়টায় সে সাধারণত ইন্টারভিউ, দলীয় মিটিং ও প্রশিক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখে।

আবার একটু দেরিতে লাঞ্চ করে যখন সে কাজে ফিরে আসে, তখন তার অ্যানার্জি লেভেল কম থাকে। এবং তার এই কর্মক্ষমতা পুনরায় বাড়তে থাকে বিকেলের দিকে। এই সময়টাই সে বেনিফিট ম্যানেজমেন্ট বা কর্মদক্ষতা পর্যালোচনার মতো সহজ কাজগুলি করে থাকে।

এভাবে দিনের পুরো সময়টা নিজের অ্যানার্জি সাইকেলের ওপর নির্ভর করে নিশ্চিত করে যে, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি সুন্দরভাবে করা হচ্ছে।

আপনিও আপনার কাজগুলিকে অফিসের অ্যানার্জি সাইকেলের ওঠানামার সাথে মিলিয়ে সাজাতে পারেন। যেমন, আপনি যদি একজন ভোরে ওঠা মানুষ হন, তাহলে একটু তাড়াতাড়ি অফিসে গিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করে ফেলতে পারেন।

অফিসের খালি ভবনটি আপনাকে মনোযোগী হওয়ার জন্য নির্বিঘ্ন সময় দিতে পারে। এবং এতে করে আপনি লাঞ্চের পরে চাপ সৃষ্টিকারী মিটিংগুলি এড়িয়ে যেতে পারেন। কারণ এই সময়টা সৃজনশীল কাজের জন্য খুব বেশি উপযুক্ত নয়।

খাদ্য ও পানীয়ের প্রভাব

খাবার হিসেবে আপনি যা গ্রহণ করেন, তা আপনার কাজ করার সামর্থ্যের ওপর অনেক প্রভাব ফেলতে পারে:

আপনার বিষণ্ন মুহূর্তে এক কাপ কড়া চা অথবা কফি আপনার দেহ ও মনকে চাঙ্গা করে তুলতে পারে। কিন্তু, ক্যাফেইন-এর প্রভাব সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয়, এবং এতে কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকিও থাকে।

অনেকেই দিনের ক্লান্ত সময়টাতে হালকা নাস্তার জন্য ক্ষুধার্ত বোধ করতে পারে। হালকা নাস্তা শরীরকে রি-অ্যানার্জাইজ করার জন্য উত্তম উপায় হতে পারে। কিন্তু চিনিযুক্ত জাঙ্কফুড এড়িয়ে চলাই ভালো। কফির মতই এ ধরনের খাবারগুলি আপনাকে অল্প সময়ের জন্য সতেজ করে তোলে। কিন্তু এতে আপনি চিনির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তে পারেন।

তার চেয়ে ফল, টকদই ও বাদামের মতো স্বাস্থ্যকর হালকা খাবারগুলি খাওয়া যেতে পারে। এই খাবারগুলি আপনাকে আরো অনেকটা সময় কাজ করতে সাহায্য করে।

দুপুরের খাবারের পর যদি নিস্তেজ বোধ করেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনি বেশি খাচ্ছেন। আপনি যত বেশি খাবার খান, আপনার শরীর খাবার হজম করতে গিয়ে তত বেশি ধীরগতির হয়ে পড়ে। তাই শক্তি বাড়ানোর জন্য অল্প খাবার খান, খাবারের তালিকায় সালাদ রাখুন এবং সকাল-বিকেলে বেশি বেশি হালকা খাবার খান।

অনেকেই দিনের বেলায় পর্যাপ্ত পানি পান করে না। পানিশূন্যতা আপনাকে ক্লান্ত ও ধীরগতির করে তুলতে পারে। অ্যানার্জি লেভেল বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি পান নিশ্চিত করতে হবে।

আরো পড়ুন: পটাসিয়াম—কম বা বেশি নয়, দরকার সঠিক পরিমাণ 

# টিপস

অফিসে আপনার দিনটাকে কর্মক্ষম করে তোলার জন্য সতেজ বাতাস অনেক কার্যকর হতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে মিটিং করার ব্যাপারটিও আপনার চিন্তাকে আক্ষরিক অর্থেই পরিবর্তন করে দিতে পারে।

মূল বিষয়বস্তু

দিনের বেলায় আমাদের সবারই প্রায় কিছু স্বাভাবিক ভালো ও মন্দ সময় থাকে। এই ভালো-মন্দ ওঠানামার সাথে মিল রেখে কাজের সময়সূচী ঠিক করে আমরা নিজেদের কাজের গুণগত মান বাড়াতে পারি।

তাই বিশ্লেষণ করে দেখুন, কখন আপনার অ্যানার্জি বেশি এবং কখন কম থাকে। চিন্তা করে দেখুন, কখন আপনার আশেপাশের পরিবেশ হাই অ্যানার্জির কাজের জন্য সহায়ক এবং কখন না। হাই-অ্যানার্জি অথবা সৃজনশীল কাজের জন্য সময়সূচি ঠিক করুন, যখন এই কাজগুলির জন্য আপনার সঠিক পরিবেশ ও দেহে শক্তি থাকে। ডাউন টাইমে আপনি সহজ অথবা দৈনন্দিন কাজগুলি করতে পারেন।

অনুবাদ: মাইন্ডটুল ডটকম থেকে মাহতাবুল আলম