বিমান থেকে প্যারাসুট ছাড়া লাফ দেওয়ার চিন্তাটা যে অত্যন্ত বাজে, তা বুঝতে পিএইচডির প্রয়োজন হয় না। কেননা এর পরিণতি কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা আমাদের জানা আছে। তবে যদি কোনো কারণে আপনাকে চলমান বিমান থেকে লাফ দিতেই হয়?
“যে মুহূর্তে আপনি পানির পৃষ্ঠ ভেদ করবেন, সাথে সাথেই আপনার গতি অত্যন্ত দ্রুত কমতে শুরু করবে। আসলে গতিবেগের এই আকস্মিক এবং দ্রুত পরিবর্তনের কারণে শরীরে প্রচুর পরিমাণ শক্তির আঘাত লাগবে। মানুষের পক্ষে এই আঘাত সহ্য করা এক কথায় অসম্ভব।”
হাজার ফুট ওপর থেকে ভূমির দিকে পড়তে থাকলে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ‘মুক্ত পতন’ বা ‘ফ্রি ফল’ (free-fall) অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় কেউ পানিতে গিয়ে পড়লে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?
শুরুতেই, আশা করা যাক এমন পরিস্থিতি যেন কখনও না ঘটে।
প্যারাসুট নিয়ে লাফ দিলে আপনি হয়ত নিরাপদে নিচে নেমে আসার আশা করতে পারেন। তবে প্যারাসুট ছাড়া বিমান থেকে লাফ দেয়ার চিন্তাটা অবশ্যই সর্বশেষ পন্থা হওয়া উচিৎ।
এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কেবল তখনই বিবেচনা করা উচিৎ, যখন একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমান থেকে পালানোর আর কোনো বিকল্প কারো কাছে থাকে না।
যদি লাফ দিতেই হয়, সেক্ষেত্রে প্রায় সময় বিস্তৃত জলাশয়, যেমন সমুদ্র বা নদী, খোঁজার ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া হয়। এবং যে লাফ দেবে, তার পতনের লক্ষ্য সেদিকে নিয়ে যেতে বলা হয়।
কথা হচ্ছে, আপনি যদি এ সবকিছু নিখুঁতভাবেও করেন, আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আসলে কতটুকু?
প্যারাসুট ছাড়া লাফ দেয়ার কাজ নিরাপদ করে তুলতে ‘রেকেজ রাইডিং’
বিমান থেকে লাফ দেয়ার আগে বড় কোন জিনিস বা বস্তু খুঁজে বের করার চেষ্টা করা উচিৎ। সেটা এমন কোনো বস্তু হতে হবে, যেটা আপনার আসন্ন মুক্ত পতন বা ‘ফ্রি ফল’ এর সময় আপনি ‘চালাতে’ পারবেন। আরেক অর্থে, যার ওপর আপনি চড়ে বসতে পারবেন।
অন্য কথায়, আপনাকে একজন ”রেকেজ রাইডার” (Wreckage Rider) হতে হবে। ‘রেকেজ রাইডিং’ পরিভাষাটি উদ্ভাবন করেন ম্যাসাচুসেটস ভিত্তিক অ্যামেচার ইতিহাসবিদ জিম হ্যামিলটন। তিনি মানুষের পতন বিষয়ে কল্পনা করা যায়, এমন প্রতিটি সম্ভাব্য শব্দ বা পরিভাষার একটি অনলাইন ডাটাবেস সংকলন করেন।
আরো পড়ুন: অবশেষে দেজাভ্যু রহস্য সমাধান হতে যাচ্ছে
যাই হোক, বিশেষ একটি কারণে প্যারাসুট ছাড়া লাফ দেয়ার আগে আপনার সাথে আধা-প্রতিরক্ষামূলক কোনো বস্তু থাকা দরকার। কেননা, এই বড় বস্তুই মারাত্মক পতনের হাত থেকে আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কিছুটা বাড়াতে পারবে।
