তানাকা হিসাশিগে ছিলেন জাপানের একটি টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। যেই প্রতিষ্ঠান এখন তোশিবা কর্পোরেশন নামে পরিচিত।

জাপানে তার খ্যাতি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত উদ্ভাবক থমাস এডিসনের সম পর্যায়ে। নিউম্যাটিক ফায়ার পাম্প, বাষ্পচালিত যুদ্ধ জাহাজ, দা মিরিয়াদ ইয়ার ঘড়ি—এমন অনেক ইন্টারেস্টিং প্রযুক্তির স্রষ্টা তিনি। কিন্তু তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় উদ্ভাবন হচ্ছে অদ্ভুত এক যান্ত্রিক পুতুল যা তিনি ২০০ বছর আগে তৈরি করেছেন। যেগুলি জাপানের ঐতিহ্যবাহী কারাকুরি পাপেটকে বদলে দিয়েছিল।


রূপেন্দ্র ব্রহ্মভট্ট
ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১


জাপানে কারাকুরি নিংইয়ো বা কারাকুরি পাপেট এক ধরনের যান্ত্রিক পুতুল। রয়েছে ১৭ শতাব্দী থেকে। ইতিহাসবিদরা এই প্রাথমিক পর্যায়ের রোবট পুতুলকে জাপানের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ গণ্য করেন। একই সাথে রোবটের প্রতি জাপানের ভালোবাসার অনুপ্রেরণাও মানেন এই পুতুলগুলিকে।

আরো পড়ুন: টেডি বিয়ার এলো কোথা থেকে?

কারাকুরি নিংইয়োর পেছনের ইতিহাস

তানাকা হিসাশিগে হয়তো সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তির কারাকুরি পাপেট তৈরি করেছিলেন কিন্ত তিনি পৃথিবীর প্রথম কারাকুরি শিল্পী ছিলেন না।

প্রকৃতপক্ষে কারাকুরি নিংইয়োর মতো যন্ত্রের উদ্ভাবনের ইতিহাস শুরু সেই সপ্তম শতাব্দীতে। নিহোন শোকি, ধ্রুপদী জাপানের ইতিহাস নিয়ে দ্বিতীয় প্রাচীনতম এই বইয়ে একটি স্বয়ংক্রিয় কাঠামোর কথা বলা হয়েছিল। যাকে বলা হতো দক্ষিণমুখী রথ (প্রাচীন এক ধরনের চাকার যানবাহন যা পুতুলের মতো পয়েন্টারের সাহায্যে চালানো যেত)। এর মেকানিজম ছিল অনেকটা হিসাশিগের রোবট পুতুলের মত।

বলা হয়, ইউরোপের যান্ত্রিক ঘড়ি আসার পরে জাপানে যান্ত্রিক কারাকুরি পুতুলের বিকাশে গতি আসে। ১৭ শতকের প্রথম দিকেই অনেক শিল্পী কারাকুরি পাপেট তৈরির জন্য ঘড়ির যন্ত্রাংশ ব্যবহার শুরু করেন।  ‘বুটাই কারাকুরি’ ছিল প্রথম কারাকুরি পুতুল, যেটা মঞ্চে দেখানোর জন্য প্রস্তত করা হয়েছিল। এর নির্মাতা ছিলেন ঘড়ি প্রস্ততকারক তাকেদা অমি।

তাকেদা জাপানের প্রথম পাপেট থিয়েটার (তাকেদা-জা) শুরু করেন ১৬৬২ সালের মে মাসে, দোতোনবাড়ি জেলাতে। একই বছর তিনি প্রথম কারাকুরি শো পরিচালনা করেন। ১৭৪০ সালের মধ্যে জাপানের অন্যান্য জায়গায় আরো তাকেদা থিয়েটার চালু হয়। ১৭৪১ সালের মধ্যে এমন সময় আসে যে দর্শকদের ভিড়ের কারণে তোকিও তাকেদা থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ তিন দিনের জন্য থিয়েটার বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়।

এর আগে কারাকুরি শিল্প কেবল জাপানের ধনী ও ক্ষমতাবান শ্রেণির জন্য উন্মুক্ত ছিল (সেসময়ের সামন্ত প্রভুদের বলা হতো ‘দাইনমো’)। তবে তোকুগাওয়া অথবা এদো আমলে ( ১৬০৩ সালের তোকুগাওয়া শোগুনাতে থেকে ১৮৬৮ সালেই মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত) কারাকুরি উপস্থাপনা ও এর নির্মাণ জাপানে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তখন এই যান্ত্রিক পুতুলগুলি মানুষকে আনন্দ দেয়ার জন্য কেবল তাকেদা স্টাইল পাপেট থিয়েটারের ব্যবহার করা হতো না, শিল্পীরা বিভিন্ন উৎসব, কার্নিভালময় রাস্তায়ও পারফর্ম করতেন।

