ভালো টাইম ম্যানেজমেন্ট বা সময় ব্যবস্থাপনা স্কিল রপ্ত করার অর্থ ‘একদিনে যত বেশি সম্ভব কাজ করা’ নয়।
টাইম ম্যানেজমেন্ট টেকনিকগুলির লক্ষ্য আপনার কাজ আরো সহজ করে দেয়া। আপনি যাতে দিনের কাজ আরো দ্রুত, আরো ভাল ভাবে শেষ করতে পারেন। আপনার হাতে যেন ‘ফ্রি টাইম’ কাটানোর স্বাধীনতা থাকে। বিশ্রামের জন্য, হাঁটাচলার জন্য আরো বেশি সময় থাকে।
বিষয়টা হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম না করে স্মার্ট উপায়ে কাজ করা।
ড্যান সিলভেস্টার
অনুবাদ: আমিন আল রাজী
দিনে আমরা ২৪ ঘণ্টা পাই কাজ করার জন্য। এই সময়টা আমরা কীভাবে ব্যয় করব সেটাই আসলে ঠিক করে দেয় জীবনে আমরা আসলে কী করতে চাই।
আমরা সময় জমিয়ে রাখতে পারি না, আরেকজনের কাছ থেকে ধার করতে পারি না কিংবা পরে ব্যবহারের জন্যও রেখে দিতে পারি না। আমরা কেবল সিদ্ধান্ত নিতে পারি যা হাতে আছে, সেটা সঠিকভাবে ব্যয় করব নাকি না।
সময় ব্যবস্থাপনার পুরো বিষয়টাই হচ্ছে সিদ্ধান্তের—কোন প্রজেক্ট আরম্ভ করব, কোনটা শেষ করব, কোন রুটিন মেনে চলব ইত্যাদি।
“সময় ব্যবস্থাপনা বলতে আলাদা করে কোনো কাজ বা দক্ষতা বোঝায় না। বরং এটাই সেই মূল দক্ষতা যার উপর জীবনের বাকি সব কিছু নির্ভর করে।”
—ব্রায়ান ট্রেসি
আমি আপনাদেরকে সঠিকভাবে সময় ব্যবহার করার জন্য আমার প্রিয় কিছু টেকনিকের কথা বলব। আপনি কি আরো বেশি কাজ করতে, কাজে আরো বেশি মনোযোগ দিতে, আরো বেশি প্রোডাক্টিভ হতে চান?
তাহলে এই নিয়ম ও দক্ষতাগুলি আপনাকে আয়ত্ত করতে হবে। তবেই আপনি জীবনের সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
সূচিপত্র
- সময়ের খেয়াল রাখুন (ট্র্যাক করুন)
- সময় আলাদা করুন
- ব্যাঙটি খেয়ে ফেলুন (Eat that Frog)
- পোমোদোরো টেকনিক
- আইজেনহাওয়ার ম্যাট্রিক্স
- নিজের কর্মশক্তি বুঝে কাজ করুন
- মনোযোগ নষ্ট করে এমন সবকিছু দূরে রাখুন
- ৮০/২০ নিয়ম মেনে চলুন
- ব্যাচ করুন
- কাজ স্বয়ংক্রিয় করুন
- দিনের কাজ পরিকল্পনা করুন
- যে যে কাজ করা যাবে না—তার লিস্ট করুন
- সময় নির্ধারণ করে কাজ করুন
১. সময়ের খেয়াল রাখুন
প্রতিটা কাজের পেছনে আপনি কেমন সময় দেন? আমরা মনে করি এটা তো চিন্তা করলেই বের করা যাবে। তবে সত্যি হল, আমাদের অনুমান অনেক সময়ই ভুল হয়।
কাজের সময়ের হিসাব রাখার টেকনিক হচ্ছে টাইম ট্র্যাকিং। কতক্ষণ কাজ করছি, কোন কাজে কত সময় দিচ্ছি—এ সকল হিসাব টাইম ট্র্যাকিং করে বের করা যায়।
কীভাবে সময় ট্র্যাক করা যায়?
আপনি হাতে-কলমে করতে চাইলে স্প্রেডশিট ব্যবহার করতে পারেন। এর জন্য প্রতি আধা ঘণ্টায় লিখে রাখতে হবে, এর মধ্যে কী কী কাজ করলেন।
অথবা টাইম ট্র্যাকিংয়ের জন্য অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন। আপনি কতটুকু প্রোডাক্টিভ সে বিষয়ে অ্যাপ থেকে তাৎক্ষণিক সময়ে ডেটা পাওয়া যায়।
আরো পড়ুন: ওয়ান থিং অ্যাট এ টাইম: একবারে এক কাজ করার ৭টি টিপস
কম্পিউটারে আপনি কী পরিমাণ সময় কাটান সেটার হিসাব রাখার জন্য ‘Rescue Time‘ নামে একটা ফ্রি অ্যাপ আছে। প্রতি সপ্তাহ শেষে এখান থেকে একটা রিপোর্ট দেয়া হয়। আপনি কত সময় কাজ করলেন, কোন কাজে কত সময় গেল সেগুলি সব পাবেন এই রিপোর্টে।
কয়েক সপ্তাহ ব্যবহার করার পর আপনি নিজের কাজের একটা ধরন বা প্যাটার্ন খুঁজে পাবেন। কোন কাজে আপনার সময় বেশি নষ্ট হচ্ছে সেটা তখন সহজে বোঝা যাবে। সহজেই তখন সময় সঠিকভাবে কাজে লাগানোর প্ল্যান সাজাতে পারবেন।
এজন্য সময় ট্র্যাকিং করা একটা ভাল টেকনিক। প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনি এভাবে পাবেন।
২. টাইম ব্লকিং
কখনও কি এমন মনে হয়, কাজের শিডিউলই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে? বা সময়ের ওপর আপনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন?
আসলে কম সময়ে আমাদেরকে অনেক কাজ করতে হয়। আপনি যদি ভাবেন একটা বিশাল কাজের লিস্ট বানিয়ে সব কাজ শেষ করে ফেলবেন, তবে আপনাকে হিমশিম খেতে হবে। কারণ এভাবে দিনের কোনো রুটিন বা সিস্টেম তৈরি হয় না। আর এভাবে কাজ করতে গিয়ে আপনি খুব জরুরি একটা বিষয়ের কথা মাথায় নিচ্ছেন না—সেটা হচ্ছে ‘সময়’।
তাই কাজের সাথে অবশ্যই সময়ের কথা মাথায় রাখতে হবে। প্রতিবার কাজ করার আগে ঠিক করতে হবে, কাজটা কোন সময়ে করবেন এবং কতক্ষণ ধরে করবেন।
শুনতে সহজ মনে হচ্ছে? বিষয়টা কিন্তু আসলেই সহজ।
টাইম ব্লকিং হচ্ছে ক্যালেন্ডারের সাথে মিলিয়ে কাজের প্ল্যান করা। এজন্য দিনের বিভিন্ন সময়কে বিভিন্ন ব্লক বা অংশে ভাগ করতে হবে। এই অংশগুলিতে আপনি আলাদা আলাদা ধরনের কাজ করবেন।
এতে কাজে আপনার মনোযোগ বাড়বে।
প্রতিটা কাজকেই আপনি কোনো না কোনো ব্লকের মধ্যে রাখবেন। ফলে এক কাজের মধ্যে অন্য কাজ চলে আসবে না। আপনার কাজের শিডিউল পরিপূর্ণ থাকবে। অফিসের কাজ, সামাজিক অনুষ্ঠান, বিশ্রাম সবকিছু আপনার পরিকল্পনা মতো হবে।
এই টেকনিকের সবচেয়ে ভাল বিষয় হল, এভাবে আপনি বাধ্য হবেন সঠিক ভাবে সময় কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে।
বড় বড় কাজের লিস্ট তৈরি করার চেয়ে এটা অনেক উপকারী, অনেক বেশি প্রোডাক্টিভ উপায়।
৩. ইট দ্যাট ফ্রগ
কানাডিয়ান-আমেরিকান বক্তা ও লেখক ব্রায়ান ট্রেসি প্রথম এই কথাটি ব্যবহার করেন: Eat That Frog—ব্যাঙটি খেয়ে ফেলো।
“একটা মাছ পুকুরের সব ব্যাঙ খেতে পারবে না। কিন্ত সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে বিদঘুটে ব্যাঙ সে নিশ্চয়ই খেতে পারবে। এখনকার জন্য এটাই যথেষ্ট।”
প্রতিদিন আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোনটি তা খুঁজে বের করুন। এই কাজটাই হচ্ছে আপনার ‘ব্যাঙ’। এটাই সেই কাজ আজকে যেটার প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
তাই দিনের প্রথমেই আপনাকে ব্যাঙ খুঁজে বের করতে হবে। এখানে নিজেকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার বিষয়ও আছে। দিনের শুরুতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে নিজেকে বাধ্য করুন।
কেন এই টেকনিক কাজ করে?
