সুদূর অতীতের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়, চিরকাল দারিদ্র্যের চিত্র এমনটা ছিল না। বরং সময়ের সাথে সাথে এতে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান সময়ের ধনী দেশগুলি কয়েক প্রজন্ম আগেও খুব দরিদ্র ছিল।

‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’ (সংক্ষেপে OWID) একটি অনলাইন নির্ভর বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা সংস্থা। দারিদ্র্য, রোগ, ক্ষুধা, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, অস্তিত্বের ঝুঁকি এবং বৈষম্যের মত বড় বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে ডেটানির্ভর নিবন্ধ প্রকাশ করে তারা।

‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’র সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা সবাই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক। বর্তমানে এই সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন কিংস কলেজ লন্ডনের ভিজিটিং প্রফেসর হেতান শাহ।

সাম্প্রতিক মহামারীর সময় জাতিসংঘ, হোয়াইট হাউস ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে মহামারী বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও গবেষকরা এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত তথ্য ব্যবহার করেছে।

এদিকে শুধুমাত্র ২০২১ সালেই সংস্থাটির ওয়েবসাইট ভিজিট করেছে ৮৯ মিলিয়ন মানুষ।


ম্যাক্স রোজার

প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ১৪, ২০১৬
তথ্য, লেখা ও লেখচিত্র হালনাগাদ: ২০২০
ভূমিকা, অনুবাদ ও দ্রষ্টব্য: ফারহান মাসউদ


ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস-এ নিবন্ধিত একটি দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা। প্রতিষ্ঠা করেন জার্মান ইতিহাসবিদ এবং অর্থনীতিবিদ ম্যাক্স রোজার।

ম্যাক্স রোজারের কর্মজীবন অনুপ্রাণিত হয়েছে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ টোনি অ্যাটকিনসন, নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এবং সুইডিশ চিকিৎসক ও বক্তা হ্যান্স রসলিং এর কর্ম থেকে।

গত ২০০ বছরে মানবজাতির অগ্রগতি সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার জন্য ২০১৬ সালে একটি প্রবন্ধ লেখেন ম্যাক্স রোজার, যার শিরোনাম ছিল “The short history of global living conditions and why it matters that we know it”। এই লেখা মূলত সেই নিবন্ধেরই অনুবাদ।

নিবন্ধটি ম্যাক্স রোজার লিখলেও তথ্য সংগ্রহ এবং চার্ট তৈরিতে কাজ করেছে আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’র সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা। প্রকাশের পর থেকেই এই নিবন্ধের সাথে যুক্ত চার্ট বা গ্রাফ চিত্র বিশ্বজুড়ে প্রকাশনা ও সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

এই নিবন্ধের সাথে যুক্ত লেখচিত্র বা লেখার সারাংশ ছাপে ফোর্বস, ইউরোনিউজ, মিডিয়াম, ভক্স, ফাস্ট কোম্পানি, হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল, বিজনেস ইনসাইডার কিংবা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মত বিখ্যাত অনেক মিডিয়া ও প্রকাশনা সংস্থা।

আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটার গবেষকদের তৈরি এই চার্টগুলি প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় কিছু লেখচিত্র। এসব চার্ট ও তথ্যের ওপর নির্ভর করে এখনো (২০২৩) বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হচ্ছে।

সম্পূর্ণ নিবন্ধ অনুবাদ করার সময় সকল তথ্য, উপাত্ত ও বক্তব্য মূল লেখার মতই রাখা হয়েছে। এবং বোঝার সুবিধার্থে কিছু ধারণা ও বক্তব্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেই ব্যাখ্যা মূল লেখায় নেই।

তবে অল্প যে কয়টি স্থানে ম্যাক্স রোজার উত্তম পুরুষে (‘আমি’ সর্বনামে) লিখেছেন, সেসব স্থানের বাক্য বর্ণনামূলক হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। এতে প্রথমত, মানবজাতির ইতিহাসের মত বিস্তৃত একটা বিষয়ে ব্যক্তি হিসেবে কারো মতামতের চেয়ে সামগ্রিকভাবে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব আরো স্পষ্টভাবে উঠে আসবে বলে ধারণা করা যায়।

দ্বিতীয়ত, ম্যাক্স রোজারের পাশাপাশি আরো যারা এসব তথ্য সংকলন ও পরিসংখ্যান তৈরিতে অবদান রেখেছেন, তাদের ভূমিকার নীরব স্বীকৃতি জানানোর চেষ্টা করা হয়েছে এভাবে।

বিশ্বজুড়ে আমরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি, সময়ের সাথে সাথে সেগুলির কতটা সমাধান হচ্ছে? মানুষের জীবন যাপনের মান কতটা উন্নত হচ্ছে? মোটের ওপর মানবজাতি কতটা এগিয়ে গেছে গত দুই শতাব্দীতে?

এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে খুব বেশি মানুষ আশাবাদী হতে পারেন না। খুব কম মানুষই মনে করেন, আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।

এ ব্যাপারে একটি জরিপ পরিচালিত হয় ২০১৫ সালে। সেখানে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করা হয়, সবকিছু বিবেচনা করলে, আমাদের বিশ্ব ভালোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না খারাপের দিকে? নাকি আগের মতই আছে?

জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সুইডেনের মাত্র ১০ শতাংশ নাগরিক মনে করেন মানুষের জীবনমান আগের চেয়ে উন্নত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে এ ধরনের ইতিবাচক উত্তর দেয়া মানুষের সংখ্যা আরো কম, যথাক্রমে ৬ ও ৪ শতাংশ।

কিন্তু মানবজাতির উন্নতির ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা রাখা মানুষদের কাছে কী এমন তথ্য-প্রমাণ আছে?

আসলে, এ ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। নিকট অতীতে পৃথিবী কীভাবে পাল্টে গিয়েছে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। বুঝতে হবে এই গ্রহের সব প্রান্তের মানুষের জীবনযাত্রার মান কতটা পরিবর্তিত হয়েছে, আর সেই পরিবর্তন কী রকম।

দেখে নেয়া যাক সামগ্রিকভাবে শিক্ষা, দারিদ্র্য বা চিকিৎসার মত জরুরী সব বিষয়ে মানবজাতি কতটা উন্নতি করতে পেরেছে।

অতি দারিদ্র্য

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় এক সমস্যা হল দারিদ্র্য। এই সমস্যার সমাধান সম্ভব কিনা, তা নিয়ে মতবিরোধ আছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করা মানুষদের মধ্যে। অতীতে এই সমস্যা কতটা প্রকট ছিল, সেটা বুঝতে হলে তাকাতে হবে ইতিহাসের দিকে। কিন্তু ৩০ বা ৫০ বছরের ইতিহাস এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।

দারিদ্র্যের মত সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে অনেকেই শুধু তাদের জীবনকালে পৃথিবীর অবস্থার কথা ভাবেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের এই গ্রহে মানুষের দারিদ্র্যের অবস্থা একইরকম আছে বলে মনে হয় তাদের কাছে। তারা দেখেন পৃথিবীর কিছু অঞ্চল ধনী আর কিছু অঞ্চল দরিদ্র। এতে ভুল করে অনেকেই ভেবে বসেন, চিরকালই হয়ত বিশ্বের চিত্র এমন ছিল।

অথচ সুদূর অতীতের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়, চিরকাল দারিদ্র্যের চিত্র এমনটা ছিল না। বরং সময়ের সাথে সাথে এতে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান সময়ের ধনী দেশগুলি কয়েক প্রজন্ম আগেও খুব দরিদ্র ছিল। এই সত্যিটা উপলব্ধি করতে পারলে আশা করা যায়, পৃথিবীর বৈষম্যের চিত্র বদলে ফেলা সম্ভব।

অনেকেই সারাজীবন দেখে এসেছেন, আমাদের গ্রহের উত্তর অংশের দেশগুলি মোটের ওপর দক্ষিণের দেশগুলির চেয়ে বেশি ধনী। কিন্তু সবসময় এমন ছিল না। মানুষের জীবনযাত্রার মানদণ্ড নাটকীয়ভাবে পাল্টে যাওয়া শুরু হয় মাত্র ২০০ বছর আগে।

জাতিসংঘের মতে, যারা প্রতিদিন ১.৯০ ডলারের কম আয় করে, তারা ‘চরম দারিদ্র্যে’র মধ্যে আছে। এটি দারিদ্র্য পরিমাপের অত্যন্ত নিম্ন এক সীমারেখা। বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষেরাই এই সীমার মধ্যে পড়ে।

ডলার দিয়ে হিসাব করা হলেও দারিদ্র্য সংক্রান্ত এসব পরিসংখ্যানে অর্থের বাইরে মানুষের আয় বিবেচনা করা হয়েছে। অতীত ও বর্তমান সময়ের দরিদ্র পরিবারের চিত্র বোঝার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা অনেক দরিদ্র মানুষই কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করে জীবন পরিচালনা করেন। অনেকে বেঁচে থাকে নিজেদের চাষ করা খাবার খেয়ে।

পরিসংখ্যানে এ বিষয়টাও বিবেচনা করা হয়েছে, দেশে দেশে বিভিন্ন পণ্যের দাম যে বিভিন্ন রকম হয়। এবং সময়ের সাথে সাথে এই দামে পরিবর্তন আসে। তাই মূল্যস্ফীতির মত অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখা হয়েছে। এজন্য দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডলার’ এর হিসাবে।

‘ইন্টারন্যাশনাল ডলার’ এক ধরনের কাল্পনিক ও কৃত্রিম মুদ্রা, যার সাহায্যে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির অবস্থা তুলনা করার সময় হিসাবে সামঞ্জস্য আনা হয়। একইসঙ্গে বিভিন্ন দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার পার্থক্য বিবেচনায় আনা হয়।

প্রথম চার্ট বা লেখচিত্রে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সময়ের সাথে সাথে কীভাবে পাল্টে গিয়েছে, তা দেখা যাচ্ছে। ১৮২০ সালে মাত্র গুটিকয় অভিজাত মানুষেরা উন্নত জীবনযাপন করত। অন্যদিকে বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরা এমন পরিস্থিতিতে বাস করত, যাকে বর্তমান সময়ের ভাষায় ‘অতি দারিদ্র্য’ বলা যায়।

এরপর থেকে এই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত কমে এসেছে। নতুন করে বিশ্বের অনেক অঞ্চল শিল্পোন্নত হয়েছে, আর সেসব অঞ্চলে বেড়েছে উৎপাদনশীলতা বা ‘প্রডাক্টিভিটি’। এতে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ মুক্তি পেয়েছে দারিদ্র্য থেকে।

১৯৫০ সালেও বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করত। ১৯৮১ সালে এই সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় ৪২ শতাংশে। এই লেখচিত্রে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তথ্য যুক্ত করা আছে। এবং সে বছরের হিসাবে চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ।

গত ২০০ বছরে যেভাবে এগিয়ে গেছে মানবজাতি
২০২২ সালের ডিসেম্বরের হিসেবে, পৃথিবীর প্রায় ৮ শতাংশ মানুষ এখনো চরম দারিদ্র্যের মধ্যে আছে। সূত্র: বিশ্বব্যাংক

১.৯০ ডলারের সীমারেখা আসলে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষদের চিত্র তুলে ধরে। তুলনামূলকভাবে যারা আরো কম দরিদ্র, তাদের অবস্থাও সময়ের সাথে সাথে উন্নত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্যসীমা যেভাবেই নির্ধারণ করা হোক না কেন, বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের পরিমাণ সময়ের সাথে সাথে কমছে।

এ সবকিছুই আমাদের বিশাল এক অর্জন। বিশেষ করে বৈষম্য ও সমৃদ্ধি নিয়ে যাদের আগ্রহ, তাদের কাছে গত ২০০ বছরে দারিদ্র্যের চিত্রের এই পরিবর্তন ইতিবাচক মনে হবে।

গত দুই শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৭ গুণ বেড়ে যাওয়ার তথ্যটা বিবেচনা করা হলে এই অর্জন আরো বড় হয়ে ধরা দেবে। বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি না হলে জনসংখ্যা ৭ গুণ বেড়ে যাওয়ার ফলে সব মানুষই আরো কম আয় করত। এতে চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করত পৃথিবীর প্রায় সবাই।

অথচ, ঘটেছে এর ঠিক উল্টোটা। জনসংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার সময়েও বিশ্বের মানুষ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে আরো বেশি মানুষ বেরিয়ে আসছে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে।

উৎপাদনশীলতা বা প্রডাক্টিভিটি বৃদ্ধি পাওয়াটা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণেই অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। একইসঙ্গে খাদ্যের পরিমাণ বেড়েছে, মিটেছে পোশাকের চাহিদা। মানুষের থাকার জায়গার পরিসরও বড় হয়েছে।

কিন্তু উৎপাদনশীলতা আসলে কী?

বিষয়টা আরো ভালোভাবে বুঝতে আমরা যতটুকু কাজ বা পরিশ্রম করি, সেটাকে ধরা যাক ‘ইনপুট’। এবং আমাদের কাজের ফলাফলকে ধরা যাক ‘আউটপুট’। অর্থনীতিতে ইনপুট এবং আউটপুটের মধ্যে থাকা অনুপাতকেই বলা হয় ‘উৎপাদনশীলতা’ বা ‘প্রডাক্টিভিটি’।

প্রডাক্টিভিটি বাড়ার সাথে সাথে আমাদের আউটপুট যেমন বেড়েছে, তেমনি কমেছে ইনপুটের পরিমাণ। এ কারণেই আগের তুলনায় প্রতি সপ্তাহে এখন অনেক কম সময় ধরে কাজ করতে হয় কর্মজীবী মানুষদের।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। কারণ এতে মানুষে-মানুষে সম্পর্কে পরিবর্তন এসেছে। কীভাবে?

দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের মানুষ যেই অর্থনীতির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, তাতে প্রবৃদ্ধির ধারণা ছিল না। ফলে একজন মানুষের উন্নতির একমাত্র উপায়ই ছিল অন্য কারো অবনতি। আরেক কথায় বললে, আপনার নিজের সৌভাগ্যই আসলে আপনার প্রতিবেশীদের দুর্ভাগ্য। অর্থনীতিতে এই অবস্থাকে বলা হয় ‘জিরো-সাম গেম’ (Zero-sum game)।

আরো পড়ুন: টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্ট (১৯৩২-১৯৭২) — কুখ্যাত সিফিলিস গবেষণা

অথচ বর্তমানে আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময়ে বাস করছি। এখন নিজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অন্য কারো উন্নতিও সম্ভব হচ্ছে। এই অবস্থাকে বলা হয় ‘পজেটিভ-সাম গেম’ (Positive-sum game)। গাড়ি, যন্ত্রপাতি ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মত অনেক কিছুই বর্তমানে আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। এতে কিছু মানুষ অকল্পনীয় রকমের ধনী হয়ে উঠেছে ঠিক, কিন্তু একইসাথে সব স্তরের মানুষের আয় বেড়েছে।

‘জিরো-সাম’ এবং ‘পজেটিভ-সাম’ অর্থনীতিতে মানুষের জীবন কতটা আলাদা হয়ে ওঠে, বর্তমান বিশ্বে বসে তা বোঝানো কঠিন।

বর্তমান সময়ে মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যম নির্দিষ্ট এবং আলাদা আলাদা ঘটনা নিয়েই খবর প্রচার করে। ফলে অর্থনীতি ও দারিদ্র্য সংক্রান্ত যেসব খবর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং দুর্দশা তুলে ধরবে, সেগুলিই উঠে আসে মিডিয়ায়।

অথচ দীর্ঘ সময় ধরে আস্তে আস্তে আমরা যে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তা নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবেদন বা প্রচারণা দেখা যায় না। এখন পর্যন্ত দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক উন্নতি সংক্রান্ত যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তার ওপর ভিত্তি করে একটা খবরের শিরোনাম কল্পনা করা যাক: “গতকালের তুলনায় আজ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করা মানুষের সংখ্যা কমেছে ১,৩০,০০০।”

এ ধরনের ইতিবাচক শিরোনাম খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু ১৯৯০ সাল থেকে গড়ে প্রতিদিনই অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমছে ১,৩০,০০০ জন করে।

গত ২০০ বছরে যেভাবে এগিয়ে গেছে মানবজাতি

সাক্ষরতা

একই সময়ের মধ্যে বিশ্বজুড়ে মানুষের সাক্ষরতার হার কীভাবে পাল্টে গেছে? গত ২ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যার কত শতাংশ মানুষ পড়ালেখা জানে, তার চিত্র দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় চার্ট বা লেখচিত্রে।

অতীতে শুধুমাত্র বিশ্বের মানুষদের ক্ষুদ্র একটি অংশ পড়তে ও লিখতে পারত। তারা ছিল অভিজাত বা সমাজের উঁচু শ্রেণী। শিক্ষার দিক দিয়ে উন্নত দেশগুলি সহ অন্যান্য সকল দেশের মানুষ যতটা এগিয়েছে, সেটা সাম্প্রতিক এক অর্জন। সকল স্তরের জনগণের জন্য শিক্ষা গ্রহণ ও সাক্ষরতা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে গত দুই শতাব্দীতেই।

১৮২০ সালে ১৫ বছরের বেশি বয়সী প্রতি ১০ জন মানুষের ১ জন মাত্র পড়তে বা লিখতে পারত। অথচ ১৯৩০ সালের মধ্যেই সাক্ষরতার হার এতটা বেড়ে যায় যে, প্রতি ৩ জনে ১ জন পড়তে-লিখতে জানে তখন।

বর্তমানে বিশ্বের ৮৫% মানুষের সাক্ষরজ্ঞান আছে।

অন্যভাবে বললে, ১৮০০ সালে বেঁচে থাকলে আপনার নিরক্ষর থাকার সম্ভাবনা ছিল ১০ ভাগের মধ্যে ৯ ভাগ। অথচ এখন প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনেরও বেশি মানুষ লিখতে-পড়তে পারে। যদি আপনি তরুণ হন, তাহলে এই সম্ভাবনা আরো বেশি। কারণ বর্তমানে নিরক্ষর জনসংখ্যার বড় একটা অংশই বয়স্ক মানুষ।

পৃথিবীর অনেক সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। এবং পড়ালেখা শেখার মাধ্যমেই এসবকিছু অর্জনের পথ তৈরি হয়।

বর্তমান ১৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে ৫.৪ বিলিয়ন। লেখচিত্র অনুসারে, এর মধ্যে ৮৫% মানুষেরই সাক্ষরজ্ঞান আছে। সংখ্যার হিসাবে এই পরিমাণ ৪.৬ বিলিয়ন।

অথচ ১৮২০ সালে পড়তে বা লিখতে পারত ১০০ মিলিয়নেরও কম মানুষ।

গত ২০০ বছরে যেভাবে এগিয়ে গেছে মানবজাতি

স্বাস্থ্য

ইতিহাসে নিজেদের অগ্রগতি বুঝতে না পারার একটি কারণ হল অতীত কতটা খারাপ ছিল, সে সম্পর্কে ধারণা নেই আমাদের।

সুস্থতা বা চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারে আমাদের পূর্বপুরুষদের অবস্থা বেশ খারাপই ছিল। যেমন, ১৮০০ সালে বয়স ৫ হওয়ার আগেই মারা যেত বিশ্বের প্রায় ৪৩% শিশু। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে ধারণা করা যায় আজকের তুলনায় সমগ্র বিশ্বই তখন দরিদ্র অবস্থায় ছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে দারিদ্র্যের হারের মধ্যে তারতম্য ছিল অনেক কম।

গত ২০০ বছরে যেভাবে এগিয়ে গেছে মানবজাতি
আধুনিক যুগ আসার আগে জন্ম নেয়া প্রায় অর্ধেক শিশুই মারা যেত।

তখন বিশ্বের সব দেশেই প্রতি ৩ জন শিশুর একজন ৫ বছর বয়স হওয়ার আগে মারা যেত।

তবে আধুনিক চিকিৎসাই যে বর্তমানে আমাদের স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি উন্নত হয়ে ওঠার একমাত্র কারণ, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। মূলত মানুষের অবস্থার সমৃদ্ধি এবং জীবন যাপনের ধরণ পাল্টে যাওয়াটা ওষুধের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আগের তুলনায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার ব্যাপারে এখন অনেক বেশি মানুষ সচেতন। এছাড়াও এখন আমাদের আবাসন ব্যবস্থা আগের চেয়ে উন্নত। বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ দুটি বিষয় আমাদেরকে অনেক সুবিধা দিয়েছে।

এদিকে কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে এবং বেড়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ। এতে সময়ের সাথে সাথে আরো বেশি মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়েছে আমাদের শরীর।

তাছাড়া পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ও স্বাস্থ্যের উন্নতির সাথে সাথে আমরা যেমন উচ্চতায় লম্বা হয়েছি আগের চেয়ে, তেমনি হয়ে উঠেছি আরো বুদ্ধিমান।

অবশ্যই এক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও উন্নত ওষুধও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আরো বেশি মানুষ শিক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে নতুন সব বৈজ্ঞানিক সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এতে রোগের পাশাপাশি মৃত্যুহারও কমে এসেছে।

এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি সাফল্য হল জীবাণু তত্ত্বের আবিষ্কার।

বিভিন্ন ধরনের রোগের কারণ যে জীবাণু, তা আমরা দীর্ঘদিন জানতাম না। মাত্র ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে এই তত্ত্বের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা সচেতন হয়ে ওঠেন।

মোটের ওপর ইতিহাসে একটা নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের গুরুত্ব বোঝা কঠিন। তবে যখন জীবাণু সম্পর্কে চিকিৎসক সহ অন্যান্য পেশাদার লোকেরা সচেতন ছিলেন না, সে সময়ের কথা ভাবলে এই তত্ত্বের গুরুত্ব কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। যেমন, সে সময় মৃতদেহ সৎকার, কাটাছেঁড়া বা বাচ্চা প্রসব করানোর আগে চিকিৎসকরা হাতই ধুতেন না।

এই পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়া শুরু হয় জীবাণু তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। এই তত্ত্বের মাধ্যমেই সবার সুস্থতা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার গুরুত্ব তৈরি হয়।

জীবাণু তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ও বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন বা টিকার উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। জনস্বাস্থ্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, বিশ্বের মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছে জীবাণু তত্ত্বের মাধ্যমেই।

তাই মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার চিত্র উন্নত করে তোলার ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কারণ একজন ব্যক্তির টিকা নেয়ার মাধ্যমে তার আশেপাশের মানুষও উপকৃত হয়। একইভাবে কেউ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে উপকৃত হয় সমাজের বাকিরাও।

এসব পরিবর্তনের হাত ধরে মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির এতটাই উন্নতি হয়েছে যে, এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছেই অকল্পনীয় ছিল। ২০১৫ সালের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার নেমে আসে ৪.৩%-এ, ২ শতাব্দী আগের তুলনায় যা ১০ গুণ কম।

অর্থাৎ, সময়ের সাথে সাথে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, তা বুঝতে হলে দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমান অবস্থার তুলনা করতে হবে।

গত ২০০ বছরে যেভাবে এগিয়ে গেছে মানবজাতি

স্বাধীনতা

এখন আমরা উন্নয়ন বলতে যা বুঝি, তার কেন্দ্রে আছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের ধারণা। এই ধারণা দুটি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই যেমন সব ধরনের উন্নয়ন সম্ভব হয়, তেমনি উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকারের চাহিদা পূরণ হয়।

সাংবাদিকতা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনায় জনগণের অংশগ্রহণের অধিকার হল সেই স্তম্ভ, যার ওপর স্বাধীনতা টিকে আছে। কিন্তু এই দুটি বিষয়ের “গুণগত বিচার” করলে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে। অনেকেরই এতে ভুলভাবে মনে হতে পারে যে, সময়ের সাথে সাথে আমাদের স্বাধীনতা কমছে।

