আমি সাধারণত দুঃস্বপ্ন দেখি আমার ভাই আর বোনরে নিয়া। মা-বাবারে নিয়া দেখি না, স্বামী সন্তানদের মৃত্যু বা বিপদ আপদ নিয়া দুই একবার দেখছি, কিন্তু ভাইবোনদের মৃত্যু বা ভয়ানক কষ্টে থাকার স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি। দেখার সময় আমার প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়, ঘুম ভাইঙ্গা উঠার অনেকক্ষণ পর পর্যন্ত আমি সেই স্বপ্নগুলা ভুলতে পারি না, যন্ত্রণা পাইতে থাকি। ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা মানলে আমার সাপ্রেসড ফিয়ার তাদেরে নিয়াই বেশি।
আজকে সকালে আমি একটা অভিনব দুঃস্বপ্ন দেখছি। সেইটা হইল আমার পড়ার ঘর নিয়া। দেখলাম যে আমার পড়ার ঘরের দুইটা বুক শেলফ দুইটা জানলায় রাইখা দিছে কোন এক মিস্ত্রি, রঙমিস্ত্রি সম্ভবত। ঘর রঙ করার উদ্দেশ্যে অবশ্যই। বৃষ্টি আইসা আমার দুই বুক শেলফের সকল বই ভিজ্যা গেছে। আমি অফিস থাইকা বাসায় আইসা আম্মাকে জিজ্ঞেস করতেছি কেমনে এই সর্বনাশটা হইল, আর আকুল হইয়া কানতেছি।
স্বপ্ন ভাইঙ্গা যাওয়ার পরে বিছানা থাইকা উইঠা আমি প্রথম যে কাজটা করলাম সেইটা অবশ্যই পড়ার ঘরে যাওয়া না। জানলা দিয়া বৃষ্টির ছাঁট আইসা বই ভিজতে পারে, সেই সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু লজিক্যালি আমি জানি যে আমার বুক শেলফ দুইটার কোনোটাই জানলার দিকে মুখ কইরা বইগুলা এক্সপোজড অবস্থায় ছিল না।
আমি পানি খায়া, বাচ্চাদেরে খাওয়ার ব্যবস্থা কইরা দুপুরের দিকে পড়ার ঘরে গেলাম।
পড়ার ঘরে যাওয়া একটা আয়োজনের ব্যাপার, কারণ ঘরটা আমার মূল বাসার বাইরে। আমাদের বাসায় একটা গ্যারাজ আছে যেটা দিয়া ঢুইকা সিঁড়িঘর পাওয়া যায়। দোতলায় আর তিনতলায় সেই সিঁড়িঘরের উপরের জায়গাটাকে কাজে লাগায়া এক্সট্রা ঘর বানানো হইছে। যেহেতু আমাদের বাসা বেশ ভালো ডিজাইন কইরা বানানো তাই পূর্ব, দক্ষিণ এবং উত্তর দিক খোলা রাইখা পশ্চিমে সিঁড়িঘর আর রান্নাঘর রাখা হইছিল। কিন্তু গ্যারাজের উপরের এই এক্সট্রা ঘরটার পশ্চিমে জানলা। তাই মূল বাসা থাইকা ঘরটা অনেক গরম। উত্তরেও জানলা আছে বইলা বসা যায়, নাইলে হয়ত ব্যবহার করাই যাইত না।
বইলা রাখা ভালো আমার পড়ার ঘরে বইয়ের সংখ্যা খুব বেশি না। আমার ছাত্রজীবনে কেনা বই অধিকাংশই আমি বিক্রি কইরা দিছি। ফ্রেন্ডস বুক কর্নারে এই সুবিধা ছিল, সম্ভবত এখনও আছে। ইয়ার ফাইনাল শেষ কইরা বইগুলা ফেরত দিয়া পরের বর্ষের বই নিয়া নিতাম আমি। একাডেমিক পারপাসের বাইরে যেসব কেনা হইছিল সেইগুলা কিছু আছে আর স্কুল-কলেজে পড়ার সময়ে কেনা বইগুলা আম্মার বাসায়। আমরা তিন ভাই বোন বাসায় না থাকাতে বই ধার করা আত্মীয়-বন্ধুরা আমাদের বইয়ের সংখ্যা অর্ধেকে নামায় আনছেন।
গত সাত বছরের চাকরি জীবনেও বেশি বই কেনা হয় নাই আমার। সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে অধিকাংশ পড়ানের বই পাওয়া যায়। সেমিনার লাইব্রেরি থাইকাও ধার নেওয়া যায় আর কিছু বই পিডিএফ ডাউনলোড কইরা নিতে হয়। একেবারেই না পাওয়া গেলে তা কিনতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় আগে বই কেনার জন্য মাত্র ১২০০ টাকা দিত শিক্ষকদেরে। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকদের জন্য সেইটা একটা হাস্যকর অ্যামাউন্ট। পেপারব্যাক বই নতুন কিনতে গেলে ৭০০/৮০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। পুরাতন বই কিনলে তো আর মানি রিসিট পাওয়া যায় না। আগে বই কিন্যা সেইটার মানি রিসিট দেখায়া আবেদন করা লাগত, সেইটাও আবার জুনের আগে। এত হ্যাপা কইরা সেই টাকা আমি নিছিলাম মাত্র একবার। এখন নাকি ৩০০০ টাকা দেওয়া হয়। সেইটা অ্যাকাউন্টে আসে কি না আমি খোঁজ নেই নাই।
এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হওয়ার পরে আমার সামর্থ্য বাড়ছে, মাস শেষে আম্মার থাইকা ধার করতে হয় না। সেই জন্য আমি কিছু বই কিনতে পারি। বই কেনার সময় আমার ‘নষ্টনীড়’-এর চারুলতার হাজবেন্ড ভূপতির কথা মনে হয়। বই না পইড়া যে পাপ করতেছি তার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যই বই কিনতেছি বইলা মনে হয়। ইদানীং কিনার পরেই পড়তে শুরু কইরা ১০/২০/২৫/৫০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পইড়া শেষ না কইরা আরেক দফা বই কেনার আর পড়ার জন্য ঝাঁপাইয়া পড়ার লিস্টে অনেকগুলা নাম যুক্ত হইছে।
এই মুহূর্তে মনে পড়তেছে টনি মরিসনের ‘জ্যাজ’ (এই বইয়ের সঙ্গে আরো কিনছিলাম টার বেবি আর প্যারাডাইজ), কাজুয়ো ইশিগুরোর ‘নেভার লেটমি গো’ (সঙ্গে কিনছিলাম ‘দ্য বেরিড জায়ান্ট’ আর ‘আ পেল ভিউ অফ হিলস’), নেওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকির স্মৃতিকথা ‘আ মেময়ার—অ্যান অর্ডিনারি লাইফ’ (সঙ্গে কিনছিলাম মিলান কুন্ডেরার ‘লাফেবল লাভস’, ‘ইগ্নোরেন্স’, ওরহান পামুকের ‘ইস্তাম্বুল’, টনি মরিসনের ‘গড হেল্প দ্য চাইল্ড’, ‘লাভ’)। এছাড়াও আরো অনেকগুলা না পড়া বই ছড়ায়া ছিটায়া আছে আমার পড়ার ঘরে যেগুলা আমি সেই ঘরে ঢুকলেই আমার দিকে চায়া উপহাস করে বইলা আমার মনে হয়। এই মুহূর্তে পড়তেছি মারিয়ো বার্গাস য়োসার ‘দ্য স্টোরিটেলার’, লগে হারুকি মুরাকামির ‘কাফকা অন দ্য শোর’—কিনছি কিন্তু পড়তে ধরি নাই এখনও। এছাড়াও অমিতাভ ঘোষের ‘ইমাম অ্যান্ড দি ইন্ডিয়ান’, ‘ইন এন অ্যান্টিক ল্যান্ড’ আর ‘রিভার অফ স্মোক’ আমার আধাপড়া বা শুরু করা বইয়ের তালিকায় আছে।
কলকাতা গেছিলাম ১৭/১৮ হাজার টাকার মতন নিয়া। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় গিয়া প্রায় ৪/৫ হাজার টাকাই খরচ কইরা ফেললাম বই কিন্যা। যদিও জানি ইদানীং ক্লাসে পড়ানোর জন্য যা পড়তে হয় তার বাইরে বই পড়া বেশ কম হইতেছে। খাতা দেখা আর বাসার কাজের মতন অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলা করার পর সময় পাইলে ইচ্ছা করে একটু ঘুমায়া লই।
