দেশ যত ধনী হয়, খাদ্য অপচয় করার পরিমাণও তত বাড়ে। সম্পদের দিক থেকে ধনী ও গরীব দেশের তুলনা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের অত্যধিক খাদ্য অপচয়ের চিত্রটা স্পষ্ট হয়। এই দেশের মানুষেরা জনপ্রতি প্রতিদিন ৫০৩ গ্রাম করে খাদ্য অপচয় করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯০০ মিলিয়ন একর কৃষিজমি আছে। এসব জমি ২ মিলিয়নেরও বেশি খামারের অধীনে। শতকরা হিসাবে এই জমির পরিমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের মোট ভূমির প্রায় ৪০%।
এই কৃষি জমির বেশিরভাগই ব্যবহার হয় গবাদি পশু পালন, ভুট্টা ও সয়াবিন চাষে। তবে এর সবটা সরাসরি মানুষের খাওয়ার জন্য খাদ্যশস্য বা খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় না। বরং এসব জমির একটা বড় অংশ চলে যায় গবাদি পশুর জন্য খাদ্য উৎপাদনের পেছনে। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি শিল্প থেকে বাড়তি সুবিধা গ্রহণ করে গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণীর খামার। ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি, খাদ্য উৎপাদন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্প (যেমন খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করা এবং খুচরা বিক্রয়) থেকেই দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১.০৫৫ ট্রিলিয়ন ডলার এসেছে। এই পরিমাণ অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের মোট জিডিপির ৫%।
গ্যাব্রিয়েল সলসবেরি
স্ট্যাকার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২
অনুবাদ: ফারহান মাসউদ
অপচয় করা খাদ্যের ফলে পরিবেশের ওপর কেমন প্রভাব পড়ে, সে ব্যাপারে ‘ওহমকানেক্ট’ (OhmConnect) নামের একটি প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করেছে। সেজন্য তারা নির্ভর করেছে ২০২১ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা ‘এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি’ (ইপিএ) প্রকাশিত একটি রিপোর্টের ওপর। যার নাম ‘ফ্রম ফার্ম টু কিচেন: দ্য এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্টস অব ইউএস ফুড ওয়েস্ট’।
প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর উৎপাদিত খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ খাওয়াই হয় না। সেসব খাদ্য বর্জ্য হয়ে যায়। এর অর্থ হল, এই পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন করতে যত কিছুর প্রয়োজন হয়েছে, নষ্ট হয়েছে তার সবই। এর মধ্যে ধরা যেতে পারে পানি, কীটনাশক, পণ্য পরিবহণ আর সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত ডিজেল বা গ্যাস এবং খাবার হিমায়িত রাখার জন্য বিদ্যুৎশক্তির মতো অনেক কিছু।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি’র তথ্য অনুসারে, দেশটি প্রতিবছর ১৬১ থেকে ৩৩৫ বিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত খাদ্য অপচয় করে। অর্থাৎ গড়ে দেশটির একজন সাধারণ মানুষ প্রতি বছর অপচয় করে ৪৯২ থেকে ১,০৩২ পাউন্ডের সমান খাদ্য। বিষয়টা আরো বোধগম্য করার জন্য ক্যালোরির হিসাবে বর্ণনা করা যায়। কারণ অনেকেই কতটুকু ক্যালোরি গ্রহণ বা খরচ হলো, নিয়মিত সেই হিসাব রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী একজন মানুষ প্রতিদিন ১,৫২০ ক্যালোরির সমান খাবার নষ্ট করে। অথচ প্রতিদিন নষ্ট হওয়া এই পরিমাণ খাবার ১৫০ মিলিয়ন মানুষ খেতে পারতো।
আরো পড়ুন: মাইকেল পোলান এর ‘ইন ডিফেন্স অফ ফুড’ থেকে
গত এক দশকে জনপ্রতি খাদ্য নষ্ট ও অপচয়ের পরিমাণ বেড়েছে, এবং ১৯৬০ সালের তুলনায় এই হার বেড়েছে ৩ গুণ। সব ধরনের খাবারের মধ্যে ফল ও শাকসবজি সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয়। আর অপচয় হওয়া খাদ্যের বেশিরভাগই নষ্ট হয় ভোক্তা পর্যায়ে, অর্থাৎ বাসাবাড়িতে বা রেস্তোরাঁয়।
ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর পরই বেশিরভাগ খাবার নষ্ট হয়
সব ধরনের খাবারই সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় ভোক্তা পর্যায়ে যাওয়ার পর। অর্থাৎ বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ এবং ফুড সার্ভিস নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানেই এই অপচয় বেশি হয়। যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্যের অপচয় অর্ধেকে নামিয়ে আনলে পরিবেশের কেমন উপকার হবে, তা নিয়ে ২০২০ সালে একটি গবেষণা করা হয়েছিল। সেখানে দেখা গেছে, বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করার সময় অপচয় কমালেই পরিবেশের ওপর সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক ফুড সার্ভিস বা খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে অপচয় কমালে পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়বে কম।
‘ওহায়ো স্টেট ফুড ওয়েস্ট কোলাবোরেটিভ’ নামে একটি সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক ব্রায়ান রো। তার মতে, একটি সাধারণ আমেরিকান পরিবার প্রতি বছর হাজার হাজার ডলারের খাবার ডাস্টবিনে ফেলে দিতে পারে।
আরো পড়ুন: ভার্টিকাল ফার্মিং: যে ১৩ উদ্ভাবন বদলে দেবে কৃষির ভবিষ্যৎ
২০২০ সালে ‘আমেরিকান জার্নাল অফ এগ্রিকালচারাল ইকোনমিকস’-এ একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেই গবেষণা অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের বাসাবাড়িতে ২৪০ বিলিয়ন ডলারের খাদ্য অপচয় হয়। অর্থাৎ প্রতি পরিবার গড়ে ১,৮৬৬ ডলারের খাদ্য নষ্ট করে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারির ফলাফলের সাথে তুলনা করলে এই টাকার অংক আরো বাড়বে।
প্রতি বছর নষ্ট হওয়া খাদ্যের ফলে দেশটির একজন মানুষ পরিবেশে যে প্রভাব ফেলে:
- কৃষি জমি নষ্ট হয়: ১৯,০০০ বর্গফুট
- পানি: ১৯,০০০ গ্যালন
- কীটনাশক: ২.৫ পাউন্ড
- সার: ৪৪.৫ পাউন্ড
- শক্তি: ২,১৪০ কিলোওয়াট-ঘণ্টা
- গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন: ১,১৯০ পাউন্ড কার্বন ডাই অক্সাইড
অর্থাৎ কতটুকু খাবার আবর্জনায় পরিণত হলো, শুধুমাত্র তা দিয়ে খাদ্য অপচয়ের সমস্যাটা বোঝা যাবে না। বরং একটা আলু, কলা বা পেঁয়াজ উৎপাদন করতে গিয়ে যা কিছু খরচ হয়, তার সবকিছুই হিসাবের মধ্যে ধরতে হবে। এরমধ্যে পানি, জমি, কীটনাশক, সার ও শক্তির মতো অনেক কিছুই থাকতে পারে।
খাদ্য অপচয় ও নষ্ট হওয়ার ফলে পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়ে, সেটা নির্ণয়ের জন্য গবেষকরা বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করেন। যেমন, কতটা খাদ্য নষ্ট হয়েছে, খাবারের ধরন কেমন এবং সাপ্লাই চেইনের কোথায় এসব খাদ্য অপচয় হয়েছে, এসব বিষয়। সাপ্লাই চেইনের যতদূর পর্যন্ত গিয়ে খাদ্য নষ্ট হবে, পরিবেশের ওপর তত বেশি প্রভাব পড়বে। কারণ সাপ্লাই চেইনের প্রতিটি পর্যায়েই খাদ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাত করার পেছনে নতুন করে রিসোর্স যোগ হতে থাকে।
সবকিছু হিসাবের মধ্যে আনলে প্রতিবছর একজন মানুষের নষ্ট করা খাদ্যের কারণে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়, সেটা সাধারণ যাত্রীবাহী একটা গাড়ি ১,৩৩৬ মাইল চালালে যতটুকু গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়, তার সমান। আর বছরে একজন মানুষ যতটা পানি নষ্ট করে, তা দিয়ে আমেরিকার সাধারণ একটা পরিবার ৬৩ দিন চলতে পারবে।
সাপ্লাই চেইনের বিভিন্ন অংশ নষ্ট হওয়া ৯০% খাদ্যই খাওয়ার উপযোগী
নষ্ট হওয়া খাবারের ৯০ শতাংশই ভোজ্য। বাকি ১০% হলো হাড় ও খোসার মতো, যা খাওয়া যায় না। বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায়, প্রতিদিন ১,১০০ থেকে ১,৫২০ ক্যালোরির মতো খাবার নষ্ট হয়। এই পরিমাণ ক্যালোরি একজন মানুষের দৈনিক চাহিদার বড় একটা অংশ।
বর্জ্য হিসেবে এসব নষ্ট খাবার শেষে আবর্জনাভূমি (আবর্জনা যেখানে স্তূপ করে রাখা হয়) বা বর্জ্যভূমিতে গিয়ে পৌঁছায়। ‘এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি’র রিপোর্ট অনুসারে, পোড়ানোর সময় দেশের বর্জ্যভূমিতে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় খাদ্য বর্জ্য। মূলত দেশটির নগর থেকে বর্জ্যভূমিতে আসা কঠিন বর্জ্যের ২৪% এবং পোড়ানো বর্জ্যের ২২% হলো খাদ্য বর্জ্য।
খাদ্য অপচয়ের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশকে ছাড়িয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের চেয়ে ৩ গুণ বেশি খাদ্য বর্জ্য তৈরি হয় উত্তর আমেরিকায়। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের লোকদের চেয়ে ১০ গুণ বেশি খাদ্য অপচয় করে উত্তর আমেরিকানরা।
সম্পদের দিক থেকে ধনী ও গরীব দেশের তুলনা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের অত্যধিক খাদ্য অপচয়ের চিত্রটা স্পষ্ট হয়। এই দেশের মানুষেরা জনপ্রতি প্রতিদিন ৫০৩ গ্রাম করে খাদ্য অপচয় করে। অন্যান্য উচ্চ-আয়ের দেশগুলির তুলনায় এই পরিমাণ ১৯৬ গ্রাম বেশি। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের দেশগুলির মানুষ জনপ্রতি প্রতিদিন মাত্র ৪৩ গ্রাম খাদ্য অপচয় করে। অর্থাৎ, দেশ যত ধনী হয়, খাদ্য অপচয় করার পরিমাণও তত বাড়ে।
এই প্রজন্মে এসে খাদ্য বর্জ্য উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে শুধুমাত্র চীন ও ভারত। আর জনপ্রতি খাদ্য অপচয়ের সূচকে নিউজিল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড, এই দুটি দেশের পরেই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান।
বিশ্বব্যাপী অপচয় হওয়া খাদ্য ও বর্জ্যের সবচেয়ে বড় অংশ হলো ফল এবং শাকসবজি
আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে নষ্ট হওয়া খাদ্য বর্জ্যের ৮০ শতাংশই ফল ও শাকসবজি। অন্যদিকে এশিয়ার শিল্পোন্নত অঞ্চলে নষ্ট হওয়া খাদ্যের মধ্যে এর পরিমাণ ৬৪%। আর উত্তর আমেরিকা এবং ওশেনিয়ায় নষ্ট হওয়া খাবারের মধ্যে ফল এবং শাকসবজিই অর্ধেক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, পৃথিবীতে উৎপাদিত সব ফল ও সবজির ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বর্জ্যভূমিতে চলে যায়।
স্বল্প উন্নত অবকাঠামোর দেশগুলিতে খাদ্য অপচয়ের পেছনে বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা হয়। এর মধ্যে একটা হলো খাদ্য উৎপাদনের আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা। এছাড়াও অনুন্নত খাদ্য বিতরণের নেটওয়ার্ক এবং ফসল কাটা ও আনুষাঙ্গিক কাজ পরিচালনায় দুর্বল প্রযুক্তিকেও কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়। বছরে বিলিয়ন ডলারের লোকসান হয় এসব কারণে। তাছাড়া মানুষ দেখতে ‘নিখুঁত’ ফল আর সবজি কিনতে চায়। এ কারণেই অনেক ফসল বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া হয়।
এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি’র মতে, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যের অপচয় ও বর্জ্যের পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারলে সংরক্ষণ করা যাবে প্রচুর পরিমাণ রিসোর্স বা সম্পদ। পাশাপাশি খাদ্য ব্যবস্থার কারণে পরিবেশের ওপর যেসব প্রভাব পড়ে, সেগুলিও কমিয়ে আনা যাবে। দেশটির খাদ্যের অপচয় ও বর্জ্যের পরিমাণ অর্ধেক করতে পারলে কমিয়ে আনা যাবে পরিবেশের ওপর অনেক নেতিবাচক প্রভাব। এর ফলে বাঁচবে ৩.২ ট্রিলিয়ন গ্যালন পানি আর ২৬২ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎশক্তি। এই পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ২১.৫ মিলিয়ন বাড়ির এক বছরের চাহিদা মেটানোর জন্যে যথেষ্ট।