প্রকৃতপক্ষে, আমরা যা কিছু বিচার করে বলি আমরা কতটা স্বাধীন বা পরাধীন, সেসবের সংজ্ঞাও পাল্টে যাচ্ছে। সময়ের সাথে আসতে থাকা নতুন সব সংজ্ঞায় আমরা এমন অনেক কিছু করার অধিকারকে স্বাধীনতা হিসেবে বিবেচনা করছি, যা আগে করা হতো না।

ব্যাপারটা বুঝতে হলে আমাদেরকে “গুণগত বিচার” এর বদলে “পরিমাণগত মূল্যায়ন” করতে হবে। নির্দিষ্ট একটি মানদণ্ডের সঙ্গে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলের তুলনা করলেই আমরা বুঝতে পারব পরিবর্তনের আসল চিত্র।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেসব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শাসন করা হয়, তার মধ্যে তুলনা ও মূল্যায়নের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। তবে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মত জটিল কিছু নিয়ে তুলনামূলক বিচার করতে গেলে তাতে বিতর্ক থাকেই। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে বিতর্ক এড়ানোর কোনো উপায় নেই।

এই চার্ট বা লেখচিত্রে তথ্য সংকলিত করা হয়েছে ‘পলিটি ফোর ইনডেক্স’ (Polity IV index) থেকে। কেননা, অন্যান্য সূচকের তুলনায় এতে জটিলতা কম। একইসঙ্গে রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতেও সাহায্য করে এই সূচক।

সূচকটির একপ্রান্তে সম্পূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে, এমন রাজনৈতিক শাসন বোঝাতে +১০ পর্যন্ত মাত্রা রাখা হয়। এবং বিপরীত প্রান্তে সম্পূর্ণ স্বৈরাচার রয়েছে, এমন ব্যবস্থা বোঝাতে মাত্রা রাখা হয় -১০ পর্যন্ত। যেসব শাসনব্যবস্থা এই মাত্রার মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকে, তাদের বলা হয় ‘অ্যানোক্রেসি’ (anocracy) বা ‘আধা গণতান্ত্রিক, আধা স্বৈরাচারী ব্যবস্থা’।

তবে এই সূচকের সঙ্গে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বিশ্বের যেসব দেশ অন্য দেশের দ্বারা শাসিত হয়েছিল, তাদের ব্যাপারেও তথ্য যোগ করা হয়েছে।

কেননা, গত ২০০ বছরে রাজনৈতিক স্বাধীনতা কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে সে সম্পর্কে ধারণা দেয়াই এই আলোচনার উদ্দেশ্য।

এই চার্ট বা লেখচিত্রে গত ২ শতাব্দীতে কোন ধরনের রাজনৈতিক শাসনের অধীনে কত ভাগ মানুষ বসবাস করেছে, তার চিত্র উঠে এসেছে। সমগ্র ১৯ শতক, বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ বাস করত ঔপনিবেশিক শাসনাধীন দেশে। বাকিদের প্রায় সবার বসবাস ছিল স্বৈরাচার শাসিত দেশে।

১৯ শতকের শেষের দিকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে। তবে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার দেশগুলি বরাবরই স্বাধীনতাকামী মানুষদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত একইরকম চিত্র বিরাজ করতে থাকে।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক চিত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসা শুরু হয়। তখন বিশ্বে, নানান প্রান্তে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে এবং আরো বেশি সংখ্যক দেশ গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। এতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অধীনে বসবাস করা বিশ্বের মানুষের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে নতুন করে অনেক দেশ গণতন্ত্রকামী হয়ে ওঠে। এখন বিশ্বের প্রতি ২ জন মানুষের মধ্যে ১ জনেরও বেশি গণতন্ত্রের অধীনে বসবাস করে।

এছাড়াও যারা স্বৈরাচারের অধীনে বাস করে, তাদের মধ্যে বড় একটা অংশ—প্রতি ৫ জনের ৪ জন—বসবাস করে শুধু একটি দেশেই: চীনে।

গত ২০০ বছরে যেভাবে এগিয়ে গেছে মানবজাতি

জনসংখ্যা

এ পর্যন্ত যতগুলি চার্ট বা লেখচিত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তার সবগুলিতেই যে বিষয়টি স্পষ্ট, সেটি হল জনসংখ্যা বৃদ্ধি। ১৮০০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন। এরপর থেকে তা ৮ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

তবে জনসংখ্যার এই বিপুল বৃদ্ধি শুধু নেতিবাচকভাবে দেখলে হবে না। কেননা প্রথমত, এই বৃদ্ধি অসাধারণ এক অর্জনের চিত্র তুলে ধরে। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, আমাদের পূর্বপুরুষেরা হাজার হাজার বছর ধরে যে হারে মারা যাচ্ছিল, সেভাবে আর মৃত্যু হচ্ছে না।

আধুনিক সময়ের পূর্বে জন্মহার ছিল বেশি। গড়ে একজন নারী তার জীবদ্দশায় ৫ থেকে ৬টি সন্তানের জন্ম দিত। এরপরও জনসংখ্যা খুব বেশি বাড়ত না। কারণ অনেক মানুষ মারা যেত। শিশুরা মারা যেত প্রজননে সক্ষম হওয়ার মত বয়সে পৌঁছানোর আগেই।

মৃত্যুর বিরুদ্ধে আমরা সবসময়ই যুদ্ধ করে এসেছি। কিন্তু এই যুদ্ধে যখন মানুষ জয়ী হওয়া শুরু করে, তখনই বাড়তে থাকে বিশ্বের জনসংখ্যা। অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বের সকল অঞ্চলে মানুষের গড় আয়ু দ্বিগুণ হয়ে যায়।

কিন্তু দীর্ঘ ইতিহাসের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি অস্থায়ী ঘটনা। জন্মহার ও মৃত্যুহার একইসাথে না কমার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই জনসংখ্যা এতটা বেড়ে গেছে। জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হয় তখনই, যখন জন্মহার শত শত বছরের মত একইরকম থাকে, শুধু মৃত্যুহার কমে আসে।

