কবিরা যখন চোখের সৌন্দর্য বোঝাতে চোখকে সাগর বা আকাশের সাথে তুলনা করেন তখন তারা সম্ভবত জানেনও না যে এক্ষেত্রে তারা কতটা সঠিক।
মানুষের চোখের রঙ যে কারো কারো নীল হয় তা নীল রঙ বা নীল রঙের পিগমেন্টের কারণে হয় না। নীল চোখের মণিতে সূর্যের আলো পড়লে বহুরঙের আলোর প্রতিফলন ঘটে তা থেকে, তবে যিনি দেখছেন তার কাছে শুধু নীল রঙই পৌঁছায়। পরিষ্কার উজ্জ্বল দিনে বাতাসের কণায় সূর্যের আলো পড়লে কণা থেকে তা প্রতিফলিত হয়, বহু রঙ অলা সূর্যের আলোর এই ছড়িয়ে পড়া ঘটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। সূর্যের আলোর নীল রঙ সব সময়ই লাল রঙের চেয়ে চেয়ে দশগুণ বেশি প্রতিফলিত হয়।
যাদের চোখ নীল তাদের চোখের মণি এভাবেই আলোর প্রতিফলন ঘটায়। যদি তাদের চোখে সাদা রঙের আলো পড়ে, সাদা রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য মিশ্র হওয়ার কারণে সূর্যের আলোতে থাকা নীল রঙের প্রতিফলন বেশি ঘটে। ফলে যারা দেখে তারা চোখের রঙ নীল দেখতে পায়। ঘরের ভিতরে যথেষ্ট আলো না থাকায় নীল আলোর প্রতিফলন কমে যায়, এ কারণে ঘরের ভিতরে চোখের মণি থেকে প্রতিফলিত আলোর রঙ প্রান্তের দিকে কিছুটা লাল আলোর দিকে বেঁকে যায়। ফলে ইনডোরে বা ঘরের ভিতরে চোখের রঙ বদলে গেছে মনে হতে পারে।
কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই ‘স্ট্রাকচারাল কালারেশন’ বা নির্দিষ্ট রঙ বিন্যাসের এই ঘটনা ঘটে না। সমুদ্রের তলদেশের প্রানী, পোকামাকড় এবং পাখির ক্ষেত্রেও এরকম ঘটে থাকে।
বাদামি চোখে এটি আরো সরলভাবে ঘটে। বাদামি চোখের লোকদের স্ট্রমায় বা চোখের সামনের স্তরে প্রচুর পরিমাণে মেলানিন নামের হরমোন থাকে। মেলানিনের উপস্থিতির কারণেই গায়ের চামড়া কালো হয়ে থাকে। বাদামি রঙের চোখে যে আলো পড়ে তার বেশিরভাগই মেলানিনের কারণে শোষিত হয়ে যায়। যে অল্প আলো ফিরে আসে বা প্রতিফলিত হয় তা আমরা বাদামি হিসেবে দেখি।
হালকা বাদামি রঙের চোখে পুরাপুরি বাদামি চোখের চেয়ে আরো কম মেলানিন থাকে। বেশিরভাগ শোষিত হয়ে গেলেও যথেষ্ট পরিমাণ আলো প্রতিফলিত হতে পারে বা দর্শকের কাছে ফিরে আসতে পারে। এর ফলে নীল এবং বাদামির মিশ্রণে একটি রঙ তৈরি হয়। চোখের বিভিন্ন জায়গায় ঘনত্ব বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এ কারণে ড্যাপলিং এফেক্ট ঘটে, এবং এই ড্যাপলিং এফেক্টের কারণেই আমরা চোখের রঙ হালকা বাদামি দেখি।
সবুজ চোখের ক্ষেত্রে এটি অন্যভাবে ঘটে। সামান্য পরিমাণ মেলানিনের পরিবর্তনের ফলে প্রতিফলিত আলো নীলের বদলে সবুজ দেখা যায়। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই চোখের মণির ক্ষুদ্র কালো অংশটি আলো প্রতিফলনের জন্য পিছনের স্তর বা রিয়ার লেয়ার হিসেবে কাজ করে।
ধূসর চোখের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আরেকটু আলাদা। ধূসর চোখে মেলানিন কম তবে চোখের মণিতে কোলাজেন থাকে। ধূসর রঙের চোখে এই কোলাজেন বড় থাকার কারণে আলো বড় বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যে প্রতিফলিত হয়, ফলে মিশ্র রঙ দেখা যায়। এই প্রক্রিয়ার সাথে আকাশে অপেক্ষাকৃত কম ঘনত্বের মেঘের তুলনা করা যায়। ধূসর চোখের মণিতে যে পরিমাণ আলো প্রতিফলিত হয় তার থেকে বেশি আলো শোষিত হয়। এ কারণে যে মেঘগুলি থেকে বৃষ্টি হয় চোখের মণির রঙ সেই মেঘের মত ধূসর দেখা যায়।
অনেক শিশুর চোখে প্রাথমিকভাবে মেলানিনের পরিমাণ কম থাকে। এমনকি তাদের চোখ পরবর্তীতে যদি বাদামিও হয় তবুও শিশু অবস্থায় চোখে মেলানিনের পরিমাণ কম থাকতে পারে। শিশুদের চোখের রঙ যখন নীল হয় তা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তুলনায় অপেক্ষাকৃত গাঢ় নীল হয়। কারণ, নীল রঙের চোখ অলা বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চোখের মণিতে কিছু বস্তুকণা থাকে যেগুলির কারণে চোখের মণি থেকে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত নীল রঙের প্রতিফলন ঘটে, ফলে নীল রঙের তীব্রতা কমে যায়।
আরো পড়ুন: সিগারেটের ধোঁয়া চোখের কোষ ধ্বংস করে
আর চোখের রঙ কেমন হবে তা নির্ভর করে জিনগত বৈশিষ্ট্যের ওপর। মেন্ডেলিয়ান জেনেটিকসে বাদামি রঙের চোখকে প্রকট বৈশিষ্ট্য এবং নীল রঙের চোখকে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চোখের অন্য রঙগুলিকে জিনগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।একাধিক জিন চোখের রঙ ঠিক করে থাকে, বেত চোখের নীল রঙকে নিকটতম পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা হয়। OCA2 ও HERC2 নামের পাশাপাশি অবস্থিত জিন দুটি মেলানিনের পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকে। অন্যান্য জিনগুলি কোলাজেনের উপস্থিতির মত অন্যান্য ব্যাপারগুলি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।