তিথির (সুচিস্মিতা তিথি) জন্মদিন। এবং সে বেজায় পেটুক। প্রতিদিনই আমার কাছ থেকে খায়। স্কুল থেকে ওকে আনার দায়িত্ব আমার। আসার পথে বাদাম, বুট, ঝালমুড়ি, সিঙ্গারা, আইসক্রিম এবং চিপস—হাত ভর্তি করে জিনিস কিনে আনবে আর বাসায় ঢুকে চেয়ারে বসে জুতা-মোজা না খুলেই আগে দুই হাতের জিনিসগুলি খেয়ে শেষ করবে, এইটাই ওর রুটিন।

প্রতিদিন এত টাকা আমি পাবো কই? টাকা না থাকলে বাকিতে কিনে হইলেও প্রতিদিন ওকে এভাবেই আমার বাসায় আনতে হয়। নাহলে হাজারো পথচারী আর দোকানদারের সামনে আমার মান সম্মানের ফালুদা বানায়ে ফুটপাতে শুয়ে শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে। বাসায় আসে না। জন্মের ন্যাগিং করে। তখন পরিচিত অন্য অভিভাবকেরা আমাকে টাকা দিতে চায়! এই লজ্জায় আমি দোকানে বাকি করে হলেও ওকে সবকিছু কিনে দিয়েই বাসায় আনি।

সেদিন ওর জন্মদিন। তাই রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবে আমার কাছ থেকে। আমার পকেটে নাই একটা পয়সা। এদিকে বিকালেই সে সেজেগুজে রেডি। বলল মোহাম্মদ আলী রোডে শিল্পকলার সামনে যে কাবাবের হোটেল ওখানে ওরা খাবে। ওরা মানে আমার ছোটবোন ইতি আর বার্থডে গার্ল তিথি। ওদের সাজগোজ দেখে আমি তো বলার সাহসই পেলাম না যে আমার কাছে এক টাকাও নাই।

তিথির জন্মদিন ১৩ জুন। আনলাকি থার্টিন। তখন মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত টাকা থাকা খুব মুশকিল আমার জন্য কারণ আমি নিজেই তখন স্কুলে পড়ি। ক্লাস এইট/নাইনে হবে। তার উপর আমার একটা পোষা হাতি ছিল। মানে একটা ওয়াকম্যান ছিল যেটার রিচার্জেবল ব্যাটারি ছিলো না। ছিল ওয়ান টাইম ব্যাটারি। ব্যাটারি কিনতে কিনতে আমি পথের ফকির হয়ে যেতাম। তারপর বাকিতে কিনতাম। তারপরে মাসের শুরুতে টিউশনির টাকা পেলে ব্যাটারির টাকা আর তিথির খাদ্যব্যবস্থার দেনা পরিশোধেই বেশিরভাগ টাকা চলে যেতো।

আমরা তিন বোন দামপাড়ার রাস্তা ধরে মোহাম্মদ আলী রোডের হোটেলের দিকে যাচ্ছি। ওরা দুইজন খুবই খুশি। আমার সামনে হেঁটে হেঁটে কী কী খাবে সেটা নিয়ে তুমুল আলোচনা চালাচ্ছে। আর এদিকে পেছনে টেনশনে আমি শেষ। আমরা সাধারণত কখনো হোটেল/রেস্টুরেন্টে খাই না। খেলেও যাই বড়দের সাথে। ওরা বিল দেয়, আমরা বসে থাকি। এরকম শুধু আমরা তিনজন কখনো যাই নাই। এই প্রথম।

যেতে যেতে ভাবতেছিলাম পাড়ার পোলাপান কারো না কারো সাথে পথে দেখা তো হবেই। ওদের কারো কাছ থেকে ১০০ টাকা ধার করে নিবো। আর দেনাদার কাউকে পেলে তো কথাই নাই! একদম টুটি চেপে ধরব!