পানির ওপর আছড়ে পরার সময় আপনি যে বিশাল পরিমাণ শক্তি অনুভব করবেন, তার কিছুটা এই বস্তু শোষণ করবে।
ভেসনা ভুলোভিচ ছিলেন যুগোস্লাভিয়া নামক সাবেক এক রাষ্ট্রের বিমালবালা। ৩৩,৩৩০ ফিট (৬.৩১ মাইল বা ১০ কিলোমিটারের কিছু বেশি) উচ্চতা থেকে পড়েও বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।
দুর্ঘটনার সময় তিনি ছিলেন ‘ডিসি-৯’ মডেলের বিমানে। মাঝ আকাশে বিস্ফোরিত হয় বিমানটি। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ার জন্যে তাকে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তালিকাভুক্ত করা হয়।
তিনি একটি ক্যাটারিং ট্রলি, অন্য একজন ক্রু সদস্যের দেহ এবং বিমানের লেজের অংশের মধ্যে আটকে ছিলেন। এত উঁচু থেকে পানিতে সংঘর্ষের ফলে যে শক্তি তৈরি হয়েছিল, এসব বস্তু তার কিছুটা শোষণ করেছিল। এগুলি তার সাথে না থাকলে এই প্রচণ্ড শক্তির প্রভাব পুরোটা তাকেই অনুভব করতে হত।
প্রান্তিক বেগ
কোনো ব্যক্তি যখন চলন্ত বিমান থেকে বাধাহীনভাবে পড়তে থাকে, তখন সে তার প্রান্তিক বেগ অর্জন করে। অর্থাৎ, তখন তার নিম্নগামী গতিবেগ আর বৃদ্ধি পায় না।
একজন সাধারণ স্কাইডাইভারের কথা ধরা যাক। একটি বাণিজ্যিক বিমান যে উচ্চতায় চলাচল করে, তার চেয়ে অনেক কম উচ্চতা থেকে স্কাইডাইভাররা ঝাঁপ দেয়। বিমান থেকে লাফ দেয়ার সময় তারা নিজেদের শরীর এমনভাবে রাখে, যেন ভূমির দিকে নিজেদের পেট এগিয়ে থাকে। ইংরেজিতে একে বলে ‘বেলি টু আর্থ পজিশন’।
এ সময় স্কাইডাইভারের প্রান্তিক বেগ থাকে ঘণ্টায় প্রায় ১২০-১৪০ মাইল, বা সেকেন্ডে ৫৪ থেকে ৫৮ মিটার। সুতরাং এটি ধরে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত যে, আপনি যখন বাধাহীনভাবে পড়ছেন, আপনার গতিবেগের সর্বনিম্ন মান হতে পারে ১২০-১৪০ মাইল। এই গতি কত হবে, তা আপনার ভরের ওপর নির্ভর করবে।
এই গতিতে পানিতে আছড়ে পড়লে তাতে আঘাত লাগার অনুভূতি অনেকটা একই রকম হবে, যেমনটা কোনো বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়ে রাস্তার সাথে আঘাত লাগলে হয়।
যদিও পানি রাস্তার মত শক্ত নয়, তবুও এর ‘সারফেস টেনশন’ বা পৃষ্ঠটান থাকে। এ কারণে পানির ওপরের স্তর একসাথে আটকে থাকতে চায়। এর মানে হল, যেকোনো জলাশয়ের পৃষ্ঠের ওপরে থাকা যেকোনো বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করে পানি।
পতনের আগে শরীরের অবস্থান যেমন রাখা সুবিধাজনক
আমরা হাজার ফুট উচ্চতা থেকে নিচে পড়ছে, এমন মানুষের অবস্থা নিয়ে কথা বলছি। মানুষের যথেষ্ট ভর রয়েছে। ফলে ধাক্কা লাগার সাথে সাথেই পানি যে প্রতিক্রিয়াগত শক্তি শরীরে প্রয়োগ করবে, তা হবে প্রচণ্ড।
