আপনি কি কখনো গুগলে বিষণ্ণতা থেকে বের হয়ে আসার উপায় খুঁজেছেন? খুঁজে থাকলে ‘ফেসিয়াল ফিডব্যাক হাইপোথিসিস’ এর কথা হয়ত আপনি জেনে থাকবেন।

শুনলে পরস্পরবিরোধী মনে হলেও এই হাইপোথিসিসে বলা হয়, বেশি হাসার মাধ্যমে আপনি সুখী হতে পারবেন। অন্যভাবে বলতে গেলে, এই হাসি কেবল চেহারার অভিব্যক্তিতে পরিবর্তন আনে না, কখনো কখনো আমাদের অনুভূতিকেও প্রভাবিত করে।

বেশি হাসার মাধ্যমে আপনি সুখী হতে পারবেন। অন্যভাবে বলতে গেলে, এই হাসি কেবল চেহারার অভিব্যক্তিতে পরিবর্তন আনে না, কখনো কখনো আমাদের অনুভূতিকেও প্রভাবিত করে। 

ফেসিয়াল ফিডব্যাক হাইপোথিসিস

সাধারণভাবে আমরা বিশ্বাস করি, অনুভূতি আমাদের চেহারার অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। যখন আমরা খুশী থাকি, তখন হাসি। যখন কষ্টে থাকি বা আমাদের মন খারাপ থাকে তখন আমাদের মুখও গোমড়া থাকে। যখন বিরক্ত থাকি, আমাদের চেহারায়ও বিরক্তির ভাব থাকে।

হতাশা, বিষণ্নতা বা দুঃখ-বেদনা থেকে বের হয়ে আসার উপায় খুঁজছেন?—জোর করে হাসুন!
আপনার যদি মন খারাপ থাকে, তখন যদি জোর করে হাসেন সেটা কিছুটা হলেও আপনার মন খারাপ কমাতে সাহায্য করবে

তবে ফেসিয়াল ফিডব্যাক হাইপোথিসিসে আমাদের এই বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এই হাইপোথিসিস বা বৈজ্ঞানিক অনুমানে দাবি করা হয় আমাদের চেহারার অভিব্যক্তির কারণেও আমাদের অনুভূতি পরিবর্তিত হয়। তার মানে আপনার যদি মন খারাপ থাকে, তখন যদি জোর করে হাসেন সেটা কিছুটা হলেও আপনার মন খারাপ কমাতে সাহায্য করবে। তাই হতাশা, বিষণ্নতা বা দুঃখ-বেদনা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে জোর করে হাসুন!

আমরা এ বিষয়ে যেভাবে জানলাম

১৯৮৮ সালে মনোবিজ্ঞানী ফ্রিটজ স্ট্র্যাক ও তার সহকর্মীরা ফেসিয়াল ফিডব্যাক হাইপোথিসিস পরীক্ষা করার জন্য একটি গবেষণা করেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের কয়েকটি কার্টুন দেখিয়ে বলা হয়, কার্টুনগুলি কতটুকু মজার সেটার ভিত্তিতে র‍্যাংক করার জন্য। তবে এই সময় অংশগ্রহণকারীদের মুখে কলম ধরে রাখতে হয়। এক দল অংশগ্রহণকারী দাঁতের মধ্যে কলম ধরে রাখে, অন্য দল ঠোঁটের মধ্যে কলম চেপে রাখে। মুখে কলম ধরে রাখার কারণে তাদের চেহারার অভিব্যক্তি বদলে যায়। ঠোঁটে কলম ধরা দলের চেহারায় নিরপেক্ষ বা ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি চলে আসে। আর যাদের দাঁতের মাঝখানে কলম ছিল, তাদের চেহারায় হাসি হাসি ভাব তৈরি হয়।

গবেষণাতে দেখা যায়, যাদের দাঁতের মাঝখানে কলম ধরা ছিল অর্থাৎ মুখে হাসি হাসি ভাব ছিল তাদের কাছে কার্টুনগুলি বেশি মজার বলে মনে হয়েছিল। সেই তুলনায় যাদের মুখের অভিব্যক্তি নিরপেক্ষ ছিল তাদের কাছে কার্টুনগুলি কম মজার মনে হয়। এই হাইপোথিসিস এর পক্ষে ২০১০ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানীরা আরো কিছু প্রমাণ দেখান।

আরো পড়ুন: বড় আকারের ছবি বা ভিডিও কি বেশি মনে থাকে?

