প্রেজেন্টিজম বা মানুষকে দেখাতে বেশি কাজ করার বিষয়টা আসলে কী?

এই লেখাটি যখন পড়ছেন তখন আপনি কোথায়? আপনি কি অফিসে, নিজের বাসায় নাকি কোনো ক্যাফেতে? মহামারির পরে যে কয়টা ভালো বিষয় ঘটেছে তার মধ্যে একটা হলো, এখন আমরা আমাদের সুবিধা মতো জায়গায় সুবিধা মতো সময়ে কাজ করতে পারি।

কিন্ত কর্ম ও জীবনের মধ্যে ব্যালেন্স করার এই সুযোগ কাজে না লাগিয়ে অনেকে উলটো খারাপ অভ্যাস তৈরি করে ফেলেছেন। যেমন হচ্ছে প্রেজেন্টিজম, বা এর আধুনিক ভার্শন ডিজিটাল প্রেজেন্টিজম।

প্রেজেন্টিজম বলতে কী বোঝায়
প্রেজেন্টিজম বলতে বোঝায় যখন আপনি মনে করেন আপনার অনেক সময় ধরে অনেক কাজ করা উচিত বা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কাজ করা উচিত যাতে মানুষ বোঝে আপনি অনেক কাজ করেন। আপনি হয়তো ক্লান্ত হয়ে যান, আপনার প্রোডাক্টিভিটি কমে যায় বা আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবুও আপনি আরো কাজ করতে থাকার চাপ অনুভব করেন।

প্রেজেন্টিজম একটা দুষ্টচক্রের মতো হতে পারে। মানুষ হয়ত কাজ করতে করতে দুর্বল হয়ে যায়, কিন্তু প্রেজেন্টিজম-এর কারণে তারপরও কাজ করতে থাকে। তাতে তাদের প্রোডাক্টিভিটি আরো কমে যায়। উদাহরণে বলা যায় যেমন যুক্তরাজ্যে প্রেজেন্টিজম-এর কারণে প্রতি কর্মীর বছরে ৩৫ কর্মদিন নষ্ট হয়।

কোভিডের আগের অবস্থাকে প্রেজেন্টিজম-এর উদাহরণ হিসেবে নিলে বলা যায়, কর্মীরা অফিসের সময় শেষেও ডেস্কে পড়ে থাকতো। এখন আমরা বিষয়টাকে ঘরে নিয়ে এসেছি। গবেষণায় দেখা গেছে আমরা আগের চেয়ে বেশি সময় ধরে কাজ করি, তবে সেটা ঘরে বসে।

ডিজিটাল প্রেজেন্টিজম-এর সময় এখন। সারাদিনই আমরা ই-মেইল, এসএমএস এর রিপ্লাই দিতে থাকি। এক কথায় আমরা কখনো থামি না।

নোট: প্রেজেন্টিজম বলতে, “আমি অফিসে অনেক বেশি কাজ করি”, এমন গর্ব করা বোঝায় না। বরং এটা এক ধরনের ভয়, যখন আপনার মনে করেন অন্যেরা ভাবছে আপনি অফিসে যথেষ্ট কাজ করেন না। একে ইমপোস্টার সিনড্রোমের সাথে মিলানো যাবে না। ইম্পোস্টার সিনড্রোম হলো অন্যেরা আপনাকে অদক্ষ বা অযোগ্য ভাববে এমন ভয়।

কেন প্রেজেন্টিজম ঘটে
অনেকের জন্য প্রেজেন্টিজম অফিস কালচারের অংশ। মানুষ সবার আগে অফিসে আসতে চায় না বা সবার শেষে অফিস থেকে বের হতে চায় না। আমরা টেনশন করি, যদি বস আমাদের কিছু বলে, যদি কলিগরা আমাকে নিয়ে কানাঘুষা করে তাহলে তো প্রমোশন আটকে যাবে।

মহামারীর কারণে মানুষের মধ্যে চাকরি হারানোর ভয় অনেক বেড়ে গেছে। তাই আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা মনে করছে চাকরি ধরে রাখার জন্য অফিসে তাদের খাটুনি আরো বাড়ানো উচিত।

আরো পড়ুন: প্রোডাক্টিভিটির ফাঁদে পড়েছেন? বার্ন-আউট থেকে বাঁচার ৭টি উপায়

তবে গবেষণা বলছে এই আশঙ্কা আসলেই সত্য। ২০১৯ সালের একটা গবেষণায় দেখা যায় দূরে থেকে কাজ করা কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির হার অফিসে এসে কাজ করা কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। মনোবিজ্ঞানীরা এর পেছনে অবচেতন মনের বায়াসকে দায়ী করেন:

  • মিয়ার-এক্সপোজার ইফেক্ট (Mere-exposure effect): কাউকে আপনি যত বেশি দেখবেন তত আপনি তার সাথে নিজেকে মেলাবেন এবং তাকে পছন্দ করবেন
  • হেলো ইফেক্ট (Halo effect): যখন আপনি কারো নম্র ভদ্র আচরণে আকৃষ্ট হয়ে যান কিন্ত সে কতটুকু প্রোডাক্টিভ সেটা খেয়াল করতে পারেন না

এসব কারণে অনেক সময় কম যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মীরা বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মীদের আগে প্রমোশন পেয়ে যায়। যার একটাই কারণ, তারা বেশি সময় অফিসে থাকে। তার কাজ বা প্রোডাক্টিভিটি এখানে মূল বিষয় আর থাকে না।

নোট: প্রেজেন্টিজম আর অ্যাবসেন্টিজমকে একসাথে রাখা হয়। অবশ্য পরেরটা বলতে বোঝায় যারা অসুস্থতা বা কোনো অনিবার্য কারণ দেখিয়ে অফিসে অনুপস্থিত থাকা।

প্রেজেন্টিজম ও মানসিক স্বাস্থ্য
প্রেজেন্টিজম থেকে কেবল উদ্বিগ্নতার শুরু হয়, তা না। গবেষণা বলে স্ট্রেস, অনিদ্রা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের কারণেও এটি ঘটতে পারে।

আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে গবেষণায় এসেছে, মহামারির সময় আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে অবনতি ঘটেছে। আমরা এখন কম ঘুমাচ্ছি, বেশি বিষণ্ন থাকছি, আমাদের শারীরিক ও আর্থিক অবস্থা নিয়ে আমরা অতিরিক্ত চিন্তা করছি।

তার উপর দূরে থেকে কাজ করার ফলে আমরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। আমরা মানুষের সাথে সংযোগ তৈরির সুযোগ পাচ্ছি, কিন্ত আমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে অতিরিক্ত কাজ করতে করতে।

আরো পড়ুন: অ্যাকশন প্রোগ্রাম: গুছিয়ে কাজ করার অসাধারণ উপায়

কীভাবে প্রেজেন্টিজম থামাবেন
প্রেজেন্টিজম কমাতে চাইলে এই টিপসগুলি কাজে লাগাতে পারেন:

১. সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া

লিডার এবং ম্যানেজারদের সব সময় একটা স্বাভাবিক কর্ম-জীবন ব্যালেন্স বজায় রাখা দরকার। তাই যখন দিনের কাজ শেষ হবে, সেটা যখনই হোক, বাকিদের জানিয়ে দিতে হবে আজকের মত আপনি আর কাজ করছেন না।

শারীরিক বা মানসিক কারণে অসুস্থ থাকলে আপনার টিম বা প্রতিষ্ঠানকে আগেই জানিয়ে রাখুন। বস যদি আশেপাশে ঘুরাঘুরি না করে, তবে কর্মীরা কিছুটা স্বস্তি নিয়ে কাজ করতে পারে, যেহেতু তারা নজরদারিতে নেই।

২. ফলাফলের দিকে নজর দেয়া

কয় ঘণ্টা ধরে কাজ করছেন এটা প্রোডাক্টিভিটি পরিমাপের একটি ভুল পদ্ধতি। তাই আপনার টিমের মেম্বারদের জানান, আপনি কাজের কোন আউটপুটকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। আপনি কী চান তা সবার কাছে পরিষ্কার করে দেখিয়ে দিন।

কনসাল্টিং কোম্পানি আর্টেমিস কথাই চিন্তা করুন। প্রজেক্টের কাজ ফাইনাল করার পর আর্টেমিস অফিস কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকটি কাজ শেষ করতে কত সময় প্রয়োজন হবে তা নির্দিষ্ট করে এবং সেই অনুযায়ী কর্মীদের নির্দেশনা দেয়। কর্মীরা জানে কখন কোথায় তাদের প্রয়োজন। আর ম্যানেজাররা খেয়াল রাখে সবকিছু ঠিকমতো হচ্ছে কি না। এধরনের কাজের পদ্ধতিকে বলে রেজাল্ট-অনলি ওয়ার্ক এনভায়রনমেন্ট বা ROWE

৩. ঘরে বসে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়া

মহামারীর কারণে মানুষ এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা হাইব্রিড ওয়ার্ক (অফিস ও বাসা মিলিয়ে) পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, তা আমরা চাই বা না চাই। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্কিল শেখার জন্য এখনও দেরি হয়ে যায়নি। যেমন টাইম ম্যানেজমেন্ট এবং কীভাবে কাজের সময় নিজের গণ্ডি মেনে চলতে হয় তার কৌশল।

আপনার টিম মেম্বারদের সাহায্য করুন, কোন রুটিন তাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো কাজ করে সেটা খুঁজে বের করতে। নিয়মিত বিরতি দিয়ে অল্প সময়ে অনেক কাজ করার রুটিন হতে পারে, বা কাজের মাঝখানে অ্যানার্জি লেভেল বাড়ানোর জন্য এক্সারসাইজের রুটিনও হতে পারে।

আরো পড়ুন: লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে নিজেই যেভাবে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন

যুক্তরাজ্যের মানব সম্পদ ও ব্যক্তিগত উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা পেশাদারী প্রতিষ্ঠান CIPD, মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা গ্রহণের পরামর্শ দেয়। তারা বলে এভাবে কর্মীরা নিজেদের ও কলিগদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করতে পারবে।

৪. মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে খোলামেলা কথা বলা

কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা এখনো ট্যাবু হিসেবে মনে করা হয়। এইজন্য ডিলোইট নামে একটি প্রতিষ্ঠান একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যাতে পরামর্শ দেয়া হয় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের আরো কথা বলা উচিত।

“আমাদের অনুমান, কর্মীদের নেতিবাচক মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে যুক্তরাজ্যের অফিসগুলির প্রতি বছর ৪২-৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড অপচয় হয়। এর মধ্যে আছে অনুপস্থিতির জন্য অপচয় ৭ বিলিয়ন পাউন্ড, প্রেজেন্টিজম-এর জন্য ২৭-২৯ বিলিয়ন পাউন্ড এবং টার্নওভার কস্ট ৯ বিলিয়ন পাউন্ড। ২০১৭ সালের থেকে এই পরিমাণ ১৬% বেশি যা অর্থের পরিমাণে ৬ বিলিয়ন পাউন্ড। মূলত প্রেজেন্টিজম-এর কারণে এই অপচয় বেড়েছে, যখন কর্মীরা অসুস্থ বা কাজে অমনোযোগী থাকা সত্ত্বেও কেবল উপস্থিতির জন্য অফিসে আসে।

আমাদের রুটিন করে নিজেদের ভালো থাকার বিষয়ে আলাপ করতে হবে। প্রথমে নিজের টিম মেম্বারের সাথে শুরু করুন। তারপর ম্যানেজার ও অন্যান্য কর্মীদের মধ্যেও আলাপ চালিয়ে যান যতক্ষণ না বিষয়গুলি নিয়ে আমরা খোলামেলা কথা বলতে পারি।

আরো পড়ুন: এটা কি আসলে “সকালের কাজ”?

অফিসে না গিয়ে দূর থেকে কাজ করতে চাওয়ার প্রবণতা বাড়ায় আমরা আরো ভালো কাজ আর জীবনের ব্যালেন্স করার সুযোগ পেতে পারি। তবে তা কাজে লাগানোর জন্য আগে আমাদের কাজ করার পদ্ধতিগুলি পুনঃমূল্যায়ন করতে হবে এবং প্রেজেন্টিজম-এর মত অভ্যাসগুলি বাদ দিতে হবে, সেটা অফিসেই হোক বা ভার্চুয়ালি হোক।

গার্টনারের ডিরেক্টর আলেক্সিয়া ক্যামবন বলেন, “সোজা কথা আমরা কোথায় আছি সে বিচার করে কাজ ঠিক করবো না, আমরা মানুষের আচরণের উপর ভিত্তি করে আমাদের কাজের ডিজাইন করবো।” এমন করতে পারলে আমাদের কাছ থেকে সেরা কাজ বের হয়ে আসবে।

মূল পয়েন্ট
প্রেজেন্টিজম হচ্ছে যখন আপনি মনে করেন আপনার অনেক সময় ধরে কাজ করা উচিত অথবা অতিরিক্ত কাজ করার উচিত, যাতে সবাই ভাবে আপনি অনেক কাজ করেন।

ম্যানেজাররা প্রেজেন্টিজম কমানোর জন্য এই উপায়গুলি মানতে পারেন:

১. সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া
২. ফলাফলের দিকে নজর দেয়া
৩. ঘরে বসে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়া
৪. মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে খোলামেলা কথা বলা

মাইন্ডটুল থেকে অনুবাদ: আমিন আল রাজী