উমবের্তো একো’র উপন্যাস দ্য নেইম অফ দ্য রোজ-এ উল্লিখিত অ্যারিস্টটলের বিষাক্ত বইটির কথা নিশ্চয় অনেকেরই মনে আছে। উপন্যাসটির প্লটের বড় অংশজুড়ে আছে এই বই। এক উন্মাদ বেনেডিকটাইন সন্ন্যাসী অ্যারিস্টটলের বইটির পৃষ্ঠায় বিষ মিশিয়ে রেখেছিলেন। চতুর্দশ শতকের একটি ইতালিয়ান আশ্রমে এই বই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। বইয়ের বিষাক্ত পৃষ্ঠাগুলি উল্টানোর পরে যারাই জিভ দিয়ে আঙুল স্পর্শ করেছেন তারা সবাই একে একে মারা যান।
এরকম কিছু কি বাস্তবে ঘটা সম্ভব? এইভাবে বইয়ের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করা?
সাম্প্রতিক গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে, এরকম ঘটা সম্ভব। ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ডেনমার্ক’র গ্রন্থাগারে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিষয়ের উপর রচিত তিনটি বই পাওয়া গেছে। তিনটি বইয়ের মলাটেই প্রচুর পরিমাণে আর্সেনিক মেশানো আছে। বইগুলি ১৬শ থেকে ১৭শ শতকের দিকে রচিত।
যেখান থেকে শুরু হলো এই গবেষণা
‘The Poison Book Project‘ নামে একটি প্রজেক্টও চালু করা হয়েছে ভিক্টোরিয়ান যুগে ছাপা হওয়া বিষাক্ত বইগুলির ওপর আরো বিশদ গবেষণা ও অনুসন্ধান করার জন্য। ইউনিভার্সিটি অফ ডেলাওয়্যারের প্রফেসর মেলিসা টেডন ১৯ শতকের একটি বই ঠিকঠাক করছিলেন উইন্টারথার মিউজিয়ামের এক্সিবিশনের জন্য। কিন্তু তিনি ভাবতেও পারেননি ওই বইটি এরকম গবেষণার বিষয় হয়ে উঠবে।
একাধিকবার এক্স-রে ফ্লুরেসেন্স অ্যানালাইসিস (মাইক্রো-এক্সআরএফ) করার মাধ্যমে বইগুলিতে মিশ্রিত বিষ শনাক্ত করা হয়। মাইক্রো-এক্সআরএফ প্রযুক্তি আর্কিওলজি ও আর্টের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন, বিভিন্ন পাত্র ও চিত্রের মধ্যে কী কী রাসায়নিক উপাদান আছে তা শনাক্ত করার কাজে।
যে কারণে এই তিনটি দুষ্প্রাপ্য বই এক্স-রে ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করা হলো, গ্রন্থাগারের পরিচালকেরা আবিষ্কার করেন এই বইগুলির মলাট করা হয়েছে মধ্যযুগের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির, যেমন রোমান আইন ও যাজকীয় আইনের টুকরা দিয়ে। একটা কথা হয়ত অনেকেই জানেন, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের ইউরোপীয় বুক বাইন্ডাররা পুরনো পার্চমেন্ট ব্যবহার করতেন বই বাঁধাইয়ের সময়।
মলাটে আর্সেনিকের ব্যবহার
বইগুলিতে ল্যাটিন ভাষায় যা লেখা রয়েছে তার অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেন গবেষকরা। অন্তত এদের বিষয়বস্তুর কিছুটা হলেও। তখনই তারা আবিষ্কার করেন, তিনটি বইয়ের মলাটেই ল্যাটিন ভাষায় যা লেখা আছে তার পাঠোদ্ধার করা খুবই কঠিন। মলাটের ওপরে ব্যাপক পরিমাণে সবুজ রঙ লেপে দেয়া হয়েছে। যে কারণে হাতে লেখা শব্দগুলি পড়া যাচ্ছিল না। তারা এগুলি নিয়ে ল্যাবে গেলেন। উদ্দেশ্য ছিল মাইক্রো-এক্সআরএফ ব্যবহার করে রঙের নিচে কী লেখা আছে এবং লেখাগুলির কালিতে কী কী রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে তা বের করা। আশা ছিল এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা আরো ভালো করে শব্দগুলি পড়তে পারবেন।
আরো পড়ুন: যেভাবে কোনো বস্তুর বয়স বের করেন বিজ্ঞানীরা
কিন্তু এক্সআরএফ বিশ্লেষণে দেখা গেল, সবুজ রঞ্জকের স্তরটি হল আর্সেনিক। এই রাসায়নিক উপাদান পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত পদার্থগুলির মধ্যে অন্যতম। আর এটিকে বিভিন্ন উপায়ে বিষক্রিয়ার কাজে ব্যবহার করা যায়। এর সংস্পর্শে আসলে ক্যান্সার এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
