কীভাবে কোনো জিনিসের বয়স বের করেন বিজ্ঞানীরা? পৃথিবীর বয়স কত? অতীতে পৃথিবীর জলবায়ু কেমন ছিল? লাখ লাখ বছর আগের মানুষেরা কীভাবে জীবনযাপন করত? আপনি কি জানেন বিজ্ঞানীরা এসব প্রশ্নের উত্তর কীভাবে বের করেন?

রেডিওকার্বন ডেটিং

নির্দিষ্টভাবে কোনো জিনিসের তারিখ নির্ধারণ বা বয়স শনাক্তকরণ এর জন্য বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন ‘রেডিওকার্বন ডেটিং’ পদ্ধতি।

এই পদ্ধতিতে কার্বন-১৪ এর পরিমাণ পরিমাপ করা হয়। কার্বন-১৪ হল তেজষ্ক্রিয় কার্বন আইসোটোপ বা বিভিন্ন সংখ্যক নিউট্রনযুক্ত পরমাণুর একটি সংস্করণ। কার্বন-১৪ পরিবেশের সব জায়গায় পাওয়া যায়।

কার্বন-১৪ এর আণবিক গঠন

ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক এবং রেডিও কার্বন ডেটিং বিশেষজ্ঞ টমাস হিগহাম এ বিষয়ে কথা বলেন বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট লাইভ সায়েন্সের সঙ্গে। তিনি বলেন, বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-১৪ গঠিত হয়। গাছপালারা একে নিঃশ্বাসের সঙ্গে নেয় আর প্রাণীরা নিঃশ্বাসের সঙ্গে ছাড়ে।

পদ্ধতিটি যেভাবে কাজ করে

কার্বনের সবচেয়ে সাধারণ গঠনে ৬টি নিউট্রন থাকে, আর কার্বন-১৪তে থাকে ৮টি। অতিরিক্ত দুটি নিউট্রন কার্বন-১৪ আইসোটোপটিকে আরো ভারি ও কম স্থিতিশীল করে তোলে। যে কারণে হাজার বছর পরে গিয়ে কার্বন-১৪ অবশেষে ভেঙে যায়। এর নিউট্রনগুলির একটি ভেঙে প্রোটন ও ইলেকট্রনে বিভাজিত হয়। ইলেকট্রনটি পালানোর সময়, প্রোটনটি পরমাণুর অংশ হয়ে যায়। একটি কম নিউট্রন এবং আরো একটি বেশি প্রোটন নিয়ে, আইসোটোপটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে নাইট্রোজেনে পরিণত হয়।

আরো পড়ুন: গলবে না বা নষ্ট হবে না এমন বরফ উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা

যখন জীবন্ত জিনিসগুলি মারা যায় তখন তারা কার্বন-১৪ নেয়া বন্ধ করে দেয়। এবং তাদের দেহে যে পরিমাণ কার্বন অবশিষ্ট থাকে তা তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের ধীর প্রক্রিয়া শুরু করে।

হাফ লাইফ

অবশিষ্ট কার্বন-১৪ এর অর্ধেক ক্ষয় হতে কত সময় লাগে তা বিজ্ঞানীরা জানেন। এই সময়টুকুকে বলা হয় ‘হাফ লাইফ’ বা অর্ধ-জীবন। এই জ্ঞান থেকে বিজ্ঞানীরা একটি জৈব পদার্থের বয়স পরিমাপ করতে পারেন। কোনো পশুর ত্বক বা কঙ্কাল, ছাই বা গাছের রিং যাই হোক না কেন, এতে থাকা কার্বন-১৪ থেকে কার্বন-১২র অনুপাত পরিমাপ করে বের করে এবং সেই অনুপাতের সঙ্গে আবার কার্বন-১৪র অর্ধ-জীবনের তুলনা করে তার বয়স পরিমাপ করা যায়।

কার্বন-১৪ এর অর্ধজীবন ৫,৭৩০ বছর। ফলে যারা বিগত ৫০ হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে চান তাদের জন্য কার্বন ডেটিং একটি আদর্শ পদ্ধতি।

