অজানা এবং রহস্যময় কিছু একটা যেন মহাবিশ্বজুড়ে সোনার বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। কিন্তু কেউ’ই বলতে পারছে না কী সেই রহস্যময় জিনিস!

সোনা বা স্বর্ণ মৌলিক পদার্থ। আপনি চাইলেই রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করতে পারবেন না। আলকেমিস্ট বা অপরসায়নবিদরা শত শত বছর ধরে চেষ্টা করেও সোনা তৈরি করতে পারেননি।

এই ঝকঝকে ধাতুটি তৈরি করতে চাইলে আপনাকে ৭৯টি প্রোটন এবং ১১৮টি নিউট্রনকে একসঙ্গে বাঁধতে হবে একটা একক পারমাণবিক নিউক্লিয়াস গঠন করার জন্য। যার জন্য আবার দরকার নিউক্লিয়ার ফিউশন রিঅ্যাকশন। কিন্তু এই ধরনের অতি ঘন পারমাণবিক গলন বিক্রিয়া খুব সচরাচর ঘটে না। এমনকি আমাদের এই পৃথিবী এবং সৌর জগতে সোনার যে অফুরন্ত মজুদ রয়েছে তা তৈরিতেও যথেষ্ট পারমাণবিক গলন বিক্রিয়া ঘটার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।


রাফি লেটজার
লাইভ সায়েন্স , ১ অক্টোবর ২০২০


স্বর্ণের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রচলিত তত্ত্বটি হল, নিউট্রন নক্ষত্রগুলির মধ্যে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে স্বর্ণের উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, মহাবিশ্বজুড়ে যে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ আছে তার জন্যে যত বেশি সংখ্যক সংঘর্ষ হওয়া দরকার তা ঘটা সম্ভব না।

তাহলে কোথা থেকে আসছে এই রাশি রাশি সোনা? এক্ষেত্রে আরো ভিন্ন কিছু সম্ভাবনা আছে। যেমন সুপারনোভা। কোনো নক্ষত্রের আয়ু শেষ হয়ে গেলে যে মহা বিস্ফোরণ ঘটে এবং নিউক্লিয়ার ফিউশন সৃষ্টি হয় তাতে ওই নক্ষত্র উলট-পালট হয়ে তৈরি হয় সুপারনোভা। কিন্তু নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, মহাবিশ্বে যে বিপুল পরিমাণ সোনার মজুদ রয়েছে তা তৈরি হওয়ার জন্য যত সংখ্যক সুপারনোভা সৃষ্টি হওয়া দরকার ছিল ততটা হয়নি।

নিউট্রন নক্ষত্রগুলির মধ্যে সংঘর্ষের সময় প্রোটন ও নিউট্রন পিষে একসাথে মিশে গিয়ে পারমাণবিক নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত হয়ে সোনা তৈরি হয়। তারপর সেই নতুন-আবদ্ধ ভারি নিউক্লিয়াসগুলি মহাকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাজ্যের হার্টফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানী চিয়াকি কোবায়শি বলেন, সুপারনোভা মহাবিশ্বের সোনার উৎস হতে পারে না। কারণ, সংখ্যায় কম কিন্তু স্বর্ণ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট ওজনদার নক্ষত্রগুলি মারা যাওয়ার আগে বিস্ফোরিত হয়ে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়। আর উৎপাদিত সোনা সেই ব্ল্যাক হোলের ভেতর হারিয়ে যায়।

তাহলে আরো অদ্ভুত সেই নক্ষত্র-উল্টানো সুপারনোভাগুলির কী হবে? কোবায়শি লাইভ সায়েন্সকে বলেন, এই ধরনের তারকা বিস্ফোরণ, তথাকথিত চৌম্বকীয়-ঘূর্ণমান সুপারনোভা, “খুবই বিরল সুপারনোভা, যা খুব দ্রুত ঘুরে।”

চৌম্বকীয়-ঘূর্ণমান সুপারনোভা চলাকালীন, মুমূর্ষু নক্ষত্রটি এত দ্রুত গতিতে ঘুরে এবং এমন শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা আবৃত হয় যে এটি বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে এর ভেতরটা বাহিরের দিকে চলে আসে। তারকাটি মারা যাওয়ার পরপরই সাদা-গরম তরল বস্তুর দলা মহাকাশে নিক্ষেপ করে। নক্ষত্রটির ভেতরের অংশ বাহিরের দিকে চলে আসে বলে এই তরল বস্তুর দলা স্বর্ণের নিউক্লিয়াসে পরিপূর্ণ থাকে। যেসব তারকা স্বর্ণ উৎপাদনে সক্ষম তারা বিরল। আর যেসব তারকা স্বর্ণ উৎপাদন করে এবং এরপর তা মহাশূন্যে নিক্ষেপ করে এমন নক্ষত্র আরো অনেক বেশি বিরল।

কিন্তু কোবায়শি এবং তার সহকর্মীরা গবেষণায় দেখেন যে, এই নিউট্রন তারকা এবং চৌম্বকীয়-ঘূর্ণমান সুপারনোভা এই দুটি মিলেও পৃথিবীতে যে বিশাল পরিমাণ সোনার মজুদ রয়েছে তার উৎস কী তার ব্যাখ্যা দিতে পারছে না।