তানাকা হিসাশিগের রোবট পুতুল যেভাবে ব্যতিক্রম ছিল

১৮২০ সালের দিকে তানাকা যে কারাকুরি পুতুল তৈরি করেন তার পক্ষে জটিল শারীরিক চলাচল ও কাজ করা সম্ভব ছিল। তার রোবট পুতুলগুলি চোখ, হাত ও মুখের নড়াচড়ার মাধ্যমে অঙ্গভঙ্গি ও অভিব্যক্তি দেখাতে পারতো, যেগুলি আগের পুতুলে ছিল না।

তানাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় পুতুল ছিল তীর ছুঁড়তে পারা বালক ইউমি-হিকি-দোজি এবং চিঠি লিখতে পারা পুতুল মজি কাকি। তাদের অসাধারণ যান্ত্রিক ক্ষমতার জন্য এগুলিকে কারাকুরি মাস্টারপিসও বলা হয়। তানাকার তীর ছুঁড়তে পারা পাপেট স্টেপ বাই স্টেপ ধনুর্বিদ্যার অনুশীলন দেখাতে পারতো। একে যান্ত্রিকভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছিল কিছু শট মিস করতে। যখন সে মুখের বিভিন্ন অভিব্যক্তি দেখাতো।

অন্যদিকে চিঠি লিখতে পারা পুতুলটি অসাধারণ হাতের লেখা দিয়ে কাগজে চিঠি লিখতে পারত। এটা বেশ অবাক করার মতো বিষয় ছিল। কারণ এখনও সুন্দর হাতের লেখা কপি করার জন্য আধুনিক রোবটের উচ্চ প্রযুক্তির মেশিন লার্নিং প্র্যাকটিসের প্রয়োজন হয়।

কারাকুরি পাপেট
কারাকুরি পাপেট (১৬০৩-১৮৬৪)

হিগাশিনো সুসুমু, জাপান কারাকুরি অটোমেশন সোসাইটির একজন কারাকুরি বিশেষজ্ঞ আধুনিক প্রযুক্তির রোবটের সাথে কারাকুরির সম্পর্ক টেনে বলেন, “জাপানের রোবট প্রযুক্তি এখন সবচেয়ে উঁচু মানের। আসলে এর সূচনা হয়েছে সেই এদো আমলের উদ্ভাবক ও শিল্পীদের হাতে। আশা করি পৃথিবীর সব জায়গার মানুষ এই প্রাচীন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবে।”

অন্য যেকোনো কারাকুরি পাপেটের চেয়ে তানাকার রোবট পুতুল আধুনিক সময়ের রোবটের সাথে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। কারণ সেগুলি ছিল ১০০% যান্ত্রিক। এর ভেতরের মেকানিজম তৈরি করতে ব্যবহার করা হতো তার, পুলি, লিভার, ক্যাম, চাকা, নিউম্যাটিক্স ও হাইড্রোলিক্স।

আরো পড়ুন: মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ও ২ ফুট মিথ্যাচার

তানাকাকে যান্ত্রিক বিশ্বের জিনিয়াস হিসেবে সন্মান জানানো হত। কচ্ছপের খোল দিয়ে শিল্প নির্মাণকারী পিতার বড় সন্তান তানাকা, ২০ বছর বয়সে স্বয়ংক্রিয় পুতুল বানানো শুরু করেন এবং ২১ বছর বয়সের মধ্যে তিনি অসাধারণ সব কারাকুরি পারফরমেন্স করেন জাপানের বিভিন্ন জায়গায়।

তানাকা হিসাশিগে ও তার কারাকুরি রোবট পুতুল বিষয়ে কয়েকটা ইন্টারেস্টিং তথ্য

কারাকুরি পুতুল নির্মাণ শৈলী জাপানের সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করে। এখানে কারাকুরি রোবট পুতুল এবং তানাকা হিশাশাগের ব্যাপারে কয়েকটি কম প্রচলিত তথ্য দেয়া হল:

  •  কারাকুরি পুতুলকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: বুটা কারাকুরি (থিয়েটার পারফর্মিং পুতুল), দাশি কারাকুরি (জাপানের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসবের সময় ঐতিহ্যবাহী রূপকথা ও লোককথা নিয়ে পার্ফরমেন্স করা বড় যান্ত্রিক পুতুল), এবং জাশিকি কারাকুরি (গৃহস্থালি পুতুল, যেগুলিকে বিলাসী সামগ্রী হিসেবে বা ঘরে পার্টির সময় ব্যবহার করার হয়, এরা ঘরের বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে পারে। যেমন নাচা, হাঁটা, চা দেয়া, ড্রাম বাজানো ইত্যাদি। এগুলি বেশ দামি।)
  • হিসাশিগে তানাকার নিজের হাতে তৈরি করা কিছু কারাকুরি (এর মধ্যে আছে তীর ছুঁড়তে পারা বালক, ইউমি-হিকি দোজি) বর্তমানে কানাগাওয়ার, জাপানের তোশিবা বিজ্ঞান জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতার কক্ষে প্রদর্শিত হচ্ছে।
  • তানাকা কারাকুরি পুতুল নির্মাণের ব্যাপারে এতটাই আবেগপ্রবণ ছিলেন যে তিনি তার পরিবারের ব্যবসার দায়িত্ব নিতে চাননি, বরং পুরো দায়িত্ব তার ছোট ভাইকে দিয়ে দেন। বিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়স কাটিয়েছেন কারাকুরি পুতুল বানাতে, জ্যোতির্বিদা ও পশ্চিমা প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে। যাইহোক, জীবনের পরের ভাগে তানাকা উপলব্ধি করেন তার উচিত অন্যান্য কাজে লাগে এমন যন্ত্র উদ্ভাবন করা। তখন তিনি তার মনোযোগ যান্ত্রিক পুতুলের বদলে হাইড্রোলিক এবং নিউম্যাটিক নিয়ে কাজ করে এমন যন্ত্রে দেয়া শুরু করেন। তিনি বাষ্পচালিত ইঞ্জিন, রিভার্বেরাটরি ফার্নেস, টেলিগ্রাফ নিয়ে আরও গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। ১৮৭৩ সালে তিনি তানাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠা করেন, যখন তার বয়স হয়েছে ৭৪। তার মৃত্যুর পর কোম্পানির নাম বদল করে রাখা হয় শিবাউরা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস এবং ১৯৩৯ সালে তোকিও দেনকির সাথে একীভূত হওয়ার পর এর নাম হয় তোশিবা কর্পোরেশন।
  • ২০১৩ সালে জাপানের সবচেয়ে বড় বুলেটিন বোর্ড 2channel-এ তানাকার তৈরি তীর ছোঁড়া বালক নিয়ে ফিচার করা হয়।
  • দানগায়েরি নিংইয়ো ও শিনাতামা নিংইয়ো এদো আমলের দুটি জনপ্রিয় কারাকুরি পুতুল। বিশেষজ্ঞদের জানান, প্রথম পুতুলটি পেছনের হাতে ডিগবাজি খেতে খেতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে পারতো আর অন্য পুতুলটি জাদু দেখাতে পারতো।
কারাকুরি পাপেট
এদো আমলের জনপ্রিয় কারাকুরি পাপেট। বামে দানগায়েরি নিংইয়ো, বামে শিনাতামা নিংইয়ো।

তানাকা হিসাশাগের রোবট পুতুলগুলিকে আদিম আমলের রোবট বলে মনে হতে পারে, কিন্ত ইতিহাসবিদরা এদের সাথে জাপানের রোবট সংস্কৃতির একটা যোগাযোগ খুঁজে পান। তারা অভিমত দেন আগের কারাকুরি পুতুল নির্মাণ থেকেই জাপানের রোবট প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও রোবটের প্রতি জাপানের ভালোবাসার সূত্রপাত।

যদিও মেইজি পুনরুত্থানের (১৮৬৮) সময় জাপানে রোবট পুতুলের প্রতি আগ্রহ অনেকটা ফিকে হয়ে আসে, কিন্ত বর্তমান সময়ে আবার কারাকুরি পুতুলের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ দেখা দিচ্ছে। কারাকুরি পুতুলের গল্পগুলি নতুন প্রজন্মের কাছে রোবটিক্স নিয়ে আগ্রহ তৈরি করতে সাহায্য করছে।

অনুবাদ: আমিন আল রাজী