এই সহজ টেকনিক অনেক উপকারী, কারণ দিনের শুরুতেই এটা আপনাকে ভাল ফলাফল বা জয় এনে দেয়। আপনার মধ্যে আরো কাজ করার ইচ্ছা, আরো অর্জন করার আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। মানুষ একটা বড় উদ্দেশ্যের দিকে এভাবেই আগায়: প্রতিদিন ছোট ছোট কাজের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে।
মনে রাখুন, দিনের প্রথমে সবচেয়ে সহজ কাজটি করা থেকে নিজেকে সামলাবেন। আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে।
কিন্ত যদি অনেকগুলি জরুরি কাজ থাকে?
মার্ক টোয়েন এ বিষয়ে ভাল একটা কথা বলেছেন, “আপনার কাজ যদি ব্যাঙ খাওয়া হয়, তাহলে সকালে উঠে প্রথমেই সে কাজটি করতে হবে। আর আপনার কাজ যদি হয় দুইটি ব্যাঙ খাওয়া, তবে আপনাকে প্রথমে বড় ব্যাঙটাই খেতে হবে।”
তাই সকালে উঠেই ‘ব্যাঙ’টি খেয়ে ফেলুন। যদি একাধিক ‘ব্যাঙ’ থাকে তবে সবচেয়ে বড় ‘ব্যাঙ’টি আগে খেতে হবে।
৪. পোমোদোরো টেকনিক
আমাদের মস্তিষ্ক এক সময়ে কেবল একটা বিষয়েই ফোকাস করতে পারে। এক কাজের মাঝখানে অন্য কাজ করলে কাজের মান যেমন খারাপ হয়, প্রোডাক্টিভিটিও কমে যায়।
কোনো কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে পোমোদোরো ভাল একটা টেকনিক।
কাজ শুরুর আগে মনোযোগ নষ্ট করে এমন সবকিছু সরিয়ে ফেলুন। এরপর ঘড়িতে ২৫ মিনিটের টাইমার চালু করে দিন। এই সময়ে আপনি কেবল একটা কাজই মন দিয়ে করবেন।
২৫ মিনিট শুনতে বেশি মনে না হলেও ২৫ মিনিট কাজ করতে পারলে আপনি অনেকটা কাজই করতে পারবেন, সেটার মানও ভাল হবে।
আরো পড়ুন: দক্ষতার ফাঁদ থেকে মুক্তি ও মনের শান্তি খুঁজে পাওয়া
এখন থেকে প্রতিদিন এভাবে প্র্যাকটিস করুন। এতে করে আপনার মধ্যে অভ্যাসটি তৈরি হবে।
পোমোদোরো টেকনিক কীভাবে আপনার সময় বাঁচাতে পারে?
বিষয়টা সহজ। এটা আপনার মধ্যে জলদি কাজ করার মানসিকতা তৈরি করবে।
আপনি জানেন, হাতে মাত্র ২৫ মিনিট আছে কাজ শেষ করার জন্য। তাই আগে যেখানে মনে হত হাতে সারাদিন আছে, এখন মাত্র ২৫ মিনিট থাকার কারণে আপনি কম সময়ে বেশি কাজ করতে চাইবেন।
আর এই টেকনিকে আপনি কাজে বিরতি নিতেও বাধ্য। সারাদিন কাজের মধ্যে থেকে নিজেদের চাঙ্গা রাখাও দরকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটারের সামনে বসে থেকে সবাই ক্লান্ত হয়ে যায়। তাই পোমোদোরো টেকনিকে বিশ্রাম আমাদের প্রোডাক্টিভিটিও বাড়ায়।
৫. আইজেনহাওয়ার ম্যাট্রিক্স
সময় ঠিকভাবে কাজে লাগানোর অর্থ হচ্ছে কোন কাজে কতটুকু গুরুত্ব দিতে হবে সেটা বুঝতে পারা। আপনার কাছে যদি সবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, এর অর্থ আসলে কোনো কাজই অত গুরুত্বপূর্ণ না।
সব কাজ সমান না। কোনটা আপনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝার জন্য আইজেনহাওয়ার ম্যাট্রিক্স (জরুরি-গুরুত্বপূর্ণ ম্যাট্রিক্স) আপনাকে সাহায্য করবে।
আপনার সবগুলি কাজই চারটা ভাগের মধ্যে পড়ে:
- জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ
- জরুরি নয় তবে গুরুত্বপূর্ণ
- জরুরি তবে গুরুত্বপূর্ণ নয়
- জরুরিও নয়, গুরুত্বপূর্ণও নয়
যেভাবে এই ম্যাট্রিক্স ব্যবহার করবেন:
- সব কাজ লিখে ফেলুন। কোন কাজ আগে রাখবেন সেটা নিয়ে (এখনই) ভাবতে যাবেন না।
- এখন শনাক্ত করুন কোন কাজটি জরুরি এবং কোন কাজটি গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি (Urgent) কাজগুলিকে “U” দিয়ে শনাক্ত করবেন এবং গুরুত্বপূর্ণ (Important) কাজকে “I” দিয়ে শনাক্ত করবেন। কাজগুলি এক ধরনের হতে পারে, দুই ধরনের হতে পারে আবার কোনটিই না হতে পারে।
- এবার এই ছকের মধ্যে কাজগুলি বসান এবং ঘর অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন।
- প্রথম ঘরের কাজগুলি এখনই করুন
- দ্বিতীয় ঘরের কাজগুলি পরে করার জন্য শিডিউল করুন
- তৃতীয় ঘরের কাজগুলি অন্যদের দিয়ে করান
- আর চতুর্থ ঘরের কাজগুলি বাদ দিয়ে দিন
আপনি যদি আরো প্রোডাক্টিভ হতে চান তবে দ্বিতীয় ঘরের কাজগুলির পেছনে বেশি সময় দিন। এগুলি হচ্ছে এমন কাজ যেগুলি প্রয়োজনীয় তবে এখনই দরকার নয়। আপনার আত্ম উন্নয়নে এই কাজগুলিই সবচেয়ে অর্থবহ।
ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার বলেন, “বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ কাজই জরুরি না, আবার বেশিরভাগ জরুরি কাজই গুরুত্বপূর্ণ না।”
সকাল বেলাতেই আইজেনহাওয়ার ম্যাট্রিক্স কাজে লাগান। কোন কাজ আগে করতে হবে সেটা বোঝার জন্য এটা একটা অসাধারণ টেকনিক।
৬. কর্মশক্তি হিসাব করে কাজ করুন
আমাদের কর্মশক্তি বা এনার্জি প্রভাব ফেলে আমাদের প্রোডাক্টিভিটির উপর। তাই যখন এনার্জি সবচেয়ে বেশি থাকে, তখনই জটিল ও কঠিন কাজগুলি করতে হয়।
আপনাকে বুঝতে হবে কোন সময়ে আপনি সবচেয়ে ভাল কাজ করতে পারেন। সেই সময় হচ্ছে Deep Work বা গভীর মনোযোগের কাজ করার জন্য আদর্শ সময়। আর যখন আপনার এনার্জি কম থাকে তখন কম পরিশ্রমের সহজ কাজগুলি করুন (Shallow work)।
যেমন: যদি সকালে বেশি প্রোডাক্টিভ থাকেন তাহলে তখন কঠিন কাজগুলি করুন। লাঞ্চের পর এনার্জি কমে যেতে পারে। এ সময় সহজ কাজগুলি অর্থাৎ গোছগাছ করা, ই-মেইল চেক করা বা স্প্রেডশিট আপডেট করার কাজগুলি করতে পারেন।
আরো পড়ুন: যে ৭টি মানসিক বাধা আপনাকে সফল হতে দেয় না
এনার্জি কখন বেশি থাকে সেটা হিসাব করার জন্য একটা স্প্রেডশিট তৈরি করা যেতে পারে। প্রতি ৩০ মিনিট পর ১ থেকে ১০ এর মধ্যে আপনার এনার্জি কত সেটা স্প্রেডশিটে লিখে রাখুন। এভাবে কয়েক সপ্তাহ পর একটা প্যাটার্ন খুঁজে পাবেন, যে কোন সময়ে আপনার এনার্জি সবচেয়ে বেশি থাকে।
আবার সপ্তাহের এক এক দিন এনার্জিও ভিন্ন ভিন্ন থাকতে পারে। বেশির ভাগ মানুষের মঙ্গলবার সবচেয়ে প্রোডাক্টিভ কাটে। আপনার জন্য সেটা কোন দিন?
এনার্জি লেভেল হিসাব করে সপ্তাহের কাজগুলি আপনি এভাবে সাজাতে পারেন:
রোববার: সাপ্তাহিক ছুটির পর এই দিন এনার্জি কম থাকে। তাই সহজ কাজ যেমন সপ্তাহের প্ল্যানিং, ব্যবস্থাপনা এই ধরনের কাজ শিডিউল করুন।
সোমবার ও মঙ্গলবার: এনার্জি সবচেয়ে বেশি থাকে। এই সময়ে সবচেয়ে কঠিন কাজগুলি করুন। লেখালিখি, ব্রেইনস্টর্ম করার জন্য সময় রাখুন।
বুধবার: এই সময় আবার এনার্জি কমতে থাকে। তাই মিটিং বা আলোচনা ধরনের কাজগুলি এই সময়ে রাখতে পারেন।
বৃহস্পতিবার: সবচেয়ে কম এনার্জি থাকে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য যে সকল কাজ থাকে এগুলি করতে পারেন।
[মূল লেখাতে বারগুলি যথাক্রমে সোম, মঙ্গল ও বুধ, বৃহস্পতি এবং শুক্র। অনুবাদে আমাদের দেশের কর্মদিবস ও ছুটির দিন অনুসারে সাজানো হল। – সম্পাদক]
৭. মনোযোগ নষ্ট করে এমন সবকিছু দূরে রাখুন
প্রোডাক্টিভিটি ও মনোযোগ নষ্ট করে এমন সবকিছু সরিয়ে ফেলুন।
মনোযোগ একবার চলে গেলে সেটা ফিরিয়ে আনতে প্রায় ২৩ মিনিট সময় লাগে। মনোযোগ নষ্ট হলে কী ঘটে বিষয়টা ‘দা ওয়ান থিং’ এ গ্যারি কেলার বুঝিয়ে বলেন।
এই সত্যটি মনে রাখবেন: আধা ঘণ্টার পূর্ণ মনোযোগের কাজ, দুই ঘণ্টার কম মনোযোগের কাজের চেয়ে ভাল। তাই কাজের সময় মনোযোগ নষ্ট করবে এমন সব কিছু দূরে সরিয়ে রাখুন। এজন্য আপনি যা করতে পারেন:
- ফোন ও কম্পিউটারের নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিন
- কাজের জায়গা থেকে মোবাইল দূরে সরিয়ে রাখুন
- নয়েজ ক্যান্সেলিং হেডফোন ব্যবহার করুন। এতে করে আপনার সহকর্মীরা আপনাকে কম বিরক্ত করবে
- পরে পড়ার জন্য Pocket ও Instapaper এ আর্টিকেল রেখে দিন
- কাজের জন্য দরকার না হলে ওয়াই-ফাই বন্ধ করে রাখুন
- কাজের সময় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করবেন না; নিজেকে সামলাতে পারেন না? তাহলে সারা দিনের জন্য ‘ডিস্ট্র্যাকশন টাইম’ শিডিউল করে রাখুন
- ফোন এবং অ্যাপে ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ অন রাখুন
- ই-মেইল’কে GTD ই-মেইল এ পরিবর্তন করে ফেলুন। আপনি Inbox Pause অপশনও ব্যবহার করতে পারেন যাতে নতুন ই-মেইল আসা বন্ধ হয়
- আপনার যদি অফিস থাকে, দরজা বন্ধ করে রাখুন
৮. ৮০/২০ নিয়ম মেনে চলুন
এই নিয়মে বলা হয়, “৮০% আউটপুট (ফলাফল) পাওয়া যায় মাত্র ২০% ইনপুট (কাজ) দিয়ে।” অন্য ভাবে বলা যায়: কোন কাজের ফলাফলের অধিকাংশ নির্ভর করে মাত্র অল্প কয়েকটা বিষয়ের ওপরে।
কাজের সময় সেই ২০% এর দিকে জোর দিন যেটা আপনার ৮০% কাজ করে দেয়। তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রয়োজনীয় সময় পাবে।
৮০/২০ নিয়ম কাজে লাগাতে নিজেকে এই প্রশ্নগুলি করে দেখুন:
- আপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপগুলির ৮০% কি মোট ই-মেইল এর ২০% থেকে আসে
- মাত্র ২০% বিষয় আপনার ৮০% মনোযোগ নষ্টের কারণ?