কোবায়শি বলেন, “এই প্রশ্নের দুটি স্তর আছে। প্রথম স্তরটি হল: নিউট্রন তারকার সংঘর্ষ এবং সংযুক্তিই যথেষ্ট নয়। আর দ্বিতীয় স্তরটি হল: দ্বিতীয় উৎসকে গোনায় ধরলেও আমরা পর্যবেক্ষণে যে বিশাল পরিমাণ সোনা দেখতে পাই তার উৎস ব্যাখ্যা করতে পারি না।”

অতীতের গবেষণাগুলি একথা বলায় ঠিক ছিল যে, নিউট্রন তারকাদের সংঘর্ষ থেকে সোনার বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সে গবেষণাগুলিতে এই ধরনের সংঘর্ষ যে খুবই বিরল সেই বিষয়টা বিবেচনায় রাখা হয়নি।

প্রাচীন সুপারনোভার অতি ঘন অবশিষ্টাংশ ক্ষুদ্র নিউট্রন তারকারা কত ঘন ঘন সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তার হিসাব বের করা কঠিনই বটে। তবে এমন সংঘর্ষের ঘটনা অহরহ ঘটে না। বিজ্ঞানীরা মাত্র একবারই এমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে দেখেছেন। এমনকি মোটামুটি অনুমান থেকেও দেখা যায় যে, শুধু আমাদের সৌরজগতে যে পরিমাণ সোনার মজুদ আছে তা উৎপাদিত হওয়ার জন্য যে সংখ্যক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটা দরকার সে সংখ্যায় সংঘর্ষ ঘটেনি। কোবায়শি এবং তার সহ-লেখকরা গবেষণায়ও যার পক্ষে প্রমাণ পেয়েছেন।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইয়ান রডেরার বলেন, “এই গবেষণাতেই প্রথম বলা হয়নি, নিউট্রন তারার সংঘর্ষ সোনার প্রাচুর্য ব্যাখ্যা করার জন্য অপর্যাপ্ত। এই গবেষণার আগেও আরো গবেষণায় এই বিষয়টি উঠে এসেছে।“ ইয়ান দূর নক্ষত্রের বিরল উপাদানগুলির সন্ধান করছেন।

ইয়ান রডেরার আরো বলেন, “তবে কোবায়শি ও তার সহকর্মীরা গত বছরের ১৫ অক্টোবর দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল-এ যে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন তার একটি ভাল দিক হল এতে বিষয়টি পুরোপুরি তুলে আনা হয়েছে। এতে গবেষকরা পাহাড় পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত জড়ো করেছেন। এবং কীভাবে গ্যালাক্সি বিকশিত হয় ও নতুন রাসায়নিক উৎপাদিত হয় সে সম্পর্কিত শক্তিশালী তাত্ত্বিক মডেলও হাজির করেছেন।

“তাদের গবেষণায় ৩৪১টি অন্যান্য গবেষণার রেফারেন্স আছে, যা আজকাল অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নালে প্রকাশিত সাধারণ কোনো গবেষণাপত্রে থাকা রেফারেন্সের চেয়ে ৩ গুণ বেশি”, লাইভ সায়েন্সকে বলেন রডেরার।

তিনি বলেন, “কোনো একটা বিষয়ে সমস্ত তথ্য এক জায়গায় জড়ো করা একটা “হারকিউলিয়ান প্রচেষ্টা।”

এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা কার্বন-১২ এর মতো হালকা পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করতে যেমন সক্ষম হয়েছেন তেমনি ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন ইউরেনিয়াম-২৩৮ এর মতো ভারি পরমাণুর গঠনও। রডেরার বলেন, এটা অসাধারণ কাজ হয়েছে। এই ধরনের গবেষণায় সাধারণত এমন উপাদানগুলিকে উপেক্ষা করা হয়।

আর সবচেয়ে বড় কথা হল, তাদের গাণিতিক হিসাব-নিকাশগুলি বেশ কাজের হয়েছে।

যেমন, তাদের গাণিতিক মডেলের হিসাব মতে নিউট্রন তারার সংঘর্ষে স্ট্রন্টিয়াম বা রুপার মত শুভ্র নরম ধাতব পদার্থ উৎপাদিত হয়। তাদের এই হিসাব বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণের সাথেও মিলে যায়। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা যেই নিউট্রন তারার সংঘর্ষের ঘটনা দেখেছেন সে ঘটনার পর তারা যে পর্যবেক্ষণ চালান তাতেও মহাকাশে স্ট্রন্টিয়ামের দেখা মেলে।

চৌম্বকীয়-ঘূর্ণমান সুপারনোভা তাদের মডেলে ইউরোপিয়ামের উপস্থিতির ব্যাখ্যাও করেছিল, যেই পরমাণুটিকে এর আগে ব্যাখ্যা করা বেশ জটিল মনে হচ্ছিল।

কিন্তু স্বর্ণের বিষয়টি এখনো রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে।

কোবায়শি বলেন, এমন কিছু একটা আছে যা সোনা তৈরি করে চলেছে এবং বিজ্ঞানীরা তা এখনো জানেন না। অথবা এমনও হতে পারে বিদ্যমান মডেলের নিউট্রন তারকাদের সংঘর্ষ থেকেই হয়তো বর্তমান ধারণার চেয়ে আরো অনেক বেশি সোনা তৈরি হয়, যা এখনো ধরতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তবে উভয় ক্ষেত্রেই, জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য এখনও বিশাল গবেষণার কাজ বাকি আছে এটা খুঁজে বের করার জন্য যে মহাবিশ্বজুড়ে এই রাশি রাশি সোনা আসলে কোথা থেকে এলো।

অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক