১৯৪৭ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কারের পরেও তাদেরকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে যাতে সিফিলিসের ভয়াবহতা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে নেওয়া যায়।

টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্ট (১৯৩২-১৯৭২) — কুখ্যাত সিফিলিস গবেষণা
‘টাস্কিগি  সিফিলিস স্টাডি’র  সাবজেক্টের হাত থেকে রক্ত নিচ্ছেন চিকিৎসক (১৯৫৩)। লোকটিকে প্রতারণা করা হচ্ছে এভাবে যে, এই রক্তের নমুনা সংগ্রহ তার চিকিৎসার অংশ।
১৯৩২ সালে সিফিলিস ছিল ভয়ঙ্কর যৌন সংক্রামক রোগ, যার কোনো চিকিৎসা ছিল না। সে সময়ে অ্যালাবামা শহরের মেকন কাউন্টির ৬০০ আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষকে ফ্রি মেডিক্যাল কেয়ার দেবার কথা বলে তাদের ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয়। তাদের শরীরে ইনজেক্ট করা হয় সিফিলিস রোগের জীবাণু।

এই হতভাগ্য মানুষদের অধিকাংশই ছিলেন বর্গাচাষী। যারা এর আগে কখনো ডাক্তারের কাছেই যাননি। এই স্টাডি (টাস্কিগি  সিফিলিস স্টাডি) পরিচালনা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের পাব্লিক হেলথ সার্ভিস (PHS)। তারা এই ৬০০ জনকে জানিয়েছিল তাদের শরীরে খারাপ রক্ত (Bad Blood) এসেছে। তাদেরকে সেটার চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ওই অঞ্চলে সে সময়ে নতুন অজানা অসুখকে খারাপ রক্ত বলে ডাকা হত।


এলিজাবেথ নিক্স


স্টাডিতে অংশ নেয়া পুরুষদের প্ল্যাসিবো হিসেবে স্বাস্থ্যকর্মীরা কেবল এসপিরিন আর মিনারেল সাপ্লিমেন্ট দিতেন। যদিও ১৯৪৭ সালে পেনিসিলিন সিফিলিস রোগের ওষুধ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, কিন্ত গবেষণা যাতে প্রভাবিত না হয় সেজন্য পাবলিক হেলথ সার্ভিসের গবেষকরা লোকাল ডাক্তারদের নির্দেশ দেন, তাদের সাবজেক্টদের যাতে কোনো প্রকার চিকিৎসা না দেওয়া হয়। এরপর তারা গবেষণাটি টাস্কিগি ইন্সটিটিউটের অধীনে নিয়ে যান।

টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্ট (১৯৩২-১৯৭২) — কুখ্যাত সিফিলিস গবেষণা
১৯৫০-এ টাস্কিগিতে সিফিলিস গবেষণার শিকার পুরুষদের ছবি। ১৯৪৭ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কারের পরেও তাদেরকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে যাতে সিফিলিসের ভয়াবহতা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে নেওয়া যায়।

রোগের সম্পূর্ণ গতি প্রকৃতি বোঝার জন্য গবেষকরা সাবজেক্টদের কোনো প্রকার চিকিৎসা দেননি। ফলে অনেকে মারা যান, অনেকে অন্ধ হয়ে যান, কেউ পাগল হয়ে যান, কেউ সিফিলিসের জটিলতা থেকে সৃষ্ট অন্য মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হন।

ষাট দশকের মাঝামাঝিতে সান ফ্রান্সিসকোতে পাবলিক হেলথ সার্ভিসের যৌন সংক্রামক রোগের ইনভেস্টিগেটর পিটার বাক্সটন টাস্কিগি স্টাডির ব্যাপারে জানতে পারেন। তিনি তার সিনিয়রদের কাছে শংকা প্রকাশ করেন যে এখানে অনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছে। এরপর এই স্টাডির ওপর রিভিউ করার জন্য হাই অফিসিলাররা একটা কমিটি গঠন করে দেন। কিন্ত শেষ পর্যন্ত তারা এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত দেন যাতে সকল অংশগ্রহণকা মারা গেলে তাদের ময়নাতদন্ত করে প্রজেক্টের ডেটা পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন: পেটের ভেতরে আপনার দ্বিতীয় মস্তিষ্ক

বাক্সটন তখন বিষয়টা তার এক রিপোর্টার বন্ধুকে জানান। সেই বন্ধু আবার বিষয়টা জানান এসোসিয়েটেড প্রেসের জন হেলারকে। হেলার ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে এই বিষয়টি পুরো দুনিয়ার সামনে নিয়ে আসেন। ফলে গণরোষের মুখে অবশেষে বন্ধ হয় এই অনৈতিক স্টাডি।

কিন্ত এর মধ্যে ২৮ জন সিফিলিসের কারণে মারা গিয়েছিলেন। আরো ১০০ জন সিফিলিস জনিত অন্য রোগের কারণে মারা যান, ৪০ জনের স্ত্রীর মধ্যে এই রোগ সংক্রমিত হয় এবং সিফিলিস নিয়ে জন্ম হয় ১৯ জন শিশুর।

টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্ট (১৯৩২-১৯৭২) — কুখ্যাত সিফিলিস গবেষণা
হোয়াইট হাউজ, ১৯৯৭ সালের ১৬ই মে। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন টাস্কিগি এক্সপেরিন্টের ট্র্যাজেডির শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্য ক্ষমা চেয়ে ভাষণ দেয়ার অনুষ্ঠানে হার্মান শ’ কথা বলছেন।

১৯৭৩ সালে কংগ্রেসে টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে শুনানী হয়। এর ফলশ্রুতিতে পরের বছর এক্সপেরিমেন্টের অংশ করা জীবিত ব্যক্তিদের এবং মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারদের ১০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সময় আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ইউএস সরকারের ফান্ডে পরিচালিত সকল রিসার্চ প্রজেক্টে মানুষকে সাবজেক্ট হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন গাইডলাইন আরোপ করা হয়।

টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্টের একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব সেই সময় আফ্রিকান আমেরিকান গোষ্ঠীর মধ্যে পড়েছিল। তারা তাদের সরকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও ভ্যাকসিন সিস্টেমকে অবিশ্বাস করা শুরু করে। ১৯৯৭ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে একটি ভাষণ দেন। যেখানে তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরকার খুব ভুল একটা কাজ করেছিল—যেটা ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর অনৈতিক কাজ। এই লজ্জাজনক অতীতের কথা ভেবে আমরা আমাদের ক্ষতিপূরণ ও সংশোধন করতে পারি। এই শিক্ষা নিয়ে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে সুন্দর করার চেষ্টা চালাতে পারি।” ক্ষমা প্রার্থনা করতে গিয়ে ক্লিনটন তার ভাষণে টাস্কিগি ইউনিভার্সিটিতে ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োইথিক্স ইন রিসার্চ অ্যান্ড হেলথ কেয়ার প্রতিষ্ঠারও প্রতিশ্রুতি দেন। ২০০৪ সালে টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্টের শিকার সর্বশেষ মানুষটি মারা যান।

টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্ট (১৯৩২-১৯৭২) — কুখ্যাত সিফিলিস গবেষণা
মার্কিন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরিসংখ্যান কর্মকর্তা ড. বিল জেনকিনস (১৯৪৫-২০১৯) টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে জানতে পারেন ১৯৬৭ সালের কিছু পরে, তার এক সহকর্মীর কাছ থেকে। ড. জেনকিনস কাগজপত্র ঘেটে দেখতে পান এ বিষয়ে ডজন খানেক মেডিক্যাল আর্টিকেলও পাওয়া যায়। যখন বুঝতে পারেন এটি কোনো গোপন বিষয়ও না, তখন তিনি তার উর্ধতন কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। তাকে এই বিষয়ে চিন্তা করতে নিষেধ করা হয়। বিল তখন সহকর্মী পিটার বাক্সটনকে ঘটনা জানান।

টাস্কিগি ছাড়াও সিফিলিস নিয়ে আরো কিছু অনৈতিক স্টাডি হয়েছিল খোদ যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং কয়েকজন ফেডারেল অফিসিয়াল যুক্তরাষ্ট্রের স্পন্সরে গুয়াতেমালায় এক এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চলা এই এক্সপেরিমেন্টে সাবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয় ৭০০ জন নারী পুরুষ—এরা ছিল বন্দি, সৈন্য, মানসিক অসুস্থ। তাদের কারো কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে তাদের শরীরে প্রবেশ করানো হয় সিফিলিসের জীবাণু। এই স্টাডির অংশ হিসেবে আরো কয়েকশ মানুষের শরীরে অন্য যৌন সংক্রামক রোগের জীবাণু প্রবেশ করানো হয়েছিল।

স্টাডিটির উদ্দেশ্য ছিল পেনিসিলিন সিফিলিসের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে কিনা তা পরীক্ষা করা। স্টাডিতে অংশ নেয়া অনেক সাবজেক্টকেই কোনো প্রকার চিকিৎসা সুবিধা দেয়া হয়নি। গুয়াতেমালা সরকারের সহযোগিতায় পরিচালিত এই রিসার্চের ফল কখনো প্রকাশিত হয়নি। বরং এই রিসার্চের হেড হিসেবে নেয়া হয়েছিল আমেরিকান পাব্লিক হেলথের গবেষক ডক্টর জন কাটলারকে, পরবর্তীতে তিনিই টাস্কিগি এক্সপেরিমেন্টের প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করেন।

আরো পড়ুন: ভাইরাস আসলে কী? 

পিটার বাক্সটন (জন্ম: ১৯৩৭)

২০০৩ সালে কাটলার মারা গেলে, ইতিহাসবিদ সুসান রিভারবি গুয়াতেমালা স্টাডি এবং টাস্কিগি স্টাডির মধ্যকার যোগসূত্র উদঘাটন করেন। তিনি ২০১০ সালে তার বের করা ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের অফিসিয়ালদের জানান। এর কিছুদিন পরেই তৎকালীন সেক্রেটরি অফ স্টেট হিলারি ক্লিনটন, সেক্রেটরি অফ হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস ক্যাথলিন সেবেলিউস এই ইস্যু নিয়ে পাবলিকলি ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্টের কাছে নিজে ক্ষমা চান।

সূত্র. হিস্ট্রি ডটকম,  ১৫ ডিসেম্বর ২০২০
অনুবাদ: আমিন আল রাজী