ছবিতে কার্বন-১৪ ডেটিং

হিগহাম বলেন, “বিগত ৫০ হাজার বছর মানব ইতিহাসে সত্যিই এক আকর্ষণীয় অংশ। কৃষির উদ্ভব, সভ্যতার বিকাশ: এই সমস্ত কিছুই এই রেডিও কার্বন যুগে ঘটেছিল।”

বেশি বয়সী বস্তুর বয়স নির্ণয়ে ‘ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম-লিড ডেটিং’ পদ্ধতি

তবে এর চেয়ে বেশি বয়সী জিনিসগুলি ইতিমধ্যেই তাদের কার্বন-১৪ এর ৯৯%-রও বেশি হারিয়ে ফেলেছে, এবং এত কম অংশ অবশিষ্ট আছে যে তা শনাক্ত করাই কঠিন।

অনেক বেশি পুরোনো বস্তুর বয়স পরিমাপের জন্য বিজ্ঞানীরা কার্বন-১৪ ব্যবহার করেন না। তার পরিবর্তে, তারা প্রায়শই পরিবেশে উপস্থিত অন্যান্য উপাদানের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপকে পর্যবেক্ষণ করেন।

পেনসিলভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির রেডিওকার্বন ল্যাবরেটরির সহকারী গবেষণা অধ্যাপক ব্রেন্ডন কাল্লেটন বলছিলেন এ বিষয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো বস্তুগুলির জন্য, ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম-লিড ডেটিং সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। হিগহাম বলেন, “আমরা খোদ পৃথিবীর বয়স নির্ণয়ের জন্য এটি ব্যবহার করি।”

রেডিওকার্বন ডেটিং কেবলমাত্র সেই বস্তুগুলির জন্য কার্যকর যেগুলি একসময় জীবিত ছিল। বিজ্ঞানীরা পাথরের মতো বস্তুর বয়স নির্ধারণের জন্য ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম-সীসা ডেটিং ব্যবহার করেন। এই পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের পরিমাণ পরিমাপ করেন, যার সবগুলিই ক্ষয় হয়ে সীসা আকারে স্থির হয়। ক্ষয়ের এই চক্রগুলি ইউরেনিয়াম-২৩৮, ইউরেনিয়াম-২৩৬ এবং থোরিয়াম-২৩২ ভাঙার মধ্য দিয়ে শুরু হয়।

আরো পড়ুন: ভিনচি যেভাবে মোনা লিসার মুখে ছায়া তৈরি করেছিলেন—সায়েন্টিস্টদের ধারণা 

উটাহ স্টেট ইউনিভার্সিটির ভূতাত্ত্বিক টমি রাইটেনর বলেন, “ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়াম এত বড় আইসোটোপ যে সেগুলি ভেতরে ভেতরে ফুটতে থাকে। ওরা সবসময় অস্থির থাকে। এই ‘প্যারেন্ট আইসোটোপগুলি’ প্রতিটি সীসা হিসাবে রূপ ধারণের আগে আলাদা আলাদা ক্যাসকেডে বিভাজিত হয়।

অস্ট্রেলিয়ার জ্যাক হিলসে আবিষ্কৃত ৪৪০ মাইক্রোমিটার জিরকনের ক্যাথেডোলুমিনেন্স ছবি

পরিবেশ সুরক্ষা এজেন্সির (ইপিএ) মতানুসারে এই আইসোটোপের প্রতিটির ভিন্ন ভিন্ন হাফ লাইফ বা  অর্ধেক-জীবন থাকে, যা কয়েক দিন থেকে কোটি কোটি বছরও হতে পারে।

রেডিও কার্বন ডেটিংয়ের মতো করেই বিজ্ঞানীরা এই আইসোটোপগুলিকে নিজ নিজ অর্ধ-জীবনের সাথে তুলনা করে তাদের অনুপাত গণনা করেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই বিজ্ঞানীরা অস্ট্রেলিয়ায় আবিষ্কৃত ৪৪০ কোটি বছরের পুরনো জিরকন স্ফটিকের প্রাচীনতম শিলাটির বয়স নির্ণয় করতে পেরেছেন।