- আপনার চাকরির ৮০% আনন্দ কি কাজের ২০% থেকে আসে?
- মোট প্রজেক্টের ২০% কি আপনাকে ৮০% সমস্যা তৈরি করে?
- ৮০% ক্রেতাই কি সফটওয়্যারের মাত্র ২০% ফিচার ব্যবহার করে?
- মোট অভিযোগের ৮০% কি ২০% ক্রেতা থেকে আসে?
৯. ব্যাচিং বা কাজকে গুচ্ছ আকারে সাজানো
একই ধরনের কাজ একসাথে রাখা এবং করাকেই বলা হয় ব্যাচিং। ব্যাচিং এর উদ্দেশ্য কোন কাজ করতে হবে সেটা নিয়ে কম ভেবে বরং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা।
আপনি যখন এক বসাতে সবগুলি ই-মেইলের কাজ সারছেন অথবা একেবারে সারা সপ্তাহের রান্না করে ফেলছেন সেটাই হচ্ছে ব্যাচিং।
এই টেকনিক আপনাকে অনেক দ্রুত ও দক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেবে। এতে কাজের ফ্লো নষ্ট হবে না, কারণ আপনি একই ধরনের কাজই করছেন। তাই মাইন্ড সেট পাল্টানোর দরকার নেই।
ব্যাচ করার কারণে মস্তিষ্ককে আপনি একই ধরনের কাজে মনোযোগ দিতে বাধ্য করেন। এতে করে কাজ শুরু করার জন্য আপনার কম সময় লাগে। এছাড়া কাজের গতি কমে যাওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়, প্রতিদিনের কাজ গোছানো হয়ে যায় এবং মনোযোগ বাড়ে।
তাহলে আপনি জানতে চান কোন কাজগুলিকে একসাথে রাখবেন? প্রথমে প্রতিদিন ও পুরো সপ্তাহের কাজ লিখুন। এবার যে কাজগুলি এক ধরনের সেগুলিকে একসাথে রাখুন। একবার চেষ্টা করে দেখুন, পরে প্রয়োজন হলে আবার পাল্টে নিলেন।
আরো পড়ুন: ১০ মিনিটের যে রুটিন আপনার স্বচ্ছতা ও সৃজনশীলতা বাড়িয়ে তুলবে
পুরো সপ্তাহে কোন কোন ব্লগ পোস্ট করবেন সেটা এক বসাতে ঠিক করে ফেলতে পারেন।
যোগাযোগের সবগুলি মাধ্যমের কাজ একসাথে করতে পারেন। যেমন ই-মেইল, স্ল্যাক, ফোন কল একসাথে সব ওয়ার্কশিট আপডেট করতে পারেন। ঘরের কাজ যেমন বাজার সদাই, লন্ড্রি, পোস্ট অফিস যাওয়া এগুলি একসাথে করতে পারেন।
নির্দিষ্ট সময় ধরে একই ধরনের কাজ একসাথে করার জন্য পোমোদোরো টেকনিক কাজে লাগাতে পারেন।
১০. কাজ অটোমেট (স্বয়ংক্রিয়) করুন
সবারই এমন কাজ থাকে যেগুলি প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতভাবে করতে হয়। এই কাজগুলি যদি অটোমেট বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে করার উপায় না বের করেন, তবে মূল্যবান সময় নষ্ট হবে। এভাবে বছরে আপনার হাজারো ঘণ্টা চলে যাবে। স্মার্ট উপায়ে কাজ করার জন্য প্রতিদিনের কিছু কাজ তাই আপনাকে স্বয়ংক্রিয় বা অটোপাইলট করতে হবে।
আর বেঁচে যাওয়া সময় জটিল কাজের পেছনে দিতে পারেন বা বিশ্রামও নিতে পারেন।
মাত্র ১০ মিনিটে অটোপাইলট অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় করতে পারেন এমন কিছু কাজ হলো:
- জি-মেইলে একই ধরনের রিপ্লাই বার বার না লিখতে Canned Responses ব্যবহার করতে পারেন