এদিকে গত ২০০ বছরে একের পর এক দেশে নারীরা সন্তান গ্রহণের ব্যাপারে একইরকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যখন নারীরা আরো স্বাধীন হয়, একইসাথে শিক্ষা ও সমৃদ্ধি অর্জন করে এবং বুঝতে পারে যে তাদের সন্তানদের মৃত্যুর সম্ভাবনা কমে এসেছে, তখন তারা কম সন্তান জন্ম দেয়।

আর এভাবেই ভবিষ্যতে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির যুগ শেষ হয়ে আসবে। উচ্চ মৃত্যুহার এবং উচ্চ জন্মহার থেকে নিম্ন মৃত্যুহার এবং নিম্ন জন্মহারের এক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। ‘জনসংখ্যাতত্ত্ব’ বা ডেমোগ্রাফির ভাষায় এ বিষয়টাকে বলা হয় ‘ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন’।

যেসব দেশে শিল্পায়ন আগে ঘটেছিল, সেসব দেশে এই ট্রানজিশন বা রূপান্তর আগেই শুরু হয়: মোটামুটি ১৯ শতকের মাঝামাঝি থেকে ২০ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। যুক্তরাজ্যের কথাই ধরা যাক। দেশটিতে প্রত্যেক নারীর ৬টি সন্তান গ্রহণের পর্যায় থেকে ৩টিরও কম সন্তান গ্রহণের পর্যায়ে পৌঁছাতে সময় লেগেছে ৯৫ বছর।

শিল্পায়ন পরে হয়েছে, এমন অনেক দেশে এই রূপান্তর ঘটেছে অনেক দ্রুত। প্রতিজন নারীর সন্তান গ্রহণের সংখ্যা ৬টি থেকে ৩টিরও কমে নেমে আসতে দক্ষিণ কোরিয়ার সময় লেগেছে ১৮ বছর। ইরান আরো কম সময়ে, মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই এই রূপান্তর ঘটিয়েছে।

যেভাবে বিভিন্ন দেশ এই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তেমনি যাচ্ছে পুরো বিশ্ব। বিশ্বব্যাপী জন্মহার গত ৫০ বছরে অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। ১৯৬০ এর দশকের গোড়ার দিকে প্রত্যেক নারী গড়ে ৫টিরও বেশি সন্তান জন্ম দিত, যেই সংখ্যা এখন ২.৫ এর নিচে নেমে এসেছে।

গত ২০০ বছরে যেভাবে এগিয়ে গেছে মানবজাতি

এর অর্থ, সমগ্র বিশ্বই এই ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের মধ্যে আছে। এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আসলে অর্ধ শতাব্দী আগেই শীর্ষে পৌঁছেছিল।

এখন বরং আমরা দেখছি বিশ্বজুড়ে জন্মহার কমছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যেই হার আমরা লক্ষ্য করেছি, সেটা আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে। শুধুমাত্র বিংশ শতাব্দীতেই বিশ্বের জনসংখ্যা চারগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ চলমান একুশ শতকে জনসংখ্যা দ্বিগুণ পরিমাণও বাড়বে না।

জাতিসংঘ ধারণা করছে, এই শতাব্দীর শেষের দিকেই বিশ্বের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে ০.১%-এ গিয়ে ঠেকবে। অন্যদিকে ‘আইআইএএসএ’ (IIASA, যার পূর্ণরূপ ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর অ্যাপ্লায়েড সিস্টেমস অ্যানালাইসিস) এর জনসংখ্যাবিদদের মতে, অন্তত ২০৭৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার একেবারেই থেমে যাবে।

শিক্ষা

জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসার ছাড়া গত দুই শতাব্দীর কোনো অর্জনই সম্ভব হত না। শিক্ষার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয় আমরা কীভাবে জীবনযাপন করব। এ কারণে আগের তুলনায় এখন শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি।

অন্যান্য অনেক সামাজিক বিষয়ে সঠিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হয় না। তুলনায় শিক্ষা এমন একটি বিষয়, যে ব্যাপারে সঠিকভাবে অনেক অনুমান করা যায়। কারণ আজকের বিশ্বে শিক্ষার অবস্থার ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতে শিক্ষার অবস্থা কেমন হবে, সে ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়। বর্তমান সময়ের একজন শিক্ষিত যুবতী ২০৭০ সালে গিয়ে একজন শিক্ষিত বৃদ্ধা হবেন।

সাক্ষরতার হার সম্পর্কে যেমনটা আগেই দেখা হয়েছে, সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার অবস্থা উন্নত হয়েছে। ধারণা করাই যায়, এই ধারা অব্যাহত থাকবে। কারণ এখনকার অল্প বয়স্ক যুবক-যুবতীরা বয়স্ক লোকদের তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষিত।

২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যার আকার এবং তাদের শিক্ষাগত অবস্থা কেমন হবে, সে ব্যাপারে ‘আইআইএএসএ’-এর জনসংখ্যাবিদদের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে এই চার্ট বা লেখচিত্রে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আকর্ষণীয় এক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে এই লেখচিত্র। বর্তমান সময়ের নিম্ন জন্মহারের ওপর ভিত্তি করে গবেষকরা ধারণা করছেন, এখন থেকে শিশুদের সংখ্যা কমতে থাকবে।

অর্থাৎ, আজ যত বেশি শিশু পৃথিবীতে আছে, তেমনটা আর কখনো হবে না। এবং আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, জনসংখ্যাবিদদের ধারণা ২০৭০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং তারপর কমতে থাকবে।

বর্তমানে শিক্ষার হারের সাথে তুলনা করলে ধারণা করা যায়, ২১০০ সালের মধ্যে এই বিশ্বে কোনো নিরক্ষর ব্যক্তি থাকবে না। প্রায় সবাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করবে। ৭ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ থাকবে, যারা কমপক্ষে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করেছে।

স্বাস্থ্যের উন্নতি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের অবসানের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক আছে। ফলে ভবিষ্যতের এই চিত্র খুবই সম্ভাবনাময়।

গত ২০০ বছরে যেভাবে এগিয়ে গেছে মানবজাতি

আমরা জানি কেন জানি না আমাদের পৃথিবী কীভাবে বদলে যাচ্ছে?

