মানোলিসের সঙ্গে আমার পরিচয় আকস্মিক; কিন্তু প্রায় ঐশী পর্যায়ের অদৃষ্ট-নির্ধারিত। কারণ মানোলিস আর আমি দুজনেই সাইবার প্রজা। আবার সাইবার প্রজা বললেই যে সবটা বোঝানো গেল তা কিন্তু নয়। যেমন, আমার মনে পড়ে যে আমি দু’চারবার ওকে নানান নামের কম্বিনেশনে ফেসবুকে খুঁজেছি। ইমেইলে ওকে জিজ্ঞাসা করলেই পারতাম যে ও ফেসবুকে একটা জমি বরাদ্দ নিয়েছে কিনা। তা আমি করিনি। বরং আমাদের ইমেইলে নানাবিধ যোগাযোগের মধ্যেই এটাই এড়ানো হয়েছে। কিন্তু অন্য সময় আমি ঠিকই খুঁজেছি। মানোলিস নাই। অন্তত আমার পক্ষে আন্দাজযোগ্য কোনো ইংরাজি নামে সে ফেসবুকে নাই। আন্দাজযোগ্য বিষয়ে কথা তোলারও কারণ আছে। ওর ঠিকানা লিখতে গিয়ে যা যা লিখলাম তার মধ্যে আর যাইহোক মানোলিস নাই। ‘ই’ আছে, প্যান্টোস আছে; আসলে একটা ডক্টরও আছে। মানোলিস নাই। কিন্তু আমি ওকে মানোলিস ডাকি; মানে লিখি।

মানোলিসের সঙ্গে আমার মিল আর অমিলের মধ্যে কোনটা যে আগে লেখা উচিৎ তা আমি একদমই নিশ্চিত নই। শুরুই করলাম দুজনেই সাইবারপ্রজা দিয়ে। শুরু করতে না করতেই ফেসবুকে ওর অ্যাপার্টমেন্ট না-থাকা নিয়ে না-বলে পারলাম না। এছাড়া ওর নামের, অন্তত যে নামটা আমি জানি, এবং ইমেইলে ও নিম্নস্বাক্ষর করে যে নামে, সেই নামের মধ্যে ‘লি’ টুকু বাদ দিলেই প্রায় যে আমার নাম হয়ে যায় এটা আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু বলিনি। সম্ভবত সেও লক্ষ্য করেছে; বলেছে বলে মনে পড়ে না।

মানোলিস

মানোলিস আর আমি দুজনেই একাডেমিয়া ডট এডুর নিয়মিত প্রজা। এটা একটা গুরুতর মিল। বস্তুত, এই মিলের কারণেই মানোলিস আমাকে পাকড়াও করেছে। এই মিলটা এত জবর মিল যে আমাদের লাগাতার ইমেইল যোগাযোগ হয়। কিন্তু এই সামান্য দুটি মিলের বিষয়ে গুরুতর আনন্দ করার সুবিধা নাই। মানোলিস একজন প্রকৃত দাদু। ওর চিঠিপত্রে, মানে ইমেইলে, প্রায়শই ওর নাতি-নাতনিরা একটা বাক্য নিয়ে ফেলে। আমি এমনই অপদার্থ যে কখনো সেসব নাতিবর্গের বিষয়ে তেমন কিছু জানতে চাই নাই। ছবিও চাই নাই। এই এখন লিখতে বসে আমার এই বিশ্রী ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে আমি সজাগ হলাম। কী করা!