লুমিনেসেন্স ডেটিং

সর্বশেষ ডেটিংয়ের আরেকটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা। যার মাধ্যমে কোনো বস্তুর বয়স নয় বরং তা শেষবার কখন তাপ এবং সূর্যের আলো পেয়েছিল তা নির্ণয় করা হয়। ‘লুমিনেসেন্স ডেটিং’ নামে পরিচিত এই পদ্ধতিটি ভূ-বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন বিগত লাখ লাখ বছর ধরে ভূভাগের পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করার জন্য। পাথুরে উপত্যকায় হিমবাহ তৈরি হলে বা পশ্চাদপসরণ করলে তা আবিষ্কার করতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, অথবা যখন বন্যার পানি নদীর অববাহিকায় পলি মাটি এনে ফেলে তখন।

যখন এই পাথর এবং পলির খনিজ সমাহিত হয়, তখন তারা তাদের চারপাশের পলল দ্বারা নির্গত বিকিরণের সংস্পর্শে আসে। এই বিকিরণ পরমাণু থেকে ইলেকট্রনকে বের করে দেয়। কিছু ইলেক্ট্রন পরমাণুর মধ্যে ফিরে আসে। তবে অন্যরা তাদের চারপাশের পরমাণুর ঘন নেটওয়ার্কে গর্ত বা অন্যান্য ত্রুটির মধ্যে আটকে যায়। এই ইলেকট্রনগুলিকে তাদের আসল অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে তাপ বা সূর্যের আলোতে দ্বিতীয়বারের মতো উম্মুক্ত করার প্রয়োজন পড়ে। বিজ্ঞানীরা ঠিক এটাই করেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা পড়ে থাকা খনিজের নমুনা নিয়ে তা আলোতে উম্মুক্ত করেন। তখন ইলেকট্রনগুলি পরমাণুর মধ্যে ফিরে আসার সাথে সাথে তাপ এবং আলো নির্গত করে বা লুমিনেসেন্ট সংকেত প্রকাশ করে।

আরো পড়ুন: প্লাস্টিক প্যাকেজিং এর সমস্যা মোকাবেলায় যুগান্তকারী ৫টি প্রকল্প

টমি রাইটেনর বলেন, “কোনো বস্তু যত দীর্ঘ সময় ধরে সমাহিত থাকবে, তত বেশি তা রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আসবে।” অর্থাৎ, দীর্ঘদিন সমাহিত থাকা বস্তু অনেকবার রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আসার কারণে প্রচুর ইলেকট্রন নিজ স্থান থেকে ছিটকে যায়, যেগুলি আবার পরমাণুর দিকে ফিরে আসার সময় একত্রে একটি উজ্জ্বল আলো নির্গত হয়। তিনি আরো বলেন, “লুমিনেসেন্ট সিগন্যালের পরিমাণ থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন কত সময় ধরে বস্তুটি ঢাকা পড়ে ছিল।”

ডেটিংয়ের অন্যান্য ব্যবহার

বিশ্বের বয়স এবং প্রাচীন মানুষেরা কীভাবে জীবনযাপন করতেন তা বোঝার জন্যই কেবল এইসব ডেটিং বস্তুগুলি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফরেনসিক বিজ্ঞানীরা হত্যা থেকে শুরু করে শিল্প জালিয়াতির মতো অপরাধ সমাধানের জন্যেও এগুলি ব্যবহার করেন। হিঘাম বলেন, “রেডিওকার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে উৎকৃষ্ট মদ বা হুইস্কির বয়স কত তা নির্ণয় করা যায়। একইসঙ্গে, তাতে নকল করা হয়েছে কিনা এও ধরা পড়ে। এছাড়া আরো নানা ধরণের প্রয়োগ রয়েছে ডেটিংয়ের।

লাইভ সায়েন্স থেকে অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক