অতীতে এমন হয়েছে, মানুষ গণিত নিয়ে ভাবতে ভাবতে এমন কিছু আবিষ্কার করেছে যা আগে থেকেই ছিল। আবার এমনও হয়েছে, মানুষের ভাবনা থেকে নতুন কিছু সমীকরণ আর লেখার কৌশল বের হয়েছে, যা মানুষ নিজের উদ্ভাবন বলে মনে করেছে।
কেউ কেউ মনে করেন বিশ্বজগতে গণিত সব সময়ই ছিল। মানুষ কেবল গণিতশাস্ত্র আবিষ্কার করেছে।
আবার কারো মতে, গণিত আমাদের মনের সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই না। এমনকি ইতিহাসে এতদূর এসেও এই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর পাওয়া যায় নাই।
গণিতের কোনো সমস্যা সমাধান করতে হিমশিম খাওয়া কিংবা গণিত ক্লাসে শেখা লম্বা সূত্রগুলি মনে রাখার চেষ্টা করি আমরা সবাই। স্কুল জীবনে প্রায় সবারই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে।
কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে আপনি নিজে কখনও ভেবেছেন? গণিত কি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সব সময়ই ছিল, আর আমরা কেবল তা খুঁজে পেয়েছি? নাকি কেউ ইচ্ছা করে বাচ্চাদের শাস্তি দেয়ার জন্য গণিত আবিষ্কার করেছিল?
এই প্রশ্নের উত্তর বের করাটা ক্যালকুলাসের অংকের মতই জটিল এক বিষয়।
কেতাকি বাপাত
সর্বশেষ সংস্করণ: জানুয়ারি ১০, ২০২২: সূত্র. সায়েন্স এবিসি
অনুবাদ: আমিন আল রাজী
আপনার বিশ্বাস হোক আর না হোক, আমাদের আধুনিক বিশ্বের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে গণিতের অবস্থান। স্মার্টফোন, গাড়ি, বাড়ি এমনকি আবহাওয়ার পূর্বাভাস, সবকিছুই গণিত মেনে চলে। বহু বছর ধরে এ নিয়ে আলোচনা হলেও এখনও গণিতশাস্ত্র নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে বিতর্ক চলছে।
গণিত কি মানুষের উদ্ভাবন নাকি আবিষ্কার?
কারো মতে, গণিতের অবস্থান আমাদের ভেতরে। এ কারণে গণিত আমাদের আবিষ্কার। আবার অন্য দার্শনিকরা ভাবেন গণিত মানুষের চিন্তা নিরপেক্ষ একটা বিষয়, আর এর অবস্থান আমাদের স্বাধীন চিন্তার বাইরে।
তবে কি গণিতের উদ্ভব, উদ্ভাবন আর আবিষ্কারের মাঝামাঝি কোনো পর্যায়ে? এর সত্যতা বের করতে হলে আমাদের অনেক পেছনে তাকাতে হবে। জানতে হবে প্রাচীন গণিতশাস্ত্র আসলে কবে শুরু হয়েছিল।
গণিত কত পুরোনো?
মানুষ আর গণিতের শুরুর গল্প একই সময়ে। একটা গরুর পালে কয়টা গরু আছে, এমন খুব সাধারণ অঙ্ক থেকেই ধীরে ধীরে আধুনিক গণিত এর উদ্ভব। এখন আমরা গণিতের সাহায্যে শুধু গণনাই করি না, বরং বিমূর্ত কোনো বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান করার জন্য ব্যবহার করি গণিত।
খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালের দিকে আধুনিক মানব সভ্যতার ভিত্তি গড়ে উঠতে শুরু করে এবং নানান জায়গায় মানুষ বসতি স্থাপন করে। আর তখনই গণিতের প্রাথমিক বিকাশের আরম্ভ।
জমির পরিমাপ বা গৃহস্থের করের হার বের করার মত কাজে গণিতের ব্যবহার শুরু হয়। পরে খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ সালে আমরা রোমান সংখ্যার বিকাশ দেখতে পাই। আজও সংখ্যা প্রকাশ করতে রোমান সংখ্যার ব্যবহার প্রচলিত।
বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, হাজার বছর আগে যোগ বিয়োগের মত মৌলিক গণিত একই সময়ে ভারত, ইজিপ্ট ও মেসোপটেমিয়াতে শুরু হয়। তবে আধুনিক গণিতের কথা জানা যায় খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০০ সালে, গ্রীসে। তখনই গ্রীক গণিতবিদ পিথাগোরাস তার বিখ্যাত সমীকরণের ধারণা প্রকাশ করেন।
পিথাগোরাসের সূত্র নামে পরিচিত সমকোণী ত্রিভুজের বাহু নিয়ে পিথাগোরাসের সেই বিখ্যাত সমীকরণ আজও গণিত শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়।
তবে শুরুর সেই সময় থেকে অনেক গণিতবিদ গণিত দিয়ে তাদের চর্চা ও গবেষণা করে আসছেন। তবুও গণিতের উৎপত্তি সংক্রান্ত বড় এই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর কেউ বের করতে পারেন নাই।
গণিত কি আমাদের মহাবিশ্বে আগে থেকেই ছিল?
অতীতে এমন হয়েছে, মানুষ গণিত নিয়ে ভাবতে ভাবতে এমন কিছু আবিষ্কার করেছে যা আগে থেকেই ছিল।
আবার এমনও হয়েছে, মানুষের ভাবনা থেকে নতুন কিছু সমীকরণ আর লেখার কৌশল বের হয়েছে, যা মানুষ নিজের উদ্ভাবন বলে মনে করেছে।
কেউ কেউ বলেন, লাইট বাল্ব উদ্ভাবনের মত কোনো উদ্ভাবন নয় গণিত। বরং এটা একটা আবিষ্কার। এই দাবির পেছনের ধারণাটি হল, গণিত ঈশ্বরের মনের মধ্যে আছে। কিংবা চিন্তার প্লেটোনিক জগতে গণিতের অবস্থান। আমরা একে কেবল খুঁজে বের করেছি। এই অবস্থানের নাম প্লেটোনিজম বা প্লেটোবাদ।
প্রাচীন চিন্তাবিদ ও গণিতবিদ প্লেটোর নাম অনুসারে প্লেটোবাদ এর নামকরণ। প্লেটো বিশ্বাস করতেন গণিতের অস্তিত্ব বিমূর্ত জগতে। এবং সময় বা স্থান-কালের বাইরে গণিত নিজের জগতে স্বাধীন।
কিছু গাণিতিক চিন্তা এতটাই মৌলিক যে, একজন সেটা আবিষ্কার না করলে অন্য কেউ বের করে ফেলত। গণিত হচ্ছে বিজ্ঞানের ভাষা। আর গণিতের কাঠামো আমাদের প্রকৃতির মধ্যেই সহজাত আকারে মিশে রয়েছে।
যদি আগামীকাল মহাবিশ্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়, গণিতের চিরন্তন সত্যগুলি তবুও একই রকম সত্য থাকবে। গণিতের প্রকৃতি বোঝা এবং একে আবিষ্কার করার দায় আমাদেরই। আমাদের চারপাশের বাস্তব পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে গণিতের জ্ঞানকে কাজে লাগাই আমরা নিজেদের প্রয়োজনেই।