মানোলিস গণিতজ্ঞ নাকি ইঞ্জিনিয়ার, নাকি ইলিয়াড-ওডিসি বিশেষজ্ঞ, নাকি আসলে ভাষাবিজ্ঞানের লোক, নাকি আসলে গ্রীক ভাষাদক্ষ নাকি হিস্টোগ্রামার তা কিছুতেই ভালমতো লিখতে গিয়ে মনে করতে পারছি না। ওর একটা ডক্টরেট আছে, সম্ভবত আমার জন্মের আগে, কিংবা পরপরই ইংলন্ড থেকে। সেটা মনে আছে, গোড়ার দিকেই দেখেছিলাম বলে। আর ও নিজেকে ম্যাথমেটিশিয়ান বলেছিল কখনো সেটাও মনে আছে। কিন্তু ওর লাগাতার ইনার্জিটিক কর্মকাণ্ডে এতসব জিনিস আছে যা আসলে গুলিয়ে দিতে যথেষ্ট। সর্বোপরি, ওর চিঠিতে সারাক্ষণই নাটবল্টু, হাতে-সিমেন্ট, বাগানে-চারা এইসব বিচিত্র, এবং ভীতিকর, সব জিনিসে ভরপুর থাকে। বিচিত্র কারণ গণিত বলুন বা প্রকৌশল, ভাষাবিজ্ঞান বলুন বা হিস্টোগ্রাম কোনো কিছুর সঙ্গে আশেপাশেও সেসব কাজ নয়। আর ভীতিকর কারণ হলো, ওর গলার মধ্যে এমন একটা প্রত্যয় থাকে যে মনে হয় ওইসব কাজ যে আমারও করা উচিত তা সে ভাবতে পারে। এমনকি, নাগালের মধ্যে থাকলে, করিয়েও ছাড়ত। খুবই ভীতিকর!

তো সে যে কোনো এক কালে গ্রীসে জন্মেছিল, আর এখন যে ব্রিটেনে থাকে এটুকু নিশ্চিত ছিলাম। আর তার কাছে ঠিকানা চাইলে সে ব্রিটেনের ঠিকানাই পাঠায় বলে ওই বিষয়ে বিশেষ কোনো মাথা-আউলানি ঘটার সুযোগ পায়নি আমার। একটা পরিষ্কার ব্রিটিশ, এমনকি ইংলন্ডীয় ঠিকানা। আমি কম্পুটারে আলাদা ওয়ার্ডফাইলে সংরক্ষণ করলাম। আবার খামের উপরেও লিখলাম। নিজ হাতে।

পোস্ট অফিসগত পাঁচমাসে আমাদের ইমেইলের গতি ও হার যেকোনো তৃতীয় পক্ষের জন্য ভীতিকর হবে। মানোলিসের সঙ্গে পরিচয়ের আগে আমার ধারণা ছিল যে আমার ইমেইলচালান ও উত্তরপ্রদান সামর্থ্য যেকোনো ‘স্বাভাবিক’ গেরস্ত-কেরাণির জন্য আতঙ্কজনক হতে পারে। অবশ্যই কলসেন্টার বা বিপণনের লোকজন বাদ দিলে। তাছাড়া মুরগি বা যশোরের পাটালি কেনার অনলাইন দোকানগুলোতে মানুষে ইমেইল করে নাকি যন্ত্রতে তা নিয়ে অনেক নিশ্চিত হওয়া কঠিন। যাহোক, মানোলিসের সঙ্গে পরিচয় হবার পর বুঝলাম যে আমি নস্যি, তুচ্ছ, বিনাকারণে ইমেইল সামর্থ্যে আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন এক সাইবার নাগরিক। ওর গতি, হার, বিষয়বৈচিত্র্য, আর দরকার মতো এক ইমেইলেরই তিনটা উত্তরপ্রদানে কোনো আত্মবিশ্বাসী সাইবার নাগরিকেরই ব্যক্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে না।

ওর ইমেইলও নিজগুণে নজরকাড়া, ও পাগলপারা। আমি যদি ইমেইলে হই ‘হরিপদ কেরাণি’, পঁই পঁই করে সব বিষয় আলাদা করে লেখা, প্রায় দরখাস্তের মতো; তো মানোলিসের শব্দবিন্যাসই হচ্ছে প্রচলিত কবিতার মতো। যেকোনো জায়গায় বাক্য ভাঙছে, যেকোনো বাক্যই শেষ করার দরকার মনে করছে না, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয় নিয়ে বলে যেটা নিয়ে বলবার সেখানে আসছে, কিংবা যে প্রশ্নটা আপনি করেছিলেন সেটার উত্তরই করার দরকার মনে করেছে না। আমার রচনার বিষয়ে সে লাগাতার আগ্রহ দেখায়। ওদিকে আমি লাগাতার বাংলায় লিখি। অন্তত পাঁচ/ছয় ক্ষেত্রে আমি টের পেয়েছি যে সে গুগলকে আমার বাংলা পাঠিয়ে ইংরাজি নেয়। তারপর আমাকে জানায়।