আর্সেনিক এমন এক প্রাকৃতিক উপধাতু যা দুনিয়ার সর্বত্রই পাওয়া যায়। আর্সেনিক সাধারণত প্রকৃতিতে অন্যান্য উপাদানের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। যেমন, কার্বন ও হাইড্রোজেনের সাথে। এইগুলিকে বলা হয় অর্গানিক আর্সেনিক। ইনঅর্গানিক আর্সেনিক, যা ধাতব বস্তু বা মিশ্র পদার্থরূপে থাকতে পারে, তা আরো মারাত্মক পদার্থ। আর সময়ের সাথে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার ক্ষমতা মোটেও কমে না।
কেউ কীভাবে আর্সেনিকের সংস্পর্শে আসছে তার ওপর নির্ভর করবে আর্সেনিকের বিষ ক্রিয়ায় সে কী কী লক্ষণ দেখাবে। আর্সেনিক কোনোভাবে শরীরে প্রবেশ করলে পেটে যন্ত্রণা, শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থিতে যন্ত্রণা, বমিভাব, ডায়রিয়া, চর্মরোগ এবং ফুসফুসের সমস্যা দেখা দেবে।
‘এমারেল্ড গ্রিন’ আর্সেনিক
বইগুলির মলাটে যে সবুজ রঙের আর্সেনিকযুক্ত রঞ্জক পাওয়া গেছে তা সম্ভবত প্যারিস গ্রিন, বা কপার-টু এসেটেইট অথবা কপার-টু এসেটো-আর্সেনাইট (Cu(C₂H₃O₂)₂·3Cu(AsO₂)₂)। পান্নার মত রঙ সবুজ হওয়ার কারণে একে ‘এমারেল্ড গ্রিন’ বা ‘পান্না সবুজ’ও বলা হয়ে থাকে।
এই আর্সেনিক রঞ্জকটি একধরনের স্ফটিকের মত পাউডার। উৎপাদন করা বেশ সহজ। বিভিন্ন কাজে, বিশেষ করে উনিশ শতকে এগুলি ব্যবহার করা হত। পাউডারের কণাগুলি ছবি আঁকার সময় কালার টোনিংয়ে ব্যবহৃত হত। কণা যত বড় হত, সবুজ ততই গাঢ় হত। একইভাবে ক্ষুদ্র কণা ব্যবহৃত হত হালকা সবুজ রঙ তৈরিতে। রঞ্জকটি বেশি পরিচিত ছিল এর রঙের তীব্রতার কারণে। এছাড়াও এটি সহজে ক্ষয় হয় না।
উনিশ শতকের শিল্পকর্মে আর্সেনিকের ব্যবহার
উনিশ শতকে ইউরোপে প্যারিস গ্রিনের শিল্পোৎপাদন শুরু হয়। ইম্প্রেশনিস্ট ও পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের অনেকেই এই রঙের ব্যবহার করেছেন তাদের মাস্টারপিসগুলি আঁকতে। জাদুঘরে সংরক্ষিত অনেক শিল্পকর্মে তাই আর্সেনিক বিষ পাওয়া যাবে। বইয়ের মলাট, কাপড় ইত্যাদিসহ অনেক পণ্যেই নান্দনিক কারণে এই রঙ মেশানো হত। এই রঙ গায়ের চামড়ার সংস্পর্শে এলে বিভিন্ন রোগ হতে পারে।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই আর্সেনিকের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে মানুষ সচেতন হতে শুরু করে। রঙ তৈরিতে আর্সেনিক মিশ্রিত পদার্থের ব্যবহার হ্রাস পায় ও কীটনাশক হিসেবে কৃষিজমিতে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। পোশাক শিল্প ও চিত্রশিল্পে প্যারিস গ্রিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারযোগ্য রঙ আবিষ্কৃত হয়। বিশ শতকে এসে কৃষিজমিতেও এর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।
বইয়ের ক্ষেত্রে প্যারিস গ্রিন অবশ্য নান্দনিকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়নি। উনিশ শতকের দিকে প্রাচীন বইগুলির ওপরে প্যারিস গ্রিনের প্রলেপ দেয়া হতো সম্ভবত সেগুলিকে পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।
আরো পড়ুন: CRISPR বা জিন এডিটিং-এর অন্ধকার দিক
কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ও পরিবেশে আর্সেনিকযুক্ত যৌগ, যেমন আর্সেনেইট ও আর্সেনাইটকে মাইক্রো-অর্গানিজমের সাহায্যে আর্সাইনে (AsH₃) পরিণত করা যায়। এটি রসুনের মত গন্ধ বিশিষ্ট ভয়ানক বিষাক্ত গ্যাস। ভিক্টোরিয়ান যুগে, সবুজ রঙের দেয়ালচিত্র বাচ্চাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে এমন গল্প প্রচলিত ছিল। যেটাকে সত্য ঘটনা বলে ধারণা করা হয়।
বর্তমানে বিষাক্ত বইকে গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বায়ু চলাচল করতে পারে এমন কার্ডবোর্ডের বাক্সে আলাদা করে রেখছেন। বাক্সের গায়ে সতর্কবাণীও লাগানো আছে। এখন পরিকল্পনা হচ্ছে, এগুলিকে ডিজিটালাইজড করে ফেলা যেন হাতে নিয়ে দেখার প্রয়োজন না পড়ে।