উপকূলীয় বনগুলি বন্যপ্রাণীকে আশ্রয় দেয়, মানুষকে রক্ষা করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
বিশ্বজুড়ে কিছু সরকার বাস্তুতন্ত্র ও উপকূলীয় সম্প্রদায় নিয়ে চিন্তা করছে। তারা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাচ্ছে। তাদের উচিত হবে ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ম্যানগ্রোভ বনগুলিকে ফিরিয়ে আনা ও সেগুলিকে যথাযথ রক্ষা করা।
স্টেসি বায়েজ
পিউ ট্রাস্ট ডটঅর্গ, জুলাই ২৬, ২০২২
সি-গ্রাস বা সামুদ্রিক ঘাস ও সল্ট মার্শ বা লবণাক্ত জলাভূমির মতো লবণাক্ত জলাভূমির মতো, ম্যানগ্রোভও এক ধরনের উপকূলীয় জলাভূমি। যা নানা ধরনের প্রজাতির জন্য নার্সারি হিসেবে কাজ করে এবং এদের খাদ্যের জোগান দেয়। এছাড়া উপকূলীয় সম্প্রদায়গুলিকে ঝড় থেকে রক্ষা করে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ অত্যন্ত নিপুণভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বায়ুমণ্ডলের কার্বনের মাত্রা কমায়। যেসব দেশ প্রকৃতি-ভিত্তিক জলবায়ু পদক্ষেপ (ক্লাইমেট অ্যাকশন) নিতে আগ্রহী, তাদের জন্য এ ধরনের মানগ্রোভ বন একটি বড় আকর্ষণ।
আরো পড়ুন: তিমির বিষ্ঠার আশ্চর্য ক্ষমতা
পরিবেশের জন্য ম্যানগ্রোভ প্রচুর উপকারী হওয়া সত্ত্বেও ম্যানগ্রোভ বনগুলিই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে হুমকির সম্মুখীন হওয়া বাস্তুতন্ত্র। বিশেষজ্ঞদের মতে আবাসস্থল ধ্বংস, উপকূলীয় উন্নয়ন ও দূষণের কারণে গত ৫০ বছরে বিশ্বের অর্ধেক ম্যানগ্রোভ হারিয়ে গেছে।
কেন ম্যানগ্রোভ রক্ষা করা প্রয়োজন সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৬টি তথ্য শেয়ার করা হল।
১. ম্যানগ্রোভ বন একই এলাকার অন্যান্য বনের তুলনায় ৩ থেকে ৫ গুণ বেশি কার্বন সঞ্চয় করতে পারে
আসলে একটি সবল ম্যানগ্রোভ বন বছরে একর প্রতি আনুমানিক ২,০১৬ পাউন্ড কার্বন সঞ্চয় করতে পারে।
২. ম্যানগ্রোভ বন হাজার বছরের জন্য মাটিতে কার্বন জমা রাখতে পারে
ম্যানগ্রোভ বনের মাটিতে জোয়ার-ভাটার প্রভাব পড়ে এবং অধিকাংশ সময় এর মাটি পানিতে নিমজ্জিত থাকে। ফলে মানগ্রোভ বনের মাটি হয় আর্দ্র, অক্সিজেন থাকে স্বল্প।
এ কারণে এখানে জন্মানো উদ্ভিদ ও অন্যান্য জৈব উপাদানের ক্ষয় ধীরে ধীরে হয়। গাছপালা মারা গেলে বা শুকনা পাতা ও শিকড় ঝরে মাটিতে পড়ার পর তা থেকে জৈব পদার্থ সৃষ্টি হয়। আবার এই ক্ষয়প্রাপ্ত জৈব পদার্থ থেকে তৈরি হয় কার্বন। ম্যানগ্রোভ বনে এসব কার্বন মাটিতেই আটকে থাকে।
সবল ম্যানগ্রোভ বনগুলি হাজার হাজার বছর ধরে এই কার্বন সংরক্ষণ করতে পারে। ফলে এই কার্বন বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে গিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন করতে পারে না। কার্বন থেকে বাঁচার জন্য ম্যানগ্রোভ বন একটি প্রাকৃতিক উপায়।
৩. উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে ঝড়ের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা দেয় ম্যানগ্রোভ
সায়েন্টিফিক রিপোর্টস নামের জার্নালে ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী বন্যা নিয়ন্ত্রণে ম্যানগ্রোভের কারণে যে সুবিধা পাওয়া যায়, তার আর্থিক মূল্য প্রায় ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের শিকড় উপকূলীয় মাটিকে শক্ত করে, ঝড়ের সময় ক্ষয় ও বন্যার মাত্রা কমায়। এধরনের বন ঢেউয়ের তীব্র প্রভাব থেকে উপকূলীয় তীরকে বাচায়।
৪. ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ কোনো একক প্রজাতি নয় বরং নানা উদ্ভিদ প্রজাতির একটি দল
যদিও ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদগুলির বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম হয় তবে এরা নানা প্রজাতির হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে, এই প্রজাতিগুলি এমনকি জেনেটিকভাবেও একে অপরের সাথে সম্পর্কিত থাকে না।
আরো পড়ুন: নেকড়েরা যে ভাবে নদীর স্বভাব পাল্টে দেয়
ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ গুল্ম থেকে গাছ পর্যন্ত নানা ধরনের হতে পারে। উচ্চতা ৩ মিটার (১০ ফুট) থেকে ৪০ মিটার (১৩১ ফুট) বা তার বেশি পর্যন্ত হয়। মানগ্রোভ উদ্ভিদের প্রজাতিতে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও, এদের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্যে মিল থাকে। যেমন ভেজা ও লবণাক্ত পরিবেশে এদের বেড়ে ওঠার ক্ষমতা।
৫. ম্যানগ্রোভ বনগুলি কচ্ছপ, মাছ থেকে শুরু করে পাখি, হাঙর এমনকি বাঘ পর্যন্ত নানা ধরনের বণ্যপ্রাণীর আবাসস্থল
একটি ম্যানগ্রোভ বনে যে প্রচুর পরিমাণ প্রাণের উপস্থিতি থাকবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। অনেক সামুদ্রিক মাছের জন্য ম্যানগ্রোভ বন আদর্শ নার্সারি হিসেবে কাজ করে। যেমন গ্রুপার, স্ন্যাপার ও কিছু হাঙর প্রজাতি ইত্যাদি।
বিপুল সংখ্যক মাছ, মলাস্ক, ক্ল্যাম, ঝিনুক, কাঁকড়া, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী ম্যানগ্রোভের মধ্যে বাসা তৈরি করে। ফলে এখানে একটি আদর্শ বাস্তুসংস্থান তৈরি হয় যা প্রাণীদের পাশাপাশি মানুষকেও প্রচুর খাদ্য সরবরাহ করে।
৬. ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ উচ্চ ও নিম্ন উভয় পর্যায়ের লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে
উপকূলীয় পরিবেশে লবণাক্ততা কখনো বাড়ে কখনো কমে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ এরকম পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এমনকি কিছু প্রজাতি বেঁচে থাকার জন্য পাতার মাধ্যমে অতিরিক্ত লবণ বের করে দিতে পারে।
ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদগুলি তাদের বিশেষ বায়োলজির কারণে বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে দ্রুত বেড়ে উঠতে পারে। অন্যান্য বেশিরভাগ গাছের জন্য বিষাক্ত এমন পরিবেশেও একটি ম্যানগ্রোভ গাছ টিকে থাকতে পারে।
ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ উচ্চ ও নিম্ন উভয় পর্যায়ের লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। লবনাক্ত মাটির গভীরে যেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ সামান্য সেখানেও তাদের শিকড় পৌঁছাতে পারে। বিশেষ এই ক্ষমতাই ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদগুলিকে সর্বদা পরিবর্তনশীল উপকূলীয় পরিবেশের জন্য আদর্শ ও উপযুক্ত করে তোলে।
অন্য সব উপকূলীয় জলাভূমির মতো, এসব ম্যানগ্রোভ বন ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক পরিচিতি
স্টেসি বায়েজ (Stacy Baez) উপকূলীয় জলাভূমি এবং প্রবাল প্রাচীর প্রকল্পের একজন সিনিয়র অফিসার। যেসব দেশ উপকূলীয় জলাভূমি এবং প্রবাল প্রাচীরের জন্য শক্তিশালী সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে আগ্রহী থাকে, তিনি তাদেরকে সহযোগিতা দেন। বায়েজ বিশ্বের নানা দেশে বড় আকারের ও সম্পূর্ণ সুরক্ষিত সামুদ্রিক অঞ্চল তৈরিতে সহায়তা করেছেন। এবং তিনি ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে হাঙর অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠার জন্যও কাজ করেছেন। পিউতে যোগদানের আগে, বায়েজ ছোট আকারের মৎস্যশিকার এলাকা নিয়ে ফিলিপাইন সরকারকে পরামর্শ দেয়ার কাজ করেছিলেন। তিনি মরগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক এবং ওল্ড ডোমিনিয়ন ইউনিভার্সিটি থেকে সমুদ্রবিদ্যায় ডক্টরেট করেছেন।
অনুবাদ. জুবায়েদ দ্বীপ