কাক ও দাঁড়কাকের মধ্যে গুরুতর পার্থক্য আছে। কাকদের গড় আয়ু যেখানে ৮, দাঁড়কাকের সেখানে ৩০। এবার নতুন একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, আমরা যতটা মনে করে থাকি, দাঁড়কাকের সামাজিক দক্ষতা তার থেকে অনেক বেশি। তারা নিজেদের মধ্যে সামাজিক গতিশীলতা বজায় রাখতে পারে, যা এর আগে কেবল মানুষের মধ্যেই দেখা গেছে।
সম্প্রদায়ে কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ
ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জর্গ ম্যাসেন এবং তার সহকর্মীরা পাখিদের সামাজিক দক্ষতা বিষয়ে আরো বেশি জানার লক্ষ্যে দাঁড়কাক নিয়ে কাজ করছিলেন।
দাঁড়কাক সমাজবদ্ধভাবে বাস করে। নেচার কমুনিকেশনস-এ প্রকাশিত তাদের গবেষণায় জানা যায়, তারা দেখতে চাইছিলেন দাঁড়কাকেরা নিজেদের সমাজের মধ্যে সম্পর্কগুলি বোঝার মত যথেষ্ট বুদ্ধিমান কিনা। সেই সাথে দাঁড়কাকেরা যে-সমাজের অংশ নয় সেই সমাজকে আলাদা করতে পারে কিনা।
কোনো সম্প্রদায়ের দাঁড়কাকেরা তাদের র্যাংক বা মর্যাদা অনুসারে কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ করে থাকে। উচ্চ মর্যাদার কাকেরা খাদ্য এবং অন্যান্য দিক থেকে বেশি সুবিধা পায়। পুরুষরা সবসময়ই নারী দাঁড়কাকদের বেশি মর্যাদা দেয় এবং ঝগড়া বা বাদানুবাদ সাধারণত একই লিঙ্গের কাকদের মধ্যে হয়ে থাকে।
উচ্চ মর্যাদার দাঁড়কাকদের মাধ্যমে এই বাদানুবাদ বা ঝগড়া শুরু হয়। একটি নির্দিষ্ট ধরনের ডাক দিয়ে তারা নিচু মর্যাদার কাকদের মাঝে নিজদের কর্তৃত্ব জাহির করে। সাধারণত নিচু মর্যাদার কাকেরা উঁচু মর্যাদার কাকদের সামাজিক উচ্চ স্থানের স্বীকৃতি দিয়ে বিশেষ ধরনের ডাক দেয়। এই প্রক্রিয়ায় কর্তৃত্বের অধিকারী দাঁড়কাক নিজের সামাজিক অবস্থান টিকিয়ে রাখা নিশ্চিত করে।
কিন্তু মাঝে মাঝে নিচু মর্যাদার কাক কর্তৃত্বের ডাকে নতি স্বীকার করে সাড়া দেয় না। এর ফলে একটা বাদানুবাদ বা সালিশ ঘটে, এবং এটি দাঁড়কাক সম্প্রদায়ের সামাজিক কাঠামো বদলে দিতে পারে।
ম্যাসেন এবং তার দল কিছু দাঁড়কাককে আটকে রেখে তাদের ঝগড়া রেকর্ড করেন। এর মধ্যে ছিল সাধারণ ঝগড়া (যে ঝগড়াগুলিতে নিচু মর্যাদার কাকেরা কর্তৃত্বের নতি স্বীকার করে জবাব দেয়) এবং প্রতি-কর্তৃত্বের ঝগড়া। একই পদ্ধতিতে অন্য জায়গায় রাখা আরেকটি দাঁড়কাক-গ্রুপের ডাক রেকর্ড করা হয়।
এরপর গ্রুপ থেকে কিছু কাককে আলাদা করে রাখা হয়। এরপর রেকর্ড করা ডাকগুলি বাজানো হয়, একটি কাকের আড়ালে আরো দুইটি কাক বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছে এরকম আবহ তৈরি করা হয়।
ম্যাসেন বলেন, তারা সাধারণ কর্তৃত্বের ডাক ও প্রতি-কর্তৃত্বের ডাকের প্রতি অন্য রকম প্রতিক্রিয়া দেখায় কিনা তা আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি। অন্য গ্রুপের একই আচরণে তারা কী প্রতিক্রিয়া দেখায় তা জানার জন্য আমরা অন্য গ্রুপের কাকদের রেকর্ডিংসগুলিও ব্যবহার করেছি।
সম্পর্কের চাপ
যখন কাকদের নিজেদের দল থেকে প্রতি কর্তৃত্বের বা বিপরীত কর্তৃত্বের রেকর্ড ছাড়া হয়েছিল তখন কাকেরা হাল ছেড়ে দেয়ার মত আচরণ করেছে। কারণ তারা তাদের সামজিক কর্তৃত্বে একটি বিশৃঙ্খলা প্রত্যাশা করেছিল। কাকদের ইতস্তত ঘোরাঘুরি বা নিজেদের পালক ঠোকরানোর মধ্য দিয়ে এই হাল ছেড়ে দেয়ার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে।
কাকেরা আরো বেশি হতাশ হওয়ার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে যখন একই লিঙ্গের সদস্যদের প্রতি-কর্তৃত্বের ডাকের রেকর্ড চালু করা হয়। এর একটি অর্থ আছে, কারণ শুধুমাত্র একই লিঙ্গের কাকদের মধ্যে কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দুটি নারী কাকের মধ্যে বিবাদ হলে কোনো পুরুষ কাকের সামজিক অবস্থানে তার কোনো প্রভাব পড়ে না, কিন্তু অন্যান্য নারী কাকদের ওপর এর প্রভাব পড়ে।
যখন প্রতি-কর্তৃত্বের রেকর্ডিং ছাড়া হয়েছিল তখন নারী কাকেরা পুরুষ কাকের চেয়ে বেশি হতাশ আচরণ করেছে। এর কারণ হতে পারে যে, দাঁড়কাক সমাজে নারী কাকের মর্যাদা পুরুষ কাকের চেয়ে কম। কাকসমাজে মর্যাদার অদল-বদল ঘটলে নারী কাকের মর্যাদা আরো কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এতে প্রথমেই কমে যায় খাদ্য সুবিধা।
কিন্তু সবচেয়ে মজার যে জিনিসটি পাওয়া গেছে সেটি হল, কাকেরা অন্যান্য আলাদা গ্রুপে কর্তৃত্ব বদল হওয়ার ঘটনা খেয়াল করে, যদিও তাদের আচরণে এর প্রভাব অত বেশি না। শুধুমাত্র আওয়াজের দিক থেকে পার্থক্য থাকায় কাকেরা আলাদাভাবে ডাকগুলি শনাক্তই করে না, এটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ম্যাসেন কর্তৃত্ব বদলের নয় এমন ডাকের রেকর্ড প্লে করেন, তিনি দেখতে পান এতে কাকেরা হতাশ হয় না বা হাল ছেড়ে দেয় না।
আরো পড়ুন: কোনো কোনো প্রাণী কি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম?
ম্যাসেন বলেছেন, এতে বোঝা যায় দাঁড়কাকেরা তাদের সাথে কখনো কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় নি এমন গ্রুপের সাথে তাদের সম্পর্কের একটি মানসিক উপস্থাপন ঘটাতে সক্ষম। এটি আমাদের টেলিভিশন দেখার মত ব্যাপার। বানরদের মধ্যেও এরকম দেখা যায় নি।
তবে সেখানে সীমাবদ্ধতাও আছে। এক্সটার বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালেক্স থর্নটন বলেন, গবেষণার ফলাফল নিশ্চিতভাবেই উত্তেজনাকর, কিন্তু এটা নিশ্চিত হতে হবে যে কিছু কাক আলাদা করার পর তাদের ব্যবহার করা হয়েছিল। এত কাছাকাছি একে অন্যের সাথে তাদের রাখার কারণে হয়ত কাকদের একে অন্যের ব্যবহার বিচার করার ক্ষমতা বেড়ে গিয়েছিল।
কাকদের মানুষের মত সামাজিক দক্ষতা রয়েছে, এ ব্যাপারটির সাথে সাথে আরেকটি ব্যাপারের ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, সামাজিক সম্প্রদায়ের উন্নতির সাথে সাথে হয়ত কাকদের বুদ্ধি বিবর্তিত হয়েছে।
আরো পড়ুন: বছরে ১০০ কোটি পাখিমৃত্যু—জানালার কাচের কারণে
ম্যাসেন বলেছেন, বুদ্ধিমান হওয়ার কারণে দাঁড়কাকেরা সমাজের মধ্যে রাজনীতি চালু রাখতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তাদের গ্রুপের সদস্যদের মর্যাদা বুঝতে পারার ব্যাপারটি কাকদের কোন কাকটিকে বেছে নিতে হবে, কোন কাকটির সাথে দল গঠন করতে হবে এবং কর্তৃত্ব অর্জনের সময় কোন কাকটিকে বাদ দিতে হবে তা নির্ধারণ করতে সাহায্য করে।