গবেষকরা এখানে নতুন ধরনের টেকনিক গ্রহণ করেন। তারা মুখের পেশিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে কলমের বদলে বোটক্স ইঞ্জেকশন ব্যবহার করেন। ইঞ্জেকশন দেয়ার আগে অংশগ্রহণকারীদের কয়েকটি ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভিডিও দেখানো হয়। এরপর অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় এই ভিডিওগুলি দেখে তাদের কেমন অনুভূতি হয়েছে সেটা র‍্যাংক করতে।

ভিডিও র‍্যাংক করার পর একটি গ্রুপকে বোটক্স ইঞ্জেকশন দেয়া হয়, ফলে তাদের মুখের পেশী অবশ হয়ে যায় এবং মুখের নড়াচড়া কমে যায়। অন্য গ্রুপকে (কন্ট্রোল গ্রুপ) দেয়া হয় রেস্টাইলেন (Restylane) নামের একটি ঔষুধ। এই ঔষুধ কেবল মুখের বলিরেখার ওপর কাজ করে এবং মুখের পেশির নাড়াচাড়ার ওপর এর কোনো প্রভাব পড়ে না।

ইঞ্জেকশন দেয়ার ১৪ থেকে ২৪ দিনের মধ্যে প্রতিযোগীদের আরো কিছু ভিডিও দেখানো হয়। তবে এবারের ভিডিওগুলি ভিন্ন ছিল। ভিডিও দেখানোর পর অংশগ্রহণকারীদের আবার জিজ্ঞাসা করা হয় ভিডিওগুলি র‍্যাংক করার জন্য। দেখা যায় যে গ্রুপকে বোটক্স ইঞ্জেকশন দেয়া হয় তারা দাবি করছে ভিডিওগুলি তাদের আগের মত আলোড়িত করতে পারে নি। অন্যভাবে বলা যায়, নেতিবাচক ভিডিও দেখার পর অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যেমন নেতিবাচক অনুভূতি কম হয়েছিল, তেমনি ইতিবাচক ভিডিও দেখার পর তাদের মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতিও কম দেখা যায়।

২০১৬ সালে সাইকোলজিক্যাল বুলেটিন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাতে ফেসিয়াল ফিডব্যাক হাইপোথিসিস এর ওপর ১৩৮টি স্টাডি করা হয়। এই গবেষণায়ও একমত পোষণ করে বলা হয়, মুখের অভিব্যক্তি আমাদের অনুভূতিকে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি করেও।

গবেষকরা সিদ্ধান্তে আসেন, আমরা যদি আমাদের মুখে ইতিবাচক অভিব্যক্তি দেখাতে পারি, তখন মনেও ইতিবাচক অনুভূতির তৈরি হয়।

তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, ফেসিয়াল ফিডব্যাক হাইপোথিসিস এর বিষয়টি একাধিক গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত।

কেন এই হাইপোথিসিস কাজ করে

ফেসিয়াল ফিডব্যাক হাইপোথিসিস কাজ করে ফিডব্যাক লুপের মাধ্যমে। আমরা যখন হাসি তখন সেটা আমাদের মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতি সঞ্চার করে। ইতিবাচক অনুভূতির কারণে তখন আমাদের মন আরো প্রফুল্ল হয়।

