এবারের ঈদে বঙ্গ বাংলা সাম্প্রতিক উপন্যাস অবলম্বনে সিরিজাকারে কিছু টেলিফিল্ম নির্মাণ করেছে। উদ্যোগটা দারুণ। বাংলা নাটক-টেলিফিল্মের যে ধারা তৈরি হয়েছে এ সিরিজটা তার বাইরের কিছু। এবং যেহেতু উপন্যাস অবলম্বনে সেহেতু এখানে কাহিনির বৈচিত্র্য আশা করাই যায়।

সিরিজে মোট ৭টি টেলিফিল্ম আছে। প্রথমেই দেখলাম মাহবুব মোর্শেদ রচিত উপন্যাস ‘নোভা স্কসিয়া’ অবলম্বনে বানানো ‘মিস্টার কে’ টেলিফিল্মটি। পরিচালনা করেছেন ওয়াহিদ তারেক। আমার ধারণা, সবগুলি টেলিফিল্মের মধ্যে এটাই সব থেকে ওয়েল প্লটেড এবং স্মার্ট।

গল্পটা রহস্যময়, এবং অনুমান বিদ্যা নামে এক চিন্তা পদ্ধতিকে মূল ধরে আবর্তিত।

টেলিফিল্মের প্রধান চরিত্র পরিসংখ্যানবিদ প্রফেসর ড. আনাম (পার্থ বড়ুয়া)। তিনি কিডন্যাপড হন এবং পরে তাকে কনভিন্স করা হয় একজন স্বনামধন্য বিজনেসম্যানের ব্যাংক লকারের পাসওয়ার্ড উদ্ধার করতে। বিজনেসম্যান (শাহেদ) এর সন্তান মিজান জানতে চায় তার বাবার এমন সিদ্ধান্তের কারণ এবং মৃত্যুর আগে তার বাবার মাথায় কী চলতেছিলো।

‘মিস্টার কে’ টেলিফিল্মে কায়কোবাদের রেখে যাওয়া লকারের পাসওয়ার্ড উদ্ধার করতে ড. আনামকে কনভিন্স করছে মিজান

প্রফেসর আনামের স্পেশালিটি এখানে যে তিনি অনুমান বিদ্যা নামের এক বিশেষ বিদ্যার জনক। এটা ঠিক সায়েন্স নয়। বিজ্ঞানে যেমন পর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, অনুমান বিদ্যা এই জায়গাটাতে বিজ্ঞান থেকে আলাদা, আপাতত একটা হাইপোথিসিস।

কিন্তু এই অনুমান বিদ্যা কীভাবে কাজ করে?

অনুমান বিদ্যার কাজ অনেকটা আমাদের ইনটিউশনের মতো। হয়তো মনে একটা চিন্তা আসলো যার আপাত কোনো মূল্য নেই কিন্তু পরে দেখা যায় এই চিন্তার প্রেক্ষিতেই অনেক কিছু এখন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, এবং ঐ চিন্তাটা মামুলি ছিল না বরং গুরুত্বপূর্ণই ছিল।

এরকম অল্প তথ্য ও গুরুত্বহীন তথ্য ব্যবহার করে একটা অনুমান করা এবং আরো তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বিদ্যাটাই অনুমান বিদ্যা।

অনুমান বিদ্যা যেন অনেকটা লেখকদের চিন্তাপদ্ধতি যেমন, তেমন। যেমন একজন লেখক কিছু চরিত্র তৈরি করেন তারপর তিনি অনুমান বিদ্যার মাধ্যমেই চরিত্রগুলির ব্যাকগ্রাউন্ড ও প্রবণতা এবং চিন্তা/দর্শন আবিষ্কার করেন এবং সেভাবেই চরিত্রগুলিকে পরিচালিত করেন।

এবং অভিনয়শিল্পীরাও অনুমান বিদ্যার সাহায্যে তাদের চরিত্রকে আরও ভালোভাবে আয়ত্ত করে থাকেন।

এখানে ড. আনাম পাসওয়ার্ড অনুমান করার জন্য  বিজনেসম্যান খন্দকার কায়কোবাদের আইডেন্টিটি গ্রহণ করেন। এখন তিনি আর ড. আনাম নয়, তিনি বিজনেসম্যান কায়কোবাদ হিসেবে যাপন শুরু করেন।

এবং এ পরিচয়েই তিনি কায়কোবাদের বাড়িতে বাস করতে থাকেন, তার মতো চিন্তা করার ট্রাই করেন, কায়কোবাদের সন্তান, ভাই এবং পিএস (অর্ষা) এর সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যান নিয়মিত। এতে করে তার কিছু ভিশন হয় এবং সামান্য তথ্যের ক্লু থেকে তিনি কায়কোবাদের জীবনের অনেক ঘটনাই অনুমান করতে সক্ষম হন।