এদফা আমি তাকে আমার একমাত্র ইংরাজি কিতাব, যক্ষের ধন, পাঠাতে পোস্ট অফিস গেছি। ঢাকায় পোস্ট অফিস বলতে আমার স্মৃতিতে, বা দৃশ্যকল্পে দুইটা—জিপিও আর মোহাম্মদপুর। আমার বেকারকালীন কমলাপুর-সদরঘাটের মর্যাদারও অধিকন্তু মর্যাদায় আসীন ছিলেন জিপিও। প্রায় পারলৌকিক গাম্ভীর্যে। আর মোহাম্মদপুর পোস্টাফিস লৌকিক। দীর্ঘকাল লালমাটিয়া অঞ্চলে থাকা কিংবা তার আগে বেকারকালীন আমার ডাকঠিকানা মোহাম্মদপুর আইনুনের বাসা (অধ্যাপক আইনুন নাহার, জা.বি.) হবার কারণে। শ্যালিকাকে মতিঝিল পর্যন্ত অফিসে সঙ্গ দিতে গেছি বস্তুত জিপিও পানে যাব বলে, ফেরার কালে।

পোস্ট অফিসআমার স্মৃতিতে নাই শেষ কবে আমি একটা ন্যায্য ডাক-পোঁটলা পাঠিয়েছি। তবে যবেই হোক, তা ছিল ইএমএস— এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস। আমি এখনো সেটার কাউন্টার যে কাউকে বলে দিতে পারব। তখন ৮০০ টাকার আশপাশে ওই ইএমএস পাঠিয়েছি তাও মনে আছে। কিন্তু চিঠি না পুস্তক তা ভালভাবে মনে নাই। মনে রাখবেন, ইএমএস-এ আমি দুই-ই পাঠিয়েছি; কিন্তু শেষবার, যদি এক দশক আগে হয়ে থাকে, কী ছিল তা মনে নাই। আমার বুদ্ধি বলে, এখনকার অংকটা আমি খরচ করতে চাইব না। ফলে জিপিওতে আমি নন-ইএমএস রাস্তা বোঝার জন্য লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বেশ খানিকক্ষণ পর আমি কাউন্টার পর্যন্ত আসতে পারলাম; এবং কাউন্টারের ভদ্রমহিলা ও মহোদয় (আমি ত্যারছা ভাবে দুজনের বাক্য-পরিষেবা গ্রহণ করার সুযোগ নিয়েছিলাম) আন্তরিকভাবেই নিয়ম বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। এখন, এটাও সত্যি, আমার মতো কৌতূহলী লোককে না-মেরে সামলানো খুব কঠিন। আমি কেবল আমার কাজটা হলেই যে ক্ষান্ত হব তা নয়। ওটা কেন ওটা, সেটার সঙ্গে ওটার কী পার্থক্য, কোনটাতে প্লাস্টিকের খোসা পরাতে হয়, কোনটা উন্মুক্ত থাকতে পারে, কোনটা সুতাযুক্ত—ডাকপোঁটলার কথাই হচ্ছে—এসব বিবিধ জিজ্ঞাসা ছাড়া আমি মুক্তি পাই না। সারাংশে, ওইদিন কিছুই বুঝলাম না। ডাকও হলো না।

