মস্কোতে দাবা প্রতিযোগিতায় একটি দাবারু রোবট অংশ নিচ্ছিল। সাত বছর বয়সী এক দাবারুর সাথে ম্যাচ চলাকালে, সে শিশুটির আঙুল ভেঙে দিয়েছে। কারণ, শিশুটি চাল দেয়ার ব্যাপারে খুব তাড়াহুড়া করছিল; একবার নিজের চালের পরে, রোবটকে চাল দেয়ার সময় না দিয়ে সে বোর্ডে হাত রাখলে, রোবট শিশুটির আঙুল চেপে ধরে, এতে আঙুল ভেঙে যায়।

আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) কতোদূর এগিয়েছে, এবং কতোদূর যেতে পারে, তা নিয়ে সাধারণ্যে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। এখন যা আলোচিত হচ্ছে তা হলো, এআই-এর সংবেদন।

আমরা জানি বা না জানি, বুঝি বা না বুঝি, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যুগে, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যার মূল বাহন, সেটাতে প্রবেশ করেছি। প্রাত্যহিক জীবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে আমাদের মিথষ্ক্রিয়া চলছে।

এর আগে আমরা দেখেছি, মানুষ যখনই কোনো কাজের জন্যে যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে সেটা তার নিজের সামর্থকে অতিক্রম করতে পারে এমন কিছুই তৈরি করেছে। চাকা আবিষ্কার করেছিল, নিজের গতিসীমাকে ছাড়িয়ে গেছে। অ্যাবাকাস বা ক্যালকুলেটর যখন বানিয়েছে, গণনার গতিতে সেগুলি মানুষের চেয়ে এগিয়ে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পারফরম্যান্স কেমন? মাথা খারাপ করে দেয়ার মতো! এখন অনেক কাজ হচ্ছে, যেগুলি মানুষের দ্বারা সম্ভব হতো না; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে সম্ভব হচ্ছে। গুগল সার্চ বলুন, আর আমাদের ফেসবুক টাইমলাইন বলুন—এআই-এর খেলা!

এই এআই নিয়ে একটি আলাপ হলো, এটি কি মানুষের উপর নির্ভরশীল থেকে যাবে, নাকি স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারবে; অন্য ভাষায় বললে, এর “স্বাধীন” বিকাশ কি সম্ভব হবে? অল্প কিছুদিন আগেও এই নিয়ে পপুলার ফ্রন্টে ডিবেট হতে দেখা গেছে; এখন কিন্তু কেমন যেন, সেই সব বিতর্ক আর হয় না।

এখন যেহেতু শুধুমাত্র মানুষের লেখা কোডই শেষ কথা নয়, “মেশিন” চালিয়ে দেয়ার পর, মেশিন “অভিজ্ঞতা” অর্জন করে, এবং সেই অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের কাজ কীভাবে করা বেটার, সেই নির্দেশনার কোড নিজেই এডিট করে; তা হলে, তাদের স্বাধীনতার সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় কোথায়? বিবর্তন ও বিকাশের অপেক্ষা ছাড়া?

রাশিয়ার ঘটনায়, অনেকে এই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যে, দাবারু রোবটটি শিশুটিকে নিবৃত্ত করতে নয়, তার আঙুলকে দাবার গুটি মনে করেছিল।

হতে পারে। তবে, খেলা কোন পর্যায়ে ছিল, ওই সময়ে শিশুটির হাত যেখানে ছিল, সেখানে কোনো গুটি ছিল কিনা, যেটি দাবারু রোবটের চাল দেয়ার মতো—এই ব্যাখ্যাটি পেলে ভাল হত।

তবে, গুগলে যা ঘটে গেছে, তা ভাববার মতো ব্যাপার।

গুগলের সাম্প্রতিক বিস্ময় হলো ল্যামডা [The Language Model for Dialogue Applications (LaMDa)]। এটি মানুষের সাথে যেরকম সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে, তা অনেক কাজের ক্ষেত্রেই বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবে।

গত মাসে গুগলের এক ইঞ্জিনিয়ার পাবলিকলি বলেছেন, ল্যামডার “অনুভূতি আছে।” গুগল সেটা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়ে শক্তভাবে অস্বীকার করেছে, সেই ইঞ্জিনিয়ারকে সাথে সাথে পেইড লিভে পাঠিয়েছিল (পড়ুন, গুগলের কার্যক্রম থেকে, সাথে সাথে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল)। গত দুয়েক দিন আগে, তাকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

আগে, এআই নিয়ে কেউ একটু এগুলেই, বেশ খুশি মনে তা জানান দিত। এখন বড় কর্পোরেটগুলি, বড় টাকার থলে নিয়ে, এআই নিয়ে মেতেছে; কিন্তু তারা তাদের অগ্রগতি যেন জানাতে চায় না; কেমন যেন “ঢাক ঢাক গুড় গুড়” ভাব।

এই ব্যাপারটি সন্দেহের জন্ম দেয়।

গুগল যেহেতু বলছে, ল্যামডার অনুভূতি থাকার কথা সত্য নয়, এবং যিনি মুখ খুলেছিলেন তাকে সাথে সাথে গুগলের কার্যক্রম থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে ফলে তা আসলেই আছে কি নাই, সেটা আর জানা হচ্ছে না, আপাতত।

ওই ইঞ্জিনিয়ার যা বলেছিলেন, তা এখন যাচাই করার সুযোগ আর নাই। তবে, যা বলেছিলেন তা চমকপ্রদ। উনি বলেছিলেন তার সাথে কথোপকথনে ল্যামডা “অহংকার” দেখিয়েছে। হ্যাঁ, অহংকার—আমি জানি, তুমি জানো না!

মেশিন যদি মানুষের মতো আচরণ করে, তবে অবাক হতে নিষেধ করেন, ওস্তাদরা। তারা বলেন, মানুষের মনন সমাজের দান। তেমনি মেশিনের মনন, মানুষেরই দান। শুরুতে কোড লিখেছে কোনো মানুষ, সেটা যদি এডিট করে করে মেশিন নিজে এগিয়ে যায়ও, কোর (মূল ভাব) তো সহজে বদলানোর প্রয়োজন বোধ করবে না। বা যদি করেও, এর রেশ তো রয়ে যাবে!

তো ভাবুন, মানুষের চেয়ে অঙ্ক কষায় (সিদ্ধান্ত নেয়ায়) অনেকগুণ দ্রুত ও নির্ভুল কোনো সমাজের মুখোমুখি মানব সমাজকে হতে হবে; সেটা কি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হবে? না হওয়ার কোনো কারণ নাই, বলা যেত; কিন্তু মানুষের মধ্যে আইন ভাঙা বা অমান্য করা, ফাঁকি দেয়া, চুরি করা—এমন আচরণ আছে; মেশিনকে তো এমন করা শেখানোর কোড লিখে চালু করা হয় না। মেশিন যদি এসবের মুখোমুখি হয়ে, মানুষকে শাস্তি দিতে শুরু করে?

যেহেতু অন্যায়ের শাস্তি হচ্ছে, সেহেতু মানুষের তো মাইন্ড করার কিছু নাই। কিন্তু, মানুষের মধ্যে স্বাজাত্যবোধ জেগে ওঠে কি, অন্যায় করা সত্ত্বেও, জাতভাইকে রোবটের হাতে শাস্তি পেতে দেখতে খারাপ লাগবে?

সেটা যদিও, ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন।

কিন্তু বেশি ভাবনার বিষয়, দানবাকৃতির কর্পোরেটগুলি! এত টাকা এআই গবেষণায় বিনিয়োগ করছে, নিশ্চয় কোনো মতলবে। এত গোপন করার চেষ্টা তো সন্দেহজনক। কবে তাদের খাঁচা থেকে বের হয়ে, এআই জনপদে এসে ত্রিভঙ্গ মুরারি রূপ দেখাবে, তখন কী হবে রে…!

হ্যাঁ, মানুষকেই আসল ভয়, শেষ পর্যন্ত!