এখানে কায়কোবাদের মৃত্যুর একটা বিষয় আছে। যেহেতু তিনি মারা গেছেন এবং কাউকে না জানিয়ে একটা পাসওয়ার্ড রেখে গেছেন এবং তার একমাত্র সন্তানের সাথে তার বহুদিনের যোগাযোগ নেই সেক্ষেত্রে তার মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারাটা জটিলই হবে। এবং তার জীবনে নিশ্চয়ই এমন কিছু ব্যাপার থাকবে যা তাকে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করবে। এবং সে ব্যাপারগুলি অবশ্যই যন্ত্রণাদায়কই হবে।

এবং আরেকটা মেইন কনসার্ন হচ্ছে অপরের জীবন এভাবে যাপন করার রিস্ক থাকে, তার দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা তীব্রভাবে অনুভব করা গেলেই পরে তার চিন্তাকাঠামো বুঝতে পারা যাবে।

হলিউডের নায়িকা মনিকা বেলুচির সাথে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। একটা মুভির চরিত্রকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করতে সে চরিত্রটাতে এতই মনোনিবেশ করেন যে চরিত্রটার জীবন তথা ট্রমা এবং বাস্তবতা তার নিজের জীবনকে ছেয়ে ফেলে। তিনি কিছুতেই চরিত্রটা থেকে বের হতে পারছিলেন না। পরে বহুদিন চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে দূরে থেকে থেরাপি নিয়ে নিজেকে ঠিক করেন।

এমনকি আমি আমার বন্ধুদের মধ্যে দেখেছি যে বই/মুভি/সিরিজের কোন কোন চরিত্র ওদেরকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে। এবং এসব প্রভাব শক্তিশালী তা মানসিকতা, অ্যাটিটিউড (মনোভাব), ভাষা, (এমনকি) চেহারা পর্যন্ত বিস্তৃত।

যাই হোক, রহস্য সমাধানে অনুমান বিদ্যা আইডিয়াটা বাংলা সাহিত্য-সিনেমাতে নতুন। দেশি-বিদেশি রহস্য সমাধানের গল্পগুলিতে ডিডাকশানের মাধ্যমে অপরাধী ধরা হয় অথবা কখনো কখনো অনুমানের মাধ্যমে অপরাধীর অপরাধের মোটিভ বুঝতে অথবা অপরাধীর পরবর্তী স্টেপ প্রেডিক্ট করতে অনুমান ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এ টেলিফিল্মে বিষয়টা যেভাবে এসেছে ঠিক সেই প্রক্রিয়ায় নয়। বিদেশি সিনেমাতে হয়তো খুঁজলে এরকম উদাহরণ পাওয়া যেতে পারে। অন্যের লাইফ যাপন করে রহস্য সমাধান আইডিয়াটা অভিনব তা কিন্তু নয়, আমি এ পদ্ধতির সাথে পরিচিত এবং বিছিন্ন ভাবে অনেকগুলি হলিউডের মুভি/সিরিয়ালে এ বিষয়টা আমি দেখেছি। তবে বাংলা রহস্য নাটক বা টেলিফিল্মে অনুমান বিদ্যা নতুন।

অন্যের জীবন যাপন করার উদাহরণ হয়তো পাওয়া যাবে, যেমন ‘আয়নাবাজি’ বা অন্যান্য আরো। তবে মি. কে টেলিফিল্মের মতো অনুমান বিদ্যার মাধ্যমে রহস্য সমাধানের উদাহরণ নেই। এ ক্রেডিট এই গল্পের মূল লেখক মাহবুব মোর্শেদকেই দিতে হয়। বাংলা গোয়েন্দা গল্পে ড. আনাম চরিত্রটি নতুন সংযোজন। এবং সম্ভাবনাময়। ধারাবাহিকভাবে ড. আনামকে নিয়ে আরো গল্প আরো টেলিফিল্ম হতে পারে।