পরদিন মোহাম্মদপুর গিয়ে দেখি আস্ত পোস্টাফিসই উধাও। নাই। ছয় লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করে একটা দিশা পাওয়া গেল। আগের ভবন বদলানোর জন্য এই অফিস চাঁন মিয়া হাউজিংয়ে। আরো কয়লোকের সহায়তায় চাঁনমিয়া হাউজিংয়ে গিজ গিজ ভিড়ের মধ্যে আমি পোস্টাফিসে যেতে পারলাম। গিজ গিজ ভিড়, পোস্টাল ব্যাঙ্কিংয়ের কারণে। এবং মুখ্যত প্রবীণ লোকে ঠাসা। সে আরেক আলাপ। এখানে আমি এমন এক হাসিমুখ পরিষেবাদাত্রী পেলাম যে মনে হলো পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছি। তিনি একগাল হাসি দিয়ে, “সব করে দিচ্ছি, এনআইডি ফোটোকপি করে আনেন আগে” বলার পর আমি যে এনআইডি ছাড়াই এই গুরুতর কাজ করতে এসেছি তা আর তাঁকে না বলে বাসা চলে এলাম।

বলাই বাহুল্য, পরদিন গেলাম এনআইডির পর্যাপ্ত সংখ্যক ফোটোকপি নিয়ে। আমার ডাকপোঁটলা ছয়টা, একটাই তার মধ্যে মানোলিসের জন্য। এই নারী (যাঁর নাম বলব না) একগাল হাসি দিয়ে বললেন “আপনার এত কিছু জানার দরকার আছে? আপনার কম খরচে পৌঁছালেই তো চলল নাকি?” আমি কিছুতেই না বলতে পারলাম না। আমি লক্ষ্য করেছি, আমাকে কেউ থামায়ে দিতে পারলে আমার কৌতূহল-জিজ্ঞাসার পেটভুডভুডগুলোর বেশ সহজেই উপশম ঘটে। পোস্টাফিস-নায়িকা আমাকে অম্লান মুখে হুকুম দিতে থাকলেন কোথায় কী করতে হবে, কোথায় ‘স্মল প্যাকেট’ লিখতে হবে; আমার এতসব কৌতূহল যে কোনো কাজের জিনিস না সেটাও মনে করিয়ে দিলেন। আর সমানে নিজেও পোঁটলাতে ক্ষিপ্র হাত লাগাতে থাকলেন। অমুকটা টেপ, তমুকটা প্রিন্ট করে বসানো। ঘ্যাচাঘ্যাচ হাত চলছে তাঁর। এরপর অংক কষে এই সস্তা ডাকের মধ্যেও সস্তাতর একটা রাস্তা বের করে দিলেন ম্যাজিকের মতো। সেটা বের করাতে হাজারখানেক টাকা নেমে গেল। ভুরু নাচিয়ে তিনি এই ম্যাজিকের একটা সম্মানীও নির্ধারণ করলেন। কোনোরকম কৌতূহল ছাড়াই বরফশান্ত মাথায় আমি পোঁটলা ডাক নিবন্ধন করতে পারলাম। কী অদ্ভুত তাঁর ব্যবস্থাপনা সামর্থ্য! আমাকে নির্বাপিত করেছেন, তাই ভাবছিলাম!

কুশল বিনিময়ের একটা পর্যায়ে জানতে পারলাম এই সপ্তাহে তিনি একটু ক্লান্ত। কয়েকদিন আগেই তাঁর মেয়ে বাজে একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রায় কৌতূহলহীন আমি না জিজ্ঞাসা করে পারলাম না তিনি হাসিমুখ লাগাতার রাখতে পারছেন কীভাবে। তিনি জানালেন “এটা তো কাজ!”

কাজ-অকাজ-কুকাজ নিয়ে মেলা ভাবনা আছে দুনিয়ায়। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে মানোলিস ছবি পাঠালো সেই পোঁটলার, যার অনেকটাই ওই পোস্টঅফিস-নায়িকার কীর্তি। তাঁর নাম, ধরা যাক, নয়নতারা।

আদাবর, ২৬ সেপ্টেম্বর  ২০২১
কভারে মানস চৌধুরী; ছবি. সাব্বির রহমান, ২০১৫