এমনকি প্রাণীদের আচরণের উদ্দেশ্যও বেশ জটিল হতে পারে। আর এদিক দিয়ে উঁচু স্তরের প্রাইমেট হিসেবে মানুষের আচরণের পেছনে আরো গভীর উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে।

প্রাণীরা নিজেদের অস্তিত্বের ব্যাপারে সচেতন কিনা, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। কিন্তু আমরা সবাই একমত যে, মানুষ নিজের অস্তিত্বের ব্যাপারে সচেতন। সজাগ থাকা অবস্থায় আমরা বিভিন্ন ধরনের কাজ করি। এতে মনে হয় আমাদের স্বেচ্ছায় করা প্রায় প্রতিটা কাজের পেছনেই একটা সচেতন উদ্দেশ্য আছে।

সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর গবেষণা থেকে আমরা বুঝতে পারি, মাঝে মধ্যে অবচেতন মন (সাবকনশাস) আমাদের কাজ ও সিদ্ধান্তের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু সামাজিক জীবনে নানান কাজ ও কথার পেছনে সচেতনভাবে বিভিন্ন উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার সময় অবচেতন মন আমাদেরকে বাধা দেয় না। কাজেই, কেউ যখন বলে, আমরা যা কিছু বলি অথবা জানি তা আসলে আমাদের উদ্দেশ্য না, তখন সেটা মেনে নিতে কষ্ট হয় (গবেষণা: গাজানিগা, ২০১১)। তা সত্ত্বেও এরকম হওয়া কি সম্ভব?

“দ্য এলিফেন্ট ইন দ্য ব্রেইন: হিডেন মোটিভস ইন এভরিডে লাইফ” বইটাতে কেভিন সিমলার ও রবিন হ্যানসন দেখাতে চেয়েছেন সামাজিক জীবনে আমরা যেসব আচরণ করি, তার পেছনে এমন অনেক উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যার ব্যাপারে আমরা সচেতন নই।


জিং ঝ্যাং
ফন্ট্রিয়ার, ৩০ মার্চ ২০২১
অনুবাদ: মাহতাবুল আলম


বইটির আসল শিরোনাম এসেছে একটি ইংরেজি প্রবাদ থেকে, “দ্য এলিফেন্ট ইন দ্য রুম” (বাংলায় ‘রুমের মধ্যে হাতি’)। সমাজে স্পষ্ট একটা সমস্যা এড়িয়ে চলার যে প্রচলন আছে, প্রবাদটি দিয়ে সেটাই বোঝানো হয়। এভাবে “দ্য এলিফেন্ট ইন দ্য ব্রেইন” (বাংলায় ‘মাথার মধ্যে হাতি’) নামটি ব্যবহার করে লেখকরা বোঝাতে চেয়েছেন, আমাদের মস্তিষ্কে থাকা একটা কিছুর প্রতি আমরা সচেতন নই।

বইটির প্রথম অংশ বা পার্ট-১ এর শিরোনাম হচ্ছে “আমরা কেন আমাদের ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যকে লুকিয়ে রাখি”। এই অংশে দেখানো হয়েছে আমাদের কাজের পেছনে নানান উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু আমরা এর মধ্যে শুধুমাত্র ভাল ও সমাজে গ্রহণযোগ্য উদ্দেশ্যগুলির দিকে মনোযোগ দেই। সেগুলিই ফলাও করে বলে বেড়াই। অথচ মন্দ ও স্বার্থপর উদ্দেশ্যগুলি চেপে যাই।

দ্য এলিফেন্ট ইন দ্য ব্রেইন: প্রতিদিনের জীবনের গোপন উদ্দেশ্য

লেখকদ্বয় পশুদের সামাজিক আচরণ নিয়ে আলোচনা করে বইটা শুরু করেন। অধ্যায় ১ এর শিরোনাম হল “পশুদের আচরণ”। প্রাইমেটরা স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে যতটা দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় একসঙ্গে কাটায়। এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, সামাজিক মেলামেশার ফলে বিভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্য পূরণ হয়। যেমন, এতে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব তৈরি হয়। আর এই ঐক্যের ফলে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সুবিধা পাওয়া যায় (গবেষণা: ডানবার, ২০১০)।

এরপর প্রাণীরা অন্যের উপকার করতে গিয়েও যে প্রতিযোগিতা করে, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখকদ্বয়। কিছু প্রাণী আছে যারা সঙ্গীদের খাদ্য ও নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করে থাকে। এরকম উদাহরণ টেনে সিমলার ও হ্যানসন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, এমনকি প্রাণীদের আচরণের উদ্দেশ্যও বেশ জটিল হতে পারে। আর এদিক দিয়ে উঁচু স্তরের প্রাইমেট হিসেবে মানুষের আচরণের পেছনে আরো গভীর উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে।

আরো পড়ুন: যে কারণে আগাথা ক্রিস্টির ‘অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়ের নান’ একটি মাস্টারপিস

অধ্যায় ২ এর শিরোনাম হচ্ছে “প্রতিযোগিতা”। এই অধ্যায়েও বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা হয়েছে। মানুষের আচরণ গঠিত ও পরিচালিত হয় বিবর্তন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় অনুসারেই। আর বিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের পূর্বপুরুষদের তিনটা প্রধান প্রতিযোগিতা ছিল সম্ভবত যৌনতা, সামাজিক অবস্থান ও রাজনীতি নিয়ে। তবে যে বিষয় নিয়ে বা যেভাবেই প্রতিযোগিতা হোক না কেন, একই প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে প্রায়ই অনেক সম্পদ নষ্ট বা অপচয় হয়। আর অপচয় কমানোর জন্যই মানুষ ‘নর্ম’, আদর্শ বা আচরণের স্বীকৃত প্রথা তৈরি করেছে।

“যে বিষয় নিয়ে বা যেভাবেই প্রতিযোগিতা হোক না কেন, একই প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে প্রায়ই অনেক সম্পদ নষ্ট বা অপচয় হয়। আর অপচয় কমানোর জন্যই মানুষ ‘নর্ম’, আদর্শ বা আচরণের স্বীকৃত প্রথা তৈরি করেছে।”

অধ্যায় ৩ এর শিরোনাম “নর্মস” বা “আদর্শ”। [লেখায় এরপর থেকে ‘নর্ম’ শব্দটার বাংলা হিসেবে ‘আদর্শ’ ব্যবহার করা হবে।-অনুবাদক] এই অধ্যায়ে ‘আদর্শ’ গঠনের ইতিহাস অনুসন্ধান করা হয়েছে, ব্যাখ্যা করা হয়েছে কেন আমাদের ‘আদর্শ’ প্রয়োজন। পরচর্চা ও মর্যাদা কীভাবে ‘আদর্শ’ তৈরিতে ভূমিকা রাখে, সেটাও আলোচনা করা হয়েছে। কাগজে কলমে বা তত্ত্ব অনুসারে, সফলভাবে আদর্শ চাপিয়ে দেয়া গেলে মাথা আরো কম খাটাতে হয় বা মস্তিষ্কের ব্যবহার কমে যায়। তবে সত্যিটা হচ্ছে, সঙ্কুচিত হওয়ার পরিবর্তে মানুষের মস্তিষ্ক দিন দিন আরো বড় হচ্ছে। এবং অপেক্ষাকৃত বড় মস্তিষ্কের কাজ করতে আরো বেশি শক্তির প্রয়োজন হয়। কাজেই, এ বিষয়টা মানুষের টিকে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয়—এছাড়াও অন্য যেসব কারণ আমাদের টিকে থাকার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে, তার মধ্যে একটি হল প্রতারণার অস্তিত্ব।

অধ্যায় ৪ এর নাম হচ্ছে “প্রতারণা”। এই অধ্যায়ে লেখক দুইজন ঘোষণা দিচ্ছেন, “প্রত্যেকেই প্রতারণা করে।” জোর করে যারা আদর্শ চাপিয়ে দেয় আর যারা সেসব আদর্শ এড়িয়ে চলতে চায়, তাদের নিজেদের মধ্যে একধরনের পারস্পরিক বিধিনিষেধ থাকে, যা তাদের মানসিক দক্ষতার উন্নতি ঘটায় (গবেষণা: ট্রিভার্স, ২০১১)।

বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা আছে। যেমন পরীক্ষা দিতে গিয়ে প্রতারণা, জালিয়াতি বা নকল করা হচ্ছে আদর্শ এড়িয়ে যাওয়ার একটা কৌশল। পরীক্ষার হলে থাকা অধ্যাপকের মত একজন বিশেষ ব্যক্তি এই প্রতারণা ধরতে পারছেন কিনা, তার ওপর বিষয়টা নির্ভর করে। আবার পাবলিক প্লেসে মদ্যপান করাটা নির্ভর করে কতজন লোক দেখছে তার ওপর। তবে এর বাইরেও আরেকটা বিশেষ ধরনের প্রতারণা হল “আত্ম-প্রতারণা” বা নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা।

অধ্যায় ৫-এ লেখকেরা “আত্ম-প্রতারণা”র উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুটি অনুমান বা হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছেন। প্রথমটাতে “আত্ম-প্রতারণা”কে আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এবং পরেরটাতে আত্ম-প্রতারণাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে নিজেকে বুঝ দেয়া, নিজের স্বার্থ রক্ষা করা এবং সর্বোপরি বাহ্যিক বা বহির্মুখী এক কৌশল হিসেবে।

দ্বিতীয় এই হাইপোথিসিস-এ যেই আরেকটা বিষয় পরিষ্কার করা হয়েছে, তা হল আত্ম-প্রতারণা অন্তর্মুখী, আত্মরক্ষামূলক বা কোনো কাজে নিজেকে ব্যর্থ প্রমাণ করার কৌশল না। উপরন্তু একই ধরনের তত্ত্ব ফ্রয়েডও প্রস্তাব করেছিলেন। আর লেখকরাও দ্বিতীয় হাইপোথিসিসকেই বেশি সমর্থন দিয়েছেন। তারা দেখিয়েছেন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে আত্ম-প্রতারণা করি, যার মধ্যে অনুপ্রেরণার সঙ্গে যুক্ত আত্ম-প্রতারণা আমাদের জন্যে প্রয়োজনীয়।

