ইউক্রেন এর জন্য বাইডেন প্রশাসন থেকে পাঠানো ১.৮৫ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজে রয়েছে মার্কিন অস্ত্র ভাণ্ডারের সবচেয়ে আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—দা প্যাট্রিয়ট সিস্টেম। ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই মিসাইল ব্যবস্থা আগে থেকে চেয়ে আসছিল। অনেকের মতে প্যাট্রিয়ট মিসাইল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় বদল করে দিতে পারে।


অ্যান্থনি টেলেজ
ফোর্বস, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২


প্যাট্রিয়ট মিসাইল কী করতে পারে এবং কেন ইউক্রেনের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ
জার্মানির সভেজিং মিলিটারি বিমানবন্দরে বুন্ডেসওয়া র অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল স্কোয়াড্রন ১ এর যুদ্ধের জন্য প্রস্তত একটি প্যাট্রিয়ট অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল সিস্টেম এর ছবি দেখা যাচ্ছে।

উল্লেখযোগ্য তথ্য

• দা প্যাট্রিয়ট (The Patriot) এর নাম এসেছে  Phased Array Tracking Radar for Intercept on Target  থেকে। প্যাট্রিয়টের প্রস্ততকারক কোম্পানি রেথিওন টেকনোলজি করপোরেশন। এই অ্যান্টি ব্যালিস্টিক সিস্টেম এবং মাটি থেকে আকাশে মিসাইল নিক্ষেপকে পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের একটি হিসেবে ভাবা হয়।
• প্যাট্রিয়ট এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এর ক্রুজ মিসাইল আটকে দেয়ার ক্ষমতা। প্যাট্রিয়ট যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করার আগেই স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল থামিয়ে দিতে সক্ষম।
• এই পুরো ব্যবস্থাটা একটা ট্রাকের ওপরে রাখা থাকে। ফলে এটি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সহজে নিয়ে যাওয়া যায়। প্রতিটি ট্রাকে ৪টি পর্যন্ত মিসাইল রাখা যায় এবং এতে ২০ থেকে ১০০ মাইল পর্যন্ত বিভিন্ন পাল্লার মোট ৮টি লঞ্চার (নিক্ষেপকারী যন্ত্র) থাকে।
• দখলকৃত ইউক্রেনিয় শহর খেরসনে রাশিয়ার মিসাইল হামলা বাড়ার পর থেকে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্যাট্রিয়ট মিসাইল প্রতিরোধ সিস্টেম চেয়ে আসছে। রাশিয়া খেরসনের বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং অন্যান্য গুরু্ত্বপূর্ণ জ্বালানি অবকাঠামো লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাচ্ছে। এইভাবে রাশিয়া ইউক্রেনের লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে শীতের মধ্যে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য করছে।
• প্যাট্রিয়ট ডিফেন্স সিস্টেম যুক্ত হওয়ার ফলে রাশিয়ার মিসাইল আক্রমণ ঠেকানোর জন্য ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও আধুনিক হলো।
• ইউক্রেন এর প্রেসিডেন্ট ভলোমিদির জেলেন্সকি প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং কংগ্রেস এর সদস্যদের সাথে দেখা করার দিনই যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্যাট্রিয়ট সিস্টেম সহায়তা দেয়ার ঘোষণা আসে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জেলেনেস্কির দেশের বাইরে প্রথম সফর ছিল এটি।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, বাইডেন প্রশাসন এরই মধ্যে প্যাট্রিয়ট সিস্টেম ইউক্রেনে পাঠানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে। পেন্টাগনও তাদের মতো প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে,  প্রস্তত হচ্ছে প্যাট্রিয়ট পাঠানোর জন্য সকল ধরনের ব্যবস্থা নিতে। যদিও রাশিয়ার রোষানলে পড়তে পারে বলে শুরুতে পেন্টাগন দ্বিধান্বিত ছিল।
• যুক্তরাষ্ট্র যদিও পুরো ব্যবস্থা স্থাপন করে দেবে কথা দিয়েছে, তবে এর জন্য কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। রয়টার্স জানিয়েছে, প্রথমে প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেম নিয়ে যাওয়া হবে জার্মানিতে। সেখানে ইউক্রেনের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিতে এক মাসের মতো লেগে যাবে— যুক্তরাষ্ট্রের অফিসিয়ালরা রয়টার্সকে জানায়।
• রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৃহস্পতিবার মস্কোতে একটি সংবাদ সম্মেলনে প্যাট্রিয়ট মিসাইলকে “বেশ পুরনো সিস্টেম” বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন তিনি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী যে এই মিসাইল কোনো হুমকির কারণ হবে না।

গুরুত্বপূর্ণ উক্তি

“গত ৩০০ বছর ধরে ক্রেমলিন ইউক্রেনকে মানচিত্র থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এখন রাশিয়া চাচ্ছে শীতকে ব্যবহার করে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষকে ক্ষুধা ও ঠাণ্ডায় কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলতে”, যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিনকিন এক বিবৃতিতে এ কথা জানান। তিনি আরো বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র এর জবাবে ইউক্রেনকে নতুন প্রযুক্তির অতিরিক্ত মিলিটারি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, যাতে রাশিয়ার এই নিষ্ঠুর ও অযাচিত আক্রমণ থেকে ইউক্রেন নিজেদের রক্ষা করতে পারে।”

ভিন্ন মতামত

ইউক্রেন বাহিনীর কাছে প্যাট্রিয়ট পাঠানো নিয়ে অন্যতম বিবেচনার বিষয় ছিল যে এই সিস্টেম চালানোর মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ইউক্রেনের আছে কিনা। যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি জানায়, কেবল একটা প্যাট্রিয়ট ব্যাটারি পরিচালনার জন্য ৯০ জন সৈন্যের প্রয়োজন হয়। এই সিস্টেমে আরো আছে একাধিক কম্পিউটার, একটা ফেইজড অ্যারে রাডার, কন্ট্রোল সিস্টেম এবং শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। বাইডেন প্রশাসন থেকে ইউক্রেনে প্যাট্রিয়ট পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, ইউক্রেনের মাটিতে এর ব্যবহার শুরু করতে কয়েক মাস লেগে যাবে। কারণ এর আগে ইউক্রেনের সৈন্যবাহিনীকে এই সিস্টেম চালানোর জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ইউএস আর্মি ইউরোপ এর অবসরপ্রাপ্ত কম্যান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মার্ক হার্টলিং সিএনএন’কে জানান, প্যাট্রিয়ট সিস্টেম কতটুকু কাজ করবে সে বিষয়ে অনেকের অবাস্তব প্রত্যাশা রয়েছে। হার্টলিং বলেন, “কেউ যদি মনে করে এই ডিফেন্স সিস্টেম ইউক্রেন-রাশিয়ার ৫০০ মাইল বর্ডারের পুরোটা জুড়ে থাকবে, তারা আসলে জানে না কীভাবে এই সিস্টেম কাজ করে।”

পেছনের কথা

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি ইউরোপে দা প্যাট্রিয়ট সিস্টেম ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। সেই থেকে ইউরোপে এর ব্যবহার শুরু হয়। এরপর ১৯৮৫ সালে ন্যাটো একটি কৌশলগত মূল্যায়ন রিপোর্ট প্রকাশ করে এবং তখন থেকে এই সিস্টেম পুরোপুরি কার্যকর করা হয়।

তবে ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সৌদি আরবের উপর নিক্ষেপ করা ইরাকি স্কাড মিসাইল  প্রতিরোধ এবং ধ্বংস করার পর প্যাট্রিয়ট মিসাইলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। রেথিওন-এর মতে বিশ্বের ১৭টি জাতি প্যাট্রিয়ট মিসাইল কিনেছে অথবা ব্যবহার করছে। এই দেশগুলির মধ্যে আছে জার্মানি, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পোল্যান্ড।

অনুবাদ: আমিন আল রাজী