আরো পড়ুন: কেন ১৮৫৬ সালে মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ২ ফুট বাড়িয়ে বলা হয়েছিল
অনেক গণিতবিদ এই ধারণাকে সমর্থন করেন। গণিতের মাধ্যমে তারা অজস্র চিরন্তন সত্য আবিষ্কার করেছেন, যার ওপর তাদের নিজেদের মনের কোনো প্রভাব ছিল না।
যেমন বলা যায় সর্বোচ্চ মৌলিক সংখ্যা বলে কিছু নাই। আবার পাই এর মান দশমিকের পর অনন্তকাল পর্যন্ত চলতে থাকতে পারে।
গণিতের প্রকাশ তাই আমরা দেখতে পাই প্রকৃতিতে। এবং বিশ্ব জগতের অনেক প্রশ্নের উত্তর এর মধ্যে নিহিত। উদাহরণের কথা আমরা জানি, যাকে বলে গোল্ডেন রেশিও বা স্বর্ণানুপাত।
গোল্ডেন রেশিও এবং ফিবোনাচ্চি সংখ্যা
মহাবিশ্বের যেকোনো ক্ষেত্রে যে প্যাটার্ন বা ধরন সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তার নাম গোল্ডেন রেশিও।
অণু থেকে শুরু করে ঘূর্ণিঝড়ের আকার, মানুষের শরীর ও চেহারা, এমনকি মহাবিশ্বের আকারও গোল্ডেন রেশিও দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
গোল্ডেন রেশিও বা স্বর্ণানুপাত বুঝতে হলে বড় এবং ছোট দুটি বস্তুর কথা কল্পনা করা যাক। ধরা যাক বড় বস্তুটি ‘ক’ এবং ছোট বস্তুটি ‘খ’। এখন, বস্তু দুটির অনুপাতের যোগফলের সঙ্গে (ক+খ) বড় বস্তুটি (ক) ভাগ করলে যা ফলাফল আসে, সেই অনুপাত যদি ‘ক’ বা ‘খ’ এর অনুপাতের সমান হয়, তাহলেই সেটা গোল্ডেন রেশিও। সংখ্যার হিসাবে এর মান ১.৬১৮ এর কাছাকাছি এবং একে গ্রীক হরফ ‘ফাই’ (Φ) এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এর আরেক নাম ‘স্বর্গীয় অনুপাত’ বা Divine Proportion।
এই গোল্ডেন অনুপাতের ধারণা এসেছে ফিবোনাচ্চি সংখ্যা, ফিবোনাচ্চি ধারা বা ফিবোনাচ্চি রাশিমালা থেকে। এই ধারার জনক ইতালিয়ান গণিতবিদ লিওনার্দো ফিবোনাচ্চি। শত বছর ধরে ফিবোনাচ্চি রাশিমালা গণিতবিদ, বিজ্ঞানী ও শিল্পীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করেছে।
ফিবোনাচ্চি রাশিমালা খুব জটিল কিছু না। এর প্রতিটি সংখ্যা হচ্ছে পূর্বের দুটি সংখ্যার যোগফল। এই নিয়ম অনুসারে ফিবোনাচ্চি ধারা হচ্ছে ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫…. এভাবে চলতে থাকবে।
ফিবোনাচ্চি ধারার উপস্থিতি আমাদের চারপাশে অনেক কিছুর মধ্যেই দেখা যায়। সামুদ্রিক জীবের খোলসের মত প্রাণীজগতের বিভিন্ন নিদর্শন থেকে শুরু করে পিরামিডের মত অনেক অপ্রত্যাশিত জায়গায় দেখা যায় ফিবোনাচ্চি রাশিমালা।
এমনকি ফুলের পাপড়িও ফিবোনাচ্চি ধারা অনুসরণ করে। খেয়াল করলে দেখবেন যেকোনো ফুলের পাপড়ির মধ্যে কোনো একটা সংখ্যাতেই হয়: ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪ অথবা ৫৫। যেমন, লিলি ফুলের পাপড়ির সংখ্যা ৩টি, কসমস ফুলের রয়েছে ৮টি, কর্ন ম্যারিগোল্ড নামের একটি ফুলে রয়েছে ১৩টি পাপড়ি, চিকোরি এবং ডেইজি ফুলের আছে ২১টি করে এবং মাইকেলমাস ডেইজি ফুলের পাপড়ি ৫৫টি।
এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়, গণিতের ব্যবহার প্রকৃতিতে আগেই ছিল। আমরা কেবল প্রকৃতি থেকে গণিতের ধারণা আবিষ্কার করেছি।
গণিত কি আমাদের মনের মধ্যে তৈরি কল্পনা?
অনেকেই ভাবেন মানুষ প্রকৃতি থেকে গণিত আবিষ্কার করেনি। ইতিহাসজুড়ে এ ধরনের মানুষেরা ‘অ্যান্টি-প্লেটোনিক স্কুল অফ থট’ বা প্লেটোবিরোধী চিন্তাধারার অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
তাদের কাছে গণিত হচ্ছে মানুষের উদ্ভাবন, যার সাহায্যে আমাদের বাস্তব পৃথিবী সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন গাণিতিক ধারণা তৈরি করতে থাকে।
আগামীকাল যদি এই মহাবিশ্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়, আমাদের তৈরি সকল জল্পনা কল্পনা, ফুটবল বা দাবা খেলা থেকে শুরু করে প্রিয় গণতন্ত্র বা গার্হস্থ্য অর্থনীতি, এমনকি গণিতও বিলীন হয়ে যাবে।
এই মহাবিশ্ব কীভাবে কাজ করে, তা মানুষ বুঝেছিল কেবল প্রকৃতির মধ্যে থাকা বিভিন্ন প্যাটার্ন বা ধরন পর্যবেক্ষণ করে। আকার, রেখা বা শ্রেণীর মত আমাদের চারপাশে থাকা বিভিন্ন বিমূর্ত উপাদান ব্যবহার করে আমরা গাণিতিক ধারণা তৈরি করেছি।
এরপর এসব ধারণা একটার সাথে আরেকটা সংযুক্ত করেছি। কখনো নিজেদের কাজের প্রয়োজনে, কখনোবা কেবলই আনন্দের জন্য।
জ্যামিতি আর পাটিগণিতের বিকাশ শুরু হয়েছিল আমাদের পর্যবেক্ষণ করার সক্ষমতা থেকে। একইসঙ্গে বৃত্ত, ত্রিভুজ, সরলরেখা কিংবা বক্ররেখার মত বিভিন্ন ধরনের আকারের মধ্যে পার্থক্য বের করতে পারার দক্ষতা থেকেও গণিতের বিকাশ শুরু।
আরো পড়ুন: কারাকুরি: কেমন ছিল ২৫০ বছর আগের জাপানি রোবট কালচার
প্রথম দিকে আমরা ১, ২, ৩…. এমন স্বাভাবিক সংখ্যা ব্যবহার করে গণনা করতাম। পরবর্তীতে আমরা ঋণাত্মক পূর্ণসংখ্যা, মূলদ ও অমূলদ সংখ্যা ও জটিল সংখ্যার মত আরো অনেক ধারণা উদ্ভাবন করি।
গণিতে এসব সংযোজন আমাদের প্রয়োজন মেটাতেই তৈরি করা হয়েছে। এমন না যে, প্রকৃতিতে এদের অস্তিত্ব আমরা দেখেছি।
ধরা যাক থার্মোমিটারে তাপমাত্রা ০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমেছে। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা বা আবহাওয়ার অবস্থা বোঝাতে আমাদেরকে শূন্যের চেয়ে কম কোনো সংখ্যা বোঝানোর পদ্ধতি বের করতে হয়েছে। ফলে এ ধরনের কাজে আমরা ঋণাত্মক পূর্ণসংখ্যা ব্যবহার করি এবং -১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা -২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লিখি।
এভাবে আমরা চারপাশে যা কিছু দেখি, তা দিয়েই নতুন কিছু উদ্ভাবন করার চেষ্টা করি। এই যুক্তিতে যদি বলা হয় গণিতের জন্ম আমাদের মানসিক ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা ভুল বলা হবে না।
শেষ কথা
গণিতকে যারা আবিষ্কার বলে মনে করেন আর যারা উদ্ভাবন বলে মনে করেন, তাদের মধ্যে এই বিতর্ক হয়ত কোনোদিনই শেষ হবে না। আসল কথা হল, ২৩০০ বছর ধরে যে সমস্যা মানুষের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই রহস্য সহসা সমাধান হয়ে যাওয়াও সম্ভব না।
কিন্তু গণিত উদ্ভাবন না আবিষ্কার, এ নিয়ে আমাদের বিশ্বাস যাই হোক না কেন, গণিতের তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের বিশ্বাস যেটাই হোক, গণিত বস্তুনিষ্ঠভাবে তার কাজ সঠিকভাবে করে যাবে।