“লেখকরা দেখিয়েছেন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে আত্ম-প্রতারণা করি, যার মধ্যে অনুপ্রেরণার সঙ্গে যুক্ত আত্ম-প্রতারণা আমাদের জন্যে প্রয়োজনীয়।”

অধ্যায় ৬ এর নাম “ভুয়া কারণ”। আমরা সুকৌশলে আমাদের উদ্দেশ্যগুলি এড়িয়ে যাই। অন্য কথায়, আমাদের কাজের পেছনের কারণগুলি আমরা সব সময় জানি না, কিন্তু জানার ভান করি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা যে শুধুমাত্র জানার ভান করে যাচ্ছি, সেটাও লক্ষ্য করি না।

আরো পড়ুন: টাসকান চাইল্ড: রিস বোয়েনের গুপ্তশিশু

প্রথম অংশ বা পার্ট-১ এ লেখকরা আমাদেরকে মাথার ভেতরে থাকা হাতিটার মুখোমুখি দাঁড় করান। তারা দেখান কীভাবে এই হাতি জন্ম নেয় আমাদের মস্তিষ্কে। আর তা দেখাতে গিয়ে তারা মাইক্রো সোশলজি বা ক্ষুদ্রতর পরিসরে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, প্রাইমেটোলজি (উঁচু বর্গের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্র) এবং অর্থনীতির মত ক্ষেত্র থেকে গবেষণা ও তথ্য উল্লেখ করেছেন।

মোটকথা “দ্য এলিফেন্ট ইন দ্য ব্রেইন” বা “মাথার মধ্যে হাতি” বাক্যটা দিয়ে মানুষের স্বার্থপরতা এবং এ ধরনের বিভিন্ন ধারণাকে বোঝানো হয়েছে। বইয়ের পরের অংশ, অর্থাৎ পার্ট-২ রচিত হয়েছে “হিডেন মোটিভস ইন এভরিডে লাইফ” বা “প্রতিদিনের জীবনের গোপন উদ্দেশ্য” নিয়ে। এই অংশে লেখকরা নানান উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে এই হাতি আমাদের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

দ্য এলিফেন্ট ইন দ্য ব্রেইন
 লেখক কেভিন সিমলার ও রবিন হ্যানসন

পার্ট-২ এ যে ১০টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলি হল “দেহের ভাষা” বা “বডি ল্যাংগুয়েজ”, “হাসি”, “কথোপকথন”, “ভোগ”, “শিল্প”, “দানশীলতা”, “শিক্ষা”, “চিকিৎসা”, “ধর্ম” ও “রাজনীতি”। আমাদের সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লেখকরা প্রথমে প্রত্যেকটি বিষয়কে সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যের সাথে যুক্ত করার পরে দেখিয়েছেন যে, এসব উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এবং শেষে গিয়ে এসবের পেছনে থাকা বিকল্প উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন।

পার্ট-২ এর প্রতিটা অধ্যায়ই একটা আরেকটার থেকে আলাদা। পাঠকরা তাদের আগ্রহ বা ইচ্ছা অনুসারে যেকোনো অধ্যায় আগে বা পরে পড়তে পারেন, তাতে তাদের বুঝতে কোনো সমস্যা হবে না। গোপন উদ্দেশ্যগুলির গুরুত্ব এবং এগুলি কতটা সার্বজনীন, তা নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি আমাদের মস্তিষ্কের হাতিটার মুখোমুখি হওয়ার উদ্দেশ্যও ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ বইয়ে। লেখকদের মতে, নিজেদের স্বার্থপরতার পেছনে অজুহাত দাঁড় করানোর চেয়ে বরং আমাদের আচরণ উন্নত করে তোলাটাই হাতিটার মুখোমুখি দাঁড়ানোর পেছনে মূল লক্ষ্য।

এই বইটার উল্লেখযোগ্য অংশই হচ্ছে মানুষের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে তাদের আচরণের পেছনে গোপন উদ্দেশ্য আছে কিনা তা পরীক্ষা করা। তবে লেখকরা তাদের যুক্তির স্বপক্ষেই বিভিন্ন প্রমাণ হাজির করেছেন। যেমন, তৃতীয় পক্ষ জানুক আর না’ই জানুক অথবা টাকার পরিমাণ যতই হোক না কেন, নিজের জন্য খরচ করার চেয়ে অন্যের জন্যে টাকা খরচ করলে মানুষ বেশি সুখী হয় (গবেষণা: ডান প্রমুখ, ২০০৮)। শুধুমাত্র গোপন উদ্দেশ্য দিয়ে মানুষের এ ধরনের আচরণ পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না।

সবশেষে বলা যায়, পড়ার মতই একটা বই এটা। সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অথবা এ ধরনের বিষয়ে যাদের আগ্রহ আছে কিংবা যাদের আগ্রহ পেশাগত কারণে, সবাই পড়তে পারেন এই বই।

The Elephant in the Brain: Hidden Motives in Everyday Life
Kevin Simler and Robin Hanson
(New York, NY: Oxford University Press), 2018, 416 pages