ইতিহাসে আমরা যে এগিয়ে যাচ্ছি, উন্নতি করছি, সে সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। লেখার শুরুতেই ২০১৫ সালে পরিচালিত জরিপের ব্যাপারে বলা হয়েছিল। সেই জরিপে অংশ নেয়া ১০ জনের মধ্যে ৯ জনেরও বেশি মানুষ মনে করতেন না যে, পৃথিবী ভালোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের এই ধারণার সঙ্গে ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণের মিল আছে কতটুকু?

মানুষের মনে এ ধরনের নেতিবাচক ধারণা জন্মানোর পেছনে শুধুমাত্র মিডিয়াকে দায়ী করা যায় না। মিডিয়া এজন্য আংশিকভাবে দায়ী। কারণ মিডিয়া আমাদের জানায় না কীভাবে পৃথিবী পরিবর্তন হচ্ছে, দিনদিন পাল্টে যাচ্ছে। বরং পৃথিবীতে ভুল বা নেতিবাচক যা কিছু হচ্ছে, সেসব খবরই উঠে আসে মিডিয়ায়।

আরো পড়ুন: নোম চমস্কি: মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার ১০টি কৌশল

মিডিয়ায় নেতিবাচক ঘটনা গুরুত্ব পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো সেখানে বিচ্ছিন্ন ঘটনা সম্পর্কিত তথ্য ও খবরাখবর প্রকাশিত হয়। আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা সাধারণত নেতিবাচক কিছুই হয়ে থাকে। সংবাদে তাই দেখবেন কোথাও বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে, কোথাও হয়েছে সন্ত্রাসী হামলা, আবার কোনো অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েছে।

অন্যদিকে ইতিবাচক উন্নয়ন সাধারণত খুব ধীরে ধীরে ঘটে। তাই সেসব ঘটনা খবরের শিরোনাম হয় না।

বর্তমান সময়ের মিডিয়া ও শিক্ষা ব্যবস্থা মোটের ওপর মানবজাতির দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন সম্পর্কিত তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক মানুষ ইতিহাসে আমাদের উন্নয়ন আর অগ্রগতি সম্পর্কে জানে না।

তাই বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বর্তমান সময়ের গুরুতর বিভিন্ন সমস্যার মোকাবেলা করা সম্ভব বলেই মনে করে না।

যেকোনো মানদণ্ড অনুসারেই বিশ্বব্যাপী চরম দারিদ্র্যের পরিমাণ কমে আসাটা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। অথচ যুক্তরাজ্যের মাত্র ১০% মানুষ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৫% মানুষ এই অগ্রগতির কথা জানে। দুটি দেশেরই অধিকাংশ মানুষ মনে করে, অতি দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।

এমনকি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ ভাবেন, অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এভাবে বৈশ্বিক উন্নয়ন সংক্রান্ত মৌলিক তথ্য না জানলে বিশ্ব যে ভালোর দিকে এগিয়ে যেতে পারে, সে ব্যাপারে আশাবাদী মানুষের সংখ্যা কম থাকাটা অবাক করার মত কিছু না।

ইতিহাস তুলে ধরার একমাত্র উপায় হলো পরিসংখ্যান ব্যবহার করা। শুধু পরিসংখ্যানের মাধ্যমেই গত ২০০ বছরে এই পৃথিবীতে বসবাস করা ২২ বিলিয়ন মানুষের জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব।

এসব পরিসংখ্যান যে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে, তাতেই বোঝা যায় আমাদের জীবনযাত্রার অবস্থা কীভাবে ইতিবাচক দিকে মোড় নিচ্ছে। উন্নয়নের গতি ধীর হলেও উন্নয়নের এই ধারা দীর্ঘদিন ধরে অব্যহত আছে।

‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’র সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা প্রায় এক বছর ধরে এসব চার্ট বা লেখচিত্র তৈরি করেছেন। তাদের উদ্দেশ্যই হল দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের চিত্র সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরা। প্রতিদিনের সংবাদে আর খবরে মানুষ যা জানতে পারে না, সেটা তাদের জানানোই তাদের এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য।

তবে গত ২০০ বছরে মানুষের জীবন কীভাবে পাল্টে গেছে, সেই ইতিহাস বর্ণনা করার একটা অসুবিধা আছে। আর সেটা হল, এতে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো গল্প বলা যায় না। একজন মানুষের জীবনের গল্প জানতে পারাটা অনেক আকর্ষণীয়, মানুষের মন এ ধরনের গল্পই শুনতে পছন্দ করে। কিন্তু বিশ্ব কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, সেটা বিচ্ছিন্ন কোনো গল্প দিয়ে বোঝানো যাবে না।

বিশ্ব কীভাবে পুরোপুরি বদলে গেছে, সেই চিত্র তুলে ধরতে হলে একসাথে অনেকগুলি গল্প বলতে হবে, যেটা পরিসংখ্যানের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব।

আমাদের জীবনযাত্রার অবস্থা কীভাবে পাল্টে গেছে, তা সহজে বোঝার জন্য সংক্ষিপ্ত আকারের কিছু চার্ট বা লেখচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এসব লেখচিত্রে ২০০ বছরের ইতিহাসকে ১০০ জন মানুষের ইতিহাস হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। গত দুই শতাব্দীতে এই ১০০ জন মানুষের জীবন কীভাবে পাল্টে গেছে, তা বুঝতে পারলে ২২ বিলিয়ন মানুষের পরিবর্তিত জীবনযাত্রার ব্যাপারেও ধারণা পাওয়া যাবে।

এই কয়েকটি লেখচিত্র থেকে ধারণা পাওয়া যায় আমাদের আগের প্রজন্ম কীভাবে বড় বড় বিভিন্ন সমস্যার মোকাবেলা করেছে।

গত ২০০ বছরে যেভাবে এগিয়ে গেছে মানবজাতি

পৃথিবী কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে তা না জানলে কী ক্ষতি