পড়ার ঘরে আমি গেলেই আরেকটা যে ব্যাপার ঘটে তা হইল আমার সাড়ে তিন বছর বয়সী পুত্র সেই ঘরে আমার পিছে পিছে যায় এবং বইয়ের শেলফ বাইয়া উঠতে শুরু করে। তার সেই শেলফ বাওয়া দেখাটা এমন একটা কাজ যার জন্য যথেষ্ট মানসিক ধৈর্য্য এবং সাহস দরকার হয়। একবারও বাজে রকমের দুর্ঘটনা ঘটে নাই বইলা আমি এখন তার এহেন সার্কাসের ছবি তুলতে সমর্থ হইছি।
পড়ার ঘরে বইসা না পড়লেও আমার এক ধরনের শান্তি অনুভূত হয়। অনেক গরম আর দীনহীন অবস্থার পরেও ঘরটা আমার নিজেরই। ভার্জিনিয়া উলফের মতে লেখালেখি করার জন্য মানুষের একটা নিজস্ব ঘর দরকার। অফিসে আমার নিজের ঘর আছে কিন্তু বাসায় এই পড়ার ঘরটাই আমার নিজের ঘর। আমার জামাই এই ঘরটা খুব একটা ব্যবহার করার সময় পান না বইলা এমন হইছে, তা না হইলে এও শেয়ার্ড রুমই হইত, শোয়ার ঘর, বাচ্চাদের ঘর, লিভিং রুম, খাবার ঘর আর রান্নাঘরের মতন।
আমার পড়ার ঘর নিয়া আমার একটা স্বপ্ন আছে। আরো দুইটা বড় বড় বুক শেলফ কিন্যা আমি সালমান রুশদী, অমিতাভ ঘোষ, ওরহান পামুক, মিলান কুন্ডেরা আর টনি মরিসনের সকল বই এবং আরো যে যে পছন্দের লেখকেরা আছেন আর ভবিষ্যতে হবেন উনাদের সকল বই কিন্যা নতুন বুক শেলফে রাখব আর একটা ডিভান পাইতা শুইয়া শুইয়া বই পড়ব। এমন একটা দিন যখন বাচ্চাকাচ্চার খাওয়া, ঘুমানো, হাগু করা, হোমওয়ার্ক করা ইত্যাদি কাজে আমার কোনো মাথাব্যথা নিতে হবে না।
তবে পামুকের ‘ইস্তাম্বুল’ বা সাদি তাইফের ‘পাখিশাস্ত্র’ এইভাবে পড়া যাবে না। ওই বইগুলা অত্যন্ত মোটা আর ওজনদার। অইগুলা চেয়ার টেবিলে বইসাই পড়তে হবে। সেইজন্যে একখানা ভালো চেয়ারও কেনা জরুরি। কিন্তু বই কিন্যাই আমার অনেক টাকা খরচ হইয়া যায় বইলা আসবাবপত্র আর ঘরের সাজসজ্জার জন্য কিছুই কিনতে পারি না।
আমার মা আর ফুপু আমারে অনেক বার বলছেন একটা সোফাসেট কিনতে। লোকজন কেউ বাসায় আসলে ডাইনিং রুমের চেয়ারে বইতে দিতে হয়। সেইটা তাঁদের কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়। আমি দুই একবার ফার্নিচারের দোকানে ঘুইরা সোফাসেট দেইখাও আসছি, কিনি নাই কারণ আমার মনে হয় সোফা আনলে ঘর ঘিঞ্জি হইয়া যাবে। সোফা রাখলে তার লগে মিলায়া কুশন, ভাল কুশনের কভার তারপরে কার্পেট ইত্যাদি কিনতে ইচ্ছা করবে। সাজসজ্জা পূর্ণ করার জন্যে দেওয়ালে পেইন্টিং বা সাইড টেবিলে ফ্লাওয়ার ভাস রাখতে মন চাইবে। মানুষের আকাঙ্ক্ষার তো সীমা নাই। কান টানলে মাথা আসার মতন একটা জিনিস পাইলে আরো অনেকগুলা আকাঙ্ক্ষা একের পর এক আসতেই থাকবে।
সীমিত রোজগারে সকল ইচ্ছা মিটানো সম্ভব না। তাই আপাতত ভবিষ্যতে পড়ার জন্য বইই কিনি। যখন পড়ার ঘরে বই আর আটতে চাইবে না তখন লিভিং রুমের জন্যে সোফা কিনবোনে।