তবে এই শক্তি দুটি বিষয় দিয়ে প্রভাবিত হয়। সেগুলি হল ভর এবং পড়ন্ত বস্তুর ‘ক্রস-সেকশন’ বা প্রস্থচ্ছেদ। আপনি মুক্ত পতন বা অন্য কোনো সময়েই আপনার শরীরের ভর পরিবর্তন করতে পারবেন না। তবে আপনি নিজের শরীরের ‘ক্রস-সেকশন’ বা প্রস্থচ্ছেদ অংশটি পরিবর্তন করতে পারেন।
এজন্যে শরীরকে এমন ভঙ্গিতে রাখতে হবে, যেন শরীরের ন্যূনতম পৃষ্ঠতল বা ‘সারফেস এরিয়া’ বিশাল শক্তির ধাক্কা সহ্য করতে পারে। আপনি পা নিচের দিকে রেখে নিশ্চিত করতে পারেন যে আপনি পানিতে একটি ছুরি বা চাকুর ফলার মত প্রবেশ করছেন।
অথবা ডুবুরিদের মত মাথা নিচের দিকে রেখে সমুদ্রে পড়তে পারেন। তবে মনে রাখবেন, এতে করে আপনার পতনের বেগ অবশ্যই কিছুটা বেড়ে যাবে। কারণ এ ধরনের সোজাসুজি ভঙ্গির কারণে আপনার শরীর বায়ুর ঘর্ষণের বিরুদ্ধে আরো সুসংহত হয়ে ওঠে। ফলে আপনার শরীর পতনের সময় কম বাধা পায়।
যে মুহূর্তে আপনি পানির পৃষ্ঠ ভেদ করবেন, সাথে সাথেই আপনার গতি অত্যন্ত দ্রুত কমতে শুরু করবে। আসলে গতিবেগের এই আকস্মিক এবং দ্রুত পরিবর্তনের কারণে শরীরে প্রচুর পরিমাণ শক্তির আঘাত লাগবে। মানুষের পক্ষে এই আঘাত সহ্য করা এক কথায় অসম্ভব।
মানুষ খুব স্বল্প সময়ের জন্যে ১০০ জি-ফোর্স বা স্বাভাবিকের তুলনায় ১০০ গুণ অভিকর্ষ বল সহ্য করতে পারে।
২০০৩ সালে একটি রেসিং দুর্ঘটনায় কেনি ব্র্যাক নামে এক রেসিং ড্রাইভার বেঁচে যান। সে সময় মূলত তার গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং ঘণ্টায় প্রায় ২০০ মাইল বেগে দেয়ালে ধাক্কা খায়। এই ধাক্কার ফলে গাড়িটি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায়।
দুর্ঘটনার সময় ব্র্যাকের শরীরে ২১৪ জি-ফোর্সের সমান শক্তি পরিমাপ করা হয়। এটি একটি রেকর্ড গড়া মাত্রা, যা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।
আরো পড়ুন: কীভাবে বয়স কমাতে হবে সে গবেষণায় বড় ধরনের সাফল্য অর্জন বিজ্ঞানীদের
তবে বিমান থেকে পড়লে তখন জি-ফোর্সের মাত্রা হবে এর চেয়েও অনেক বেশি, প্রায় ৩০০ জি এর কাছাকাছি। কোনো মানুষের পক্ষেই এ ধরনের দুর্ঘটনার পর বেঁচে থাকা সম্ভব না… অন্তত সাধারণ একজন হোমো স্যাপিয়েনসের পক্ষে তা অসম্ভব।
কেননা এই বিপুল বল মানুষের শরীরের ভেতরে ব্যাপক পরিমাণ রক্তক্ষরণ ঘটাবে এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিকে সম্পূর্ণ এলোমেলো করে ফেলবে। মারাত্মক আঘাত পাবে মানুষটি।
সব মিলিয়ে, যদি আপনি প্যারাসুট ছাড়া বিমান থেকে পানির মধ্যে ঝাঁপ দেন, আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। তবে যদি অন্য কোনো উপায় না থাকে, তবে এই কয়েকটি কৌশল মনে রাখা এবং শান্ত থাকা (প্যারাসুট ছাড়া বিমান থেকে ঝাঁপ দেয়া একজন মানুষের পক্ষে যতটা সম্ভব) সামান্য সাহায্য করতে পারে।
সূত্র. সায়েন্স এবিসি । অনুবাদ: জুবায়েদ দ্বীপ