একা একজন মানুষের পক্ষে পৃথিবী পাল্টে ফেলা সম্ভব না। আমাদের জীবনযাত্রায় যেসব পরিবর্তন এসেছে, সেগুলি কেবল পারস্পরিক সহযোগিতার কারণেই সম্ভব হয়েছে। এবং এ ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য অনেক মানুষের মাথা খাটাতে হয়েছে, প্রয়োজন হয়েছে সম্মিলিত প্রচেষ্টার।

তবে সমাধান করার জন্য এখনো বড় অনেক সমস্যা আছে আমাদের। এ পর্যন্ত তুলে ধরা কোনো গ্রাফ বা লেখচিত্র থেকেই আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। বরং এসব লেখচিত্র থেকে বোঝা যায়, এখনো অনেক কাজ করা দরকার আমাদের।

যেমন, দ্রুত সময়ের মধ্যে দারিদ্র্যের হার কমানো আমাদের গুরুত্বপূর্ণ এক অর্জন। কিন্তু এটাও সত্যি যে, বিশ্বের ৮৫% মানুষ প্রতিদিন ৩০ ডলারের কম আয় করছে। এই বৈষম্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

একইভাবে আমাদের স্বাধীনতার পথে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে এবং যেসব বিধিনিষেধ ঐতিহাসিকভাবে রয়ে গেছে, সেগুলির কোনোটিই মেনে নেয়া উচিৎ নয়।

এটাও স্পষ্ট যে, পরিবেশের ওপর আমাদের কাজের প্রভাব খারাপ বিরূপ পৌঁছে গেছে। জীবজগৎ এবং জলবায়ু বিপন্ন অবস্থায় নিয়ে গেছে মানুষের কর্মকাণ্ড, অথচ আমরা মানুষেরাই এর ওপর নির্ভরশীল। তাই পরিবেশের ওপর আমাদের কাজের নেতিবাচক প্রভাব জরুরী ভিত্তিতে কমাতে হবে।

এ ধরনের গুরুতর সব সমস্যা যে আমরা সমাধান করতে পারব, সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমন কোনো কঠোর আইন আমরা মেনে চলছি না, যাতে নিশ্চিত করা যায় বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতির এই ধারা অব্যাহত থাকবে।

তবে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যে বিষয়টা স্পষ্ট হয় তা হলো, অগ্রগতি সম্ভব। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় গত ২০০ বছরে আমরা নিজেদের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে পৌঁছেছি।

যেকোনো বড় সমস্যা সমাধান করতে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন, প্রয়োজন সবার সহযোগিতা। এই গ্রহে আগের যেকোনো সময়ে যারা বেঁচে ছিল, তাদের তুলনায় আমরা একটি সমস্যা সমাধানে অনেক বেশি সক্ষম। কারণ আগের মানুষদের তুলনায় আমরা শক্তিশালী, স্বাস্থ্যবান, ধনী আর শিক্ষিত।

এভাবে ইতিহাস থেকে যদি আমাদের উৎসাহ নিতে হয়, তাহলে আগে ইতিহাস জানতে হবে।

ইতিহাস এবং বর্তমান সম্পর্কে আমরা নিজেদেরকে যে গল্প শোনাই, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উন্নত এক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য আমাদের প্রত্যাশা এবং প্রচেষ্টার সঙ্গে অতীতে আমরা কেমন ছিলাম, সে বিষয়টা জড়িত। এ কারণেই এখন পর্যন্ত বিশ্বে যেসব উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে, তা বোঝা এবং আলোচনা করা জরুরি।

অতীতে কীভাবে আমরা বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেছি, সেটা বোঝা দরকার ভবিষ্যতের সমস্যা সমাধান করার জন্য। নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি মানুষের কাছে আত্মসম্মান যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অতীতের মানুষদের সফলতাও সম্মিলিতভাবে আমাদের সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

জীবনযাত্রা উন্নত করে তোলার এ যাত্রায় অনেক দূর এগিয়ে এসেছি আমরা এবং অতীতে আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে। বিষয়টা বোঝা আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির ক্ষেত্রে একটি প্রয়োজনীয় শর্ত।

স্বাধীন মানুষের ওপর বিশ্বাস করা ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন করা অসম্ভব। তাই, যদি আমরা নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন না হই এবং সত্যের বিপরীতে মিথ্যা বিশ্বাস করি, তাহলে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারানোর ঝুঁকি থেকে যায়।
.

দ্রষ্টব্য: ‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’র ওয়েবসাইটে লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। এরপর দারিদ্র্য ও বৈষম্য সংক্রান্ত অনেক তথ্য আপডেট করেছে বিশ্বব্যাংক।

যেসব তথ্যের ওপর নির্ভর করে এই নিবন্ধ রচিত হয়েছে, সেগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য ও বৈষম্য সংক্রান্ত পুরনো ডেটা থেকে। যেখানে মানুষের আয় হিসাব করা হয়েছে ২০১১ সালের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডলার’ এর মূল্যমান অনুসারে।

পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক তাদের দারিদ্র্য ও ক্রয়ক্ষমতা পরিমাপ করার পদ্ধতি আপডেট করেছে। বর্তমানে ২০১৭ সালের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডলার’ এর মূল্যমান অনুসারে তা হিসাব করা হয়।

এই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে চরম দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমাও হালনাগাদ করা হয়েছে। ২০১১ সালের হিসাবে ১.৯০ ডলারের বিপরীতে বর্তমানে ২০১৭ সালের হিসাবে ২.১৫ ডলারের কম আয় করা মানুষেরা দারিদ্র্যসীমার নীচে আছে বলে ধরা হয়।

বিশ্বে দারিদ্র্য ও বৈষম্যের অবস্থা সম্পর্কে নিবন্ধ রচনাকারীদের ধারণায় খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি এ সকল হালনাগাদ করা তথ্য। কিন্তু হিসাবের বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসার ফলে এই নিবন্ধে উল্লেখিত অনেক পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে ভিন্ন হবে।

এই নিবন্ধের সকল তথ্য ও পরিসংখ্যান সর্বশেষ ২০২০ সালে আপডেট করা হয়েছে।
ভূমিকা, অনুবাদ ও দ্রষ্টব্য. ফারহান মাসউদ