এ টেলিফিল্মের ডিরেকশনের টেকনিক্যাল দিক নিয়ে যদি বলি তাহলে বলতে হয়, যেসব স্থানে ঘটনাগুলি ঘটছে সেই লোকেশন নির্বাচনে অবহেলা আছে। বিশেষ করে কায়কোবাদের ছেলে মিজান-এর সাথে যেখানে ড. আনামের প্রথম দেখা হয়। হয়তো বাজেটজনিত ইস্যু আছে অথবা অবহেলাই। তাছাড়া থ্রিলারে সাউন্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিচারে সাউন্ড যে পারফেক্ট তা বলা যাচ্ছে না, ন্যাচারাল সাউন্ডগুলি বেশ ভালো আসলেও, থ্রিলিং সাউন্ড মিক্সিং রিদমিক ছিল না, অফবিট লেগেছে। থ্রিলার গল্প হিসেবে সিনেমাটোগ্রাফিতে একটা গভীরতা থাকার যে বিষয়টা, সেটা ছিল না। সম্ভবত এই কারণে দৃশ্যগুলি মনে দাগ কাটবে না।

আর প্লট হোল-এর কথা বলতে গেলে, টেলিফিল্মটি প্রায় ৭০ মিনিট। একটা পিচ পারফেক্ট থ্রিলার নির্মাণ করার জন্য এ সময় যথেষ্ট। অথচ এখানে অযথা অনেক তথ্য দেয়া হয়েছে, যা গল্প বা চরিত্রের স্বার্থ খুব একটা উদ্ধার করে নাই।

‘মিস্টার কে’ টেলিফিল্মে কায়কোবাদের পিএস লাবনীর কাছে রহস্য সমাধানে সাহায্য চাইছেন ড. আনাম। কায়কোবাদ মৃত্যুর আগে লাবনীকে তার কোম্পানির এমডি নির্বাচিত করে যান।

আমি সোর্স উপন্যাসটি পড়িনি, তাই এর অ্যাডাপশানের বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। কিন্তু টেলিফিল্মটি দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় এখানে সব থেকে চ্যালেঞ্জিং টাস্কটা হচ্ছে ড. আনাম যে কায়কোবাদের আইডেন্টিটিতে থাকবে সেটার দৃশ্যায়ন। বিষয়টা সম্ভব করতে প্রয়োজন দুর্দান্ত এডিটিং এবং পার্থ বড়ুয়ার পরিপূর্ণ অভিনয়, কিন্তু সেটা যথেষ্ট হয়নি। অল্প অল্প হয়েছে।

আর তাছাড়া যেহেতু উপন্যাস অবলম্বনে, ফলে বইয়ের ডায়লগ চরিত্রের কণ্ঠে আনতে যে একটা স্বাভাবিক অনুবাদের প্রয়োজন হয় সেটা করা হয়নি মনে হয়েছে। ফলে ডায়লগ ডেলিভারি প্রিটেনশাস লেগেছে, সিনেমাটিক মোশনকে তা ব্যহত করছে।

টেলিফিল্মটা দেখা যাচ্ছে বঙ্গ-তে। বঙ্গ অনেকদিন ধরেই ওটিটি মার্কেটে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। ‘বেসড অন বুক’ ধরনের উদ্যোগ বঙ্গকে সাহায্য করবে বলে আশা করি।

প্রথমে আমি ডেস্কটপে দেখা শুরু করেছিলাম। অ্যাড আসে ৩/৪ মিনিট পর পর, এবং অ্যাডগুলি চালু হলেই প্রচুর লাউড আওয়াজ আসে যা প্রচণ্ড বিরক্তিকর। পরে বঙ্গ-এর অ্যাপস ডাউনলোড করি, সেখানেও সেইম, প্রচুর অ্যাড। এবং টেলিফিল্মের শুরুতেই বিকাশ-এর দুই মিনিটের অ্যাড। এগুলি মুডকে প্রভাবিত করে। শুরুতে এমন কোনো ডিস্ট্রাকশান রাখা উচিত নয়। ভালো ভালো সিনেমার শুরুতে মিউজিক ও মোশনের মাধ্যমে দর্শকের মুড প্রভাবিত করে নেয়া হয়, এতে দর্শক রিল্যাক্স থাকে এবং গল্পে প্রবেশ করে। যদিও এরকম অ্যাডের ব্যাবসায়িক কারণ আছে, তবুও আমি ব্যক্তিগতভাবে এক্ষেত্রে সিনেমাটিক এক্সপিরিয়েন্সকে বেশি জরুরি মনে করি।

এরপরে দেখবো ‘বেসড অন বুক’ টেলিফিল্ম শিবব্রত বর্মন-এর ‘আলিবাবা ও চালিচোর’। আর তারপরে শাহাদুজ্জামান-এর দুটি গল্প অবলম্বনে ‘এক টুকরো রোদ’।

(‘মিস্টার কে’-এর বঙ্গ বব লিংক : https://bongobd.com/watch/7v6O5qxaXvZ)