হাইপোথিসিসটির ব্যাখ্যায় বলা হয়, হাসির সময় আমাদের মস্তিষ্ক এন্ডরফিন নামের নিউরোপেপটাইড নিঃসরণ করে। এন্ডরফিনের কারণে আমাদের মধ্যে সুখের, এমনকি উল্লাসের অনুভূতি তৈরি হয়। এন্ডরফিন আমাদের মানসিক চাপ বা বিষণ্নতা এবং দুঃখ-বেদনা ও ব্যথা দূর করতে ভূমিকা রাখে। ফলে আমাদের মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয়।

হাসলে আমাদের ভাল লাগার আরেকটি কারণ হল, হাসি ডোপামিন নামে একটি হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে। ডোপামিন আমাদের ভেতরে প্রাপ্তি ও উদ্দীপনার আনন্দ তৈরি করে। এর ফলে মনেও ইতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয়।

একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, হাসির সাথে এন্ডরফিন ও ডোপামিনের সম্পর্ক বেশ জটিল গবেষণায় বিষয়। এখনও এদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভাবে জানা যায়নি। অর্থাৎ কীভাবে এরা কাজ করে বা হাসি কীভাবে এন্ডরফিন ও ডোপামিনকে প্রভাবিত করে, ব্যক্তিভেদে কীভাবে এই হরমোনগুলির মাত্রা ভিন্ন হয়—এ সকল বিষয় জানতে আরো গবেষণার প্রয়োজন।

এমন কাজে ব্যস্ত থাকুন যা আপনার মনের নেতিবাচক ভাবনা দূর করে দিবে

মাইন্ডফুলনেস এর জনক হিসেবে অভিহিত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী থিক নাট হান বলেন, “কখনো কখনো আপনার হাসিই আপনার আনন্দের উৎস হতে পারে।”

ফেসিয়াল ফিডব্যাক হাইপোথিসিস পরীক্ষা করার বেশ কয়েকটি উপায় আছে। এর একটি উপায় হচ্ছে আপনার মনে যে অনুভূতি হচ্ছে একদম সেটার বিপরীত কোনো কাজ করা। যেমন আপনার মন ভাল হবে এমন প্রিয় গান শোনা অথবা পছন্দের কোনো কমেডি শো দেখলে তা আপনাকে কিছু সময়ের জন্য আনন্দ দিতে পারে। এই কাজগুলি হয়ত খুবই সাধারণ মনে হতে পারে, তবে এর মাধ্যমে মস্তিষ্কে সিগন্যাল চলে যায়। যা আমাদের মানসিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন করে।

আপনি যখন প্রিয় কোনো গান শোনেন বা প্রিয় কোনো কমেডি শো দেখেন, তখন আপনার মস্তিষ্ক এমন সংকেত পায় যে, হয়ত যা কিছু হচ্ছে তা অতটা খারাপ না। কারণ সেই সময় আপনার মন শান্ত থাকে এবং মুখে হাসি থাকে। হাসির কারণে আপনার মানসিক অনুভূতির পরিবর্তন আসে এবং মনে ইতিবাচক ভাবনা তৈরি হওয়ার একটা সুযোগ হয়।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না মানুষের অনুভূতি বেশ জটিল একটা বিষয়। আপনার মনের মধ্যে যে দুঃখ-বেদনা কেবল হাসিতে তা হয়ত দূর হয়ে যাবে না। আমাদের মনের অনুভূতি অনেক ধরনের বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। তাই জরুরী হচ্ছে মানসিক কোনো সমস্যা থাকলে তা অনুধাবন করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

মুখে হাসি নিয়ে আপনি মন খারাপ বা মানসিক যন্ত্রণা আড়াল করতে পারবেন কিন্তু তা আপনার জন্য দীর্ঘমেয়াদে উপকারী হবে না। তবে সাময়িক সমাধান হিসেবে এবং মানসিক স্থিরতা স্বাভাবিক রাখতে কিছু সময়ের জন্য অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ভার নিজের অভিব্যক্তির ওপর ছেড়ে দেয়াই যায়।

সূত্র: সায়েন্স এবিসি । অনুবাদ: আমিন আল রাজী