জেনেটিক তথ্যের এই ভয়াবহ প্যাকেটগুলি মহাবিশ্বের অসীম অগণিত নক্ষত্রের চেয়েও সংখ্যায় বেশি।

ভাইরাস হচ্ছে একধরনের অতিক্ষুদ্র সংক্রামক প্রতিনিধি (এজেন্ট), যা আণুবীক্ষণিক জগতে বিচরণ করে। তাদের সংখ্যা প্রচুর। একফোঁটা সাগরের পানিতে যে পরিমাণ ভাইরাস থাকে তা নিউইয়র্ক নগরীর সমস্ত লোক সংখ্যার চেয়েও বেশি। এবং মহাবিশ্বে যতগুলি নক্ষত্র আছে পৃথিবীতে তার চেয়েও অনেক বেশি ভাইরাস আছে।

এতবেশি ভাইরাস জন্ম নেয়ার জন্য অনেক সময় লেগেছে। আমরা পৃথিবীতে আসার অনেক আগে থেকেই এখানে ভাইরাস ছিল। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন যে, ভাইরাস পৃথিবীর অন্য যে কোনো জীবের চেয়ে অনেক বেশি পুরনো।


মাইকেল ট্যাব, আন্দ্রিয়া গাওরিলেভস্কি, জেফরি ডেলভিসিও
সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ১২ মে ২০২১


তারা অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়ও। ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গি, বৃক্ষ, প্রাণী থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের জীবকেই আক্রমণ করতে পারে।

কিন্তু তারা আসলে কী?

প্রযুক্তিগতভাবে ভাইরাস জীবন্ত কোনো কিছু নয়—যদিও এটা এখন পর্যন্ত একটা বৈজ্ঞানিক বিতর্কের বিষয়; তাদেরকে শুধুমাত্র জেনেটিক তথ্যের প্যাকেট হিসেবেই ভাবা যায়। কিছু ভাইরাস আছে যারা তাদের কোড বহন করে তাদের আরএনএ’র একক সুতায়। আবার কিছু ভাইরাস তাদের কোডকে বহন করে দুইটি সুতায় অথবা ডিএনএ’র ভেতরে। কিন্তু সমস্ত ভাইরাসই তাদের ব্লুপ্রিন্ট বা প্রতিচিত্র হিসেবে ওই সকল নির্দেশনাকে ব্যবহার করে থাকে সুস্থ কোনো কোষ বা “হোস্ট”- কে আক্রমণ করার জন্য।

তারা প্রথমে কোনো কোষের ভিতরে প্রবেশ করে সেই কোষটাকে দখল করে নেয় এবং কোষটাকে ভাঙতে থাকে সংখ্যায় বাড়ানোর জন্য। তারা হোস্ট সেলের জেনেটিক কোডকে ধ্বংস করে ফেলে অথবা সেই কোডগুলিকে তাদের সাথে সংযুক্ত করে নেয়।

আক্রান্ত কোষগুলির প্রতিরূপ তৈরি করার পর ভাইরাস অন্য সুস্থ কোষগুলিকে হাইজ্যাক করতে যায়। তারা হোস্ট সেলকে যে প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করে তাকে “লাইসিস” বলে।

এটা সবসময় খারাপ নয়। অন্য কোষগুলিকে ভেঙে এবং পুনর্গঠন করে—যেমন, মহাসাগরীয় ফাইটোপ্লাংকটনের ক্ষেত্রে—ভাইরাস একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশেষ করে মহাসাগরের “জৈব পাম্প”’-এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। এটা এমন একটি প্রক্রিয়া যা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড অবমুক্ত করে মহাসাগরের পানিতে দ্রবীভূত করে থাকে।

একটি প্রাচীন ভাইরাসই প্রথম মানুষের প্লাসেন্টা (অমরা) তৈরি করেছিল, এবং যে কারণেই মানবশিশুর জন্ম ডিম থেকে হয় না। 

কিন্তু ওসব ছিল ভাইরাসের ভালো দিক। ভাইরাস সবসময় একটি মাত্র কাজই করে থাকে; আর তা হলো আরো বেশি ভাইরাসের জন্ম দেওয়া। এবং এটা প্রায়ই বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করে।

আঠারো শতকের শেষের দিকে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন, অনেক রোগই অজানা ও অচেনা প্যাথোজেনের মাধ্যমে ছড়ায়। এই রহস্যময় সংক্রমণগুলি তামাক গাছ ধ্বংস করেছিল, এবং পুরো ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে গবাদিপশুর সংক্রমণ বাড়িয়ে তুলেছিল।

