সময় এমন এক অমূল্য সম্পদ যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। কিন্তু আমরা সকলেই আরও বেশি সময় চাই। কয়েক দশক আগের অলস জীবনের তুলনায় আজকের কর্মময় জীবন অনেক দ্রুতগতির। তবুও আমরা প্রতিনিয়ত আরও কিছু সময় কামনা করি, যাতে আরও বেশি কাজ সম্পন্ন করতে পারি।

এই লেখায়, আমরা কিছু কার্যকর কৌশল শেয়ার করব যা সময়কে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করবে। এর ফলে, আপনার পছন্দের কাজগুলির জন্যও আপনার হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকবে।

মনে রাখবেন, সকল কৌশল সকলের জন্য কার্যকর নাও হতে পারে। তবে, কিছু কৌশল অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করবে।

কাজে কর্মে গুছানো হোন
জানেন কি, ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অফ প্রফেশনাল অরগানাইজারস (NAPO) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা প্রতিদিন গড়ে এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করি কেবল জিনিসপত্র খোঁজার জন্য।

কল্পনা করুন! প্রতিদিন এক ঘণ্টা নষ্ট! ফাইল, পুরোনো ই-মেইল, ডকুমেন্ট, বই, এমনকি ঘরের চাবিও খুঁজে বের করতে কত সময় নষ্ট হয়! এই অযৌক্তিক সময় নষ্ট না হলে কত কাজই না সম্পন্ন করা সম্ভব হত!

দৈনন্দিন জীবনে গোছালো থাকার অভ্যাস গড়ে তুললে আপনার দিনে অনেক সময় বেঁচে যাবে। এই সময় আপনি আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যয় করতে পারবেন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারবেন এবং মানসিক চাপ কমাতে পারবেন।

সকালে ঘুম থেকে জলদি উঠুন
আপনি কি প্রতিদিন সকালে শেষ মুহূর্তের অ্যালার্মে ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়া করে কিছু খেয়ে অফিসের দিকে ছুটে যান? বার বার স্নুজ বাজিয়ে আরও কিছুক্ষণ ঘুমাতে চান? এই অভ্যাস হয়ত আপনারও পরিচিত। কিন্তু ভাবুন তো, সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি করতে পারলে কী কী সুবিধা পেতে পারেন?

সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি করতে পারলে কী সুফল পাবেন? দিনের শুরুতেই নিজের জন্য কিছু মূল্যবান সময় পাবেন, যা আপনার দিনটাকে করে তুলতে পারে আরও সুন্দর ও উৎপাদনশীল।

এই নিরিবিলি সময় কেবল কাজের জন্য নয়, আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে চিন্তা করার জন্যও একটি অসাধারণ সুযোগ। আপনি কী অর্জন করতে চান? আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? এই সময়টি ব্যবহার করে আপনি নিজের স্বপ্নগুলিকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারেন এবং সেগুলি পূরণের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেন।

যে উপন্যাসটা লিখতে চেয়েছিলেন কিন্তু কখনও শুরু করতে পারেননি, এই নিরিবিলি সময়টি ব্যবহার করে তার ড্রাফট তৈরি করতে পারেন।

নতুন কোনো দক্ষতা শিখতে পারেন, যেমন একটি নতুন ভাষা, কোডিং, বাদ্যযন্ত্র বাদন ইত্যাদি।

নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে পারেন, আপনার জীবনের লক্ষ্য কী, আপনি কতটা এগিয়েছেন, আর কতটা পথ বাকি, সবকিছু নিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারেন।

আপনার যদি দিনের রুটিনে ভোরে ঘুম থেকে ওঠার সুযোগ থাকে, তাহলে এই অভ্যাসটি ধীরে ধীরে শুরু করুন। প্রথম দিকে, নিয়মিত সময়ের চেয়ে ১০-১৫ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠুন।

এইভাবে ওঠার অভ্যাস হয়ে গেলে পরের সপ্তাহে আরও ১০-১৫ মিনিট আগে ওঠার চেষ্টা করুন। এইভাবে এক মাসের মধ্যে আপনি আগের চেয়ে এক ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠতে পারবেন। তার মানে সপ্তাহে আপনি মূল্যবান ৭ ঘণ্টা অতিরিক্ত পাচ্ছেন, যেটা আপনি কোনো কাজে ব্যয় করতে পারবেন।

তবে মনে রাখবেন, রাতের ঘুম অত্যন্ত জরুরী। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করুন। পর্যাপ্ত ঘুম ছাড়া ভোরে ওঠার কারণে আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

দিনের কাজের শিডিউল পর্যালোচনা করুন
আপনার হাতে এই মুহূর্তে কতগুলি কাজ পেন্ডিং আছে? যখন দিনের কাজের শিডিউলের ব্যাপার আসে, সময় নিয়ে কিছুটা টানাটানিতে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। নিজের কাজ ছাড়াও আপনাকে পরিবার ও বন্ধুদের জন্য, সামাজিক বা ভলান্টারি কাজ করলে সেটার জন্যেও সময় বের করতে হবে।

মানুষকে “না” বলা বেশ কঠিন। যদি সেটা বস বা ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হয় তখন তো আরও বেশি। আপনি এ বিষয়ে আইজেনহাওয়ারের আর্জেন্ট/ ইম্পর্টেন্ট প্রিন্সিপাল অনুসরণ করতে পারেন। এতে বুঝবেন কোন কাজটা সত্যিই আপনার জন্য জরুরী আর কোনটিতে আপনার “না” বলা উচিত।

আরেকটা বিষয় আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে, কাজের বাইরের সময়টাতে আপনি কী করেন? যে কাজগুলি করেন সেগুলি কি আপনার সময় নষ্ট করে, নাকি আপনি এ থেকে আনন্দ পান?

যেমন আপনি যদি টিভি দেখা বন্ধ করে দেন তাহলে দিনের কতক্ষণ সময় আপনি বাঁচাতে পারেন? কিংবা বিকালবেলার অলস সময়ে উদ্দেশ্যহীন ইন্টারনেট ব্রাউজিং করে কত সময় নষ্ট করেন? কিংবা ঘরের কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নিলে আপনার কী পরিমাণ সময় বাঁচে?

এভাবে সারাদিন আপনি কী কী কাজ করেন তার একটা অ্যাক্টিভিটি লগ তৈরি করতে পারেন। এর সাহায্যে আপনি বুঝবেন সারাদিনে আপনার সময় কীভাবে ব্যয় হচ্ছে। বুঝতে পারবেন কোন কাজগুলি আপনার সময় নষ্ট করছে, আর কোনগুলি বাদ দিলে আপনি অনেক সময় বাঁচাতে পারবেন। তখন প্ল্যান করতে পারবেন, কীভাবে দিনে কাজের সময় বাড়ানো যায়।

দিনে আপনার সবচেয়ে ভাল সময়টা ভালভাবে ব্যবহার করুন
আপনি কি জানেন দিনের কোন সময়টাতে আপনি বেশি কাজ করতে পারেন? কেউ আছে সকালে যখন কাজ শুরু করে, তখন সবচেয়ে বেশি কাজ করতে পারে। আবার কেউ আছে বিকালের দিকে কাজ করার জন্য সবচেয়ে বেশি অ্যানার্জি পায়। যদি আপনি জানেন কোন সময় আপনি বেশি কাজ করতে পারেন, সেই মত কাজের শিডিউল তৈরি করতে পারেন। ফলে দিনের বাকি সময়ে অন্য অনেক কাজ শেষ করতে পারবেন।

যেমন ধরুন, সারাদিনে আপনার সবচেয়ে অ্যানার্জেটিক সময় হচ্ছে সকাল ৯টা থেকে ১০টা। কিন্ত এই সময়টা আপনি ই-মেইল চেক করে বা ফোনে কথা বলে সময় কাটিয়ে দেন। আর আপনি দিনের সবচেয়ে জরুরী কাজ জমিয়ে রাখেন লাঞ্চের পরের জন্য। কিন্ত তখন আপনার অ্যানার্জি লেভেল একদম কমে যায়। এই কারণে আপনার কাজ শেষ করতে দেরি হয়।

তাই আপনার উচিত হল দিনের জরুরী কাজগুলি অফিসে গিয়েই শুরু করে দেওয়া, যখন আপনার অ্যানার্জি সবচেয়ে বেশি থাকে। আর ছোট কাজগুলি আপনি বিকালের দিকে রাখুন, যখন আপনার অ্যানার্জি লেভেল কমে যায়।

কাজের মাঝখানে অন্যদের বিরক্ত করা কীভাবে কমাবেন
কাজের সময় নানা রকমের বিঘ্ন আসে। কখনও সহকর্মীরা প্রশ্ন করে, কখনও টিম মেম্বাররা সহযোগিতার জন্য আসে, কখনও হঠাৎ করে মিটিং ঠিক হয়, আবার অফিসের চ্যাটবক্স একটার পর একটা মেসেজ আসতে থাকে! এইভাবে অনেক কিছুই আপনার মনোযোগ নষ্ট করে।

আর একবার মনোযোগ চলে গেলে সেটাকে ফিরিয়ে আনতে আরো সময় নষ্ট হয়। আপনি যদি অন্যদের জ্বালাতন এড়িয়ে কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে পারেন, দিনে একটা ভাল পরিমাণ সময় নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে।

আর যদি আপনি মনোযোগ দিয়ে একটা কাজ অনেকক্ষণ ধরে করতে পারেন, তাহলে আপনি ফ্লো ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। ফ্লো হচ্ছে একটা মানসিক অবস্থা, যখন আপনি কাজের মধ্যে একদম ডুবে যান, তখন আপনার আর অন্য কিছুর কথা খেয়াল থাকে না। এই সময়ে আপনি সবচেয়ে ভাল মানের কাজ করতে পারেন।

সব কাজ একসাথে করা থেকে বিরত থাকুন
অনেকে ভাবেন মাল্টিটাস্কিং অর্থাৎ একই সময়ে কয়েকটা কাজ করলে সময় বাঁচানো যায়। যেমন আপনি যদি ই-মেইল চেক করতে করতে আপনার বসের সাথে ফোনে কথা বলেন, তাহলে আপনি এক সময়ে দুইটা কাজ করে ফেলছেন, ঠিক কিনা?

তবে এই ব্যাপারটা হচ্ছে একটা মিথ। মাল্টিটাস্কিং আসলে আপনার সময় বেশি নষ্ট করে। দুইটা কাজ একসাথে করার ফলে আপনার কাজের গতি এমনিতেই কমে যায়, অন্যদিকে আপনি কোনো কাজই মন দিয়ে করতে পারেন না বলে কাজের কোয়ালিটি খারাপ হয়। আপনি কাজের খুঁটিনাটি তখন পুরাপুরি বুঝতে পারেন না। অনেক সময় আপনাকে পুনরায় কাজটি করতে হয় এ কারণে বা এর ভুল সংশোধন করতে গিয়ে।