- গুগল ক্যালেন্ডারে রিমাইন্ডার ঠিক করে রাখতে পারেন যাতে কিছু ভুলে না যান
লেখা প্রুফরিড করার জন্য Grammarly বা অন্য কোনো অ্যাপ/সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন - সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট শিডিউল ও অটোমেট করার জন্য Buffer ব্যবহার করতে পারেন
- অনলাইন ফর্ম পূরণ করতে ও সব পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করতে ব্যবহার করতে পারেন Lastpass
- প্রতি সপ্তাহে, মাসে নিয়মিত যেসব কাজ করতে হয় তার একটা স্প্রেডশিট তৈরি করে রাখতে পারেন
১১. সারাদিনের কাজের পরিকল্পনা করুন
সময় ব্যবস্থাপনার একটা সেরা উপায় হচ্ছে কীভাবে আপনার সারাদিনের সময় কাজে লাগাবেন তা আগে পরিকল্পনা করে রাখা।
সারা দিনের কাজের পরিকল্পনা থাকলে একটা অগোছালো দিন কাটানোর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন এবং সঠিকভাবে সময় ব্যয় করতে পারবেন।
এতে আপনি সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আরো বেশি প্রস্তুত থাকবেন। কাজে ঢিলামি দেয়ার সুযোগও আর থাকবে না। কাজ শেষ হবে আরো দ্রুতগতিতে।
তাহলে কখন আপনার দিনের কাজের পরিকল্পনা করা উচিত? দুইটা সময়ে করতে পারেন। আগের দিন রাতের বেলা অথবা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর।
একটু সময় নিয়ে দিনে যা যা করবেন সব লিখে ফেলুন। আর এই কাজের লিস্ট বা টু-ডু লিস্টে আপনি কোন কাজগুলি রাখবেন? সেসব কাজই রাখুন যা আপনার পেশাগত ও ব্যক্তিগত লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করে।
১২. “করা যাবে না” এমন কাজের লিস্ট
গণিতশাস্ত্রে সমস্যা সমাধানের জন্য একটা টেকনিক আছে যাকে বলা হয় ইনভার্শন (Inversion)। এক্ষেত্রে শুরু করতে হয় শেষ থেকে। অর্থাৎ, আপনি সমস্যার সমাধান দিয়ে শুরু করবেন। এরপর পেছন দিক থেকে হিসাব করে দেখবেন কীভাবে এই সমাধান এলো।
ইনভার্শন খুব কাজের একটা টেকনিক। এই পদ্ধতিতে একটা সমস্যার ব্যাপারে অনেক অজানা তথ্য সামনে চলে আসে।
ইনভার্শন পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানে আপনার কাজ হল, পজিটিভ জিনিসগুলি বাড়ানো না, বরং নেগেটিভ বিষয়গুলি কমানো।
ধরা যাক আপনি প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে চান। আপনি চিন্তা করে এমন সব কাজের লিস্ট তৈরি করলেন যা আপনাকে আরো প্রোডাক্টিভ করবে। কিন্ত ইনভার্শন উপায়ে চিন্তা করলে আপনাকে আসলে এমন জিনিসের লিস্ট বানাতে হবে যেগুলি আপনার প্রোডাক্টিভিটি কমিয়ে দেয়।
এখান থেকেই আসে, করা যাবে না এমন কাজের লিস্ট।
নিজের যে অভ্যাসগুলি আপনি বাদ দিতে চান সেগুলির লিস্ট তৈরি করুন এবং মেনে চলুন। এমন কয়েকটি উদাহরণ হতে পারে:
- সকালের শুরুতে অথবা রাতের শেষে কখনো ই-মেইল করবেন না
- সকালে কোনো মিটিং রাখবেন না
- ১০০% নিশ্চিত না হলে কথা দেবেন না
- বিকালে কফি খাবেন না
- এমন মিটিং বা ফোন কল করবেন না যেটার কোনো স্পষ্ট উদ্দেশ্য নেই বা কখন শেষ হবে সে সময় দেয়া নেই
১৩. সময় নির্ধারণ করে রাখুন
আপনি অনেক বেশি প্রোডাক্টিভ হতে পারবেন, যদি কোনো কাজ করার আগে কত সময়ের মধ্যে কাজটি শেষ করবেন সেটা ঠিক করে রাখেন। এজন্যই ডেডলাইন প্রয়োজন।
পারকিনসন্স নিয়মে বলা হয়, “একটা কাজ শেষ করার জন্য যতক্ষণ সময় রাখা থাকবে, কাজটিও ততক্ষণ ধরে চলতে থাকবে।”
তার মানে, আপনি যদি কাজ শেষ করার সময় কমিয়ে দিতে পারেন, আপনার মস্তিষ্ক বাধ্য হবে কাজে মনোযোগ দিতে এবং তা শেষ করতে।
তাই প্রয়োজন না হলেও কাজের ডেডলাইন ঠিক করে নিন। এভাবে নিজের মস্তিষ্ককে বাধ্য করুন দ্রুত কাজ শেষ করতে।
ধরুন, আপনাকে একটা ই-মেইল দেখতে হবে এবং তার জবাব দিতে হবে। সাধারণত এমন কাজে আপনার ২০ মিনিট সময় লাগে। এই সময়টা ১০ মিনিট করে ফেলুন। একটা কাউন্টডাউন টাইমারে ১০ মিনিট দিয়ে কঠোরভাবে চেষ্টা করুন ১০ মিনিটের মধ্যেই কাজটি করা যায় কিনা।
টাইমার দেয়ার কারণে আপনার কাজটা আগের চেয়ে জরুরি হয়ে যাবে। এতে আপনি আরো মনোযোগী হবেন, আরো দক্ষভাবে কাজ করবেন।
তাই আমাদের উচিত নিজেদের স্বার্থেই কাজের আগে সময় নির্ধারণ করে ডেডলাইন ঠিক করে নেয়া। যে কোনো কাজেই যখন আমরা ডেডলাইন ঠিক করব, আমাদের ব্রেইন সেই মতো নিজেকে মানিয়ে নেবে।
আপনি যদি জানেন আর মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্টের কাজ শেষ করতে হবে, তাহলে নিশ্চয়ই তখন ফেসবুকে গিয়ে ২০ মিনিট নষ্ট করবেন না।
সময় ব্যবস্থাপনার টেকনিক বিষয়ে
প্রতিদিন কাজে ব্যস্ত থাকতে থাকতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে যাই যে আমাদের মনেই থাকে না, জীবন যে উপভোগও করতে হবে। কাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে আনন্দ লাভ করা। আমরা সবাই এমন কাজই করতে চাই যা থেকে আনন্দ পাওয়া যায়। কাজ আনন্দময় হতে পারে, সেটাই হওয়া উচিত। সেই আনন্দ থেকে আমরা অনুপ্রেরণা পাবো, আবেগতাড়িত হবো, সৃজনশীল হবো, আরো প্রোডাক্টিভ হবো। নিজের কাজকে যদি আপনি অপছন্দ করেন তবে পৃথিবীর কোনো টেকনিকই আপনার কাজে আসবে না।
এই সব টেকনিকের কয়েকটি আছে খুবই সহজ ও সোজাসাপ্টা। আবার কয়েকটি আছে একটু জটিল। তবে সবগুলিই আপনি প্রতিদিনের জীবনে কাজে লাগাতে পারেন।
সঙ্গে এটাও মনে রাখবেন, প্রতিটা মানুষই আলাদা।
আমার জীবনে এই টেকনিকগুলি কাজে লেগেছে, কিন্তু আপনার জন্য এগুলি কাজ নাও করতে পারে। আপনার জন্য যা কাজ করে তা’ই অনুশীলন করতে থাকুন।
নিয়মিত নিজেকে মূল্যায়ন করুন, আর কী উপায়ে জীবনের মূল্যবান সময় আরো ভাল ভাবে কাজে লাগানো পারবেন তা ভেবে বের করুন।