আমি ছোট বেলায় শুধু রেশন কার্ডের নামই শুনেছি। চোখে কখনও দেখি নাই। আমি একটা স্বচ্ছল পরিবারে জন্মেছি। সেই সুবাদে খাওয়া পরার কষ্ট কোনোদিন বুঝি নাই। তারপরও ‘৭৬ সাল থেকে কয়েক বছর রেশন কার্ডের খাদ্য খেয়েছি। তখন আমি স্বামী বাচ্চা নিয়ে মেহেরপুর থাকি। এখন আমি ভারতে থাকি। আজ রেশন কার্ড সুবাদে কিছু কথা মনে আসছে।

এখন শুধু রেশন কার্ড তো না! কার্ডের ছড়াছড়ি! এই যেমন রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, এ,টি,এম কার্ড, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড, ডেবিট কার্ড ইত্যাদি। এরপর আরো কত কার্ড বের হবে, কে জানে? শুনেছি আমেরিকাতে গ্রীন কার্ডও আছে।

এইবার আসছি আবার রেশন কার্ড প্রসঙ্গে। কিছুদিন আগে ভারত সরকার ঘোষণা দিল, আধার কার্ডের সাথে রেশন কার্ডের লিংক করাতে হবে। সাধারণ মানুষ ছুটল লিংক করাতে। এদিকে করোনার কারণে এক জায়গাতে বেশি লোক জড়ো হতে নিষিদ্ধ। অথচ কোনো না কোনো কারণে লোকজনকে ছুটতে হচ্ছেই। দেখা যায় জড়োও হয়ে যাচ্ছে ভিড় করে।

লিংকের কাজ শেষ হবার পর পরই আবার বলছে, রেশনের দোকানে যার রেশন কার্ড, তাকেই যেতে হবে এবং তার টিপসই দিয়ে মালামাল আনতে হবে। যে পরিবারে একের অধিক সদস্য, সেখানে পরিবারের একজন সকলের দায়িত্ব নিয়ে টিপসই দিয়ে মালটা তুলতে পারবে।

ঘটনাক্রমে লকডাউন থেকে সরকার রেশনটা ফ্রি-তে দেয়। আমি কোনোদিন রেশনের কোনো কিছু নিই না। শুধু প্রুফ হিসাবে রেশন কার্ড ব্যবহার করা। কিন্তু রেশনের মালটা দিনের পর দিন না তুললে, রেশন কার্ড বাতিল হয়ে যাবে। তাই আমি প্রথম থেকেই রেশন কার্ডটা কোনো অভাবী লোককে দিয়ে দিতাম। সে মালগুলো যেমন পারতো তুলত। টাকাটা সে নিজেই দিত।

এরপরের ঘটনা হলো, লক ডাউনে দেশে হাহাকার পরে গেল। গরীব লোকজন আরো গরীব হলো। কল কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। প্রাইভেট অনেক সংস্থা বন্ধ হয়ে গেল। করোনায় প্রতিদিন অসংখ্য লোক মারা যাচ্ছে। লোকের অভাবের শেষ নাই।

আমার কিছু করার সাধ থাকলেও সাধ্য নাই। আমি তখন ঠিক করলাম,আমার বাড়িতে যে গৃহশ্রমিক, তাকে রেশন কার্ডটা দিয়ে দেবো। খোঁজ নিলাম, যাকে কার্ড দিয়েছিলাম তার কাছে। সে বলল, অত দূরে গিয়ে মাল আর তুলি না। আমার জন্য খুব ভালো হয়ে গেল। আমার যে আছে, তার নাম মানু। ঘটনাচক্রে আমার রেশন কার্ড সরকার দিয়েছে বিপিএল, অর্থাৎ গরীব লোকের কার্ড। আমার কার্ডে মাল বেশি পাওয়া যায়।

এদিকে আরেক ঘটনা। সারা পৃথিবী যখন করোনার তাণ্ডবে একেবারে দিশেহারা, আমি তখন সবেমাত্র বাইপাস সার্জারি করে বাড়ি এসেছি। হঠাৎ নাতনি একদিন বলল, “দাদুভাইয়ের রেশনের নাম কাটিয়ে নাও।” ভালো কথা সে মনে করিয়ে দিয়েছে। ওর দাদু তো আর নাই। আমি ডলিকে বললাম। ডলি এসে বলল, “এখন লক ডাউনে সকল কাজ বন্ধ। আপনাকে বা দিদিকে যেতে হবে।” তার দিদি, আমার মেয়ে বলল, “চুপচাপ থাকো। পরে যা হয় হবে।”

আমি ডলিকে বললাম, আমি রেশন কার্ড যাকে দিয়েছিলাম সে তো কোনো কার্ডের মালই আনে না। তুমি বরং আমার কার্ডের মালটা নিয়ে নিও। সরকার তো এখন ফ্রি-তে মাল দিচ্ছে। তোমার উপকার হবে। ডলি খুব খুশিই হলো।

তখন আমাদের বাড়িতে প্রতিমা থাকে। এতে প্রতিমা একটু মনোক্ষুণ্ন হয়েছে। যাই হোক ডলি আমার রেশন কার্ড ও আধার কার্ড নিয়ে রেশনের দোকানে গিয়েছে। প্রথমে যাকে রেশন কার্ড দিয়েছিলাম সে সম্ভবত অনেক দিন রেশনের কোনো মাল তোলে নাই। আমার রেশন কার্ড রিজেক্ট হয়ে গেছে। এ কার্ডের মাল পেতে হলে এখন থানায় জিডি করে, থানা থেকে লিখে দিলে, তবে মাল দিতে পারে।

রেশন কার্ড আর আমার দরখাস্ত
রেশন কার্ড

ডলির তো মন খারাপ হয়ে গেছে। ঐ সময় ওর বাবার কারখানা বন্ধ, ভাইয়ের কাজ নাই। মেজো বোন মোম তৈরির কারখানায় কাজ করত, সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। ও সন্তান হয়ে যদি রেশনের চাল ও কিছু দিতে পারত, ওর অনেক ভালো লাগত।

এইবার ডলি কাচুঁমাচু করে বলল, “মাসিমা একদিন থানায় যেতে পারবেন? আপনার কার্ডে মাল বেশি পাওয়া যেত।” আমি বললাম, “তা কেন?” ডলি বলল, “আপনার বিপিএল কার্ড।” সেদিন আমি জানতে পারলাম আমাদের খাদ্যের যে ডিজিটাল কার্ড সেটা বিপিএল। প্রথম যে কার্ড ছিল সেটা এপিএল। আমি তো বিপিএল-এপিএল কিছুই বুঝতাম না। আমার বোঝার কথাও না। যাই হোক, আমার মেয়ে বলল, “এখন আমার বা মায়ের থানায় গিয়ে জিডি করা সম্ভব না। তুমি বরং মায়ের একটা দরখাস্ত নিয়ে যাও।”

ডলি রাজি হলো। মেয়ে একখানা থানার অফিসারকে দরখাস্ত লিখল। আমি নিচে ইংরেজিতে সই করে দিলাম।

ডলি একা থানাতে না গিয়ে ওর এক বান্ধবীকে সাথে নিয়ে গেল। সে বি.এ. পাশ। থানায় গিয়ে ওরা ওদের মতো কথা বলল। অফিসারের জিজ্ঞাসা, এই সই কার? ওরা আমার কথা বলায় অফিসার বিশ্বাসই করলেন না। উপরন্তু বললেন, “এত সুন্দর সই একজন ৭২ বছরের মহিলার হতেই পারে না, তাতে আবার কিছু দিন আগে যার এত বড় একটা অপারেশনের কথা বললেন।”

ওরা বোঝানোর চেষ্টা করল, “দরখাস্তটা উনি নিজে লেখেন নাই, সই ওনার নিজের। বিশ্বাস না হলে সাথে একজন চলুন। সামনেই করবে। তখন মিলিয়ে নিবেন।”

ডলির আর রেশনের মাল তোলা হলো না। আমারও একটু খারাপ লাগল। অতি সামান্য হলেও আমি পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম।

রেশন কার্ড আর আমার দরখাস্ত
দরখাস্ত

কিছুদিন পরে প্রতিমা আমাকে বলে, “কার্ডটা আমাকে দেবেন?” আমি দিলাম, না দেওয়ার তো কিছু নাই। ও তো এখানকার কিছুই চেনে না। কীভাবে যাবে? আমাদের পাড়ার ভোলার ঠাকুমার সাথে গেল। আমি রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড দিয়ে দিলাম। ও গিয়ে কী বলল জানি না। তবে ও কথায় কথায় খুব কান্নাকাটি করতে পারত। প্রতিমা বিশ্ব জয় করার মতো হাসতে হাসতে এক বস্তা মানে ১৬ কেজি চাল ও তিন প্যাকেট আটা নিয়ে এসে হাজির। ভোলার ঠাকুমাও হতভম্ব হয়ে আছে। একখানা কার্ডে এত মাল কী করে দিল?

এই হলো আমার রেশন কার্ডের আরেক পর্ব ইতিহাস।

প্রতিমা চলে যাবার পর কার্ডটা ডলিই ব্যবহার করে। এইবার হলো কী, আমি না গেলে নাকি মাল দেবে না। আমি তো অসুস্থ বৃদ্ধ, আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না। তাই আমি ডলিকে একটা দরখাস্ত লিখে দিলাম। প্রতিবেশী এসেছিল আমাদের বাড়িতে। ওকে দেখালাম। সে বলল, এই দরখাস্ত দেখে ডলিকে মাল দেবে না। যাই হোক আমি ঐ দরখাস্ত ও আধার কার্ড ডলিকে দিয়ে দিলাম। রেশন ডিলার দরখাস্ত পড়ে, ডলিকে জিজ্ঞেস করেছে, “এটা কে লিখেছে?” ডলি আমার কথা বলল। ডিলার মাল দিয়ে দিল। আরো বললো, ওনাকে টিপসই দিতেও আসতে হবে না। এই দরখাস্ত যে লিখেছে, তার জন্যই তুমি মাল পাবে। তুমি আসলেই মাল দিয়ে দেব।

আমি আমার কাজে খুব খুশী। দরখাস্তের গুণ আবারো টের পেলাম।

২ অক্টোবর ২০২১, দেবীপার্ক, রাজারহাট-গোপালপুর, কোলকাতা ১৩৬, ইন্ডিয়া