চার বোন

পাড়ার পোলাপানদের সাথে আমার নানারকম অর্থনৈতিক লেনদেন আছে। একটা বড় লেনদেন হল ঈদের সময় কার্ড বেচাকেনার লেনদেন। ওরা রোজার সময় বিনিয়োগ হিসেবে টাকা নেয়, কার্ড আনে, পাড়ার মোড়ে সেগুলি বিক্রি করে। তারপর ঈদের পরে আমাকে লাভের অংশসহ টাকা ফেরত দেয়। এছাড়া আরো কত ক্ষুদ্র ব্যবসা যে আছে আমাদের! ঘুড়ি উড়ানোর দিনে রঙিন ঘুড়ি কেনাবেচা, মাঞ্জার সরঞ্জাম কেনার লেনদেন, ব্যাডমিন্টনের মৌসুমে আমার ব্যাট আর কর্ক ভাড়া দেবার লেনদেন, মার্বেলের লেনদেন—এইসবই মূলত সারাবছর ধরে আমরা করে থাকি। কিন্তু সেদিন আমার এমনই কপাল—একটা মানুষও চোখে পড়লো না যাকে আমি চিনি।

সবেমাত্র বিকাল হচ্ছে। দোকানপাট সব তখনো বন্ধ। নার্ভাসনেসে আমি শেষ। মনে মনে চাচ্ছিলাম ওই হোটেলটাও যেন বন্ধ থাকে। শালা এমনই কপাল! সব বন্ধ শাটারের লাইনে একটাই দোকান খোলা। শিল্পকলার বিপরীতে কাবাবের হোটেল। অন্য দোকান খোলা থাকলেও একটা কাজের কাজ হতো। কারণ অনেক দোকানের সাথে আমার বিজনেস পার্টনারশিপ আছে।

যেমন ধরা যাক মোহাম্মদ আলী রোডের মোড় সংলগ্ন ব্রয়লার মুরগির দোকান। আমার মা আমাকে সেখানে মুরগি কিনতে পাঠায়। মুরগি কেটে মেশিনে ফেলে চামড়া ছিলে মুরগির পা-পাখা-নাড়িভুড়ি বের করে সুন্দর পিস করে ডাবল পলিথিনে করে দোকানদার আমাকে প্যাকেট করে দেয়। মুরগির পা/পাখা এগুলি দেখলে মার নাকি বমি আসে! এইজন্য এসব জিনিস কোনোভাবেই বাসায় নেয়া যাবে না। আবার গিলা-কলিজা-পাখা-পা এগুলি নাকি অনেকেই খায়! হোটেলে বিক্রি হয়! এইজন্য দোকানদার ব্যাটা এগুলি আরেক প্যাকেটে যত্ন করে রেখে দেয়। আমি এসব রেখে দেয়া বাবদ তার কাছ থেকে ২০/৩০ টাকা করে নিই। শালার কাছে আমার কমপক্ষে ৬০ টাকা জমা আছে! কিন্তু ওই দোকানও তো এখন বন্ধ!

আমরা ভেতরে গিয়ে জানালার পাশে একটা টেবিলে বসলাম। ওরা দুইজন খুব মনোযোগ দিয়ে মেন্যু দেখতেছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরের রোদজ্বলা পিচঢালা চকচকে রাস্তা দেখতে দেখতে ভাবতেছি রাস্তায় কোনো না কোনো পরিচিত লোক তো থাকবেই! রাস্তায় না থাকলেও দোকানের মালিক নিশ্চয়ই আমাকে চিনবে!

আমাকে চেনে না এরকম কেউ আমাদের এলাকায় অন্তত নাই। সব দোকানদার, সমিতির লোক, খেলাঘরের ছেলে পিলে, বুড়া থেকে গুড়া—সবার সাথে আমার পরিচয় আছে। এ হোটেলের মালিকের সাথেও থাকবে! ভাবতে ভাবতেই দোকানের ক্যাশ কাউন্টারে তাকালাম। এ মোটা গোঁফওয়ালা লোককে জীবনে কোনোদিন কোথাও দেখছি বলে মনে হইল না।

এদিকে আমার দুই বোন মিলে কাবাব, নানরুটি, ফালুদা, সেভেন আপ—এটা সেটা সিলেক্ট করতে করতে খুশিতে আটখানা। একজন ওয়েটার আগায়ে আসল। জিজ্ঞাসা করল কী কী দিবে। ওরা ভড়ভড় করে অর্ডার দিচ্ছে। আমি কুলকুল করে ঘামতেছি। এ ওয়েটার কেন, এখানে কোনো ওয়েটারকেই আমি চিনি না। মনে হইল আজকে আমার জীবনের চরম অপমানটা ঘটতে যাইতেছে। কিন্তু বোনদেরকে কী বলব! এত খুশি নিয়ে খেতে আসছে যে ওদেরকে সত্য কথা বলে আনন্দটাও মাটি করতে চাচ্ছি না। তার উপর তিথির যা চরিত্র! সে তো পড়ে ক্লাস টু-তে। দেখা যাবে এইখানেই মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে নাকের সর্দি ফেলে ফেলে চিৎকার করে কান্দা শুরু করে দিবে খাওয়ার জন্য।

আমি ওদেরকে বললাম, তোমরা খাবার অর্ডার করো। আমি একটু আসতেছি। ওরা খুশিমনে ওয়েটারকে খাবার অর্ডার করতে শুরু করল। আর আমি দুরু দুরু কম্পন নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে শুরু করলাম হন্টন। উদ্দেশ্য রাস্তায় কোনো একটা ব্যবসায়িক পার্টনারের সাথে দেখা হওয়া। কারো সাথেই দেখা হইল না। মা অফিস থেকে ফিরতে তখনো অনেক দেরি। অতএব হোটেলে আমাদের আজকে অপমান হবে, অপরিচিত লোকের কাছে বাকি চাইতে হবে—ওদের সামনেই। ভাবতে ভাবতে মন খারাপ করে ওদিকে হাঁটা দিলাম। রাস্তার মোড়ে স্বপন মামার ওষুধের দোকান থেকে তখন কে যেন আমাকে অনেক জোরে ডাক দিল।

এদিকে আয়, এদিকে আয়।

কোনদিকে যাব! দোকানের শাটার ফেলানো। উপরে-নিচে-বায়ে- ডানে তাকায়ে দেখলাম কেউ নাই। কিন্তু সমানে আমার নাম ধরে কেউ চিৎকার করে যাচ্ছে! কী ভুতুড়ে কাণ্ড! একটু পেছনে গিয়ে দেখি দোকানের ছোট্ট একটা জানালা অন্যপাশে। সেখান থেকে স্বপন মামাই ডাকতেছে। আমার নামে নাকি কী একটা চিঠি আসছে!

স্বপন মামার সাথেও আমার সাইড বিজনেস আছে। সেটা হলো সিভিট, স্যাম্পল ওষুধ, ওষুধ কোম্পানির রাইটিং প্যাড, কলম বেচাকেনার বিজনেস। আমাদের বাসায় এসব জিনিস প্রচুর আসে। আর আমি নামমাত্র মূল্যে ওগুলা উনার কাছে বিক্রি করে দেই। তারপর উনি চড়া দামে সেগুলি ফার্মেসিতে বিক্রি করেন। এই হলো আমাদের লেনদেন। উনার দোকানের ঠিকানা আমি সবখানেই ব্যবহার করি। ব্যবসায়িক সম্পর্কের খাতিরে উনিও আমার ওই ঠিকানা ব্যবহারে কোনো আপত্তি করেন না কখনো।

কিন্তু উনার কাছে আমি কোনো টাকা তো পাই না। জানালার শিকের ওপাশে উনার ঘুমমাখা মুখ দেখে বোঝা যায় মাত্র উঠছে বেচারা ঘুম থেকে। এখন অগ্রিম কিছু টাকাও বা চাই কিভাবে! আমি শুকনা মুখে উনার দিকে আগায়ে গেলাম।
বললাম, বলেন!

স্বপন মামা বলল, এই যে একটা খাম আসছে সকালে তোর নামে। জরুরি মনে হয়।

আমি তখন বিভিন্ন কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। পত্রিকায়, টিভিতে যেখানে যা পাই সবখানে লেখা পাঠাতাম। তখন বিটিভিতে একটা নাটক দেখাতো। নামটা ঠিক মনে নাই! “সবুজ ছায়া” বা “সবুজ সাথী” বা “জোছনার ফুল”এরকম কোনো নাটক হবে। যেখানে নাটক শেষে প্রতি পর্বে কুইজ থাকত। আর কুইজ বিজয়ীদের মধ্যে লটারি করে বিজয়ী ৩ জনকে পুরস্কার দেয়া হতো।

প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখলাম আমি সেবারের কুইজ বিজয়ী! বিশাল এক খাম আমার নামে! আমি রাস্তার উপরেই ফটাফট সেটা খুলে ফেললাম। ভেতরে একটা বড় ক্যালেন্ডার, কয়েকটা শিক্ষামূলক বাণীসম্বলিত স্টিকার, দুইটা পোস্টার আর দুই হাজার টাকার প্রাইজবন্ড!

প্রথমে তো আমি থ, এরপরে আমি খুশিতে আত্মহারা এবং শেষে আমি জ্ঞান ফিরে পাইলাম। প্রাইজবন্ড দিয়ে তো আর বিল দেয়া যাবে না!

স্বপন মামাকে বললাম, প্রাইজবন্ড কিনবেন? ৫০০ টাকার চারটা প্রাইজবন্ড আসছে। একটা আপনি কিনেন। টাকা দরকার আমার।

স্বপন মামা বলল, কী! তোর মাকে দেখাবি না প্রাইজ পাইছিস? প্রাইজবন্ড কেউ ভাঙে নাকি পাগল। যা ভাগ। তোর মা আমাকে মেরেই ফেলবে।

আমি বললাম, মাকে বলার দরকারই নাই। এই নেন প্রাইজবন্ড। আমাকে এখনই দেন ৫০০ টাকা।

বেচারা হতভম্ব হয়ে গেল। না পারে লোভ সামলাতে, না পারে আমার মায়ের ছ্যানছ্যানানির ভয় তাড়াতে। আর আমি তো এদিকে মহা অস্থির! ইতি ও তিথি দোকানে বসে আছে!

চার বোন

স্বপন মামা শেষমেষ ৫ টা ১০০ টাকার নোট নিয়ে এসে আমাকে বলল, যদি এই প্রাইজবন্ডের নম্বর লেগে যায় আর তোর মা এসে টাকা দাবি করে আমি কিন্তু এক টাকাও দিবো না বলে রাখলাম।

আমি বললাম, আমি জানাবোই না যে আমি কত টাকা পাইছি! হি হি।

বলে টাকা নিয়ে দৌড়ে গেলাম হোটেলে। সেখানে দুই বোনে মহাসমারোহে ছ্যাকা পরোটা দিয়ে চিকেন গ্রিল খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে বিল আসল ৯৪ টাকা। আমি ১০০ টাকা বিলের খাতায় রাখলাম আর বাকি প্রাইজবন্ড আর অন্য উপহারগুলা ওদেরকে দেখালাম। তারপর পুরো ঘটনাটা বললাম। এই যে দুই মিনিট আগেও আসলে আমার কাছে কোনো টাকাই ছিলো না, লজ্জায় বলতেই পারতেছিলাম না আর দুই মিনিট পরে দুই হাজার টাকা কোথা থেকে আশ্চর্যভাবে পেয়ে গেলাম!

সব শুনে তিথি বলল, তুমি তো আমার জন্মদিনের কারণেই টাকাটা পাইছ, তাহলে আর শুধু সেভেন আপ- ফালুদা খাবো কেন! আইসক্রিমও তো খেতে পারি! বলেই আইসক্রিম বাছাই করতে শুরু করে দিলো! যেন এতক্ষণ সে কিছুই খায় নাই!

এমন আচরণ আমার এতটাই পরিচিত যে আমি এক সেকেন্ডের জন্যও অবাক হইলাম না!

যাই হোক প্রতি বছরই দেখি টাকা থাক বা না থাক তিথির জন্মদিনে কীভাবে কীভাবে যেন ঠিকই কিছু টাকা চলে আসে! আমি তো সবসময় বলি ওর জন্মদিন আনলাকি থার্টিনে হলেও আমার জন্য খুব লাকি দিন।

আজকে ঘুম ভেঙে দেখি ফেসবুকে আমার পেইজে রিল মারফত টাকা অ্যাড হইছে। প্রতি মাসে ৩০০/৪০০ ডলার রিল থেকে এমনিতে আসে। আর এ মাসে কী যেন একটা বোনাস পাইছি ১০০০ ডলার! ১০০০ ডলার এখন বাংলাদেশের টাকায় ৯৫ হাজার টাকা! আমার কোনো ধারণাই ছিলো না রিলের বোনাস সম্পর্কে—মাত্র কয়েকদিন আগে দেখলাম যে ফেসবুক রিলেও ভালো টাকা দেয়!

খুশি ও বিস্ময় কাটায়ে উঠার পরেই মনে হইল বাবারে বাবা আজকেও তো জুন থারটিন, তিথির জন্মদিন!

নিউ ইয়র্ক, জুন ১৩, ২০২২