১৯০২ সালে ওয়ালটার রিড নামের একজন আমেরিকান ডাক্তার আবিষ্কার করল যে, একই ধরনের একটি এজেন্টই হলুদ জ্বর (ইয়েলো ফিভার) মহামারীর কারণ।

গবেষকরা এই প্যাথোজেনগুলিকে ভাইরাস নাম দিয়েছিলেন। ল্যাটিন ভাষায় “ভাইরাস” অর্থ বিষ। এই সময়ে রিড ও তার সহকর্মীরা একটি কাটা-প্রান্তের ছাঁকনির সাহায্যে ভাইরাসকে আলাদা করতে পেরেছিলেন, কারণ তারা ব্যাকটেরিয়ার চেয়েও অনেক ছোট ছিল। কিন্তু তারা সাধারণ মাইক্রোস্কোপ দিয়ে তখনও ভাইরাস দেখতে পাননি। তামাক পাতার মোজাইক ভাইরাসই ছিল প্রথম ভাইরাস, যেটাকে ১৯৩০-এর দশকে উদ্ভাবিত বৈদ্যুতিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে ভাল ভাবে দেখা গিয়েছিল। একবার যখন আমরা ভাইরাস দেখতে পারলাম, আমরা উপলব্ধি করলাম যে তারা সব জায়গাতেই আছে, এমনকি শরীরের ভিতরেও।

ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রতিরূপ তৈরি করে চলেছে আমাদের বিবর্তনের শুরু থেকেই। আর একারণেই মানুষের শরীরের প্রায় ৮ শতাংশ জিনোম ভাইরাসের কাছ থেকে এসেছে—যেগুলি হচ্ছে আমাদের পূর্বপুরুষদের অবশিষ্ট সংক্রমণ।

ভাইরাস সাধারণত নিষ্ক্রিয় বা “সুপ্ত” অবস্থায় থাকে। তবে কিছু ভাইরাস পুনরায় সক্রিয় হতে পারে অটোইমিউন ডিজিজ, নিউরোডিজেনারেটিভ কন্ডিশন, ক্রনিক ইনফ্লামেশন এবং ক্যান্সার দিয়ে।

দশকের পর দশক সুপ্ত অবস্থায় থাকার পরেও ভাইরাস নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে। এরকমটা ঘটে থাকে সাধারণত শারীরিক ক্ষতি, ভাইরাসের উৎপত্তিগত উপাদানের ভিতরে রাসায়নিক পরিবর্তন, অথবা প্রতিরূপ তৈরীর প্রক্রিয়ায় কোনো ভুলের কারণে।

মিউটেশন বা পরিবর্তনের কারণেই নতুন করোনাভাইরাস, সার্স-কভ-২ ( SARS-CoV-2) বাদুড়কে সংক্রমণ করা থেকে মানুষকে সংক্রমণ করা আরম্ভ করল। আর এটাকেই বলা হয় “হোস্ট সুইচিং”। বিশেষ করে, করোনাভাইরাসের নিজেকে মিউটেশন করার একটি অনন্য পথ আছে: তারা “রিকম্বিনেশন” প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আরএনএ’র ক্ষুদ্র অংশকে অন্যান্য করোনাভাইরাসের সাথে সহজেই বিনিময় করে থাকে। আর এই প্রক্রিয়াটিই করোনাভাইরাসকে একটা নতুন প্রজাতির সাথে অভিযোজিত করে।

করোনা ভাইরাস মহামারী ভাইরাসের অভিযোজন প্রবণতাকে পূর্ণমাত্রায় আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। যে ব্যাপারটি এখনো আমাদের অজানা তা হলো: করোনাভাইরাসের মত আরো কত ভয়ানক ভাইরাস জীবজন্তুর শরীর থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমণ করার অপেক্ষায় আছে।

গবেষকদের কিছু অনুমানই এরকম উদ্বিগ্নতার কারণ। ২০১৮ সালে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী পরিচিত ১১১টি ভাইরাস পরিবারের মধ্যে এখন পর্যন্ত অজানা ৬৩১,০০০ থেকে ৮২৭,০০০ প্রজাতির ভাইরাস “মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটানোর সক্ষমতা রাখে।”

এটা এখনও অজানা যে, তাদের মধ্যে কতগুলি ভাইরাস কোনো একদিন মানুষের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। কিন্তু যেটা আমরা জানি তা হল, এই বিরাট সংখ্যক ভাইরাস—যাদের সাথে এই পৃথিবীতে আমরা সহাবস্থান করছি—সম্পর্কে এখনো আমাদের অনেক কিছু জানার আছে।

অনুবাদ: মাহতাবুল আলম